Bangla Golpo: গল্পঃ প্রেম পরশ
গল্পঃ প্রেম পরশ
তাসফি আহমেদ
ভার্সিটির গেইট দিয়ে বের হতেই একটা মেয়েকে দেখলাম গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে|আমি বের
হতেই তার সাথে আমার চোখাচোখি হল|তাকে দেখে মনে হল সে যেন আমার অপেক্ষাই করছে কেননা আমাকেদেখা মাত্রই তার চাঁদবদন উজ্জ্বল হয়ে উঠল|তবে কি আমার অপেক্ষায় ছিল মেয়েটা?এই মেয়ে কেন আমার অপেক্ষা করবে?আশ্চর্য! কি যা তা ভাবছি আমি|চোখ নামিয়ে বাসার পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম আমি|ঠিক তখনই মেয়েটা বলে উঠল,
-আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম|
আমি খানিকটা অবাক হই|খানিকটা না,পুরোপুরি অবাক হই আমি|সত্যি বলতে আজ অব্দি এতটা অবাক আমি হই নি| মেয়েটা আমার বলে উঠল,
-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?আমি সত্যিই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম|বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার?
আমি হতভম্ব হই এবার|খানিকটা লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে বলি,
-সরি|আসলে আপনাকে আমার জন্যে এভাবে অপেক্ষা করতে দেখে একটু অবাকই হলাম|তাই অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগছিল|তা অপেক্ষার কারণ?
-সে আছে অনেক কারণ|আপাতত আপনার পাশে হাঁটতে চাচ্ছি|হাঁটা যাবে?
আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে যাই|কোন মেয়েকে পাশে নিয়ে হাঁটা হয়নি আজও|আমার কেমন জানি লাগল| ভাবলাম না করে দেই|পরে আবার কি ভেবে না করলাম না|অস্বস্তি ভাব নিয়েই বললাম,
-চলুন তাহলে!
মেয়েটার উজ্জ্বল মুখটা আরেকটু উজ্জ্বল হল যেন|যেন অনেকক্ষণ যাবত এটার অপেক্ষায়ই ছিল|তাই মৃদু হাসি দিয়ে আমার পাশে চলে এল মেয়েটা|বলল,
-চলুন!
.
-আপনাকে আমার চেনাচেনা লাগছে|কোথাও যেন দেখেছি|এই ভার্সিটিতেই তো পড়েন তাই না?
অনেকক্ষন যাবত দুজনে মিলে হাঁটছি। তবে কেউ একটু শব্দও করলাম না।আমি ভেবেছি মেয়েটাই সর্ব প্রথম কথা বলবে।কিন্তু সে বলে নি। তাই অগত্যা আমাকেই কথা বলতে হল। কি প্রশ্ন করব ভাবতে ভাবতে এমন আজগুবি একটা প্রশ্ন করলাম।এতে আমিও খানিকটা বোকা বনে গেলাম।তাই বোকার মত মাথা নিচু করে রাখলাম।তবে প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা যে রেগে গেল সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে|কপট রাগ নিয়ে বলল,
-আগে কখনো দেখেন নি আমায়?
-দেখেছি বটে|তবে কোথায় দেখেছি তা ঠিক বলতে পারছি না|
মেয়েটার রাগটা যেন আরেকটু চড়ে গেল|তবে নিজের ভিতরে যে রাগটা চেপে রেখেছে তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি|অন্যদিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
-হাদারাম একটা!
আমার ভ্রু জোড়া কুচকে এল|বললাম,
-কিছু বললেন?
-নাহ!কিছু বলি নি|সে যাই হোক আরিফ ভাইয়াকে তো চিনেন|চিনেন তো?
-আরিফ!আমার ফ্রেন্ড আরিফ?
-হু!আপনার ফ্রেন্ড আরিফ|আমি তাদের বাসার ৪র্থ তলায় থাকি|আর এই ভার্সিটিতেই অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি|
-ও হ্যাঁ|এবার মনে পড়েছে|আপনাকে আমি আরিফের সাথে বেশ কয়েকবার দেখছি|
-এবার চিনতে পেরেছেন? আমি এবার বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললাম,
-হু!পেরেছি|তবে পুরোপুরি না|নাম জানা হয় নি এখনও| শেষের কথাটা শুনে মেয়েটা যেন খুশি হল ভীষণ|আগের রাগ রাগ ভাবটা হুট করেই চলে গেল|মৃদু হেসে বলল,
-আমার নাম নিরা|জান্নাতুল মাহিয়া নিরা|তবে অনেকে নিরু বলে ডাকে|আপনিও চাইলে ডাকতে পারেন!
-আপনার নামটা আমার বেশ লেগেছে|তবে অনেকের মত আমি আপনাকে নিরু বলে ডাকতে পারব না|আপনার নিরা নামটাই বেশ|
-আপনার ইচ্ছে|
এই বলে মেয়েটা চুপ হয়ে গেল|খানিকটা সময় নিরবে কাটল আমাদের|এরপর একটা মোড় আসল সামনে|একটা রাস্তা সোজা গেছে আরেকটা ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে|ঠিক মোড়ের মাঝখানেই মেয়েটা থামল|মুখটা খানিকটা মলিন করে বলল,
-আপনি তো সোজা যাবেন তাই না?
-আপনি কিভাবে জানলেন?
-আমি এমন আরো অনেক কিছুই জানি|
-কিভাবে?
-হবে কোন এক ভাবে|আমি ডানে যাব।বাসা ওই দিকেই|
চললাম|বাই|কাল দেখা হবে|
মেয়েটা চলে যেতে থাকল|আমি খানিকটা বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম রাস্তায়|কিছু দূর গিয়ে মেয়েটা
আমার দিকে ফিরে চাইল আবার|মলিন মুখে মৃদু হাসল সে| আবার হাঁটতে থাকল|আমি ঘোরে পড়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্যে।অদ্ভুত সুন্দর হাসি মেয়েটার।একেবারে ঘোর ধরিয়ে দিয়েছে।আহা! কারো মলিন মুখের হাসি এতটা সুন্দর,এত স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকবে সে আমার জানা ছিল না|ঘোর কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম|এই মেয়েটার সাথে আর কথা বলা যাবে না|প্রচন্ড মায়া কাজ করে তার মাঝে|যে কোন সময়ে প্রেম নামক অঘটন ঘটতে পারে|প্রেম?কি সব ভাবছি আজকাল|আমি আর প্রেম,এটা ভাবা যায়? হাহাহা|মাথাটার যে কি হল? অনমনে হেসে উঠলাম আমি|প্রেমে পড়লে মানুষ নাকি
আপনাআপনি হাসে|এটা আমি শুনেছি|তবে কথাটা সত্য না|এইমাত্র তার প্রমাণ পেলাম|আমি কিছুসময় আগেঅনমনে হেসেছি|কিন্তু আমি তো কারো প্রেমে পড়ি নি| তাহলে?তাহলে যে লোকটা এই কথা বলেছে ভুল বলেছে। তার এমন অযৌক্তিক কথা বলা মোটেও উচিত হয় নি| তাকে এর উপযুক্ত শাস্তি দেয়া উচিৎ|
.
বাইরে ভীষণ চাঁদের আলো|চাঁদের শুভ্র আলে বারান্দার গ্রিল ভেদ করে টাইলস করা মেজেতে লপ্টে আছে| খানিকটা আমার পায়ের উপরও লেপ্টে আছে।এমন স্নিগ্ধ, কোমল আলোয় নিজের পাঁ ভেজাতে বড্ড ভালো লাগছে আমার|সেই সাথে এমন পরিবেশে নিরুর কথা ভাবতেও বেশ লাগছে|অদ্ভুত সুন্দর করে হাসে মেয়েটা। ঘোর ধরে আমার।কোথায় যেন হারিয়ে যাই।ওকে নিয়ে
কল্পনায় ভালোবাসা-বাসি করতে ভালো লাগে ভীষন। যেন আমার পাশে আমার হাত ধরে চন্দ্রবিলাশ করে ও। অদ্ভুত কল্পনা খেলা করে ওকে নিয়ে |চোখ দুটো চারপাশের গাঢ় কাজল যেন চোখের গভীরতা আরো বাড়িয়ে দেয়|লিপস্টিক দেয়া ঠোট গুলো যখন চওড়া করে হাসে অদ্ভুত সুন্দর লাগে আমার। গালের বাঁপাশের তিলতা যেন ওর হাসির সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। আমার ঘোরের জগৎ আরেকটু গাঢ় করে তিলটা|অদ্ভুত অনুভূতি হয় আমার|ভাষায় অপ্রকাশ্য অনুভূতি|চোখ,তিল
আর হাসির সমন্বয়ে মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছে আমার|মজার বেপার হল তার বাঁ'গালে একটা তিল আছে আমারো বাঁ'গালে একটা তিল আছে|আচ্ছা নিরু কি আমার বাঁ গালের তিলটা লক্ষ্য করেছে?সে কি জানে আমাদের দুজনের মাঝে এতটুকু মিল আছে? নিরু অনেক কিছুই জানে না|নিরু জানে না আজ আমি তার সাথে কি নিখুত অভিনয় করেছি|আমিও বেশ আশ্চর্য হয়েছি এটা জেনে যে আমি বেশ ভালো অভিনয় করতে পারি|নিরু বুঝতেই পারল না যে আমি তার সাথে অভিনয় করছি| নিরুকে আমি আরো আগ থেকেই চিনি|মাস দুয়েক হবে| হঠাৎ-ই একদিন আমি আবিষ্কার করলাম যে কেউ একজন আমাকে দেখছে|আড়াল থেকে দেখছে|আমি প্রথম প্রথম ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না যে কে আমাকে দেখবে| আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম|আবার মনেরভুলও হতে পারে|তাই খুব একটা গা দিলাম না|কিন্তু ব্যাপারটা যখন দৈনিক ঘটতে থাকল তখন আর ছেড়ে দিলাম না|কারণ এটা আমার অস্বস্তির মাত্র বাড়িয়ে দিচ্ছিল|তাই খোঁজাখোজিতে লেগে গেলাম| খোঁজাখুজির এক পর্যয়ে আমি এই নিরু মেয়েটাকে আবিষ্কার করলাম|সেদিন ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম|হুট করেই আমার চোখ গেল একটা মেয়ের দিকে|মেয়েটাও তার ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল| তবে সে আড্ডা দিচ্ছিল বলে আমার মনে হল না|আমার কেন জানি মনে হল সে আমাকেই দেখছে|প্রথমবার
চোখাচোখি হতেই সে অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল| আমিও নামিয়ে নিলাম|তারপর আমি কিছু সময় তাকালাম না|এমন একটা ভান করলাম যেন আমি আড্ডায় জমে আছি|কিছু সময় চুপ থাকলাম।তারপর হুট করেই ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকেই তাকিয়েছিল।আমাকে আবার তাকাতে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।আমি ঠিক বুঝে নিলাম বুঝে নিলাম যে এই সেই দু'চোখ যা আমার
অস্বস্তির কারণ।তবুও সিউর হওয়ার জন্যে আমি বেশ কয়েকবার আড়াল হয়েমেয়েটাকে পরক্ষ করেছি এবাং যার ফলাফল বলে যে এটাই সে মেয়ে|আমার থেকে ভীষন আশ্চর্য লাগল একটা ভেবে যে কোন মেয়ে একটা ছেলেকে এভাবে দূর থেকে পরক্ষ করছে|খুব দূর থেকে ভালোবেসেছে যাকে সে
চিনেও না,কথাও হয় নি|মেয়েটা এরকমই একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে|এরপর আমি মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করতে থাকি|বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে তার সাথে আমার| প্রতিবারই অপ্রস্তুত হয়ে খানিকটা অপরাধবোধ নিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে|ওর এই জিনিসটাই আমার সর্ব প্রথম ভালো লাগে|ওকে হুট করে চমকে দিতে ভীষন মজা পেতাম আমি|এরপর থেকে ওকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি|ওর গভীরতায় পাঁ দেই খুব জলদিই! এরই মাঝে কখন যে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি
টেরই পেলাম|তবে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা কেবল আমার মাঝে সিমাবদ্ধ|কেউ জানে না যে আমার মত বোকাসোকা ছেলেটা নিরু নামক জুনিয়র মেয়েটার প্রেমে পড়ে তিব্রভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে|আমি এমন ভাবে চলি যেন কেউ টের না পায়|সবাইকে জানিয়ে,ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে ভালোবাসার কথা বলার প্রয়োজন নেই আমার|
আমি ভিন্নতা পছন্দ করি|আমি চাই খানিকটা ভিন্ন ভাবে আমাদের পথ চলা শুরু হোক|একদিন না হয়
মেয়েটাকে চমকে দিয়ে হুট করেই নিজের ভালোবাসার কথাটাতাকে জানিয়ে দিব|নিরু নিশ্চই চমকে উঠবে| চোখে বিন্দু জল জমবে|খানিকটা গড়িয়ে পড়বে নিশ্চই|মলিন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নিমিশেই|সেদিন আমি কেবল তাকিয়ে দেখবো তাকে|প্রাণ ভরে দেখবো|চোখের জল গুলো মুছে দিয়ে জড়িয়ে নিব তাকে ভালোবাসার পরম মায়ায়|আমি কথা গুলো ভাবি বারান্দায় বসে বসে| ভাবনায় হুট করেই অনমনে হেসে উঠি আমি|বাইরে জোৎস্ন্যার আবরনে চেয়ে আছে|আমার জোৎস্ন্যা বিলাশ করতে ভালো লাগে ভীষন|ভালো লাগে আনমনে হেসে উঠতে|কেউ একজন বলেছিল ভাবনার মাঝে কোন সুস্থ মানুষ আনমনে হেসে উঠলে ধরে নিতে হবে সে কারো প্রেমে তিব্রভাবে পড়েছে|যেমনটা আমি নিরুর প্রেমে পড়েছি|অনেক আগেই পড়েছি|মাঝে মাঝে আনমনে হেসে উঠেছি বহুবার|কারণ খুঁজে পাই নি|আজ পেলাম| তাই লোকটা সঠিক বলেছিল|তাকে নোবেল দেয়া উচিত|
.
নিরু আমার সাথে পরপর তিন দিন বাড়ির পথ ধরে হেঁটে এসেছে|এর মাঝে অনেক কথা হয়েছে ওর সাথে|কেবল ভালোবাসার কথা ছাড়া|ইঙ্গিত দিয়েছে ও|আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে মজা নিয়েছি|তবে একটা জিনিস আমার মাথায় ঠিক ঢুকল না|মোড়ের কাছে এলেই নিরু কেমন যেন চুপশে যায়|মুখটা মলিন করে ফেলে|আষাঢ় ডেকে আনে চেয়ারায়|কারণটা আজানা|আজকাল এই ব্যাপারটা বড্ড ভাবাচ্ছে আমায়|ক'দিন পরেই আষাঢ় নেমে আসে আমার জিবনে|আকাশ কালো করে তিব্র বেগে ছুটে আসে আমার দিকে|কেবল বর্ষণ হওয়ার অপেক্ষা|সেদিন ভার্সিটিতে মিরুকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে হাঁটছে|ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখছে|দুজনেই একসাথে|ক্লাস না ফাকি দেওয়া নিরু মেয়েটাকেও আজ দেখলাম ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে|আমার অসহ্য লাগতে শুরু করে|
ভীষন অস্বস্তি লাগে আমার|হূদয়ে শূন্যতা ঠাই পায় কেবল|মুছড়ে উঠে বাঁ পাশটা|ব্যাথা হয় ভীষন|জল জমতে থাকে বিন্দু বিন্দু করে|আড়াল করি সে জল|ভালো আছি টাইপের মুখভঙ্গিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট পাই ভিতরে ভিতরে|আমাকে দেখতেই নিরু এগিয়ে আসে|তার চোখে-মুখে তিব্র রকমের বিষন্নতা খেলা করে|ফর্সা মুখটায় ঘন কালো হয়ে থাকতে দেখি এই প্রথমবার|আমি মেকি হাসি|নিরু হাসে না|শুষ্ক ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় তার হবু বরের সাথে|আমি কুশল বিনিময় করি তার হবুর
সাথে|মুখে মেকি হাসি|এমন অবস্থায় নিজেকে একজন বিখ্যাত অভিনেতা মনে হল আমার|
.
সেদিন ক্লাস না করে চলে আসি আমি|একা আসি না| মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ় নিয়ে আসি|কিছু রাগ-অভিমানও মিসে থাকে তাতে|বাড়ি ফিরে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে শুরু হয় তিব্র বর্ষণ|পুরো পৃথিবিটাই অসহ্য লাগছিল আমার কাছে|বেঁচে থাকার মানেটাই যেন মরে গিয়েছে হুট করেই|কষ্ট গুলো যেন চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরেছে আমায়| দুই দিন যাই নি ভার্সিটিতে|প্রচুর কেঁদেছি এ দু'দিন|
নিরুকে ভীষন মিস করতে থাকি আমি|যেন অনেক দিন দেখি না তাকে|মন টিকে না ঘরে|ভার্সিটি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমি|ওকে না দেখে থাকতে পারছি না আর|কাল যাব ভার্সিটিতে|এটাই শেষ সিদ্ধান্ত|এখন কেবল রাতের পর ভোরের অপেক্ষা| বিকেলে ফোন আসে আরিফের|অবাক হই|ছেলেটা আজ দুই সপ্তাহ হল ফোন দিচ্ছে না|আমাদের সাথে আড্ডায়ও বসে না|নিজেকে আড়াল করছে আজকাল|জানতে চেয়েছি বহুবার|বলে নি ও|কাউকে বলে নি|তবে পুষ্পের সাথে যে কিছু একটা হয়েছে এটা আমি ঠিক ধরতে পেরেছি|আমি ফোন রিসিভ করি|ওপাশ থেকে হস্তদন্ত হয়ে ভেজা গলাম আরিফ বলে
-দোস্ত!জলদি করে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আয়|পুষ্পের কি জানি হয়েছে|
ও ঠিক ভালোভাবে বলতে পারে নি কথাটা|আমি আর বেশি কিছু শুনার অপেক্ষাও করলাম না|ফোন কেটে বের হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
.
পুষ্প ভালো আছে|দূর্বলতার কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে।জ্ঞান হারিয়েছে কিছু সময়ের জন্যে|দূর্বলতার কারনটা যে আমি আরিফ সেটা বুঝতে আর কষ্ট হয় নি আমার|কষ্ট হয়েছে নিরুকে দেখে|মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে খানিকটা|চোখের নিচে কালি জমেছে|মেয়েটা যেন একেবারে নিষ্প্রান হয়ে গেল|এমন উচ্ছ্বাসিত,প্রানবন্ত মেয়েটার এমন চুপশে যাওয়াটা আমার মোটেও ভালো লাগে নি|ওকে দেখে কষ্ট কমার বদলে খানিকটা বেড়ে গেল যেন|আমাকে দেখতেই দৌড়ে এল মেয়েটা|চোখ-মুখ যেন একটু উজ্জ্বল হল ওর| কাছে এসেই ছুড়ে মারল প্রশ্নবাণ|বলল,
-এতদিন কই ছিলেন আপনি?
আমি অবাক হই|বলি,
-এতদিন কই!দুই দিনই তো মাত্র! মেয়েটা মাথা নিচু করে|খানিকটা সময় চুপ থেকে বলে,
-জানেন!আমি আপনাকে খুঁজেছিলাম অনেক|কিন্তু পাই নি|এদিকে আপনার বাসাটাও চিনি না যে গিয়ে দেখে আসবো|
-আরিফকে বললেই তো পেয়ে যেতেন|
-আজ নিয়েছিলাম ভাইয়ার কাছ থেকে|ভেবেছিলাম যাব|কিন্তু পুষ্প আপু অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় যাওয়া হল না আর|
-তা খোজ করেছিলে কেন?
মেয়েটা অনেকটা সময় চুপ থাকে|কিছু বলে না|তারপর মাথা নিচু করে বলে,
-এমনি!
আমি আবার আশাহত হই|রাগ উঠে মাথায়|কষ্ট গুলো হূদয়মুখি চাপ মারে|কষ্ট বাড়ে| চোখে জল জমে|আড়াল করি পিছন ফিরে|সোজা হাঁটতে থাকি|পিছন থেকে ভেজা কন্ঠ আমার হৃদয় ছেদ করে|বলে,
-কই যান?
আমি জানি পিছন ফিরলে ওর চোখ ভরা জল দেখবো|ওর চোখের জল আমার সহ্য হবে না|তাই ওর দিকে না তাকিয়ে বললাম,
-বাসায় যাবো|
এই বলে হাঁটতে থাকলাম|
-আমিও যাব|
পিছন থেকে আওয়াজ ভেসে আসে|নিরু দৌড়ে আসে আমার দিকে|
.
তিন রাস্তার মোড়টাকে আমি বিষন্ন মোড় নাম দিয়েছি| কারন এখানে এলেই নিরুর মাঝে বিষন্নতা ভর করে|আজও করেছে|সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে|অন্ধকার হচ্ছে|নিরু আর আমি দাড়িয়ে আছি বিষন্ন মোড়ের মাঝখানে|নিরু কান্না করছে|কেন কান্না করছে তা আমি জানি না| এদিকে ও আমাকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে না, নিজেও যাচ্ছে না|মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করছে কেবল| ওর কান্না আমার সহ্য হয় না|খারাপ লাগে ভীষন|এখানে বেশিক্ষন থাকা যাবে না|তা না হলে আমাকেও কাঁদতে হবে|আমি বলি,
-আচ্ছা যাই...
ও আমার হাত আঁকড়ে ধরে| কান্না করতে করতে বলে,
-প্লিজ যাবেন না|আমি জানি আপনি এবার গেলে আর আসবেন না|প্লীজ!
আমি থমকে যাই কিছু সময়ের জন্যে|নিরু আমার হাত ধরেছে|শুষ্ক তৃণ লতা যেমন বৃষ্টির স্পর্শে সজিব হয়ে উঠে ঠিক তেমনি আমিও খানিকটা সজিব হয়ে উঠলাম|নিরুর ছোঁয়ায় কেবল ভালোবাসা অনুভব করলাম আমি|আমি আর চুপ করে থাকলাম না|এবার কিছু একটা করতে হবে|আমার অব্যক্ত কথা গুলো ওকে বলতে হবে|তা না হলে আজিবন একটা আফসুস থেকে যাবে আমার|আমি নিরুর হাতটা শক্ত করে ধরলাম|নিরু চমকে উঠল যেন!যেন ও বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি ওর হাত ধরেছি|ও জল ভরা চোখে আমার দিকে তাকায়|আমি একঝাক ভালোবাসা নিয়ে প্রথমবারের মত নিরুর চোখে চোখ রাখলাম|নিরু যেন তা দেখে কেঁপে উঠল|আমি বললাম,
-ভালোবাস?
নিরু অনেকটা সময় চুপ থাকল|কেবল আমার চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকল|কি বলবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না বোধহয়|আমি আবার বললাম,
-নিরু তুমি কী আমায় ভালোবাস? নিরু এবার আর ঠিক থাকতে পারল না|চোখ দুটো ভিজে এল ওর|ক'ফোটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে|মাথাটা কেবল উপর নিচ করে জানান দিল যে সে আমায় ভালোবাসে| এবার আমার চোখে জল জমে|গলা ভার হয়ে আসে|ভিজে গলায় বলি,
-তাহলে ওই ছেলেটা?তোমার হবু বর?
-গাধা!তাকে তো সেদিনই বিদায় করে দিয়েছি|যদি একটু অপেক্ষা করতে তাহলে দেখতে|আবার রাগ করে চলে গিয়ে দুদিন ভার্সিটিতেও আসলা না|কষ্ট হয় না আমার!
-কষ্ট হয় কেন?
-দু দিন দেখিনি তোমায়|আমার মনে হল যেন দু যুগ তোমায় দেখি নি|জানো তোমায় না দেখে কষ্ট পেয়ে কত কেঁদিছি আমি?
-আমি বোধহয় কাঁদি নি|কোথাকার কোন ছেলেকে ধরে এনে আমার সামনে নিজের হবু বর বলে দাবি করতে খারাপ লাগে নি তোমার?
-তা তো লেগেছেই|তবে সেই হবু বরের কারণেই তো তুমি মুখ খুললে|তা না হলে তো বোকার মত অভিনয় করে যেতে|
-নিরু তুমি জানতে যে আমি তোমার সাথে না চেনার অভিনয় করতাম?
-তোমার অন্তর আত্মাকে পড়ার ক্ষমতা রাখি আমি|
-খুব ভালোবাস তাই না?
-প্রামাণ দিব?
আমি কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম|আমি জানি মেয়েটা আমায় ভালোবাসে|ভীষন ভালোবাসে|আমি বললাম,
-দিয়েছে তো প্রমাণ|
-কে?
-তোমার ওই দু চোখ|জানো তোমার দু চোখ পড়ার ক্ষমতা রাখি আমি|
-আমি জানি|
এই বলে হাসল নিরু| উজ্জ্বল মুখে হাসল আজ | এই প্রথম ওর ভেজা চোখে জয়ের হাসি দেখলাম|আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে নিরুর মলিন মুখের হাসির চেয়ে উজ্জ্বল মুখের হাসি অদ্ভুত সুন্দর|একেবারে ঘোর ধরে চোখে|আমি আবার ঘোর লাগা চোখে নিরুকে দেখতে থাকলাম|আশ্চর্য!চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হয় না আমার|কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়|সত্যি মেয়েটার মাঝে মারাত্মক রকমের মায়া রয়েছে| তা না হলে আমার মত প্রেম না করা বোকা ছেলেটা কি ওর প্রেমে পড়ে?
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়