গল্পঃ ভূতেদের ভূত - প্রথম পর্ব । লেখক - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ ভালোবাসায় মিশে থাকুক সে । লেখক - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ ভূতেদের ভূত
প্রথম পর্ব
-সৃজিয়া! রাইট?
সৃজিয়ার অবাক হওয়াটা যেন আরেকটু বৃদ্ধি পেল। সে মাথা তুলে তাকাতেই ছেলেটার হাসিমাখা মুখটা দেখল। সত্যি বলতে ওর ভেতরটা যেন নড়ে উঠল চট করেই৷ বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। গা ভর্তি একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন৷ সৃজিয়া ফ্যাকাসে মুখে বলল,
-আপনি তুষার?
ছেলেটা আবারো খানিকটা হাসল। সৃজিয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো৷ তার মনে হলো এই ছেলের হাসিটা আর দেখা যাবে না৷ দেখলেই সে পাগল হয়ে যাবে৷ ছেলেটা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিনয়ী স্বরে বলল,
-অনেকক্ষণ বেল বাজাতে হয়েছে তাই না? আসলে আমি ভেতরের কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আসুন! ঘরের ভেতরে আসুন৷
সৃজিয়া যেন ওখান থেকে নড়তে পারছে না৷ বরফ হয়ে আছে৷ আশ্চর্য! ছেলেটার কণ্ঠটাও ওর কাছে কেমন মুগ্ধকর লাগছে। কেমন মোহময়৷
সৃজিয়া ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই তাকে আরো খানিকটা অবাক হতে হলো৷ সে অবাক নেত্রে চারপাশটা দেখতে থাকল। আশ্চর্য! ঘরটা যে এতো সুন্দর হবে সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না৷ তার মনে হলো এতো সুন্দর গোছানো ঘর সে এর আগে কখনই দেখেনি৷ ড্রয়িং রুমটা বেশ বড়৷ রুমটার ঠিক মাঝখানে তিন পাশে সোফা রাখা৷ সোফা গুলোর মাঝখানে টি-টেবিল। ওপাশের দেয়ালে বিশাল এলইডি টিভি! সোফা গুলো টিভি মুখী করে রাখা। এই ওঝা দেখছি টিভিও দেখে৷ সৃজিয়ার ভাবনার শেষ নেই৷ চোখমুখ ময় যেন বিস্ময় খেলা করছে৷ ও দেয়াল গুলো দেখলো৷ পশ্চিমের দেয়ালে বিশাল একটা ঈগলের ছবি। ঈগলটা ডানা মেলে আছে। যেন উড়ছে সে৷ এছাড়া প্রতিটি দেয়ালেই নানান রকমের পেইন্টিং। উত্তর দিকে ফিরতেই ওকে অবাক হতে হলো। ওদিকের দেয়ালে বিশাল একটা নেকড়ের ছবি৷ নেকড়েটা বেশ রাগি চেহারায় তাকিয়ে আছে। যেন এখনই ওখান থেকে দৌড়ে এসে সৃজিয়াকে খেয়ে ফেলবে৷ পেইন্টিংটা ওর কাছে এতোটা জলজ্যান্ত মনে হলো যে ও ভাবল নেকড়েটা জীবিত আছে৷ এখনই দৌড়ে আসবে৷
-আসুন সোফায় বসি৷
সৃজিয়ার ঘোর ভাঙ্গল। সে খানিকটা চমকে উঠল যেন৷ কোনো মতে সোফায় গিয়ে বসল। বসতেই দেখল টি-টেবিলে নানা রকমের নাস্তা রাখা৷ ও কেমন জানি লাগল। আশ্চর্য! একটু আগেও তো টি-টেবিলটা খালি ছিল! আর এই ছেলেটার পক্ষে একা এতো গুলো নাস্তা এতো স্বল্প সময়ে নিয়ে আসাটা অসম্ভব। ও আর ভাবতে পারল না। মাথাটা গুলিয়ে উঠলো যেন। ও মনে মনে ভাবলো এখানে আসাটাই ঠিক হয়নি৷ মহা অন্যায় হয়েছে। না আসলেই ভালো হতো৷ তুষার বলল,
-আপনি কি কোনো কারণে অস্বস্তি বোধ করছেন?
সৃজিয়া জবাব দিলো না৷ সে দু'হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো৷ তুষার বলল,
-আপনাকে অসুস্থ লাগছে৷ আপনি বরং আজ চলে যান৷ আমরা অন্য কোনো দিন আবার দেখা করবো৷
ঠিক তখনই সৃজিয়া বলে উঠল,
-না৷ তেমন কিছু নয়৷ মাথাটা ধরেছে খানিক৷
তুষার হাসলো। ফ্লাক্স থেকে এক কাপ চা ঢেলে বলল,
-তাহলে চা টা খেয়ে নিন৷ দেখবেন মাথা ধরাটা কমে যাবে৷
সৃজিয়ারও তাই মনে হলো৷ ওর মনে হলো এই মূহুর্তে গরম গরম এককাপ কফি কিংবা চা হলে মন্দ হতো না৷ বেশ ভালোই হয়৷ সৃজিয়া চায়ের মগটা নিতে যাবে ঠিক তখনই তুষার বলে উঠল,
-আগে পানিটা খেয়ে নিন৷ কোনো কিছু খাওয়ার পূর্বে পানি খাওয়া ভালো৷
সৃজিয়া যেন একটু নরমাল হয়ে এল৷ সে মৃদু হাসল। পানি খেয়ে চায়ের মগে চুমুক দিলো৷ কিছুটা খেতেই ওর মনে হলো এতো মজার চা সে আর কখনই খায়নি৷ ওর মনটা মূহুর্তে ভালো হয়ে গেল। মাথার হিজিবিজি ভাবটা যেন এক চুমুকেই চলে গেল। ও বলল,
-চা টা কে বানিয়েছে?
তুষার খানিকটা হেসে বলল,
-বাসাতে এই মূহুর্তে আমি ছাড়া আর কেউই নেই।
-সহজ ভাবে বললেই তো পারেন, চা টা আপনি বানিয়েছেন৷
তুষার বলল,
-আপনি মেডিকেলের ছাত্রি৷ বড় মেধাবী মানুষ। আড়ালের কথাটা সহজেই বুঝে যান কি না তার একটা ছোট্ট পরীক্ষা নিলাম আরকি৷
-পরীক্ষাটা একদমই অযৌক্তিক। এই ব্যাপারটা যে কেউই বুঝতে পারবে৷ বাই দ্য ওয়ে আপনি আমাকে চিনেন কী করে?
তুষার হাসল। বলল,
-যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন মনে করুন তার থেকেই শুনেছি।
সৃজিয়ার খানিকটা রাগ হলো তার বড় মামার উপর। এখানে আসার কথা তার বড় মামার। কিন্তু তিনি না এসে ওকে পাঠালেন! পাঠালেন তো পাঠালেন! সাথে বায়োডাটা দেওয়ার কী প্রয়োজন? অচেনা অজানা কাউকে এভাবে উপযুক্ত একটা মেয়ের বায়ো ডাটা দেওয়াটা অন্যায়৷ সৃজিয়া আবার চায়ে চুমুক দিল। তুষার বলল,
-মনে মনে আপনার বড় মামাকে বকছেন তাই না? উনি বড় ভালো মানুষ। এভাবে বকাঝকা করাটা ঠিক না৷
সৃজিয়া অবাক হয়ে তুষারের দিকে তাকালো৷ আশ্চর্য! এই মানুষটা জানলো কী করে যে ও ওর মামাকে বকছে? এই ছেলে কি মন পড়তে পারে নাকি? তুষার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-যাই হোক, এবার কেসটা নিয়ে আলোচানায় যাওয়া যাক!
সৃজিয়ার চা খাওয়া শেষ৷ সে খানিকটা স্থির থেকে বলল,
-আমার মামাতো বোন নেহা! সমস্যাটা আসলে ওকে নিয়ে৷ ইদানীং ও কিছুই খাচ্ছে না৷ ওকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছে না৷ রাতবিরেত উল্টাপাল্টা বকে৷ নানান কথা বলে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়৷ চিল্লাচিল্লি করে৷ মাঝে মাঝে এমন বুক ফাটা আর্তনাদ করে যে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠে৷ বেশ কয়েকজন ডাক্তার দেখিয়ে ফেলেছি এ যাবত৷ কিন্তু কেউই কিছু করতে পারেননি৷ আমি নিজেও মেডিকেলের স্টুডেন্ট। আমার সিনিয়রদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করলাম। শিক্ষকদের সাথেও। কিন্তু তারা কেউই কোনো সলিউশন দিতে পারেনি৷ আমরা অনেকটা উপায়হীন হয়ে পড়লাম। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ এদিকে নেহার অবস্থাও খারাপ। মাঝে মাঝে এমন ভাবে কান্না করে যে নিজেকেই আঁটকে রাখা কষ্টকর। ইচ্ছে হয় ওর রুমের তালাটা খুলে দেই। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি৷ কিন্তু তা আর হয় না৷ তালা খুললেই ও চলে যাবে৷
সৃজিয়া খানিকটা থামল। তুষার বলল,
-চলে যাবে মানে?
সৃজিয়া খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-একদিন আমরা খুলে দিয়েছিলাম৷ তারপরেই ও লাপাত্তা হয়ে গেল। ওকে আর খুঁজে পাওয়াই যায়নি৷ পরেরদিন সকালে ওকে অজ্ঞান অবস্থায় ওদের বাসার সামনে পাওয়া যায়!
কথাটা শুনতেই তুষার অস্ফুটে স্বরে বলে উঠল,
-শিট!
সৃজিয়া তুষারের দিকে ফিরল। বলল,
-কী হলো?
তুষার বলল,
-আপনাদের ওকে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ হয়নি৷
-কেন? কী হয়েছে?
-ওর বাকি ক্ষতিটুকু হয়ে গিয়েছে৷
-মানে?
-এখন বুঝবেন না৷ আমাকে আপনার মামার বাড়ি নিয়ে চলুন৷ আমাদের এক্ষুনি ওখানে পৌঁছাতে হবে।
সৃজিয়া কিছু বলল না। সে উঠে দাঁড়ালো। তুষার মাথার হ্যাটটা হাতে নিয়ে "ন্যানি" বলে ডাক দিলো। হঠাৎই সৃজিয়া দেখলো সিড়ি বেয়ে একটা ধূসর রঙের কুকুর নেমে আসছে৷ ও খানিকটা চমকে গেল৷ ধূসর রঙের কুকুর সে জীবনেও দেখেনি৷ আছে বলে জানতো না৷ যদিও এদিক দিয়ে তার জ্ঞান শূন্য। তবুও এই কুকুরটিকে কেমন জানি লাগল ওর। যেন কিছু একটা আছে এর ভেতর। অন্য আট-দশটা কুকুরের মতো নয়। সৃজিয়া বলল,
-ওর নাম ন্যানি?
তুষার ওর দিকে না ফিরেই বলল,
-হ্যাঁ৷
তারপর কুকুরটা তার কাছে আসতেই সে বলল,
-ন্যানি! আমি একটু বাইরে যাচ্ছি৷ তুমি থাকো কেমন?
কুকুরটা যেন বুঝতে পারলো৷ সে নিজের মুখটা তুষারের হাতের সাথে ঘেঁষতে থাকল। তুষার বলল,
-এই তো! গুড বয়! যাও এখন।
কুকুরটা চলে গেল। তুষার আর সৃজিয়া বেরিয়ে এলো।
তুষার যখন ঘরে তালা মারছিল ঠিক তখন সৃজিয়া জিজ্ঞেস করল,
-আপনি বাসাতে সব সময় সেজেগুজে থাকেন?
-সেজেগুজে মানে?
-এই যেমন স্যুট-কোট আর হ্যাট করে থাকেন?
তুষার ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ বলল,
-না। তা নয়৷ লোক মারফতে জানতে পারলাম আজ এক বিশেষ সুন্দরী আসছে আমার বাসায়৷ যে এসব ভূতপ্রেতাদি বিশ্বাস করে না। তবুও কেবল মামাতো বোনের দিকে তাকিয়ে আসছে এখানে। তাই আগ থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলাম৷
সৃজিয়া মৃদু হাসল। খানিকটা লজ্জা পেল যেন৷ বলল,
-আচ্ছা, আপনি কি মানুষের মনের কথা বলে দিতে পারেন? কিংবা মানুষের মনে কী চলছে তা বলতে পারেন?
-আপনাদের সাইন্স কী বলে? এটা কি আদৌ সম্ভব।
-সম্ভব তো নয়৷ কিন্তু আপনাকে দেখে আমি কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি যে আসলেই সম্ভব কি সম্ভব না!
তুষার বলল,
-এসব ব্যাপারে বেশি কথা না বলে আমরা নেহার কথাটা ভাবি! আমাদের দ্রুতই নেহার কাছে পৌঁছাতে হবে৷
ওরা ততক্ষনে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ সৃজিয়া নিজেদের গাড়িতে করে এসেছে৷ রাস্তার পাশে পার্ক করে রেখেছে গাড়িটা। তুষার ধীরে ধীরে সেই গাড়িটার দিকেই এগিয়ে গেল। সৃজিয়া এবারেও অবাক হলো৷ আশ্চর্য ব্যাপার! এই ছেলেটা জানলো কী করে যে এই গাড়িটা ওদের? বাসার বারান্দা দিয়ে দেখেছে হয়তো! কথাটা বলে সৃজিয়া নেহাত নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। বলল,
-আপনি হঠাৎ ওখানে যাওয়ার জন্যে এতো তাড়া দিচ্ছেন যে! কী হয়েছে?
তুষার ওর দিকে ফিরে বলল,
-বললে আপনি বিশ্বাস করবেন?
-সেটা বলার পর বলতে পারবো৷
-তাহলে না বলাই ভালো৷ আসুন৷ গাড়িতে বসুন।
তুষার গাড়ির দরজাটা খুলে দিল। খানিকটা সম্মান দেখালো যেন৷ সৃজিয়া গাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-না বলাই ভালো হবে কেন?
তুষার মাথা চুলকিয়ে বলল,
-অহেতুক তর্ক করার ইচ্ছে নেই৷ কোনো মেয়ের সাথে তো অবশ্যই নয়৷
এই বলে সে গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিলো৷ নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে৷ সৃজিয়ার নাকমুখ খানিকটা লাল হয়ে এলো। কথার আড়ালে সে সুপ্ত একটা অপমান বোধ করলো৷
.
সৃজিয়ার মামার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল ওরা। তুষার গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। ওর হাতে একটা হ্যান্ড ব্যাগ দেখতে পেল সৃজিয়া৷ ও অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনার হাতে এই ব্যাগটা কোত্থেকে এলো?
-মানে?
-মানে আসার সময় তো দেখিনি আপনি ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছেন!
-মিস সৃজিয়া! আমার মনে হয় আপনার বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ। আপনার মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মনে হয়৷
-মানে?
তুষার খানিক চুপ করে থেকে বলল,
-মানে হলো, ব্যাগটা আমি প্রথম থেকেই নিয়ে এসেছি। আপনি সেটা খেয়াল করেননি হয়তো৷
-না। আমার ভুল হবার কথা নয়৷ আমার ভালো মতোই মনে আছে যে আপনি খালি হাতেই বের হয়েছেন।
-তাহলে এই ব্যাগ আমার কাছে কীভাবে এলো? আপনার কী মনে হয়? কীভাবে এলো?
-সেটাই তো কথা। আপনার কাছে কীভাবে এলো?
তুষার যেন একটু বিরক্ত হলো। বলল,
-এক কাজ করুন৷ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা ভাবুন৷ আমি ভেতরে গিয়ে আমার কাজটা করে আসি৷ ওদের ফ্ল্যাট নাম্বারটা কতো যেন?
সৃজিয়ার নাকমুখ লাল হয়ে এলো৷ সে চোখ গরম করে তাকালো তুষারের দিকে। তারপর হনহন করে চলে গেল। তুষার মৃদু হাসলো৷ তারপর সৃজিয়ার পেছন পেছন যেতে থাকলো৷ লিফটেও ওদের আর কথা হলো না৷ সৃজিয়া যেন একটু রেগেই আছে। ওরা সাত তলায় এসে থামলো৷ লিফট থেকে বেরিয়ে বাম দিকের ফ্ল্যাটটাতে গেল। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল দিল কেউ৷ তুষার ভালো করে তাকাতেই দেখল মানুষটাকে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। কাঁচাপাকা চুল। চেহারায় বেদনার ছাপ। অনেকদিন যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না৷ সৃজিয়া কিছু বলল না৷ সে ঘরে ঢুকে পড়লো৷ তুষার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ বলল,
-আপনি আরমান সাহেব না?
ভদ্রলোক খানিকটা হাসার বৃথা চেষ্টা করলেন৷ বললেন,
-হ্যাঁ৷ ভেতরে এসো৷ তোমার নাম তুষার। তাই না?
তুষার বাসার ভেতরে এসে বলল,
-জ্বী।
-বসো। সোফায় বসো৷ আমি একটু ভেতর থেকে আসি।
এই বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন৷ ততক্ষনে ঘরের ভেতর একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ওঝা এসেছে! ভূতের ওঝা! এমন মানুষদের দেখা সহজে মিলে না৷ তাই সবাই একটু দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো। সৃজিয়ার মামা কড়া করে নিষেধ করলেন৷ তিনি সবাইকে এক ঘরে যেতে বললেন। নেহার ঘরের আসেপাশেও যেন কেউ না থাকে৷
.
তুষার সোফায় বসে আছে। তার মাথায় হ্যাট। সে পাঁয়ের উপর পাঁ তুলে বসে আছে। নানান বিষয় নিয়ে ভাবছে সে৷ কিছু সময় পরই দেখল পর্দার আড়াল থেকে কেউ তাকে দেখছে। সে ভালো করে তাকাতেই দেখল দুটো পিচ্ছি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তুষার ওদের কাছে ডাকল। কিন্তু ওরা সামনে গেল না৷ আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকল। তুষার ব্লেজারের পকেট থেকে একটা চকলেট বের করলো৷ বলল,
-তোমরা ম্যাজিক দেখবে?
ম্যাজিকের কথা বলতেই ওরা যেন খানিকটা নড়ে উঠল। তুষার আবার বলল,
-এদিকে এসো। তোমাদের একটা ম্যাজিক দেখাই৷
মেয়ে দুটো এগিয়ে এলো তখন৷ তুষার খানিকটা অবাক হলো। আশ্চর্য! মেয়ে দুটো দেখতে একই রকম। জমজ মনে হচ্ছে৷ তুষার বলল,
-তোমাদের নাম কী?
একজন বলল,
-আমি মিহি। আর ও নিহি৷
-বাহ! বেশ দারুণ নাম তো৷ আচ্ছা দেখো তো এখানে চকলেট কয়টা?
মিহি বলল,
-একটা।
-ওয়েট! দেখো কীভাবে ম্যাজিক করে একটা থেকে দুটো চকলেট বানিয়ে ফেলি৷
মিহি এবং নিহি খুব আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ম্যাজিক দেখবে৷ ম্যাজিকের গল্প অনেক শুনেছে ওরা৷ কিন্তু কখনই বাস্তবে দেখেনি। ওরা তাকিয়ে থাকল। তুষার চকলেটটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দু'হাত এদিক সেদিক করলো। মূহুর্তে চকলেটটা গায়েব হয়ে গেল। মিহি আর নিহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না৷ তুষার আবার পূর্বের মতো করে দুই হাতে দুটো চকলেট নিয়ে এলো৷ ওরা চট করেই হাততালি দিয়ে উঠল। যেন ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করেছে ওরা৷ তুষার চকলেট দুটো ওদের দিকে বাড়িয়ে দিল। ওরা চকলেট দুটো নিলো৷ তুষার বলল,
-আরো ম্যাজিক দেখবে?
ওরা মাথা নাড়লো। নিহি বলল,
-হ্যাঁ দেখবো। তুমি দেখাবে?
-অবশ্যই দেখাবো৷ তার আগে আমি তোমার আপু সুস্থ করে নেই কেমন?
ওরা যেন বুঝতে পারলো। দু'জনেই মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। ঠিক তখনই আরমান সাহেব এসে হাজির হলেন। বললেন,
-এসো। ভেতরে এসো।
তুষার উঠে দাঁড়ালো। ভেতরের ঘরে পাঁ দিতেই নেহার চিৎকার শুনা গেল৷ তুষার চট করেই থেমে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নেহার চিৎকারটা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। যেন অল্প কিছুক্ষণ পরেই নেহার গলা ফেটে যাবে। তুষার আবার দু'কদম পিছিয়ে এলো৷ নেহার চিৎকার কিছুটা কমে এলো যেন৷ তুষার হাসলো। আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ও ভয় পাচ্ছে৷
আরমান সাহেব ফ্যাকাসে চেহারায় বললেন,
-কে?
তুষার মুখের হাসি স্পষ্ট রেখেই বলল,
-ওই ভূতটা আমাকে ভয় পাচ্ছে৷ আমি ভেতরের ঘরে আসতেই দেখলেন না কীভাবে চেঁচিয়ে উঠলো!
আরমান সাহেবের আশার আলোটা জ্বলে উঠলো যেন৷ তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে এলো৷ তুষার বলল,
-আপনি কী ভেতরে যাবেন?
-হ্যাঁ অবশ্যই!
-ওর চিৎকারটা সহ্য করতে পারবেন?
আরমান সাহেবের চেহারায় জল জমে এলো যেন। তিনি, ভারী স্বরে বললেন,
-হ্যাঁ৷
তুষার কিছু বলল না৷ সে ভেতরের রুমে চলে এলো আবার৷ আসতেই নেহার চিৎকার বেড়ে গেল। তুষার পাত্তা দিলো না৷ বাঁ দিকের রুমটা দেখিয়ে দিলেন আরমান সাহেব। তুষার তালা খুলেই ভেতরে প্রবেশ করলো৷ আরমান সাহেবও পেছন পেছন গেলেন৷ তুষার ভেতরে ঢুকতেই দেখল নেহা রুমের এক কোণায় বসে আছে। ফ্যাকাসে চেহারা৷ চেহারায় কোনো দ্যুতি নেই৷ তাকে দেখেতে স্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু মুখ দিয়ে অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দ করছে সে৷ যেন কোন জন্তু রেগে গিয়ে হুংকার ছাড়ছে। তুষার আরমান সাহেবকে দরজাটা লাগিয়ে দিতে বলল৷ তারপর একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিল আরমান সাহেবের দিকে৷ আরমান সাহেব বসলেন৷ তুষার বসল নেহার বিছানার উপর৷ মাথার হ্যাটটা খানিকটা নাড়িয়ে সে বলল,
-হ্যালো! আমি তুষার৷ ভূতের স্পাই৷ ভূতপ্রেতাদি নিয়ে স্পাইগিরি করি৷
এই বলে খানিকটা হাসল সে৷ নেহার গোঁ গোঁ শব্দটা যেন আরো খানিকটা বেড়ে গেল৷
প্রথম পর্ব
গল্পঃ ভূতেদের ভূত
ভুলত্রুটি মার্জনীয়