Bangla Golpo: অশুভ

Bangla Golpo: অশুভ

তাসফি আহমেদ



এক দূরসম্পর্কের মামার বাসায় বেড়াতে এসেছে শাহিন। আসার সময় ভেবেছিলো, মামার এলাকায় সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে কয়েকটা দিন ভালোভাবেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু এখানে এসে তার ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। এ কেমন এলাকা রে বাবা! ৪/৫ দিন হয়ে গেলো, একটা যুবতী মেয়েও চোখে পড়লোনা তার।
.
গ্রামটি শহর থেকে অনেক দূরে, আশেপাশে আর কোনো গ্রাম নেই। গ্রামের পশ্চিম দিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এমন জায়গায়ও কেউ বেড়াতে আসে? শাহিন রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠে এই কয়েকদিনে। আশেপাশে কয়েকটা সুন্দরি মেয়ে দেখা গেলে না হয় তার দিনগুলো এখানে ভালোভাবেই কাটতো। কিন্তু এটা কেমন রসকষহীন এলাকা শাহিনের ভাবনায় আসেনা। এরকম এলাকাও থাকে নাকি যেখানে কোনো যুবতী মেয়ে নেই?
.
শাহিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, এই এলাকায় আর থাকবেনা। এই এলাকার মানুষগুলোও কেমন যেন, কেউ ভালো করে কথা বলেনা, সবসময় মনে হয় কোনো অস্বস্তিতে ভুগছে এরা। সুন্দরী মেয়ে নেয়, মানা যেতে পারে, কিন্তু মানুষগুলো যদি একটু সুন্দর করে কথা বলতো, একটু হাসিমুখে মিশতো, তাহলে না হয় আরো কয়েকদিন থাকা যেতো এই এলাকায়।
.
শাহিন তার মামার সাথে বের হলো চলে যাওয়ার জন্য। একটা রিকশায় উঠেছে দুজন। বাস স্টেশন এখান থেকে অনেক দূরে। রিকশা নিয়েই যেতে হয় এই দূরের পথে। রিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করেনা এখানে।
.
আনমনে তাকিয়ে আছে শাহিন সামনের দিকে। মামা তাকে কতো করে বললো, আরো কয়েকদিন থেকে যেতে, এই প্রথম এসেছে সে। কিন্তু শাহীন রাজি না, এমন পানসে গ্রামে থাকতে। এই প্রথম আসা, এবং এটাই শেষ।
.
এতক্ষণ শাহিনের পাশে রিকশায় বসে তার মামা কতো কিছু বললো, শাহিন শুধু "হু-হা" করছিলো। হঠাৎ তার কী হলো, রিকশাওয়ালাকে উত্তেজিত হয়ে রিকশা থামাতে বললো। রিকশা থামার পর শাহিন রিকশা থেকে নেমে তার ব্যাগটা মামার কোলে দিয়ে বললো:
--মামা, তুমি ফিরে যাও বাসায়, আমি যাবোনা...
মামা অবাক হয়ে বললো:
--মানে? হঠাৎ তোর কী হলো?
শাহিন মৃদু একটা হাসি দিয়ে বললো:
--কিছু না মামা, আমি আরো কয়েকদিন থাকবো এখানে।
.
মামা আর কিছু না বলে রিকশাটা ঘুরিয়ে চলে গেলো নিজের বাসার দিকে। মামা চলে যাওয়ার পর শাহিন আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, একটু আগে সে একটা সুন্দরি মেয়ে দেখেছে একটা দোকানে, মেয়েটা হঠাৎ কোথায় গেলো? শাহিন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো দোকানটিতে। তারপর দোকান থেকে একটা "ক্লেমন" কিনে দুই ঢোক গিলে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো:
--মামা, এখানে একটু আগে একটা মেয়ে দেখেছিলাম, লম্বা ফর্সা করে, মেয়েটা কোথায় গেলো বলতে পারবেন?"
দোকানদার রাস্তার ওপাশে একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বললো:
--ঐ বাড়ির মেয়ে সে।"
শাহিন ক্লেমনের দামটা দোকানদারকে দিয়ে দিয়ে সামনের বিল্ডিংটাতে গেলো। বাড়ির গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার কানে কয়েকজনের কান্নার শব্দ এলো। সাবধানে ভেতরে ঢুকলো শাহিন। দেখলো, বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়ি সবাই মিলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতেছে। শাহিনকে দেখে মধ্যবয়স্ক এক লোক জিজ্ঞেস করলো:
--কে বাবা তুমি?
শাহিন জবাব দিলো:
--আমাকে আপনারা চিনবেননা। আমি এই এলাকায় প্রথমবারের মতো বেড়াতে এসেছি। শফিক হায়দারকে চিনেন? উনি আমার মামা। উনার বাসায় এসেছি।"
--ও তুমি শফিকের বাসায় এসেছো? কিন্তু বাবা, তুমি এখানে কী মনে করে এলে?" মধ্যবয়স্ক লোকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
--আমি একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি আঙ্কেল। এই এলাকায় আসার পর থেকে কোনো যুবতী মেয়ে আমার চোখে পড়েনি। আজ আপনাদের এই মেয়েকে চোখে পড়লো, বাট এখানে এসে দেখি সবাই ওকে ধরে কান্নাকাটি করতেছেন। তার পাশে ব্যাগ দেখে মনে হচ্ছে, সে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই এলাকায় যুবতী মেয়ে না থাকার পেছনে কোনো কারণ আছে।"
মধ্যবয়স্ক লোকটা সামনে একটা সোফা দেখিয়ে শাহিনকে বসতে বলে, নিজেও অপর একটা সোফায় বসলেন। তারপর বললেন:
--বাবা, তোমার ধারণা-ই ঠিক। এই গ্রামটা একটা অভিশপ্ত গ্রাম। একটা খারাপ শক্তির নজর পড়েছে এই গ্রামের উপর। প্রতি অমাবস্যা এলে আমাদের বুকের ভেতর একটা তোলপাড় শুরু হয়ে যায় কীভাবে আমরা আমাদের মেয়েকে বাঁচাবো। প্রতি অমাবস্যায় একটা করে যুবতী মেয়ে উধাও হয়ে যায় এই গ্রাম থেকে। পরদিন তার লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় দূরের ঐ পাহাড়ে একটা বাংলোতে। অনেক যুবতী মেয়ে এভাবে শেষ হয়ে গেছে, আবার অনেক যুবতী মেয়ে এই ভয়ে চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। গ্রামটা এখন যুবতী মেয়ে শূন্য। যুবতী মেয়ে বলতে শুধু আমাদের মেয়েটাই অবশিষ্ট আছে এখন এলাকায়। কয়েকদিন পর অমাবস্যা রাত নামবে। তাই আমাদের ভয় বেড়ে গেছে কীভাবে আমাদের মেয়েকে বাঁচাবো। ওকে বাঁচানোর জন্যই আজ ওকে দূরের শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
এতোটুকু বলার পর লোকটা থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহীন তখন বললো:
--আঙ্কেল, সবাই যদি এভাবে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ যদি এই রহস্য জানার চেষ্টা না করে, কেউ যদি এর সমাধান বের না করে, তাহলে তো গ্রামটা আজীবন অভিশপ্ত 
হয়ে থাকবে!
:তুমি কী বলতে চাও বাবা?
লোকটা মাথা তুলে তাকালেন শাহিনের দিকে। শাহিন বললো,
:আমি চাই আপনার মেয়ে কোথাও যাবেনা, এই গ্রামেই থাকবে। আমিই এই রহস্য উন্মোচন করবো। বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।
:তোমার কি মাথা ঠিক আছে! তুমি একা একা ওই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়বে? 
:জি! আমি লড়ব।যদি আপনার মেয়ে রাজি থাকে।
:না! এটা কোন ভাবেই সম্ভব না!
:কিন্তু আঙ্কেল! আর কত! এভাবে আর কত লুকিয়ে বেড়াবে সে।একটু ভেবে দেখুন তো! যদি আপনার মেয়ের জায়গায় অন্য কারো মেয়ে হত বা এই পর্যন্ত যত গুলো মা বাবা তাদের সন্তান হারিয়েছে তাদের কেমন অনুভুতি একটু ভেবে দেখুন তো? আজ যদি আপনার মেয়ে আবার এই গ্রাম ছেড়ে যায় তাহলে ওই অশুভ শক্তি আর কোন মেয়ে পাবে না।যুবুতি মেয়ে না পেয়ে সে হয়ত পাগল হয়ে যাবে।হতে পারে সে এই গ্রামটাকেও ধ্বংস করে দিবে।
লোকটা কিছু বলল না।চুপ করে থাকল।মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবল।হঠাৎ ই শাহিনের পিছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এল।বলল,
:ও ঠিক বলছে বাবা! এভাবে আর কত লুকিয়ে থাকব।এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।হোক সেটা আমার দ্বারা।আমার দ্বারা যদি এই গ্রাম অভিশাপ মুক্ত হয় তাহলে ক্ষতি কি।বরং তোমার গর্ব হবে বাবা।তুমি গর্বের সাথে বলতে পারবে তোমার মেয়ে এই গ্রামের জন্যে কিছু একটা করে গিয়েছে। 
লোকটা হুট করেই মাথা তুলে শাহিনের পিছনে তাকাল।শাহিনও তাকাল।দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার পাশে একটা বড় ব্যাগ।মেয়েটা আবার বলল,
:আমি আসলে এটা নিয়ে খুব ভেবেছি।কিন্তু আমি একা এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারব না।তারউপর আমি একটা মেয়ে।তাই এটা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না।যাক এখন একজন পেয়ে গেছি।যে ঠিক আমার মত ভেবেছে।আমি উনার সাথে এক মত বাবা।
লোকটা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
:কিন্তু...
:কোন কিন্তু নয় বাবা।আমাকে উনার সাথে থাকতেই হবে।এই অশুভত্ব দূর করতেই হবে।
.
:কি করেন আপনি?
শাহিন প্রশ্নটা ওর পাশের মেয়েটাকে বলল।যাকে ও মিনিট কয়েক আগে চিনতও না।এখনও পুরোপুরি চিনেনি মেয়েটাকে।হ্যাঁ! তবে মেয়েটার একটা সুন্দর নাম আছে।মিহিন।নামটা যেমন সুন্দর চেহারাটা ঠিক তার চেয়ে আরো বেশি সুন্দর। মিহিন গোল গোল চোখে শাহিনের দিকে তাকাল।বলল,
:আপনি মনে হয় কথা বলার জন্যে কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।তাই না!
শাহিন কিছুটা বিব্রত বোধ করল।ও যা ভেবেছে ঠিক তাই হয়েছে।মেয়েটা ঠিকই ধরে ফেলেছে যে ও কথা বলার জন্যে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।তাই এমন একটা উদ্ভট প্রশ্ন করেছে।শাহিন কিছু বলল না বটে! তবে লজ্জা পেল।মিহিন মৃদু হাসল।বলল,
:হা হা হা! লজ্জা পাবেন না।আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছি।পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছি। আপনি?
:আমি এবার মাস্টার্স এ এডমিসন নেব।অনার্স কম্পলিট করেছি। পদার্থবিজ্ঞানের উপর।
:বাহহ! তাহলে তো ভালোই।দুজনেই একই বিষয় নিয়ে পড়ছি।
:হুম।কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল আর কি!
:হুম।কিন্তু আমরা আর কত হাঁটব।এই পর্যন্ত কত লোককে ধরলাম।কিন্ত কেউই তো ওই পাহাড় আর বাঙলো সম্পর্কে কিছুই বলছে না।
:এরা সবাই ভয় পাচ্ছে।আপনাদের গ্রামের সবাই খুব ভিতু।কেবল আপনি ছাড়া।
মিহিন কিছু বলল না।হাসল কেবল।মুখের সামনে চলে আসা চুল গুলো কানে গুজে দিল ও।শাহিন মুগ্ধ হয়ে তা দেখল। ওর এক মূহুর্তের জন্যে মনে হল এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কিছুই হতে পারে না।একদম না।
:কি ব্যাপার! এভাবে তাকিয়ে আছেন যে?
হঠাৎ ই শাহিনের ঘোর কাটল।ঘোর কাটিয়ে বলল,
:নাহহ! কিছু না।চলুন ফিরে যাই।
:হুম।চলুন।
কিছুদুর গিয়ে হুট করেই শাহিন দাঁড়িয়ে গেল।পকেট থেকে ফোন বের করল।মিহিন কিছুটা অবাক হল।বলল,
:কি করছেন?
:একজনকে ফোন করছি।যিনি আমাদের হেল্প করতে পারেন।
:কাকে!
:তাসফি কে! আমার বন্ধু! সারা দিন এগুলো নিয়েই পড়ে থাকে।
.
তাসফি রিক্সা নিয়ে যখন গ্রামটাতে প্রবেশ করল ঠিক তখনই ওর গা কেমন জানি ভারি হতে থাকল।খুব অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে ওর মাঝ্র।কেমন জানি লাগল ওর কাছে।ও ঠিকই বুঝে গেল কিছু একটা আছে এই গ্রামে।বড় অশুভ কিছু একটা! ঠিক তার কিছু সময় পরই রিক্সার একটা চাকা আপনাআপনি খুলে গেল।হুট করেই পড়ে গেল তাসফি।নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রিক্সাওয়ালা যেখান থেকে চাকা খুলে গেল সেদিকে তাকিয়ে বলল,
:কি আশ্চর্য! এই মাত্রই তো নতুন চাকা লাগালাম। এমনটা হল কেন!
তাসফি নিজেকে সামলে নিল।উঠে দাঁড়াল। খুব একটা ব্যাথা পায় নি ও।বাঁ হাতে খানিকটা চোট পেয়েছে কেবল। ওর যাত্রা পথেই বাধা পড়ল। ওর কেন জানি মনে হল সামনে একটা বিপদ আসতে চলেছে।খুব ভয়ানক একটা বিপদ আসতে চলেছে।
.
মিহিন তাসফিকে দেখেই খানিকটা অবাক হল। ও ঠিক যেমনটা ভেবেছিল ছেলেটা ঠিক তেমন না।ও ভেবেছিল তাসফি তান্ত্রিক টাইপের হবে।বেশভূষাও তেমন হবে।না! ওর ভাবনায় ভুল ছিল।তাসফিকে দেখেই সাধারণ মানুষের মত লাগল।ওর মাঝে কোন তান্ত্রিকত্ব নেই।শার্ট প্যান্ট পরে হাটে সে।সত্যিই বড় আশ্চর্যের ব্যাপার এটা।মিহিন ভাবল তাসফিকে একটা প্রশ্ন করা প্রয়োজন।প্রশ্নটা করা খুব জরুরি।প্রশ্নটা করবে করবে বলে আর করা হল না।
.
রাত আটটা বেজে একুশ মিহিট হয়ে গিয়েছে।মিহিন,শাহিন আর তাসফি তখনও তথ্য সংগ্রহে ব্যাস্ত।কিন্তু এ ক'দিন ঘুরে ওরা তেমন কোন তথ্যই পেল না।খুজতে খুজতে ওরা প্রায় পাহাড়ের কাছে চলে এসেছে।যেখানে ওই অশুভ শক্তি নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলেছে।হুট করেই তাসফি বলে উঠল,
:তোমরা দুজন ওই দিকে যাও।আমি এদিকে যাচ্ছি।খুব সাবধানে থাকবে।কোন ক্লু পেলে আমাকে ফোন দিবে।
শাহিন বলে উঠল,
:আচ্ছ।
শাহিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল তাসফি। বলল,
:যাই।
এই বলে তাসফি চলে যেতে থাকল।চাঁদের আলোয় ওর কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে কেবল।কিছু সময় পর সেটাও দেখা গেল না।শাহিন আর মিহিন দুজনেই হাঁটতে থাকল।শাহিন একটু অন্য মনষ্ক। কিছু একটা ভাবছে ও।হ্যাঁ! মিহিনকে নিয়ে ভাবছে।অনার্সে পড়ে মেয়েটা! অথচ তার কোন প্রেমিক নেই।শাহিন তো ভেবেছিল ওর বফ আছে।তাই প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগছিল ওর।কিন্তু যখন জানতে পারল ওর বফ নেই তার পর থেকেই কেন জানি খারাপ লাগাটা উবে গেল।অদ্ভুত ভাবে ওর ভালো লাগতে লাগল। শাহিন ভাবে আসলে কি ও মিহিনের প্রেমে পড়ে গেল নাকি।কি জানি! হঠাৎ-ই মিহিন বলে উঠল,
:কি ভাবছ!
শাহিন অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
:নাহ! কিছু না।
:তাহলে কিছু বলছ না যে?
:এমনি! আচ্ছা! চাঁদের আলোয় এভাবে এমন নির্জন জায়গায় হাটতে কেমন লাগছে তোমার?
:অদ্ভুত ভালো লাগছে! আমার আসলে এভাবে চাঁদের আলোয় আগে কখনো ভেজা হয় নি।সময় হয়ে উঠে নি ঠিক।খুব ইচ্ছে ছিল আমার।চাঁদের আলোয় ভিজব। হিমেল বাতাস বইবে।আমি হাঁটব।বাতাস আমার মন ছুঁয়ে যাবে।মাঝে মাঝে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকব।চাঁদের এমন রূপ দেখে খানিকটা হিংসে করব।আমার এই চাওয়াটা আজ পূরন হল।প্রথম বলে ভালো লাগার মাত্রাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল আর কি।তোমার কেমন লাগছে!
:চমৎকার লাগছে।তারউপর চাঁদ যদি নিজের পাশেই থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
মিহিন কিছু বলল না।লজ্জা পেল কেবল। লজ্জায় লাল হয়ে গেল।চাঁদের আলো পড়ে মিহিনের লাল মুখটা আরো সুন্দর হয়ে গেল।মিহিনকে অদ্ভুত সুন্দর লাগল। শাহিন মহিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল।সত্যিই! এমন সুন্দরি নারী আগে কখনো দেখে নি ও।শাহিন চোখ ফিরিয়ে নিল।সামনের দিকে হাঁটতে থাকল।হঠাৎই ও কারো হাতের স্পর্শ পেল।কেউ একজন ওর হাত ধরল।শাহিন হুট করেই মিহিনের দিকে ফিরল।মিহিন নিচু স্বরে বলল,
:ভয় লাগছে।
এতটুকু বলে ও শাহিনের হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরল।তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকলে।শাহিন তখনও অবাক হয়ে মিহিনকে দেখতে থাকল কেবল।ওর কেন জানি মনে হল মিহিন ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে।শাহিনের হাত ধরার জন্যে এমনটা বলেছে।বাহানা করেছে মাত্র।ওর একদমই ভয় লাগে নি।কথা গুলো ভাবতেই অদ্ভুত ভালো লাগল শাহিনের। হঠাৎই কারো কাশির শব্দ এল। ওরা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।কেউ একজন কাশি দিচ্ছে।কে? কে দিবে কাশি। মিহিন খানিকটা ভয় পেল। শাহিনের হাতটা শক্ত করে ধরল কেবল।
.
তাসফি হাতে টর্চ লাইটটা বন্ধ করে দিল। চাঁদের আলোয় হাঁটতে থাকল ও।কিছুদুর যেতেই ও একটা পুকুর পেল।পুকুরটার ঠিক পশ্চিমে একটা বাংলো বাড়ি আছে।খুব সুসজ্জিত একটা বাড়ি। বেশ সুন্দরও লাগছে বাড়িটাকে।যেন কেউ থাকে এখানে।কিন্তু এমন জায়গায় থাকবে কে? কথা ভাবতে না ভাবতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখল তাসফি। একটা আওয়াজ এল।তাসফি সাথে সাথে গাছের ছায়ায় আড়াল হয়ে গেল।দেখল একটা মেয়ে পুকুরটা থেকে উঠছে।তার পরনে একটা কালো প্যান্ট ও একটা কালো জ্যাকেট। জ্যাকেটের হাতা কনুই পর্যন্ত উঠানো।মেয়েটা সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকল। হুট করেই তাসফির চোখ গেল মেয়েটার হাতের দিকে।ওর হাতে একটা ট্যাটু করা।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ও তাসফি এপাড় থেকে মেয়েটার হাতের ট্যাটুটা স্পষ্ট দেখছে।একটা নেকড়ের ট্যাটু আঁকা। যার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। হা করে আছে সে।তাসফির কেন জানি মনে হল হাতের ট্যাটুটা কোন জিবন্ত নেকড়ের মুখ।যেন কাউকে সামনে পেলে খেয়েই ফেলবে।তাসফি কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকল। ঘোর কাটতেই দেখল মেয়েটা নেই।ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল।স্ক্রিনে শাহিন নামটা ভেসে উঠল।ফোন ধরল না ও। ছোট্ট একটা মেসেজ দিল "আসছি।"
তারপর ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটা ওর সামনে। ওর থেকে এক হাত দূরে।মেয়েটার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।ভ্রু কুছকে আছে।ওকে দেখেই তাসফি ভীষন ভয় পেয়ে গেল।বেশ কয়েকবার ঢোক গিলল।হঠাৎই মেয়েটা তাসফির গলা চেপে ধরল। তাসফি গুঙ্গিয়ে উঠল।তারপর তাসফি সহ মেয়েটা হুট করেই হাওয়া হয়ে গেল।
.
লোকটাকে দেখে বেশ অবাক হল শাহিন। বয়স ষাট এর উপরে হবে।দাঁড়ি আর চুল গুলো বেশ বড় হয়ে আছে। খুব সম্ভব লোকটা পাগল।কেমন জানি আবোলতাবোল বলছে। তবুও শাহিন এগিয়ে গেল।মিহিনও গেল।শাহিন বলল,
:আপনি এখানে কি করছেন?
লোকটা হঠাৎই চোখ তুলে তাকাল।বলল,
:কে? কে তোমরা? কি চাই তোমাদের?
:তেমন কিছু চাই না।আপনি কে বলুন তো? এখানে কি করছেন?
:তার আগে বল তোমরা এখানে কি করছ! কেন আসছ এখানে?
:আমরা আসলে ওই অশুভ শক্তি সম্পর্কে জানতে এসেছি।ওর বিনাশ করতে এসেছি।
লোকটা হঠাৎই হেসে উঠল। উচ্চ স্বরে হাসল।বলল,
:পারবে না তোমরা! কিছুই করতে পারবে না।তার চেয়ে বরং চলে যাও এখান থেকে।অনেক দূরে চলে যাও।বেঁচে যাবে।
এই বলে বৃদ্ধ লোকটা ছোট্ট কুড়ে ঘরটার ভিতরে চলে গেলেন।তারপর হুট করেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল একেবারে শান্ত।
.
:আপনি কে বলুন তো? আর এখানেই বা কেন এসেছেন?
মেয়েটা প্রশ্নটা তাসফিকে করল। তাসফি বলল,
:আমি এখানে ওই অশুভ শক্তি সম্পর্কে জানতে এসেছি।আর ওর বিনাশ করা ছাড়া আমি যাব না এখান থেকে।
মেয়েটা হাসল। খুব জোরে হাসল।বলল,
:আপনি! আপনি করবেন ওই অশুভ শক্তির বিনাশ।এটা মজা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
তাসফি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল।বলল,
:আপনি এখানে কি করছেন? আর আপনিই বা কে?
ঠিক তখনই একটা ঘন্টা বেজে উঠল। তারপর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।মেয়েটা হুট করেই একটা নেকড়ে পরিনত হল।তারপর পাহাড়ের দিকে এক দৌড় দিল।তাসফি কিছুটা অবাক হল।অবাক হয়ে দেখল কিছু সময়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বারোটা বেজে গেছে। হুট করেই ওর চোখ গেল একটা টেবিলের উপর।একটা খয়েরি কালারের ডায়েরি। তাসফি এগিয়ে গিয়ে সেটা নিল।তারপর মেয়েটা যেদিকে গিয়েছে ঠিক সেদিকে দৌড়ে গেল।কিছু দূর যেতেই দেখল একটা গুহা।মুখটা খোলা নাকি বন্ধ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ও।তাই গুহার দিকে এগুলো ও।মুখের কাছাকাছি যেতেই একটা অদ্ভুত গর্জন শুনল ও।কেউ যেন ওর দিকে তেড়ে আসছে।শব্দটা খুব কাছে চলে আসতে থাকল।নাহ! এখানে থাকাটা সুবিধার হবে না।তাসফি আর এক মূহুর্ত দাঁড়াল না সেখানে।দৌড়ে চলে এল।মিহিন এবং শাহিনকে দেখতে পেল সেখানেই যেখান থেকে ওরা ভাগ হয়েছে।শাহিন কিছুটা অবাক হল।তাসফি ওকে দেখতে পেয়েই বলল,
:দৌড়া দোস্ত! জলদি কর।কিছু একটা আমাদের পিছন আসছে।
ঠিক তখনই একটা আওয়াজ ভেসে এল।একটা গর্জন। খুব সম্ভব একটা নেকড়ের গর্জন। শাহিন ও মিহিন দুজনেই দৌড়ের প্রস্তুতি নিল।তাসফিও। আর যাই হোক এখানে আর থাকা যাবে না।বাঁচতে হল দৌড়াতে হবে।
.
তাসফি একটা ডায়েরি হাতে বসে আছে। শাহিন ও মিহিনও ওর সামনে বসে আছে।তাসফি বলতে লাগল,
:এই ডায়েরিটা একটা মেয়ের! যার সাথে কাল আমার দেখা হয়েছিল। মেয়েটার নাম নিতু।ওই বাংলোটা ওদেরই। ওখানে থাকত ওরা।কিন্তু যখনই এই অশুভ শক্তি এই গ্রামে আসে তখনই ওই বাংলো তারা নিজেদের আস্তানা হিসেবে বেচে নেয়।নিতুর পুরো পরিবারকে মেরে ফেলে।কেবল নিতু ছাড়া। ওর বাবাকেও মারতে পারে নি।কারন তিনি চাকরির কাজে একটা অন্য জায়গায় গিয়েছেন।তবে উনি নাকি এখনো আছেন। ওই বাংলোর আশেপাশেই নাকি থাকেন।হঠাৎই শাহিন বলে উঠল,
:তার মানে কাল যে লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল সে ছিল নিতুর বাবা?
:হয়ত তাই।শুন! নিতুকে ওরা মারে না কারন ওরা ওকে ওদের কাজে ব্যবহার করে।ওকে নেকড় বানিয়ে নিজেদের পাহারাদার হিসেবে রাখে।আর এই নিতুই একটা করে যুবুতি মেয়ে ধরে নিয়ে দিয়ে আসে ওই রাক্ষসীকে।যে যুবুতি মেয়েদের তাজা রক্ত পান করে।এতে করে তার শক্তি বৃদ্ধি পায়।এটা কেবল অমাবস্যায় করতে হয়। 
ওরা দুজন স্তব্ধ হয়ে শুনল কেবল। চট করেই শাহিন বলে উঠল,
:এদের মারার উপায় সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিস তুই?
:হুম।শুন।ও সন্ধ্যায় মিহিনকে নিয়ে যাবে।আমি তোকে কিছু মোমবাতি দিব।তুই সেগুলো নিয়ে যাবি ওই গুহার সামনে।যখন মিহিনকে নিয়ে যাবে ঠিক তারপর তুই যাবি।একটা একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে ভিতরে যাবি। মনে রাখিস মোমবাতির আলো যতটুকু দূরে যাবে তার আগ পর্যন্ত কোন অশুভ শক্তি তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।মোমের আলো যতটুকু ছড়িয়ে থাকবে ততটুকু স্থানের ভিরত তোর কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না।এভাবে কিছুদুর যেতেই একটা তলোয়ার পাবি দেয়ালে।সেটা নিয়ে নিবি।মোমের আলো নিভতেই কিছু জানোয়ার তোকে আক্রমণ করবে।তুই তলোয়ার দিয়ে সেটা সামলে নিবি।এবং একটা সাদা জলন্ত বল পাবি।ক্রিকেট খেলার বলের মত।ওটা ভেঙ্গে ফেলতে হবে।ওটা ভেঙ্গে ফেললেই ওই রাক্ষসীটা তোর সামনে হাজির হবে।এরপর বাকি আমার কাজ।
:কিন্তু এর আগ মূহুর্তে রাক্ষসীটা কই থাকবে।
কথাটা মিহিন বলল।
তাসফি বলল,
:ও তখন তোমাকে নিয়ে পাহাড়ের একদম উপরে উঠে যাবে।সেখানে গিয়ে তোমাকে মারতে চাইবে।তোমাকে মারার আগে শাহিনকে ওই বলে আঘাত করতে হবে।তারপর ও ফিরে আসবে।যদি এমনটা না হয় তাহলে তোমার মৃত্যু অবধারিত।আমরা কেউই তোমাকে বাঁচাতে পারব না।অশুভ বিনাশ তো হবেই না।সকল ক্লান্তি,গ্লানি জলে যাবে।
মিহিন একটু চুপসে গেল।মুখটা কালো হয়ে গেল।আড় চোখে শাহিনকে দেখল।শাহিন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।তাসফি শাহিনের দিকে তাকাল।ছেলেটা কাঁদছে নিশ্চই।তাসফি কিছু বলল না।মিহিনকে বলল,
:দেখবে সব ঠিকঠাক হবে।মনে রেখ অশুভের জয় হয় না কখনো। অনুকুল মুহুর্তে নিজেকে স্থির রেখ।আল্লাহ তো আছেনই।
এই বলে তাসফি উঠে এল।ছাদে উঠে গেল।ভালো লাগছে না।মিহিন মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগছে।প্রচন্ড খারাপ লাগছে। একটা সিগারেট ধরাল ও। বেশ জোরে জোরে টানতে লাগল। হঠাৎই ও কারো কন্ঠ শুনতে পেল।খুব মিষ্টি একটা মেয়েলি কন্ঠ! তাসফি বিন্দু মাত্র অবাক হল না।যে ও জানত এমন কিছুই হবে।মেয়েটা বলল,
:ছিঃ! তুমি সিগারেট খাও?
তাসফি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।সিগারেটটা ফেলে দিল। বলল,
:নাহ! খুব একটা খাই না। তা আপনি এখানে কেন?
:তোমাদের দেখতে এলাম।তা ভালোই ফন্দি আঁটলে! কাজ হবে তো!
:আশা রাখি হবে।
:আমি ভেবে পাই না তুমি এটা কিভাবে করলা!
:কি?
:চুরি?
:কি চুরি করেছি?
:আমার ডায়েরি। এটা তুমি একদমই ঠিক কর নি।এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। আমি এখন তোমায় খাব।মুহাহা!
:আমি জানি তুমি আমাকে খাবে না।কারন তুমিও আমাদের মত সাধারন মানুষ!
:হুম। তা তো বটেই।তা তোমার কি কাজ! ওদের তো কাজ ভাগ করে দিলে।
:আমার কাজ হল বাংলোর পুকুর হতে সেই বিষটা তুলে এনে ওই রাক্ষসীটাকে মারা!
:যাক! একটা ডায়েরি লিখে অন্তত কারো উপকার করতে পারলাম। এটা ভেবেই ভালো লাগল।
:আচ্ছা! ওরা এই গ্রামটাকেই কেন বেছে নিয়েছে বলেন তো?
:কারন এই গ্রামেই শয়তানের দুই শীর্ষকে মারা হয়েছে। ইস্পা আর মুনকে এই গ্রামেই মারা হয়েছে।এই গ্রামেরই কেউ নাকি ওদের মেরে ফেলেছে।ওরা নাকি ওই রাক্ষসীর বাচ্ছা ছিল।সন্তান হারিয়ে একেবারে ক্ষেপে যায় রাক্ষসী। 
:ও আচ্ছা! তাই বলেন!নাম কি সেই রাক্ষসীর।
:টিনি।
:আর পাহাড়ের পাশে যে লোকটা থাকে উনি কে? আর এভাবে একা একা এখানে থাকে কিভাবে।
হুট করেই নিতুর চোখটা ছল ছল করে উঠল।বলল,
:আমার অভাগা বাবা উনি।
তাসফি কিছু বলল না।চুপ করে থাকল। নিতুও।খানিকটা সময় নিরাবতায় কাটল।তাসফি আড় চোখে নিতু দেখল।মেয়েটার চোখ এতক্ষন ছলছল করছিল ঠিকই তবে তার আড়ালে একটা উজ্জ্বল চেহারা রয়েছে।তাসফির কেন জানি মনে হচ্ছে ভীষণ খুশি নিতু।কিন্তু সেদিন রাতে ওকে এত খুশি দেখায় নি।কেমন জানি মন মরা দেখাচ্ছিল। মুখটা কালো হয়েছিল।আজ একদম অন্য রকম লাগছে।একেবারে ভিন্ন।হুট করেই নিতু আনমনা হয়ে বলল,
:জানো! আমার না ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
:কেন?
:জানি না।তবে কেন জানি মনে হচ্ছে 
খুব তাড়াতাড়ি আমি এই রাক্ষসীর হাত থেকে মুক্তি পাব।বাবাকে দেখতে পাব।আমাকে আর ওর পোষা নেকড়ে হয়ে থাকতে হবে না।কোন যুবুতি মেয়েকে তুলে নিয়ে ওই রাক্ষসীর সামনে দিতে হবে না।তুমি জানো না এটা কত কষ্টের?একটা তাজা প্রান এভাবে মারা যাবে এটা কোন মানুষই দেখতে পারে না।জানো! ও যখন মেয়ে গুলোর মাথা কেটে ফেলে তখন আমার চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ে যায়।বাধা দিতে পারি না।যাক! এখন এর থেকে মুক্তি পাব! ভাবতেই ভালো লাগছে।আর যদি আপনারা না পারেন তাহলে সেটা হবে আমার দুর্ভাগ্য।মেনে নিব ভাগ্যকে।পোষা নেকড়ে হয়ে থাকব ওই ডাইনীর।
তাসফি কিছু বলল না।কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।তারপর নিতুর দিকে এগিয়ে গেল। ওর ট্যাটু করা হাতটা ধরে নিজের হাতের ভাঁজে রাখল।বলল,
:দেখবেন! সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার উপর বিশ্বাস রাখুন।
.
পাহাড়ের উচ্চ চূড়ায় মিহিনকে উঠানো হয়েছে।ওকে সম্পুর্ন উলঙ্গ করে ফেলেছে ওই রাক্ষসীটা।ওর হাত পা বেঁধে রেখেছে।ক্রস সিস্টেমে বাঁধা হয়েছে ওকে।চার হাত পা চার চারকোনায় বাধা।আজকে পূর্নিমা।চাঁদটা অনেক বড়।চাঁদের দিকে তাকিয়ে যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে রাক্ষসী টিনি! আজকে যদি এই মেয়ের রক্ত খেতে পারে তাহলে সে আরো শক্তিশালি হয়ে যাবে।তারপর পুরো গ্রাম তচনচ করে চলে যাবে।শেষ প্রতিশোধ নেওয়া হবে তার।রাক্ষসীটা মিহিনের হাতের তালু কেটে রক্ত নিয়ে নিজের কপালে লাগাল তারপর আঙ্গুলটা চেটে নিয়ে বলল,
:আহ্ঃ কি স্বাদ!তাজা রক্তের গন্ধে আমি পাগল হয়ে যাব।
এটা বলে হাসতে থাকল টিনি রাক্ষসী। 
নিতুর যেন গা জ্বলে যাচ্ছে।খুব ইচ্ছে হল রাক্ষসীটাকে কয়েকটা দেই।কিন্তু এখন কিছু করার কোন উপায়ও নেই। রাক্ষসী আবার যজ্ঞ শুরু করল।এরপরেই মিহিনের গলা কাটা হবে।এর আগে একটা কালো ড্রেস পরা একটা শয়তান আসবে। সে মিহিনকে বেত দিয়ে আঘাত করবে।এটা দেখে হাসবে ওই রাক্ষসী।রাক্ষসীটা যজ্ঞ করছে আবার।
.
তাসফি পানিতে নামতেই ওকে কয়েকটা কালো বড় বড় শ্যাওলা আঁটকে ফেলল।দেখতে অনেকটা হাইড্রার মত।হাত পাঁ আঁটকে রেখে ওর সেগুলো অতিক্রম করে সামনে এগুতেই পারছে না ও।এদিকে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে।ঠিক তখনই ও পকেট থেকে একটা চাকু বের করল।এরপর আস্তে আস্তে শ্যাওলা গুলোর মাথা কাটতে লাগল।ওকে যে করেই হোক ওই সবুজ বক্সটা নিতেই হবে।যেটা দিয়ে ওই রাক্ষসীকে মারা যাবে।
.
মোমের আলো নিভতেই শাহিন দেখল ওর পাশে অনেক গুলো নেকড়ে।ওর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিচ্ছে।শাহিন একটু এগুতেই একটা ঠিক ওর মুখ বরাবর হামলা করল।শাহিন এক কোপে তার মাথা আলাদা করে ফেলল।এভাবে ও মারতে থাকল।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ও যতই মারছে নেকড়ে গুলো যেন কমছে না! বাড়ছে। তবুও সে চালিয়ে যেতে লাগল।ঠিক পেরে উঠছে না ও।শাহিন হঠাৎই কারো চিৎকারের আওয়াজ পেল। খুব পরিচিত একটা আওয়াজ। ওর বুকটা ধক করে উঠল। মিহিনের কিছু হয়ে যায় নি তো!মিহিনের কিছু হলে বাঁঁচবে না।কোন ভাবেই না।শাহিন আরো জোরে তলোয়ার চালাতে লাগল।
.
যজ্ঞ শেষ।এবার মিহিনকে মেরে ফেলা হবে।মেয়েটা কান্না করছে।চিৎকার দিচ্ছে।মারের আঘাত সইতে পারছে না ও।ব্যাপারটা ভালো লাগল না নিতুর কাছে।বড় বিভৎস লাগল। কিন্তু রাক্ষসীটা যাচ্ছে না কেন? শাহিন কি তার কাজ করতে পারে নি।রাক্ষসীটা একটা তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেল। উপরের দিকে উঠিয়ে জোরে আঘাত করবে এমন সময় নিতু ওকে ধাক্কা দিল।সে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। তারপরেই উঠে বসল।নিতু বলল,
:আমি থাকতে ওর কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।
রাক্ষসীটা বলে উঠল,
:বিশ্বাস ঘাতক।তোকে বাঁচিয়ে রাখাটাই আমার ভুল হয়েছে।আজ তোকেও মেরে ফেলব।অ্যাই! ধর ওকে!ধর! 
আদেশ পেতেই কয়েকটা কালো ড্রেস পরা রাক্ষসী এগিয়ে এল।যাদের মুখ দেখা যায় না।মুখটা পুরো কালো, অন্ধকার হয়ে আছে। ওরা নিতুকে ধরল।রাক্ষসীটা তলোয়ার হাতে এগিয়ে এল।নিতুর পেটে ঢুকিয়ে দিবে তার আগেই একটা তীব্র আওয়াজ ভেসে এল।রাক্ষসীটা তীব্র স্বরে চিৎকার দিল।এরপর আরো একটা আওয়াজ।রাক্ষসীটা তলোয়ার ফেলে দিল।তারপর হাওয়া হয়ে গেল।নিতুকে ধরে রাখা শয়তান গুলোও।
.
আরো একটা আঘাত করতেই বলটা ভেংগে গেল।ঠিক তখনই কালো বিশাল দেহি দৈত্যাকার একটা মেয়েকে দেখল শাহিন। সে অগ্নি দৃষ্টিতে শাহিনের দিকে তাকাল।হা করতেই বিশাল দাঁত দুটো বেরিয়ে এল।দৌড়ে এল শাহিনের দিকে।বলল,
:কে? কে তুই? এখানে কিভাবে এলি?
শাহিন জোরে চিৎকার দিয়ে বলল,
:তোর জম আমি।আজ তোকে মেরেই এখান থেকে যাব।
কথা গুলো শুনেই রাক্ষসীটার গা যেন জ্বলে গেল।খুব জোরে একটা হুংকার দিল।শাহিনকে মারার জন্যে দৌড়ে গেল।শাহিন তলোয়ার চালাতেই দেখল রাক্ষসীটা হওয়া হয়ে গেছে।ওর সামনে কেউ নেই।পিছন থেকে একটা হাসির আওয়াজ এল।তাকাতেই দেখল রাক্ষসীটাকে।এবার আরো জোরে আঘাত করল রাক্ষসীকে।না! এবারেও লাগল না।শাহিন ভীষন চিন্তিত হয়ে গেল।তার মানে এই তলোয়ার দিকে ওকে মারা যাবে না।ঠিক তখনই কেউ একজন ওকে পিছন থেকে একটা লাথি মারল।শাহিন গুহার দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল।গুঙ্গিয়ে উঠল। কপাল ফেটে রক্ত বের হতে থাকল।রাক্ষসীটা বলল,
:হা হা হা।আমাকে মারা এত সহজ না।তোরা মরবি আজ।তোদের পুরো গ্রামে আজ লাশের বন্য বইয়ে দিব। 
এই বলে সে শাহিনকে মারার জন্যে এগিয়ে এল।শাহিনের তল পেটে একটা ঘুসি মারতেই শাহিন চিৎকার দিয়ে উঠল।কেঁদে দিল একেবারে।শাহিন অবুভব করছে ও যে শক্তি হারা হয়ে গিয়েছে।উঠে বসার শক্তি যেন ওর মাঝে নেই। শাহিনকে আবার ঘুসি মারবে ঠিক তার আগেই তাসফি ওর গায়ে সবুজ বক্স হতে কিছুটা কিছু সবুজ পানি ওর গায়ে মারল।ওমনি সে মাটিতে পড়ে গেল।চিৎকার দিতে থাকল।তাসফি বলল,
:শুন! তোর মেয়ে ইস্পা আর মুনকে এই আমিই মেরেছি।তারা যেমন কিছুই করতে পারে নি তেমনি তুইও কিছুই করতে পারবি না।কিচ্ছু করতে পারবি না।মনে রাখিস "মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।"
রাক্ষসীটা কিছুই বলতে পারছে না।কেবল মাটিতে পড়া চিৎকার দিচ্ছে।আর তাসফির দিকে হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে।তাসফি আর দেরি করল না। সম্পুর্ন সবুজ পানি গুলো ওর গায়ে ঢেলে দিল।বেশ কিছুক্ষন পর একটা তিব্র আওয়াজ করে রাক্ষসীর দেহ ধোঁয়া হয়ে উধাও হয়ে গেল।সাথে সাথে ওর মরে যাওয়া শীর্ষরাও উধাও হয়ে গেল।তারপরেই গুহার ভিতরে ভাঙ্গতে থাকল।তাসফি আর শাহিন দৌড়ে চলে আসতে থাকল।শাহিনের দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে।তবুও প্রানপনে দৌড়াচ্ছে ।গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে ঠিক তার আগেই ওরা বেরিয়ে গেল।কিন্তু নিতু কিংবা মিহিনকে কোথাও দেখতে পেল না।শাহিনের ভীষন খারাপ লাগল।ডুকরে কেঁদে উঠল ও।শাহিন বলল,
:আই এম সরি মিহিন।আই এম সরি।আমি তোমাকে ভালোবাসি।তবে সেটা আর বলা হল না।আমার জন্যেই তোমার আজ তোমার প্রান...
এই বলে ও কান্না করতে থাকল।তাসফি মুখ টিপে হাসল কেবল। মিহিনকে আর নিতুকে ইশারা করল আড়াল হতে বের হওয়ার জন্যে। মিহিন এগিয়ে এল শাহিনের সামনে। বলল,
:খুব ভালোবাস আমায় তাই না?
শাহিন হুট করেই মাথা তুলল।মিহিনকে দেখতেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।বলল,
:একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।খুব বেশি।প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
:আরে বোকা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে কি আমি নিজে মরব নাকি? তোমাকে ছাড়া আমিও এক মূহুর্ত চলতে পারি না।তোমায় বড্ড বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি গো।
.
ওদের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে তাসফি তাকাল নিতুর দিকে।দেখল ও এক মনে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর কি মনে করে পিছনের দিকে হাঁটা ধরল।এবং হুট করেই ও নেকড়ে হয়ে গেল।তাসফি বেশ অবাক হল।তারমানে এই শক্তিটা ওর মাঝে রয়ে গেছে।তাসফি চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
:অ্যাই। কই যাও।
ও পিছন ফিরল।তাসফির দিকে তাকাল।তাসফি একটু ভালো করে তাকাতেই দেখল ওর চোখ ছলছল করছে।তাসফি ঠিক বুঝে নিয়েছে ও কই যাচ্ছে।বলল,
:বাবার কাছে যাচ্ছ। তাই না? আমিও যাব।
এই বলে তাসফি দৌড়ে গেল।ওর কাছে গিয়েই ওর
মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।বলল,
:দুজনে মিলে যাই।দৌড়ে যাব।দেখি কে আগে যায়।
নিতু চোখ দুটো হুট করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।যেন বেশ খুশি হয়েছে ও।নিতু আর দেরি করল না।ওকে দৌড়ে তাসফিকে হারাতেই হবে।যেভাবেই হোক।
নিতু পজিশন নিল।তারপর দৌড় দিল। সাথে তাসফিও।দুজনেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।শাহিন এবং মিহিন মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। চাঁদটাও যেন ভীশণ খুশি।এমন দৃশ্য দেখে যে কেউই খুশি হবে।প্রকৃতিও খুশি।খুশি পাহাড়টাও।ওকে এখন আর কেউই অশুভ পাহাড় বলবে না।সবাই ওকে দেখতে আসবে।ওর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবে।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে সবাই।


.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমদ
বাংলা গল্প| Bangla Love Stories| Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url