গল্পঃ গৌধূলীর শেষ আলো । লেখক - তাসফি আহমেদ।
গল্পঃ গৌধূলীর শেষ আলো । লেখক - তাসফি আহমেদ।
গল্পঃ গোধুলীর শেষ আলো
তাসফি আহমেদ।
মেয়েটা আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকল। হঠাৎই তার উপর চোখ পড়ল আমার। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখেও সে চোখ নামালো না৷ কেবল তাকিয়ে থাকল৷ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকল৷ কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি। আমি মেয়েটাকে দেখলাম ভালো করে। কালো রঙের একটা থ্রিপিস গায়ে৷ বুকের কাছে লাল ওড়না লাগানো৷ খুবই সাধারণ পোষাকে মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। তার উপর ফর্সা চেহারা৷ কালো জামা যেন তাকে আরো ফুটিয়ে তুলছে। চোখে গাঢ় কাজল দেওয়া কেবল। মুখে অন্য কোনো প্রসাধনী আছে বলে মনে হয় না৷ হঠাৎই আমার মনে হলো মেয়েটাকে অসাধারণ লাগছে। অসাধারণ রূপবতী। এমন মেয়ে আমি এর আগে দেখেনি। দেখেছি হয়তো! তবে এতোটা ছুঁয়ে যায়নি কেউ। আমি তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। মেয়েটা যেন চট করেই টের পেয়ে গেল আমিও তাকে দেখছি। সে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল। তাকে কেমন অপ্রস্তুত দেখালো। সে চোখ নামিয়ে বাজার করায় মন দিলো৷ আবার খানিকটা চোখ তুলে দেখল আমায়। চোখাচোখি হলো আমাদের। আমার গা'টা যেন হুট করেই অজানা কোনো কারণে শিউরে উঠল। মনের ভেতর কেমন শীতল শিরশিরে অনুভূতি হলো আমার। মেয়েটা এবার যেন খানিকটা লজ্জা পেল৷ চোখ নামিয়ে বাজার করায় মন দিল। আমি এপাশ থেকে তাকে দেখতে থাকলাম।
সকাল সকাল নাস্তার পরেই আম্মা অনেক বলে কয়ে বাজারে পাঠালেন৷ ঘরে কাঁচাবাজার শেষ। আমি আসতে চাইছিলাম না। বাজারটাজার করায় বিশেষ মন নেই। কিন্তু যখন বাবা গম্ভীর স্বরে বাজারে যেতে বললেন তখন আর না এসে পারা গেল না। তবে কাঁচাবাজারে আসলে যে এমন চমক পাওয়া যাবে তা আমি স্বপ্নের কল্পনা করিনি। কল্পনা করলেও হয়তো আমি প্রতিদিনই বাজারে আসতাম। কাঁচাবাজার করতে এসে কাউকে ভালো লেগে যাওয়াটা এই বিচিত্র পৃথিবীতে এই প্রথম ঘটছে৷ হয়তো প্রথমই। কিংবা না। আমি মনে মনে হাসলাম খানিক। বাজারটা দু সারির। আমি সারির এপাশ থেকে তাকে দেখে গেলাম। তার তৃতীয়বার চোখ তুলে দেখার আশায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মেয়েটা চোখ তুলে দেখবে আবার। অবশ্যই দেখবে। আমি তাকিয়ে থাকলাম। গুটি কয়েক মানুষ আড়চোখে আমায় দেখল। যাদের দেখার কথা আরকি৷ আমি গায়ে মাখলাম না। আমার কাছে মনে হলো এই মেয়েটাই যেন আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল এই মেয়েটাই৷ মেয়েটা আবার চোখ তুলে দেখল এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো৷ আমি ভালো করে দেখলাম তাকে। তার গাল খানিকটা লালচে হলো যেন৷ লজ্জা যেন তাকে এক পরশ ছুঁয়ে গেল। আমি মনে এবারেও হাসলাম। অদ্ভুত একটা আনন্দ হলো আমার। আমি নিজের বাজার ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে সারির ও'পাশের যেতে চাইলাম। তখনই দেখলাম মেয়েটার পাশে অন্য কেউ। যথার্থ সুদর্শন এক যুবক৷ গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। নেবিব্লু কালারের টি-শার্ট গায়ে দেওয়া। ছেলেটাকেও দারুণ লাগছিল। হঠাৎই নিজেকে কেমন জানি ফিকে মনে হলো। কিংবা মনে হলো কারো বাসার অপ্রয়োজনীয় ময়লা যাকে ধরে ছুঁড়ে ফেলা হয়। আমি যেন মনের ভেতর কোথাও না কোথাও খানিকটা চোট পেলাম। আমার মন ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেলে৷ উজ্জ্বল একটি দিনে হুট করেই আকাশে মেঘ করলে যেমন হয় ঠিক তেমন। উচ্ছ্বাসিত একটা হৃদয় যেন চট করেই হোচট খেয়ে মাঝ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আমি অনেকক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মন এবং মুখ দুটোই কালো করে। বারবার মনে করতে চাইলাম ছেলেটা মেয়েটার ভাই। বড় ভাই হবে হয়তো৷ মন যেন তা মানতেই চাইলো না। কেন জানি বারবার এদের কাপল মনে হলো৷ খুব সুন্দর একটা জুটি। আমার অসম্ভব হিংসে হতে থাকল। তবে মেয়েটা আমাকে এভাবে দেখল কেন? আচ্ছা মেয়েটা কি আমাকেই দেখেছে? এবার এই ব্যাপারেও যেন সন্দেহ হতে থাকল৷ আমি মন খারাপ করে বাজার থেকে বের হলাম। বের হতেই দেখলাম মেয়েটা আর ছেলেটা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে৷ আমার যেন গা'টা জ্বলে গেল। আশ্চর্য! এই মেয়েকে আমি দেখলাম সবে। এতেই যেন আমার সমস্ত অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে৷ পাগলের মতো বিহেভ করছে। আমি ওদের পেছন পেছন যেতে থাকলাম। গা ভরা অস্বস্তি। কিছু যেন ভালো লাগছিল না। আজকে বাজারে না আসাটাই ভালো ছিল। অযথাই এসে কেমন উটকো একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম৷ আমি মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। আবার আড় চোখে ওদেরও দেখছিলাম। হঠাৎ মোড়ে এসে ছেলেটা বাঁ'দিকে চলে গেল। আর মেয়েটা ডান দিকে। আমার মনটা যেন ভীষণ খুশি হলো। হঠাৎই অদ্ভুত এক আনন্দ আমায় চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। তার মানে মেয়েটা আমাদের ওদিকের। আমি এবার দ্রুত হাঁটতে থাকলাম। মোড়ের কাছে যেতেই দেখলাম মেয়েটা মোড়ের দোকান থেকে কিছু কিনছে। আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম সে আমার দিকে একবার দেখল৷ আবার চোখ নামিয়ে নিলো। আমি এবার ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসার সামনে চলে এলাম। মেয়েটা পেছন পেছন আসতে থাকল। আমি দারোয়ান চাচার কাছে বাজারের ব্যাগটা রেখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যেতেই আমি তার পিছু নিলাম। আমাদের গলিটা পার হতেই আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
-হাই! কেমন আছেন?
মেয়েটা যেন আমার এমন আগমনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখে বলল,
-ভালো আছি। আপনি?
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। মনে হলো আমি যেন কথা হারিয়ে ফেলছি৷ তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,
-একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
মেয়েটা খানিকটা ভেবে বলল,
-আমার তাড়া আছে। যা বলার জলদি বলুন।
কথাটা এমন ভাবে বলল যেন মেয়েটা আমায় চিনে। অথবা আমাদের অনেক আগের পরিচয়। আমি এতটা নমনীয়তা আশা করিনি। বললাম,
-আপনার সাথে একটা ছেলেকে দেখেছিলাম। কে সে?
সে খানিকটা ভ্রু কুচকে বলল,
-কেন? তার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন কেন?
-আছে একটা কারণ। বলুন না কে হয় আপনার?
-যে-ই হোক৷ তাতে আপনার কী?
আমি খানিকটা ভেবে ফ্যাকাসে হেসে বললাম,
-আসলেই তো। আমার কী? কেনইবা জানতে এলাম!
মেয়েটা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-পাগল টাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি?
আমি মাথা চুলকিয়ে বললাম,
-কি জানি৷ হয়ে গিয়েছি হয়তো। আচ্ছা আপনাদের বাসা কি এখানে?
-কেন জানতে চাইছেন?
-এমনিই। মন চাইলো।
-হ্যাঁ। আমাদের বাসা এখানেই।
-এখানেই কোথায়? কোন বাসাটা?
-তা বলা যাবে না।
-কেন? বললে কী প্রব্লেম?
-আছে অনেক প্রব্লেম।
-অনেক প্রব্লেম গুলো কী কী?
-আপনাকে বলতে পারবো না। পথ ছাড়ুন। আমাকে যেতে দিন৷
আমি রাস্তা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললাম,
-এখন যে যাবেন, আমি তো দেখে যাবো আপনার বাসা কোথায়?
-এই দেখা আর আমি বলায় অনেক পার্থক্য আছে।
-কেমন পার্থক্য?
-আছে অনেক। আপনি তা বুঝবেন না।
-আপনার কি আমাকে এতো নির্বোধ মনে হয়?
সে আমার দিকে খানিকটা তাকিয়ে থেকে বলল,
-না। নির্বোধ নয়। তবে আমার আপনাকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে।
আমার গা জ্বলে গেল যেন। এমন অপমান যেন সইতে পারলাম না। কেবল মেয়েটার দিকে চেয়ে চুপ থাকলাম। বললাম,
-এভাবে অপমান করাটা অন্যায়। কী দেখে আপনার মনে হলো যে আমি পাগল?
-আছে কয়েকটা কারণ। আর তাছাড়া আপনি একটু আগে নিজেই স্বীকার করছেন যে আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন।
আমি কিছু বললাম না আর৷ চুপ করে থাকলাম। মেয়েটা আমাকে জব্দ করে বেশ মজা পেল যেন। মুচকি মুচকি হাসি দিল৷ তারপর কিছু পথ হেঁটে একটা বাসার ভেতর চলে গেল। আমি আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেন দাঁড়িয়ে থাকলাম বুঝতে পারছিলাম না। বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল।
এরপর আজ দু'দিন পেরিয়ে গেল আমি মেয়েটাকে আর দেখিনি৷ আমাদের আর দেখা হয়নি। আমি নিজের ভেতর কেমন জানি অস্থিরতা অনুভব করলাম। অচেনা অজানা একটা মেয়েকে দেখে আমার মন যেন চট করেই ভীষণ চঞ্চল হয়ে গেল। কেমন পাগল পাগল হয়ে উঠল৷ দু'দিনে আমি অন্তত ওই বাসাটার সামনে পঞ্চাশ বার গিয়েছি। একবারের জন্যেও মেয়েটাকে দেখিনি। মেয়েটা কোথায় লুকিয়ে থাকে? একটুও কি বের হয় না? বিকেল বেলাতেও না? বারান্দায় বসে কি সন্ধ্যা দেখে না? নিঝুম অন্ধকারে কি চুপচাপ বসে থাকে না? আচ্ছা, মেয়েটা কি জানে এ'পাশে কেউ একজন অধীর আগ্রহে তাকে দেখার জন্যে কতোটা অপেক্ষা করে? জানার কথা নয়। তবুও মনে এমন অস্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন তৈরী হয়৷ মেয়েটা যখন জানবে তখন কেমন রিয়েক্ট করবে? খুশি হবে? নাকি দূর করে দিবে? আর ওই ছেলেটা? আমি এখনও ওই ছেলের ব্যাপারে কোনো খোঁজ পাইনি। সে নিয়ে মনের ভেতর চলছে অন্য রকম একটা তুফান। কী অদ্ভুত হুজুগে সময় পার করছি তা কেবল আমিই জানি৷ আমার ভেতর দিয়ে কি যাচ্ছে তা যদি কাউকে বুঝাতে পারতাম! মনটাও হঠাৎ এই মেয়েকে দেখে এমন পাগল পাগল হয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? আমার কথা কি একবার ভাবলও না সে? চট করেই একটা মেয়েকে দেখে তাকে নিয়ে অনুভূতির পাহাড় তুলে দাঁড় করালো! এবার আমার সত্যি সত্যিই মনে হতে থাকল যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন দুটো সপ্তাহ আমার কীভাবে যেন কেটে গেল৷ ভারী মন নিয়ে এক বিকেল বেলা ছাদে এলাম। মন খারাপ থাকলে আমি ছাদে এসে গাছের সাথে কথা বলি৷ আমার একটা গাছ আছে। ফুল গাছ। ফুলটির নাম কাঠগোলাপ। আমার রূপসীর মতো সেও ভীষণ রূপসী। আমার রূপসী যেমন রহস্য করে এই ফুলটিও যেন তাই করে। সাদা একটা ফুলের মাঝখানে অদ্ভুত এক মায়া নিয়ে বসে থাকে হলুদ কিছু অংশ। আমি যেন বারবার এই দু'রঙের প্রেমে পড়ি৷ ভীষণ রকম পড়ি৷ আমি গাছটির ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কোনো কথা বললাম না। গাছটি যেন তা বুঝতে পারল। পাতা নড়ে উঠল তার৷ এপাশ ওপাশ করে দুললো ফুলো গুলো। হঠাৎই একটা মিষ্টি বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল আমায়। আমি একটি ফুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
-এই ফুল? তুমি কি বুঝতে পেরেছো যে আমি প্রেমে পড়েছি?
বাতাস বইলো। পাতা নড়লো। ফুলটাও যেন নড়ে নড়ে সায় জানালো। বললাম,
-তুমি প্রকৃতির পরম বন্ধু। তোমার তো জানার কথা৷ প্রকৃতি আমার মাঝে কী ঘটিয়ে গেল৷ ঘটিয়ে গেল ঠিক, তবে কিছু বিস্তার করে গেল না। আচ্ছা, তোমার প্রকৃতি এ কেমন খেলা খেলছে বলতো? কেমন অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছে আমায়? একটা মেয়েকে আমার ভালো লাগল। অথচ সে কিছুতেই যেন চাচ্ছে না আমি তার হই৷ তাকে পাই? এখন আমার মনে হচ্ছে আমার চাওয়াটাও ভীষণ অন্যায়।
গাছটি নীরব থাকল। একদম নীরব। যেন সে আমার কথা বুঝতে পারছে৷ বুঝতে পেরে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে৷ গাছটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। পশ্চিমে তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। আমি পশ্চিমে তাকালাম। এক ঝাপটা দখিনা বাতাস যেন আমার ভেতরটা ছুঁয়ে দিলো। আমি চোখ বুঁজে তা অনুভব করলাম। কেন জানি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটাকে৷ সত্যি বলতে আমি যেন চট করেই চমকে উঠলাম। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে! সেখান থেকে আমাকে দেখছে! সত্যিই আমাকে দেখছে? আমার বুকের ধপধপ শব্দটা যেন অযথাই বেড়ে গেল। কী এক অদ্ভুত আনন্দে আমার চোখে জল জমতে চাইলো। তবে জমলো না৷ সেই জল কেবল ভেতরটাই ভিজিয়ে দিলো৷ আমাদের ছাদ আর ওপাশের ছাদে এক সাথেই। তবে কার্ণিশ ভীন্ন৷ আমার খুব ইচ্ছে হলো আমি কার্ণিশ টপকে যাই। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি। বলি,
-এই মেয়ে? এক দেখা দিয়ে এতোদিন কই ছিলে? দেখা দাওনি কেন আর? আমাকে পাগল করার প্ল্যান করেছো কী?
অথচ আমি তা করতে পারলাম না। মন যেন তা করতেই দিল না। আমি আমার জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র নড়লাম না৷ আমার অনুভূতির পাহাড় যেন মূহুর্তে অভিমানে পরিণত হলো। অপার্থিব কিংবা অনধিকারী কিছু অভিমান! যেখানে এক পক্ষের অভীমানও যেন কিছু নয়৷ হঠাৎ মেয়েটা ডাকল।
-এই যে! মিস্টার! এদিকে আসুন তো!
আমি যেন নড়তেও পারলাম না। আমার সমস্ত শরীর যেন জমে বরফ হয়ে আছে। সে আবার বলল,
-কই? আসুন না?
আমি কখনও গেলাম না। মেয়েটা যে খানিকটা বিরক্ত হলো। বলল,
-এতোদিন তো পাগলের মতো খুঁজেছেন। অথচ আজ সামনে পেতেই কেমন জানি অচেনা বিহেভ করছেন৷ আমি নিজ থেকে ডাকাতে বুঝি ভাব বেড়ে গিয়েছে?
আমি এক পা দু'পা করে এগিয়ে গেলাম। তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
-আপনি এখানে কী করে এলেন?
সে যেন ভীষণ অবাক হলো! বলল,
-আশ্চর্য! আমার ছাদে আমি আসবো না তো কে আসবে?
-আপনার ছাদ মানে? আপনার না বাসা ওইদিকে?
-তা কখন বললাম?
-ওইদিন যে গেলেন?
-গেলেই কি ওটা আমার বাসা হয়ে যাবে নাকি?
-তাহলে ওটা আপনাদের বাসা নয়?
মেয়েটা মুচকি হাসি দিলো। বলল।
-না৷
আমি খানিকটা ভেবে বললাম,
-আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সেদিন আপনি ইচ্ছে করেই এমন করেছেন। অন্য কারো বাসায় ঢুকে পড়েছে৷ ওটা আপনার প্ল্যান ছিল? আমাকে দেখতেই আপনি ইচ্ছে করে এমন করেছেন? তাই না?
মেয়েটা বেশ গর্বের সাথে বলল,
-হ্যাঁ।
-ঠিক করেননি আপনি। অযথাই আমাকে ওই বাড়ির সামনে সারাদিন চক্কর চালাতে হয়েছে।
-তা মশাই এতো চক্কর চালিয়েছেন কেন শুনি?
-যে কারণে আপনি আমাকে আপনার বাসার ভুল ঠিকানা দিয়েছেন ঠিক সে কারণে।
-আপনি লেখক মানুষ! আপনার প্রতিটি কথাই ভারী। বুঝা মুশকিল!
-আমি লেখক সে খবর আপনাকে কে বলল?
-যে-ই বলুক তাতে আপনার কী! অন্তত আমি তো আপনার মতো নই। নিজের বাড়ির পাশের একটা মেয়ে থাকে অথচ তাকেই আপনি ঠিক ভাবে চিনেন না৷ কেমন মানুষ আপনি?
-এলাকার মেয়েদের নাম করে লিস্ট নিয়ে তাদের খোঁজ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমার নয়।
-এলাকার সবার খোঁজ রাখতে তো বলিনি। আমার খোঁজ রাখতে বলেছি৷ কেবলই আমার।
-কেন?
-খুবই জটিল প্রশ্ন। সঠিক উত্তর জানা নেই। কিংবা আছে হয়তো৷ গোছানো নয়।
-ভারী কথা যে কেবল লেখকরাই বলে তা কিন্তু নয়৷ আপনার মতো ক'য়েকজন নারী আছে। তারাও এমন কঠিন কঠিন কথা বলে!
-হ্যাঁ। তা তো দেখিই। ফেসবুককে দেখি তো আপনার আলামত। একদিন আন্টির কাছে এসে বিচার দিয়ে যাবো। খুব বকা খাওয়াবো আপনাকে।
আমি খানিকটা হেসে বললাম,
-আপনি আসবেন?
-কেন? আপনাদের বাসায় আসা কি নিষেধ নাকি?
-না। তা নয়। বলছিলাম...
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। হঠাৎই তার চেহারায় যেন ভীষণ পরিবর্তন ঘটে। বলল,
-বলছিলাম? তারপর?
-না থাক। বলব না।
-এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না৷
-কোনটা?
-এই যে কথা অর্ধেক বলে আর বলছেন না!
-তাহলে আপনিও তো ঠিক করছেন না। করেননি?
-আমি? কী ঠিক করিনি?
আমি এবার খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-এই যে অধো অধো অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছেন, আমার অনুভূতি গুলোকে পাগল করে দিয়ে যাচ্ছেন, আমার নিত্যদিনের রুটিন যে পাল্টে দিচ্ছেন তা কি ঠিক হচ্ছে? এটা কি এক পাক্ষিক অন্যায় নয়?
মেয়েটা মুচকি হাসি দিলো যেন। লজ্জা যেন তাকে ঘিরে ধরল। মাথা নিচু করে নিলো৷ বলল,
-কেউ একজন যে আরো আগ থেকেই আমার অনুভূতি নিয়ে খেলছে তার কী হবে? সে অন্যায়ের ভার সইবে কে?
আমার মুখ মলিন হলো৷ বললাম,
-কে সেই মানুষটা? ওইদিনের ওই ছেলেটা?
-বুদ্ধু আপনি! কিচ্ছু বুঝেন না৷ ও আমার কাজিন। লন্ডন থেকে এসেছে৷ আমি বাজারে যাচ্ছি বলাতেই সে যেতে চাইলো।
আমি যেন স্বস্তি পেলাম ভীষণ। ভারী একটা পাথর যেন বুকের উপর থেকে সরে গেল এক নিমিষেই একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসের সাথে৷ বললাম,
-বাঁচালেন!
-কীভাবে?
-তা জানি না। তবে মনে হলো! এই বার পাগল হওয়া থেকে বেঁচে ফিরবো আশা করি৷
-আর আমি? আরো আগ থেকেই যে পাগল হয়ে আছি?
-আরো আগ থেকেই? তাহলে আল্লাহ আমাদের এতো দেরিতে মেলালো কেন?
-সেটা তিনিই ভালো জানেন৷ তবে...
-তবে?
-আমি সেই ইন্টার থেকে কেবল এক তরফা একজন মানুষকেই চেয়ে এসেছি৷ তার প্রতিটি খোঁজ আমি রেখেছি৷ বার বার তার এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করেছি৷ খুব করে করেছি। কলেজ যাওয়ার পথে, ফেরার পথে, বিকেল বেলা ছাদে উঠেও তাকে দেখে গিয়েছি৷ উল্টাপাল্টা কথা বলেছি৷ চাইছি মানুষটি তাকাক একটু। দেখুক না আমায়। এই যে আমি শাড়ি পরে হাত ভর্তি চুড়ি নিয়ে ছাদে এসে বসে আছি! অথচ সে তাকালোই না৷ ছাদেই উঠে কেবল এক গাছ কে নিয়েই পড়ে থাকতো৷ আচ্ছা বলুন তো ওই গাছটায় কী আছে? এতো তাকিয়ে থাকতে হবে কেন ওটার দিকে?
আমি হাসলাম। বললাম,
-আছে নিশ্চয়ই কিছু একটা৷ তা না হলে এতো টানতো না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না৷ আপনি এই ছাদে প্রায়ই আসতেন। অথচ আমি দেখিনি? আপনি কি আসলেই আসতেন?
-আপনার কী মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি?
-না৷ তা নয়। তবে আসলে তো দেখার কথা। কেন দেখলাম না কে জানে!
-তা দেখবেন কীভাবে? এসেই তো গাছটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন?
হঠাৎই আমার যেন ভীষণ হাসি পেল। বললাম,
-আপনার হিংসে হয়?
সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-হুহ!
তার ঠোঁট বাকিয়ে 'হুহ' বলাটাও যেন ভীষণ সুন্দর। প্রেমময়। বললাম,
-আরেকবার ঠোঁট বাঁকিয়ে 'হুহ' বলুন তো!
-পারবো না।
-বলুন না৷
-না।
-রাগ করবো আমি।
-করুন৷ আমার কী!
-আপনার কিছুই না?
-উহু৷
-সত্যি বলছেন?
-আমি প্রয়োজন ব্যাতিত মিথ্যা বলিনা।
-বাহ! বেশ তো! তবে কি আমার রাগের মূল্য নেই?
-তা নয়৷ তবে অযাচিত রাগের মূল্য না দেওয়াই ভালো।
আমি হাসলাম। বললাম,
-তা আজ শাড়ি পরেছেন কেন? হায় ভর্তি চুড়িও দেখছি!
-পরেছি কাউকে দেখানোর জন্যে। অথচ মানুষের সময় কই?
-আমি কি কার্ণিশ টপকে ওপাশে আসবো?
-জানি না।
-আসলে কি রাগ করবেন? বলতে পারছি না।
আমি কার্ণিশ টপকে ওপাশের ছাদে চলে গেলাম। বললাম,
-এতো ভনিতা করার কী প্রয়োজন? সরাসরি অনুমতি দিলে কী হয়!
-কিচ্ছু হয় না।
-তবে দেননি কেন?
-আমি চাই আপনি আমার চোখের ভাষা বুঝুন৷
-এই চাওয়ার কারণ?
-কারণটা কি আমার মুখ থেকেই শুনবেন? নাকি নিজেই বলে ফেলবেন?
-আপনার কী মনে হয়? আমি কি এখন, আপনার সামনে কারণটা বলতে পারবো?
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-পারবেন। তবে আমি নিশ্চিত আপনি বলবেন না৷
-কীভাবে বুঝলেন আপনি?
মেয়েটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-সেই নিষ্পাপ অনুভূতির বয়স থেকে আপনাকে পড়ে যাচ্ছি আমি৷ এ আর এমন কী!
-খুব গভীরে চলে গিয়েছেন মনে হয়?
-যতোটা গভীরে আপনি ভাবছেন ঠিক তার চেয়ে ভীষণ গভীরে।
আমি খানিকটা চুপ করে থাকলাম। একদম তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
-আমি একটু রগচটা টাইপের। রাগটা অনেক বেশি! কন্ট্রোল করতে পারবেন?
মেয়েটা মুচকি হাসলো৷ চোখ দুটো কেমন চিকচিক করলো যেন। বলল,
-আপনার আর আমার দু'পাক্ষিক দ্বিতীয় দেখা হলো সবে৷ এখনই এতো বড় দায়িত্ব দিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-শুভ কাজে দেরি করতে নেই৷
মেয়েটাও হাসল। বলল,
-একটা কাকতালীয় ব্যাপার কী জানেন?
-কী?
-আমার নাম কিন্তু মিহিন!
আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে ফিরে তাকালাম। বললাম,
-তাই? সত্যি বলছেন?
সত্যি বলতে মিহিন নামটা শুনতেই আমার কেমন জানি আনন্দ লেগে উঠল। আনন্দঘন কিছু অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। মিহিন নামটা আমার কেবল পছন্দেরই নয়৷ মহা পছন্দের। মেয়েটা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। আমার বাজুতে মাথা ঠেকালো কেবল৷ আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল যেন। বুকের ভেতর কেমম অদ্ভুত তোলপাড় শুরু হলো। মেয়েটা বলল,
-আমি গল্পে নয়, বাস্তব হতে চাই। আমি আপনার হতে চাই ভীষণ। তাসফি, আপনি প্লীজ আমাকে আগলে রাখবেন। কারণ আমি নিজেও কেবল রাগী নই। মহা রাগী৷ আপনি আমাকে আগলে রাখবেন, কথা দিন প্লীজ?
আমি তার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললাম,
-আস্থা রাখো আমার উপর মিহিন। আমরা একদিন গল্প হবো। গল্প গড়বো। বাস্তব গল্প। মানুষ একদিন আমাদের খুঁজবে দেখো। খুব খুঁজবে। গল্পে গল্পে৷
আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম কার্ণিশ ঘেঁষে। সূর্য তখন লুকিয়েছে কেবল। কিছু আভা এখনও রেখে গিয়েছে। সেই আভাটা মিহিনের মুখের উপর পড়ছে। মিহিনকে হঠাৎই সুন্দর লাগছে। ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমি মোহভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকলাম কেবল। আমার তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। অদ্ভুত শিরশিরে এক শীতল অনুভূতি হচ্ছে । আনন্দ ঘেরা অনুভূতি।
(সমাপ্ত)
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।