গল্পঃ ভালোবাসায় মিশে থাকুক সে । লেখক - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ ভালোবাসায় মিশে থাকুক সে । লেখক - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ ভালোবাসায় মিশে থাকুক সে
তাসফি আহমেদ
আমি ইশার পেছনে দৌড়ে গেলাম। পেছন থেকে বললাম,
-এই ইশা! দাড়া! আমার টাকাটা আমাকে দিয়ে দে বলছি?
ইশা আমার কথা শুনলো না। সে দ্রুত হাঁটতেই থাকলো। আমি ওর পেছন পেছন যেতে থাকলাম। ঠিক তখনই মিহিন এসে হাজির হলো। ঠিক আমাদের সামনেই। ইশা ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। ওকে দেখতেই দাঁড়িয়ে গেলাম। কেন দাঁড়ালাম তা ঠিক বলতে পারছি না৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল। ও আমায় দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
-আপনি? এই মেয়ের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন কেন?
তার চেহারায় রাগ। ভ্রু জোড়া কুচকে আছে। খানিকটা বোকা স্বরে বললাম,
-মানে? কী বলছেন? কোন মেয়ের পেছনে দৌড়ালাম?
মিহিন আমার কথার জবাব না দিয়ে খানিকটা কর্কশ স্বরে বলল,
-আপনারা ছেলেরা এমনই৷ একটা মেয়ের কাছে পাত্তা না পেলে আরেকজনের পেছনে পড়ে যান৷ মানে প্রেম করা যেন আপনাদের নেশা। ছিহ! আমি ভাবলাম আপনি অন্য সবার মতো না। ভিন্ন কেউ। কিন্তু...
-আশ্চর্য! কী সব বলছেন? কোথাও আপনি এটা ভাবছেন না তো যে আমি ওই মেয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছি তাকে পটানোর জন্যে?
সে কোনো জবাব দিলো না। চোখে, মুখে রাগ নিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো৷ ঠিক তখনই ইশা এসে হাজির হলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কিরে? কে উনি?
মিহিন আমার পেছনে চলে গেছে ততক্ষণে। ইশাকে দেখতেই সে এগিয়ে এসে বলল,
-এই যে আপু! এই ছেলেটার কথার ফাঁদে পড়বেন না প্লীজ৷ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আপনার মন গলাতে চাইবে। বলবে, আপনাকে ছাড়া সে একদমই বাঁচবে না৷ আপনি তার ড্রিম গার্ল! আপনাকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারে না৷ আরো কতো কিছু! কিন্তু এসব কিছুই বিশ্বাস করবেন না। এটা এদের নিত্য কাজ। মেয়েদের পেছনে ঘুরাটা এদের এক প্রকার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক প্রকার রাগ দেখিয়েই কথা গুলো বলল মিহিন৷ আমি ইশার দিকে তাকালাম একবার৷ সে আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকল। তারপর মিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ও কি আপনার পেছনে ঘুরেছিল?
মিহিন দ্রুত জবাব দিলো,
-হ্যাঁ। অনেকদিন। আমি পাত্তা দেইনি বলেই আজ আপনার পেছনে ঘুরছে৷
ইশা কিছু সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি দেখলাম ওর মুখটা শক্ত হয়ে আসছে। কেমন জানি রুক্ষ রুক্ষ ভাব৷ বলল,
-আপনিই তাহলে সেই মিহিন যার পেছনে আমার ভাই ঘুরেছিল?
মিহিন খানিকটা অবাক হলো। ভ্রু কুচকে বলল,
-আপনি আমাকে চিনেন? বাট হাউ? আর আপনার ভাই বলতে?
ইশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এই যে! এই ছেলেটাকে দেখছেন না? ও আমার বড় ভাইয়া৷ আমি তার এক মাত্র ছোট বোন। কাউকে নিয়ে কিছু ভাবার আগে অবশ্যই ভেবেচিন্তে ভাবুন৷ দুটো ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলেই যে তারা কাপল হয়ে যাবে তা তো নয়? তাদের সম্পর্কটা তো ভিন্নও হতে পারে? এতো রং থট কেন আপনাদের মাঝে বুঝি না!
ইশা বেশি বেশিই বলে ফেলছে৷ আমি ওকে থামাতে চাইলাম৷ তখন মিহিন মাথা নিচু করে মলিন স্বরে বলে উঠল,
-আ'ম সরি।
-আপনি যা করেছেন তার জন্যে আপনি জীবনেও ক্ষমা পাবেন না৷ আজকেরটা না হয় ক্ষমা করা গেল। কিন্তু এর আগে আপনি যা করলেন তা কখনই ক্ষমার উপযোগ্য নয়৷
মিহিন মলিন মুখে ভ্রু কুচকে বলল,
-মানে? কী করেছি আমি এর আগে?
আমি ইশার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললাম,
-ইশা? এসব ব্যাপারে এখানে আলোচনা না করলেই কি নয়? চুপ থাক না?
মিহিন বলে উঠল,
-চুপ থাকবে কেন? আপু, আপনি বলুন কী করেছি আমি৷ আমার অপরাধ কী?
ইশা বলে উঠল,
-আমার ভাইটা না হয় আপনার পেছনে ঘুরেছিল। ঘুরাটা অস্বাভাবিক নয়৷ এ জীবনে তার মুখে কখনই কোনো মেয়ের নাম শুনিনি। কেবল আপনার নাম ছাড়া। আপনাকে যে সে সত্যি সত্যিই পছন্দ করেছিল সেটা আপনি বুঝতে না পারলেও আমি বেশ পেরেছি৷ আপনার আমার ভাইকে পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে লোক পাঠিয়ে আমার বাবার কাছে এ নিয়ে বিচার দেওয়ার কী হলো?
মিহিন বলল,
-বিচার? আমি বিচার দিয়েছি? আপনার বাবার কাছে?
-তা নয়তো কে দিবে? আপনার পেছনে ঘুরেছে তার মানে অবশ্যই আপনি দিয়েছেন৷ কিংবা আপনার বাবাকে বলেছেন, তিনি বিচার পাঠালেন। আপনি জানেন এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ঘরে কতো ঝামেলা চলছে?
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন?
-ও! এখন তো আপনি কিছুই বুঝতে পারবেন না৷ নির্দোষ সাজার অভিনয়টা আমার সামনে করবেন না প্লীজ৷
-আমি সত্যিই বলছি...।
আমি ইশাকে টেনে নিয়ে এলাম কিছুদূর। ও আসতে চাইছিল না৷ বলল,
-ছাড়। বলতে দে আমাকে।
রাগে ওর মুখটা লাল হয়ে ছিল। আমি বললাম,
-রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করার কোনো মানে হয়?
আমি ওর হাত ধরে টানতে থাকলাম। রাগে তার চেহারা কেমন জানি হয়ে আছে। মিহিনকে দেখলাম সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ইশাকে টেনে নিয়ে এলাম এদিকটায়। বললাম,
-কী করছিস তুই? এমম বিহেভ করলি কেন ওর সাথে?
ও রাগি স্বরে বলল,
-তো কী করবো? সব ঝামেলার মূল তো ওই মেয়েই। বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার! বিশ্ব সুন্দরী ভাবে নিজেকে। কেউ পেছনে ঘুরলেই ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে বাবার কাছে বিচার দিয়ে দেয়৷
আমি কিছু বললাম না। চুপ থাকলাম। ইশা আর আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎই ইশা বলে উঠল,
-চিন্তা করিস না তুই। এরচে ভালো মেয়ে জুটবে তোর কপালে৷
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ থাকলাম।
মিহিন মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি। জীবনে কখনই কোনো মেয়েকে নিয়ে আমার অনুভূতি এতোটা তীব্র হয়নি যতটা এই মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে। তাকে নিয়ে যেন এক প্রকার অনুভূতি দলা পাকিয়ে বসে আছে আমার মনের মাঝে৷ অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করছে৷ মেয়েটার সেই মুগ্ধ করা দু'চোখ, কাজল দিয়ে যেন দু'চোখের মায়া গুলো আঁটকে রাখছে সে। আমি যতোবারই দেখি, থমকে দাঁড়াই। হারিয়ে যাই ওই চোখ দুটোর মাঝে। তার বিস্তৃত হাসির মাঝে যেন এক অনবদ্য আনন্দ পাই৷ চোখে সামনে যখন অবাধ্য চুল গুলো চলে আসে, সে যখন সেই চুল গুলোকে মসৃণ ভাবে তার কানের কাছে গুঁজে দেয়, তখন তাকে অভাবনীয় রূপবতী লাগে৷ আমি একদিন সেই কথাটা তাকে বলতে গিয়েছিলাম। আমার ভেতরে যে অনুভূতিরা বংশবিস্তার করছে তাদের কিছুকে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম৷ অথচ প্রথম দিন মেয়েটা আমাকে মূল্যই দিলো না৷ অনুভূতির কথা তো দূরে থাক৷ বেলা শেষে ব্যার্থ যোদ্ধার মতো বাড়ি ফেরা আমি আনমনে তখনও তাকে কী ভীষণ ভালোবেসে যাচ্ছিলাম তা যদি এই মেয়ে অল্প হলেও টের পেত তবে অন্তত আমার সাথে এমন ব্যাবহার করতো না৷ আমি দ্বিতীয়বার তার সামনে যাই। বুক তখন ভীষণ কাঁপছিল। নেহাত ভালোবাসা এবং প্রেম নিবেদন এই সবই আমার জন্যে প্রথম বলে। সে তখন লেক পাড়ে একা একা বসে আইস্ক্রিম খাচ্ছিল৷ কারো আসার অপেক্ষা করছে হয়তো৷ বললাম,
-কেমন আছেন?
সে বসে থেকে আমায় দেখলো। বলল,
-আপনি? আজ আবার?
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। বললাম,
-কেমন পাগলামি করছি তাই না?
-হ্যাঁ। বুঝতেই যখন পারছেন তখন করছেন কেন?
-কেন করছি সেটাই বুঝতে পারছি না৷ আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে? কী সব করে বেড়াচ্ছি!
সে কিছু বলল না আর। মনোযোগ দিয়ে আইস্ক্রিম খেতে থাকল৷ আমি বেহায়ার মতো বললাম,
-পাশে বসবো?
সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
-কিছু বলবেন?
-হ্যাঁ। কিছু বলতেই তো আসা৷
-বসুন। তবে দূরত্ব বজায় রেখে৷ যা বলার জলদি বলবেন। আমার বান্ধুবিরা আসার আগে৷
সে এমন ভাবে কথাটা বলল যেন আমার ভালোবাসা তার অধিক ব্যক্তিত্বের মাঝে মলিন, ফিকে অথাব ভীষণ ছোট! নিজেকে তখন বেশ ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল। যার কোনো মূল্য নেই এই পৃথিবীতে। আমি কাঁপাকাঁপা বুক নিয়ে তার পাশে বসলাম। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। বললাম,
-কিছু কথা বলি৷ যদি মন দিয়ে শুনতেন!
সে তখনও আমায় দেখেনি৷ আইস্ক্রিম খেতে খেতে বলল,
-আপনি বলুন। আমি শুনছি।
কথায় তার অহংকার ঝরে পড়ে। আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলাম। কেমন জানি একটা অনুভূতি হলো৷ এই পৃথিবীতে মূল্যহীনতার অনুভূতি কী সেটা সে ঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিলো আমায়৷ তাও সব এক পাশে রেখে নিজের বাড়ন্ত, উচ্ছাসিত অনুভূতি নিয়ে বললাম,
-আজ প্রায় দেড় মাস আমি আপনাকে ফলো করি৷ আপনি কি জানেন সেটা?
তার মূল্যহীন উত্তর,
-হ্যাঁ।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-আপনি জানতেন?
আমি যেন ভীষণ খুশি হই হঠাৎ করেই। সে বলে,
-না জানার কী আছে? চোখ দুটো বেশ ভালো আমার। সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে দেখি।
আমি হাসলাম। এই মেয়ের কঠোর স্বরও আমায় আলোড়িত করে। বললাম,
-শুনে ভালো লাগল।
তার কঠিন জবাব,
-শুনে ভালো লাগার কিছু নেই এখানে। এটা এমন কোনো বিশেষ ব্যাপার নয় যে ভালো লাগতে হবে৷
এই বলে সে চুপ থাকল। তার আইস্ক্রিম খাওয়া শেষ৷ আমি বললাম,
-কেন ফলো করছি জানেন?
-কেন করছেন?
আমি কিছুটা সময় চুপ থাকলাম। নিজের ভেতরকার কথা গুলো গুছিয়ে নিলাম স্বল্প সময়ে। বললাম,
-মিহিন, আপনাকে আমার ভীষণ পছন্দ। সেই...
সে আমায় থামিয়ে দিল কথার মাঝে। আমার নিষ্পাপ অনুভূতি গুলো হোচট খায় যেন। বলে,
-ওয়েট! আর কিছু বলতে হবে না৷ আমি জানি আপনি এরপর কী বলবেন।
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-বাহ! তাহলে তো আর আমাকে কিছুই বলতে হবে না৷
-দেখুন, এ জাতীয় হাজারো প্রপোজাল আসে আমার কাছে। এর মানে এই না যে আমি সবার সাথেই প্রেম করবো৷
-না৷ তা বলছি কোথায়। আপনারও তো পছন্দ অপছন্দ আছে।
-রাইট৷ আমি যেমন চাচ্ছি আপনি আসলে তেমন নন৷ বলতে গেলে আপনি আমার পার্সোনালিটির সঙ্গে যান না৷
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। মন খারাপ হলো ভীষণ। আমি তার সাথে কোথায় প্রেম করতে এসেছি, সেখানে সে ব্যক্তিত্বের হিসেবে করছে? প্রেম করতে ব্যক্তিত্ব লাগে? এতো হিসেব কষাকষি করে কি প্রেম হয়? সে বলল,
-তারপরেও আপনি মানুষটা অন্য রকম। ঠিক অন্য সবার মতো নন৷ আমি যার সাথে প্রেম করবো দেখে শুনেই করবো৷ হুটহাট আবেগের বসে কিছু করে ফেলতে চাই না৷ বুঝাতে পেরেছেন?
আমি মলিন মুখে হাসলাম। মাথা নেড়ে সায় দিলাম। সে কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
-ওয়েল, আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাই৷ আপনি নিজেকে এ জন্যে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কারণ এর আগে কেউই এই সুযোগটা পায়নি। আমি আপনাকে এক মাস সময় দিলাম। এই এক মাসে যদি আপনি আমাকে ইম্প্রেস করতে পারেন তবে...
সে থামল। আমার শিরশিরে অনুভূতি গুলো তখন খুব বেগ পেয়েছে। শরীরের অঙ্গে অঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দ্রুত বললাম,
-তবে?
-কিছু একটা হতে পারে৷
এই বলে মৃদু হাসল সে। অদ্ভুত লজ্জাময়ী এক হাসি। আমার কাছে কেন জানি হুট করেই ভালো লাগতে থাকল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি আমার চারপাশটাকে ঘিরে রাখলো। আমি বললাম,
-আপনার হাসিটা ভীষণ সুন্দর।
সে তখনও হাসল খানিক। তারপর বলল,
-কিন্তু কিছু কন্ডিশন আছে। আপনাকে সে গুলো মেনে চলতে হবে।
আমি হাসলাম। বললাম,
-কী কন্ডিশন? আপনার যেকোনো কন্ডিশন মানতে প্রস্তুত আমি।
-প্রথমত গায়ে হাত দেওয়া যাবে না৷ অতিরিক্ত কথা বলা যাবে না৷ এবং অতিরিক্ত কিছুও করতে পারবেন না। এক মাস আমরা বন্ধুর পরিচয়ে থাকব। কেউ জিজ্ঞেস করলে এটাই বলব যে আমরা কেবল বন্ধু৷ আর কিছু নই৷ আমার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু আশা করা যাবে না। আমি রাগলে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।...
একের পর এক কন্ডিশন আসতেই থাকল। একসময় দেখা গেলো কন্ডিশনের তোড়ে তাকে ইম্প্রেস করার জন্যে আমাকে তার পাশে প্রতিবন্ধি হয়ে থাকতে হবে৷ এমন হলে ইম্প্রেস করাটা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে। হায় খোদা! এ কোন পরিক্ষায় ফেললে আমায়।
তবুও কেন জানি তার এই কথা গুলো শুনতে আমার ভালো লাগছিল৷ সত্যি বলতে ওর প্রতিটি জিনিসই আমার ভালো লাগে৷ সেটা রাগ হোক কিংবা অধিক ব্যক্তিত্বধারী অহংকার হোক৷ পরেরদিন থেকেই তাকে ইম্প্রেস করার কাজে লেগে পড়লাম। মেয়েটার দৈনন্দিনের রুটিন আমার বেশ জানা আছে৷ আমি হুটহাট গিয়ে তাকে চমকে দিতাম। পেছন পেছন ঘুরতাম। কথা বলতে চাইতাম। সে সাইড দিতো কয়দিন, আবার দিতো না৷ কিন্তু কিছুদিন যেতেই আমার মনে হলো আমি ভুল করছি। ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছি৷ আমার আবেগ গুলো আমি ভুল কারো জন্যে জাগিয়েছি। মেয়েটা আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসবেও না৷ আমি তাকে ইম্প্রেস করতে চাইছি, তাকে ইম্প্রেস করতে পারলে প্রেম হবে৷ না হয় হবে না৷ এতো এক প্রকার জোরাজোরি। আমি এক মাস তার পেছনে ঘুরে ঘুরে তার অনুভূতি গুলো আমিমুখী করবো, আমাকে নিয়ে যেন সে ভাবে এ জন্যে প্রতিটি মূহুর্তে তার পেছনে পেছনে ঘুরবো, তাকে ফোন দিয়ে জোর করে কথা বলবো, আমাকে নিয়ে ভাবাতে চাইবো, এটা তো জোর করে প্রেম করা। এমন রিলেশনের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়৷ অথচ আমি এমনটা চাইনি৷ আমি চেয়েছি যাকে দেখে আমার সমস্ত পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়েছে, আমাকে দেখে বিপরীত জনেরও অনুভূতি গুলো যেন থমকে দাঁড়ায়। আমি যেমন করে তাকে দেখি সেও যেন তেমন করে আমায় দেখে। আমাদের মাঝে কোনো প্রভেদ থাকবে না। থাকবে না অহংকার কিংবা অধিক ব্যক্তিত্বের কোনো দেয়াল। এমনটা হবে যেন আমি এবং সে একে অপরের জন্যেই সৃষ্টি৷ ছবি কিংবা গল্পে এমন হয়। কিন্তু ছবি কিংবা গল্প বাস্তবতার আদলেই তো হয়! সে ব্যাপার না হয় থাক, এমনটা কেবল আমার চাওয়া। এরচে' বেশি কিছু নয়। কিন্তু মিহিন আর আমার মাঝে এক মাসের যে ডীল এবং আমাদের যে কন্ডিশন, এসব করে যে আমি অবশেষে একটি সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবো সে ব্যাপারে আমি হঠাৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়লাম। আমি তখনই মন থেকে সব ঝেড়ে দিলাম। প্রকৃতি যা চাইবে তাই-ই হবে। আমাদের প্রেম আমাদের ইচ্ছায় হোক, জোরাজোরিতে নয়। তা না হলে আজীবনই জোরাজোরিতে কেটে যাবে৷ আমি এর পরের দিন গুলোতে তার সকল কন্ডিশন ভুলে গেলাম। তাকে ইম্প্রেস করার কথা ভুলে গেলাম। এভাবে যদি হয় হবে। না হলে নয়৷ তারপর হঠাৎই আমাদের দেখা সাক্ষাত কমে গেল। যখনই আমার মন টানলো আমি তাকে দেখতে চলে গেলাম। আড়াল থেকে কিংবা দূর থেকে দেখে গেলাম। সে দেখল অথচ না দেখার ভান করে থাকল। আমার তার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হলো তো গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সে তার ইচ্ছে মতো এড়িয়ে গেল। সেদিন কথার কথায় সে বলেই ফেলল,
-হুট করে আপনি কেমন জানি হয়ে গেছেন। আগের মতো পেছন পেছন ঘুরেন না৷ দূর থেকেই দেখে চলে যান। কাছে আসেন না। আবার আসেন কখনও৷ কী হলো? প্রেম কি হুট করেই উবে গেল নাকি?
আমি হাসলাম। বললাম,
-প্রেম বাষ্পের মতো নয় যে উবে যাবে৷ যেখানে যার থাকার সে সেখানেই আছে।
-তাহলে হঠাৎ এতো পরিবর্তন?
-পরিবর্তনটা আপনার দৃষ্টিতে। আমি তো সেই আগের মতোই আছি।
-দূর থেকে দেখার কারণ?
-দূরে কিংবা কাছে, যাই হোক, আপনি আমার মনের গভীরে আছেন। থাকবেন৷
-কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি লাগছে৷ মনে হচ্ছে কেউ আমাকে নিজের মতো করে ইউজ করছে। ইচ্ছে হলে সে আসছে৷ না হলে সে আসছে না৷ সব তার মতোই হচ্ছে। এমনটা তো আমি চাইনি?
-সব কিছু তো সকলের চাওয়া মতো হয় না মিহিন!
-তবুও ব্যাপারটা আমার জন্যে অপমান জনক। আপনি কি আমাকে ইম্প্রেস করা থেকে পিছু হাঁটতে চাইছেন?
-চাইলে কি আমাকে এখানে দেখতেন?
-তাহলে আমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে আপনার কিছু একটা হয়েছে৷ আপনি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছেন।
-বাহ! আমি তাহলে আপনার মনে প্রবেশ করতে পেরেছি৷
-তা কখন বললাম?
-এই যে বললেন, আপনার মনে হচ্ছে আমি পরিবর্তন হচ্ছি৷ আমি আপনার মনে আছি বলেই তো এমন মনে হচ্ছে তাই না?
-জ্বী না। মোটেও তাই নয়। যে কেউই এই পরিবর্তনটা ধরতে পারবে।
-তা সকলেই পারবে৷ কিন্তু আপনার যেমন এই পরিবর্তনটা সহ্য হচ্ছে না, তাদের তেমন এই পরিবর্তনটা সহ্য হয়ে যাবে৷ আপনি সহ্য করতে পারছেন না কারণ আপনি চাচ্ছেন আমি আপনার পেছন পেছন ঘোরাঘুরি করি৷
মিহিন আমার দিকে চেয়ে থাকল কিছু সময়৷ তারপর বলল,
-এসব রং থট কোত্থেকে আসে আপনার মাথায়?
-কিছু ভুল নয়। আমি সত্যই বলেছি৷
মেয়েটা যেন রেগে গেল। রাগে সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে যেন৷ চোখ মুখ কেমন জানি হয়ে আছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে বলল,
-যাই হোক, আপনার সময় কিন্তু আর বেশি নেই। সেদিকে খেয়াল রাখবেন!
আমি হাসলাম। বললাম,
-যা সময় আছে তা-ই অনেক।
মিহিন কিছু বলল না৷ উঠে চলে গেল৷ আমি তার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলাম। অস্থির হয়ে হাঁটছে সে। রাগে যেন তার শরীর ফেটে যাচ্ছে। অনেকটা পথ গিয়ে সে একবার ফিরে তাকালো আমার দিকে৷ আমি বসে থেকে হাসলাম। হাত নেড়ে বায় জানালাম। সে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছু সময়৷ তারপর চলে গেল। আমি হাসলাম। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য ছিল।
আমি এরপর থেকে এভাবেই ওর সাথে বিহেভ করতে থাকলাম। একদম সাধারণ আচরণ করলাম৷ তাকে ইম্প্রেস করার জন্যে বিশেষ কিছু করলাম না৷ মিহিনের যেন তা সহ্য হলো না। শেষ দিকে সে যেন একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গেল। রাগ দেখাতো ভীষণ। এক সময় আমার মনে হলো মিহিন মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে মাস শেষে সে আমায় দূরদূর করে তাড়িয়ে দিবে। আমাকে রিফিউজি করবে৷ সে যেন আগ থেকে পরিকল্পনা করে রেখেছিল। এবং সবশেষে তাইই হলো। আমাকে সে বলল আমি যেন আমার চেহারা তাকে আর না দেখাই৷ খুব কড়া করে বলল। কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিল। আমি সেদিন মন খারাপ করে চলে এলাম। মনে হলো এই জগৎ সংসার যেন বৃথা৷ মানুষের জন্ম বৃথা। যেখানে সত্যিকারের অনুভূতির দাম নেই সেই পৃথিবীতে সত্যিকারের প্রেম দাম পাবে কই? যেখানে কারো ইগোর মূল্য পায় বেশি সেখানে আর যাই হোক, প্রেম হবে না। যদিও বা হয় তবে তা বেশিক্ষনের জন্যে নয়। কিছুদিন বেশ ভুগতে হয়েছিল আমায়। কী একটা ব্যাথা যেন আমায় আঁকড়ে ধরে রাখল৷ পৃথিবীটা যেন আমার জন্যে পাথরের মতো মন্র হলো। অতি শুষ্ক শক্ত কিছু। যার মাঝে প্রেম নেই, দয়ামায়ার বিন্দুমাত্র ঠাই নেই। আলো আন্ধকারে মিলে মিশে চলছি আমার অথর্ব এই জীবন। কিন্তু কোথাও জানি কিছু একটা বেশ টানতো। কিংবা বলা যায় অভ্যাসের বসে আমি মাঝে মাঝে মিহিনকে দেখার লোভটা সামলে নিতে পারছিলাম না৷ তাই মাঝে মাঝে গিয়ে হাজির হতাম, তাকে দেখতাম আড়াল থেকে। কিছুদিন হয়তো তার চোখের সামনেই তাকে দেখে গেলাম। এই ব্যাপারটা হয়তো তার পছন্দ হয়নি। আমার বাবার কাছে বিচার আসে। বাবা খুব রাগেন আমার উপর৷ মাও। অস্পষ্ট একটা দেয়াল তৈরী হয় ঘরে। সে সময়ে মিহিন নামক মেয়েটা আমার আমার কাছ থেকে তাকে দেখার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়৷ বাবা মায়ের কঠিন আদেশ আমাকে যেন ওদের এলাকায় কিংবা তার আশেপাশে না দেখেন। অথবা যদি এই নিয়ে আর কোনো বিচার আসে তবে বাবা আমায় ত্যাজ্য পুত্র করবেন বলে হুমকিও দিয়ে ফেলেছেন৷ আমি কিছু না বলে কেবল চুপ করে সয়ে গেলাম। গেলাম না মিহিনের কাছে। তাকে দেখলামনা না হয়৷ তাতে কি আমাদের দূরত্ব বাড়বে? কিংবা বেড়েছে? কই? সে তো আমার কাছেই আছে। আমার মনের ভেতর। মাপের দূরত্বে আমার বহুদূর হলেও মনের ক্ষেত্রে তা স্বল্প। আমি তাকে কাছেই ভীষণ করে অনুভব করি।
এভাবেই দিন পার হচ্ছিল। আড়ালে আড়ালে আমার প্রেমও চলছিল। একতরফা প্রেম। যা চলে আরকি। আজ সকালে একটা ইন্টারভিউ ছিল। প্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখলাম মিহিন দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তার ভীষণ মলিন৷ আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। না জানি কোন অপরাধে আবার বিচার আসে,আমি না আবার ত্যাজ্যপুত্র হই৷ বের হয়ে আমি হাঁটতে থাকলাম। তখনই মিহিন ডাক দিল পেছন থেকে।
-এই যে শুনুন?
আমি চট করেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুখের হাসি স্পষ্ট করলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমায় ডাকছেন?
সে এগিয়ে এলো খানিক। বলল,
-না চেনার অভিনয় করছেন?
-অভিনয় আর হলো কই? আপনি তো টের পেয়েই গিয়েছেন।
সে হাসল। তার হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে। শাড়ি পরেছে আজ৷ চুল বেঁধে এসেছে অভিনব ভাবে৷ যেন এই মিহিনকে আমি চিনি না। একদমই অচেনা৷ সে বলল,
-একটা জিনিস চাইতে এসেছি। দিতে হবে কিন্তু?
-আমার সাধ্যে এমন কিছু নেই যে আপনাকে দিবো!
-এমনটা কেবল আপনার ভাবনা৷
-তাহলে আমি কি ভুল ভাবছি?
-হয়তো তাইই।
সে হাসল। আমি বললাম,
-আজকের এতো কোমলতা মেনে নিতে পারছি না। হঠাৎ এতো পরিবর্তন?
-আছে কোনো এক কারণ। আপনি তা বুঝবেন না৷ এখন বলুন দিবেন কী না?
আমি অবাক স্বরে বললাম,
-আশ্চর্য! আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মতো কী আছে?
সে কিছুটা সময় নীরব থেকে বলল,
-ক্ষমা।
আমি খানিকটা অবাক হলাম। যেন মেনে নিতে পারছি না। বললাম,
-বিশ্বাস হচ্ছে না। কথাটা আপনার মুখ থেকে শুনছি।
-অবিশ্বাসের কিছু নেই৷ মানুষ মানুষকে এতো পরিবর্তন করতে পারে তা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না৷ তাই হয়তো এমন কিছু হচ্ছে৷
-খুব ভারি কথা শিখে গিয়েছেন দেখছি!
-সময় এবং মানুষ দুটোই মানুষকে অনেক কিছু শিক্ষা দেয়।
-মনের মানুষ হয়তো পেয়ে গেছেন!
সে হাসলো। বলল,
-আরো আগেই পেয়েছি। কিন্তু অযত্নে, অবহেলায় তাকে খানিকে ভিজিয়ে ফেললাম। এখন শুকানোর চেষ্টা করছি৷
-বেশ তো! শুভকামনা রইলো!
-তা যা চাইলাম তা কিন্তু পেলাম না৷
-আমার কাছে কিছু নেই দেওয়ার। ক্ষমা করার মতো কেউ আমি নই।
-ভুল ভাবছেন। আমি যা করেছি অন্যায় করেছি। আপনি কষ্ট পেয়েছেন। তার জন্যেই ক্ষমা চাওয়া৷
-আপনার অন্যায়টা কী? কাউকে আপনার পছন্দ না হতেই পারে। এখানে অন্যায়ের কিছু নেই।
-তাহলে হয়তো অন্যায় ছিল না। কিন্তু আমি ভুলটা ঠিক অন্য জায়গায় করেছি।
-কোথায়?
-বললে বিশ্বাস করবেন না৷
-বিশ্বাস না করার কারণ?
-অনেক বড় কারণ। শুনলে মনে হবে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।
-সমস্যা নেই৷ আমি বিশ্বাস করে নিবো।
-সত্যি বলছেন?
-হ্যাঁ।
-কথা থেকে ফিরে যেতে পারবেন না কিন্তু।
-ফিরব না।
মিহিন চুপ করে থাকল কিছু সময়। তারপর বলল,
-আপনাকে আমি আসলে প্রথম থেকেই পছন্দ করতাম। কিন্তু অহংকারের ধার এতো বেশি ছিল যে আমাকে তা বুঝতেই দেয়নি। ব্যক্তিত্বের দায়ে কিছুদিন আপনাকে আমার পেছনে ঘুরাবো ভেবেছি। বুঝেনই তো! প্রিয় মানুষটা সারাক্ষণ পেছনে পড়ে থাকলে কী যে আনন্দ হয়৷ নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হয়৷ কিন্তু চট করেই আপনি কেমন জানি চেঞ্জ হয়ে যান। সেটা মানতেই পারছিলাম না। আমি চাচ্ছিলাম আপনি ঘুরুন কিছুদিন। তারপর আমি নিজ থেকেই আপন করে নিবো৷ কিন্তু কোথায় কী হলো! আপনি শেষে কেমন জানি হয়ে গেলেন। ইগোতে লেগে গেল। তাই রেগেমেগে আপনাকে রিফিউজ করে। কিন্তু এরপর মনে হলো আমার এমনটা করা ঠিক হয়নি। খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে৷ ভেতরে ভেতরে আমি ভুগতে থাকলাম। তখনও ঠিকভাবে টের পাইনি আমি আসলে আপনাকে কতটা চাই। এরপরেও দেখলাম আপনি আমাকে দূর থেকে দেখছেন। কাছে আসছেন না৷ বাবাকে সে কথা বলতেই তিনি এমন কান্ড বাধিয়ে ফেলবেন। অথচ আমি এমন কিছু ইন্ডিকেট করে বাবাকে কথাটা বলিনি। নেহাত মনের ব্যাথা থেকে বলেছি। এরপর থেকে আপনি আর আসতেনই না৷ আমি হঠাৎই আপনাকে এতো মিস করতে থাকলাম যা বলার মতো না৷ আমার অহংকার কোথায় যেন মিশে গেল। আমার মনে হলো আমি আমস্র ভেতরে নেই। কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করবেন না কেমন পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সে জন্যেই কাল আপনাদের এদিকে আসি। যদি ভুল করে হলেও একবার দেখে ফেলি আপনাকে। কিন্তু এখানে আসতেই দেখলাম আপনি অন্য একটা মেয়ের পেছনে ঘুরছেন৷ রাগ হলো ভীষণ। জেদে শরীরটা ফেটে যাচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল দৌড়ে গিয়ে কষে কয়েকটা দেই। কড়া স্বরে বলি আপনি কেবল আমার। আমার পেছনে আপনি হাঁটবেন, ঘুরবেন, দৌড়াবেন৷ এক প্রকার রাগ নিয়েই আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই৷ তখনই জানতে পারি বাবা আপনাদের বাড়িতে বিচার পাঠিয়েছে। বাবার উপর রাগ হলো ভীষণ। কাল সারারাত উনার সাথে কথা বলিনি আমি। যেই মানুষটার সাথে আমি কখনই অল্প কিছু মূহুর্ত কথা বলে থাকতে পারিনি, কাল খুব অনায়াসেই আমি উনার সাথে কথা না বলে পার করে দিলাম। এতোটা রাগ উঠেছিল আমার। এ জন্যেই আজ এলাম ক্ষমা চাইতে। দোষ আমার৷ তাই ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করিনি।
এই বলে সে থামল। মাথা নিচু করে রাখল। আমি কিছু সময় তাত দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
-গল্পটা ভালো ছিল। বিশ্বাস করবো বলে কথা দিয়েছিলাম। তাই বিশ্বাস করছি।
মিহিন আমার দিকে তাকালো। আমি স্পষ্ট তার চোখে জল দেখলাম। সে চোখে জল রেখে হাসল। ভারি কণ্ঠে বলল,
-এখন? ক্ষমা করেছেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-আমি আপনাকে কখনই দোষী মনে করিনি। আজ অল্পের জন্যে আপনাকে দোষী মনে হলো। আপনি আপনার ইগোর জন্যে আমার অনুভূতির সাথে খেললেন৷ তাই খানিকটা ব্যাথা লাগল। তবুও এতো কষ্ট করে এলেন। ক্ষমা করেই দিলাম। আমার আবার এতো ব্যক্তিত্ব কিংবা অহংকার নেই।
মেয়েটা মাথা নিচু করে রাখল। চোখ বন্ধ করে হজম করে নিলো ব্যাপারটা। বললাম,
-আসি তাহলে।
মিহিন কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে থাকল কেবল। আমি চলে এলাম সেখান থেকে৷ আসতে খানিকটা কষ্ট হলো। মন বলে কথা। তাকে বুঝানো বড় দায়৷
ইন্টারভিউ দিয়ে বের হতেই ইশার ফোন এলো। ধরেই বললাম,
-আশ্চর্য! এতোবার ফোন দিচ্ছিস কেন?
-আরে ফোন দিবো না কেন? এমন একটা কাহিনী ঘটে গেল যে!
-কী ঘটল?
-তোর মিহিন এলো ভাইয়া!
-আমার মিহিন মানে?
-আরে ওই মেয়েটা৷ যার পেছনে ঘুরে ছ্যাকা খাইলি, সেই মেয়েটা।
-স্টুপিড এর মতো কথা বলবি না৷ বড় ভাই তোর। একটু তো সম্মান দিবি।
-আরে রাখ সে সব৷ কী হয়েছে শোন!
-কী হয়েছে?
-মিহিন এসেছে৷ সাথে তার আব্বুকে নিয়ে এসেছে।
-মানে? সত্যি বলছিস তুই?
-হ্যাঁ। সত্যিই। আব্বু আম্মুর কাছে ক্ষমা চাইলো ওরা। এবং...
-এতো ঢং করে বলার কী আছে? এবং এর পরে কী তা কি একেবারেই বলে ফেলা যায় না?
-আরে একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না?
-রাখ তোর ব্যাপার স্যাপার। এবং এরপরে কী তা বল?
-তা হলো ওরা বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে গেল।
-এই কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
-অবশ্যই। তবে ব্যাপারটা তেমন নয়৷ মিহিনের বাবা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন তেমন কিছুই আরকি।
-তোর আগ বাড়িয়ে ভাবনাটা গেল না তাই না?
-না যায়নি। তবে আমি কিন্তু ভুল ভাবি না। আমার ভাবনা যৌক্তিক।
-ফোন রাখ৷ অযথা ফোন দিয়ে বকছিস। রাখ৷
আমি ফোন রেখে দিলাম। মনের মাঝে অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছিল৷ এমন এক আনন্দ যা বলে বুঝানোর মতো নয়৷
এরপর হুটহাট ভাবে আমার আর মিহিনের দেখা হয়ে যেত। কিংবা আমার মনে হতো দেখা গুলো মিহিনের ইচ্ছে মতোই হচ্ছে। সে চাচ্ছে আমাদের যেন দেখা হয়। আমি সে সব এড়িয়ে চলি। বলতে গেলে তাকেই এড়িয়ে চলি। কথা বলি না তেমন। কেমন জানি এক প্রকার অভিমান জমে আছে ভেতরে। ব্যাথাটা ভুলতে পারি না। এদিকে আমার চাকরি হয়েছে একটা। প্রায় তিনমাস বেকার থাকার পর নিজেকে কেমন জানি হালকা মনে হচ্ছিল। চাকরির পর পরই বাবা মা জোর দিলেন বিয়ের জন্যে৷ আমি তা এড়িয়ে গেলাম। বললাম এতো দ্রুত বিয়ে করবো না আমি। বাবা মাও আর জোর করলেন না৷ মিহিনের ব্যাপারটা জানতে পেরে তারাও খানিক দুঃখবোধ করছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না৷
বিকেলের দিকে হাঁটতে বের হলাম। লেক পাড়ে আসতেই মানুষজনের ভীড়। একটু আড়াল হয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। গাছের ওপাশে কখন যে মিহিন এসে দাঁড়িয়ে আছে টেরই পেলাম না। হঠাৎ তার কণ্ঠ ভেসে এলো,
-কাউকে জালে ফাঁসিয়ে কেউ কেউ অনায়াসের নিজের সুন্দর বিকেল গুলো পার করে দিচ্ছে৷ অথচ ফেঁসে থাকা মানুষটার কথা কেউ ভাবছেই না৷
আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-আপনি?
মিহিন আমায় দেখল গভীর ভাবে৷ বলল,
-স্কলারশিপ পেয়েছি ভার্সিটি থেকে। কেউ চাইলে থাকব৷ না হয় পাড়ি জমাবো পর দেশে।
আমি হাসলাম। বললাম,
-অভিনন্দন। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
-লন্ডন।
-আত্মিয় কেউ আছে?
-আছে। প্রয়োজনে আজীবন থেকে যাবো সেখানে।
শেষের কথাটা কেন বলল তা বেশ টের পেলাম। বললাম,
-বেশ!
এই বলে চুপ থাকলাম। মিহিনের চোখ ভিজে এলো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। সে ভেজা স্বরে বলল,
-এখনও নিজের জেদ ধরে রাখবেন? এবার কিন্তু ইগোটা আপনি দেখাচ্ছেন।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। মিহিন বলল,
-তাসফি?
আমি অন্যদিকে ফিরে তাকালাম। সে আবার বলল,
-এই তাসফি? দেখো তো আমায়! একটু তাকাও! আমার চোখের গভীরতা কেবল তুমিই টের পাবে। আমার ভেতরটা যে কেমন করছে তা কেবল তুমিই জানতে পারবে, কারন তুমি ছাড়া এমন কেউ নেই যে আমার মন পড়তে পারে।
আমি তবুও তাকালাম না। মিহিন শব্দ করে কাঁদতে থাকল। বলল,
-এ কেমন শাস্তি দিচ্ছো আমায়?
আমি ধরে আসা গলায় বললাম,
-কোনো শাস্তি দিচ্ছি না আপনাকে। আপনি স্বাধীন৷ মুক্ত। নিজের মতো করে বাঁচতে পারেন।
-তা পারছি কই? কেন যে আঁটকে ধরে আছে ভেতর থেকে।
-সে দোষটা কি আমার?
-না হয় কার? কে আমার কাছে আসতে চাইলো? আমাকে ভালোবাসতে শেখালো কে?
-নিশ্চয়ই আমি নই?
-এতো অভিমান? এ অভিমান কি ভাঙ্গবে না?
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। মিহিন আবার বলল,
-আমাকে এতো সহজে হারিয়ে ফেলবে তুমি? নিজের করে নিতে কি বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয় না?
আমি চুপ করে থাকলাম। মিহিন কাঁদতে শুরু করল। তার কান্নায় শব্দ হয়৷ সেই শব্দে ব্যাথা হয় আমার হৃদয়ে৷ মিহিন বলে,
-আমার পৃথিবীটা ধ্বংস হতে চলেছে! আমি ভালো থাকছি না৷ থাকবো না৷ এর জন্যে দায়ী থাকবে তুমি তাসফি৷
আমি তাও চুপ করে থাকলাম। কথা বলার শক্তি নেই যেন। কেমন জানি লাগতে থাকে আমার। মিহিন কিছু বলে না আর৷ ধীরে ধীরে পেছনে চলে যেতে থাকে। হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অদূরে কোথায়। আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হয়৷ কি একটা যেন ভীষণ করে টানছে। আমার চোখ জোড়া ঘোল হয়ে আসে৷ জল জমে দ্রুত। মিহিন দ্রুত হেঁটে চলে গেছে কিছুদূর। আমি তাকে পেছন ফিরে ডাক দেই।
-মিহিন?
মিহিন হঠাৎই থমকে দাঁড়ায়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখে আমায়। তার চোখে জল। চেহারা কেমন মলিন হয়ে আছে। বললাম,
-এপাশটায় আমাকে যে এমন একা করে চলে যাচ্ছো, একটু কি ভেবে দেখেছো যে এই মানুষটা কীভাবে বাঁচবে? কী নিয়ে বাঁঁচবে?
মিহিন কিছু বলল না৷ দৌড়ে এলো কেবল। আছড়ে পড়লো আমার দুর্দশাগ্রস্ত মলিন বুকে। যেখানে এই মেয়েটি আজকাল শান্তি খুঁজে বেড়ায়। যে মেয়েটির কোনো ব্যক্তিত্ব কিংবা অহংকারের ধার নেই। নেই কোনো কৃত্রিমতা। সে আমার বুকের সাথে মিশে গেল যেন। ঝরাতে থাকল তার মনের অসুখ। আমিও তাকে আপন করে নিলাম পরম সুখে। কী একটা আনন্দ যেন আমার সমস্ত পৃথিবী আলোকিত করে দিলো। প্রেমে ভরিয়ে দিলো সমস্ত পরিবেশ। আমার ক্লান্ত বিকেল যেন আজ সতেজ হলো তার ছোঁয়ায়। প্রাণ ফিরে পেল যেন জীবনের সৌন্দর্যতা গুলো। যেন তারা একে একে ফুটতে থাকল নিজের মতো করে।
সমাপ্ত
গল্পঃ ভালোবাসায় মিশে থাকুক সে।
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমেদ