গল্পঃ ভুতুড়ে মেয়েটা
দরজাটা খোলা মাত্রই খুব শিতল বাতাস গায়ে লাগল।যেন ওপাশ থেকে কেউ একজন এ ঝাক বাতাস ছেড়ে দিল।আমি দাঁড়িয়ে তা অনুভব করলাম।পাশ থেকে মাসুদ বলে উঠল,
:কি রে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ভিতরে যাবি না?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম।ঘোর কাটিয়ে বললাম,
:হুম চল।ভিতরে যাই।
ও কিছু বলল না।ঘরে ঢুকে গেল।আমিও আমার মত ঘরে ঢুকে গেলাম।বসার ঘরে যেতেই হঠাৎ ই একটা আওয়াজ এল।খুব ঝনঝনে শব্দ হল।ঠিক তারপরেই কেউ একজন দৌড়ে চলে যাওয়ার শব্দ হল।আমি শব্দের উৎসের খোঁজে দৌড় দিলাম।মাসুদও আমার সাথে দৌড় দিল।রান্না ঘরের দিকে যেতেই দেখলাম একটা প্লেট মেজেতে পড়ে আছে।জানালার দিকে তাকাতেই দেখলাম একটা বিড়াল!আমাদের উপস্থিতি টের পেতেই নিচে নেমে দৌড়ে চলে গেল।আমি সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম।পাশ থেকে মাসুদ বলল,
:শালার বিড়াল।একেবারে ভয় পাইয়ে দিল।
এই বলে বুকে থুতু দিল।ওর এই জিনিসটা আমার খুব বিরক্ত লাগে।একটু ভয় পেলেই বুকে থুতু দেয়।কত করে বললাম "এই থুতু দিয়ে কি তুই তোর ভয়কে কিছুটা লাগব করতে পারিস? "ও ভ্যাবলার মত বত্রিশটা দাঁত বের করে একটা হাসি দিত।তারপর বলত,"না!"আমি বলতাম, "তাহলে দিস কেন? ও হাসি মুখে রেখেই বলত," ছোট বেলা থেকে এমন করে আসছি তো? তাই। আর হবে না।" এই "আর হবে না" যে কত বার বলেছে তার অন্তঃ নেই।তবুও বার বার করে।
আমি ওর দিকে কিছু সময় বিরক্ত ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ও বত্রিশটা দাঁত বের করে একটু হাসল।তারপর বলল,
:এই কান ধরেছি।আর হবে না।
আমি কিছু বললাম না।ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল।ও একটু তাড়া দিয়ে বলল,
:কি ব্যাপার! এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?দেখ ভাই আমি বলেছি আমার ভুল হয়েছে।আর করব না।এখন দাঁড়িয়ে থাকিস না।চল! চল! অনেক কাজ পড়ে আছে।
আমি কিছু বললাম না।রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেলাম।পুরো ঘরটা মাকড়সার বাসায় ভর্তি।সোফা গুলোর উপর উপর কাপড় সাদা রঙের কাপড় দেওয়া।সাদা কাপড়ের ময়লাটে হয়ে গেছে।বালি জমে আছে।সোফার সামনে রাখা ছোট টেবিলটায় বিন্দু মাত্র ময়লা দেখলাম না।খুব পরিষ্কার দেখাচ্ছে ওটা কে।যেন কেউ এটাকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে।খুব যত্ন করে টেবিলটাকে।বসার ঘরের দরজা পেরুলেই ডান ও বাম পাশে দুইটা শোবার ঘর।ডান পাশেরটার দরজা ঠেলতেই কেঁচ কেঁচ শব্দ হল।ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিলল বিশাল এই রুমটার।দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইন্টিং শোভা পাচ্ছে।তবে কি পেইন্টিং সেটা দেখা যাচ্ছে না।বালিতে একেবারে চাপা পড়ে আছে।বিছানার পাশেই একটা টেবিল। তারউপর বেশ কয়েকটা বই দেখা যাচ্ছে অগোছালো অবস্থায়। একটা ময়লাটে গ্লাস পড়ে আছে। টেবিলটার উপরেও অনেক ময়লা। খাটের বাঁপাশের দিকটায় একটা জানালা আছে।ওটা বন্ধ করা।আমি ধির পায়ে হেঁটে বারান্দার দিকে এগুলাম। খুব বড় সড় বারান্দা। আমি আগে কখনও এমন বারান্দা দেখি নি। বারান্দা থেকে পুরো বাগান স্পষ্ট দেখা যায়।বেশ বড়সড় বাগান।শুনেছিলাম কোন এক বড় লোক এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন।টাকা পয়শার অভাব ছিল না হয়তো। তাই এত বড় বাড়ি বানিয়েছে।শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাড়িটা।আশেপাশে লোকজন তেমন নেই।পুরো বাড়ির এরিয়াটা বাউন্ডারি করা।তবে আরাম করার মত উপযুক্ত একটা জায়গা ।কারো মন খারাপ থাকলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভালো করে দেওয়ার মত জায়গা এটা।আশেপাশে অনেক গাছ বিদায় বেশ বাতাস বয়ে যায় এখানে।শান্ত, মনোরম পরিশেষ। প্রশস্ত বাগানটার দিকে তাকালেই প্রান জুড়িয়ে যায়।একেবারে অশান্ত মনটা আপনা আপনি ভালো হয়ে যায়।হৃদয়ে আনন্দেরা দোলা খেলে।এ এক অনন্য পরিবেশ।কিছু সময় দাড়িয়ে থাকলা বারান্দাটায়।নিজের পাশান হৃদয়টাকে একটু শান্তি দিলাম।হৃদয়টাকে একটু কোমল করলাম।তারপর আস্তে আস্তে ঘরটাতে ফিরে এলাম। এই ঘরটাতেই আমাদের থাকতে হবে।এমনটাই বলেছে লোকটা। আরো বলেছে বাঁপাশের রুমটা বন্ধ।তালা মারা।ওটা তে থাকা যাবে না। শোবার রুম থেকে বের হতেই দেখলাম মাসুদ সোফার উপরের ময়লাটে কাপড় গুলো সরিয়ে ফেলেছে।মাকড়শার বাসা গুলো অনেকটাই ভেঙ্গে ফেলেছে।আমি ওকে বললাম,
:দোস্ত রান্না করব কোথায়?
:কেন? রান্না ঘরে।
:আরে বেটা রান্না ঘরে তো বুঝলাম। কিন্তু আগুন পাব কই? এখানকার গ্যাসের চুলা কি এখন চলবে? দেখিস নি কত পুরোন?
:না! আমি ঠিক মত দেখি নি।চল দেখে আসি।
:চল!
.
আমি আর ও রান্না ঘরে গেলাম।ও কিছুক্ষণ চুলাটাকে ভালো ভাবে পরক্ষ করল।তারপর গ্যাস সিলেন্ডারটা উপরের দিকে উঠাল। বলল,
:দোস্ত গ্যাস নেই।নতুন সিলেন্ডার কিনে আনতে হবে।
:চুলা ঠিক আছে?
ও চুলার সুইচটা কয়েকবার ঘুরাল।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
:হুম! ঠিক আছে।শুধু একটা সিলেন্ডার হলেই হবে।
:তাহলে এক কাজ করি।চল! দুজনে ঘর গুছিয়ে এখানকার বাজারে যাই।রাতের খাবারটা কিনে নিয়ে আসব আর সাথে একটা সিলেন্ডারও।
:এত দূরে যাবি?
:যেতেই হবে।কিছু করার নেই।
.
রাত ঠিক বারোটা বত্রিশ বাজে।সারাদিন খুব খাটাখাটি হল।আমি টেবলটার সামনে বসে আছি।মাসুদ বিছানায় উপড় হয়ে ঘুমাচ্ছে।ও ঘুমালে আর কিছুরই খবর থাকে না।আমার কেন জানি ঘুম আসছে না। এই বাড়িটার ব্যাপারে ভাবতেছি।সেদিন হঠাৎ ই একটা লোক ফোন দিয়ে বলল,
:ভাই আপনার সাহায্য আমার খুব দরকার।
আমি একটু অবাক হই।আমার সাহায্য লাগবে কারো? বড় হাস্যকর লাগল ব্যাপারটা।তবুও বললাম,
:জী ভাই।কি সাহায্য করতে পারি?
:আসলে আমাদের এখানে একটা বাড়ি আছে।আমি এক সময় এই বাড়ির মালিকের গাড়ি চালাতাম। সেই সূত্রে এই বাড়ির সাথে আমার পরিচয়। লোকটা একটু থামল।আমি সেই ফাঁকে বলে ফেললাম,
:আপনি আমার সাথে দেখা করুন।তারপর সব কিছু বিস্তারিত শুনা হবে।
:আচ্ছা।
আমি উনার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি উনি কি বলতে চেয়েছেন। তাই দেখা করতে বললাম।আমার আবার এই ধরনের কাজ গুলো করতে বেশ ভালো লাগে।আনন্দের সাথেই করি।সাথে থাকে মাসুদ। আমার বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু ও আমর।
দেখা করার পর উনি বললেন বাড়িটা থেকে নাকি রাতে অদ্ভুত আওয়াজ আসে।কয়েকটা ছেলে মেয়ে খেলা করলে যেভাবে আওয়াজ হয় ঠিক সেই ভাবে। মাঝে মাঝে অনেক উচ্চ স্বরে হাসি শোনা যায়।আবার কারো কান্নাও।
হঠাৎ ই একটা আওয়াজ হল।রান্না ঘর থেকে এসেছে আওয়াজটা।আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। আসলে ভাবনার মাঝে ছিলাম তো। তাই এমন হয়েছে।ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে উঠে রান্না ঘরের দিকে এগুলাম।আমার আসার আওয়াজ পেতেই কিছু একটা ধপ ধপ করে দৌড়ে গেল।ঠিক যেমনটা প্রথমে হয়েছিল যখন ঘরে ঢুকেছিলাম।আমি আস্তে আস্তে মেজেতে পাঁ ফেললাম। এগুলাম রান্না ঘরের দিকে। গিয়েই দেখিলাম আগের সেই প্লেটটা মেজেতে পড়ে আছে।জানালার দিকে তাকাতেই দেখলাম সেই বিড়ালটাকে।যেটাকে প্রথমে দেখেছিলাম।ও রক্ত বর্নের চোখের দিকে তাকাতেই আমি খানিকটা পিছিয়ে গেলাম।কেমন যেন নেশাগ্রস্তদের মত তাকাল আমার দিকে। তারপর দিল দৌড়। কোথায় গেল বা কোন দিকে গেল তা আমি ঠিক ঠাউরে উঠতে পারি নি।চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করতে লাগলাম।কফি খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
.
কফির মগটা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রুমের লাইটটা ছাড়া বাকি সব ঘরের লাইট জ্বালানো। আমি একটা চেয়ার টেনে বসলাম।আকাশে জ্বল জ্বল করছে চাঁদটা।তার চারপাশে কাদার ন্যায় রং করা। ঠিক সেই রঙের পাশেই লালছে আভা বিদ্যমান। আমি কিছুসময় সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। রুপার কথা মনে পড়ছে। রুপা খুব আবদার করত ও আমার সাথে এমন একটা রাত কাটাবে।দুজনে চুপটি করে বসে চন্দ্রবিলাশ করবে।একটু একটু প্রেম করবে।একটু দুষ্টমিও করবে।আমি কখনই ওর এই আবদার পূরন করি নি। বলেছি, "সব করব।বইয়ের পর। "দেখতাম মেয়েটা আমার কথা শুনে বিষন্ন হয়ে বসে থাকত। ওর এমন চাহনি দেখে আমার খুব খারাপ লাগত। তবুও কিছু বলতাম না।এখানে আসার সময় খুব করে বলেছে না আসার জন্যে। আমি ওর কথা শুনি নি। নেশা কাটানোর জন্যে চলে এলাম এখানে।ওখনে মন খারাপ করে আছে মেয়েটা।হয়ত খুব রেগে আছে।তবে আমি জানি সে রাগ ক্ষনিকের। খুব তাড়াতাড়িই ও। আমাকে ফোন করবে এবং প্রান খুলে কথা বলবে। আমার সাথে কথা বললে ওর নাকি সময়টা খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়।বেশ ভালো লাগে ওর কাছে।এমনটা ও নিজেই বলে।আমার ভালো লাগে। তবে সেটা প্রকাশ করি না।নিজের মাঝেই রেখে দেই।
হঠাৎ ই খুব পরিচিত একটা ফুলের গ্রান ভেসে এল।খুব ভালো লাগে গন্ধটা আমার কাছে। বকুল ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।পুরো রুমটা যেন বকুল ফুলের গন্ধে একাকার। সামনের দিকে তাকাতেই দেখা মিলল বিশাল দেহের অধিকারি বকুল গাছটার।গাছটার পাতা নড়ছে। হিমেল বাতাস বইছে।খুব ঠান্ডা অনুভুতি হচ্ছে আমার মাঝে।এক ঝাক ভালো লাগা কাজ করছে।এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ততক্ষনে আমার কফি খাওয়া শেষ। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই রুপা নামটার দেখা মিলল।মনের অজান্তেই ঠোটের কোনে মৃদু হাসি ঠাই পেল।
.
রুপার সাথে কথা বলছি। এমন সময় একটা ছোট বাচ্ছার হাসির আওয়াজ পেলাম।প্রথমবার শুনার পর মনে হল মনের ভুল।কিন্তু দ্বিতীয় বার শুনার পর আর সেটা মনে হল না।ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিলাম।তা না হলে একের পর এক ফোন আসবেই।আবার শুনা গেল সেই হাসির আওয়াজ। চারপাশটা এতটা নির্জন যে একটু শব্দ হলেই খুব গাঢ় করে সেটা শুনা যায়।আমি সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম বকুল গাছটা নড়ছে।একটু ভালো করে তাকাতেই দেখলাম গাছটার ঢালের উপর বসে কেউ একজনের কালো মূর্তিটা দেখতে পেলাম।বাতাসের বেগটা খানিকটা বৃদ্ধি পেল।গাছের একটা ঢাল নড়তেই ছায়া মূর্তিটার উপর চাঁদের আলো পড়ল সেদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমার গায়ের লোম গুলো অনায়াসে দাঁড়িয়ে গেল। মনের মাঝে ভয়ের শিহরন বয়ে গেল। মেয়েটার পুরো শরির সাদা।চোখ গুলো খুব লাল।চোখ দুটোর চারপাশটা কালো হয়ে আছে।গায়ে সাদা একটা কাপড়। বয়স কত হবে! সাত কি আট হবে।মেয়েটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। তারপর হঠাৎ করেই আমার দিকে তাকাল। চোখ মুখ শক্ত করে, হাতের বড় বড় নখ গুলো দেখিয়ে আমার দিকে খুনের নেশা চাইল।খুব তাড়াতাড়ি বলল,
:এখানে এসেছিস কেন? বল এখনে এসেছিস কেন? মনে রাখিস, একবার যেহেতু ঢুকেছিস আর বের হতে পারবি না।তোদের শাস্তি একটাই হবে।মৃত্যু! মৃত্যু।হা হা হা।
এই বলে মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে হাসতে লাগল।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিল। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এল।হাওয়ায় মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে হেটে আমার
হেঁটে আসছে আর অদ্ভুত ভাবে হাসছে। একটু এগিয়ে আসতেই দেখা মিলল তার বড় বড় দাঁত দুইটার।ও এগিয়ে আসতে লাগল।আমি একটু পিছিয়ে গেলাম।গায়ের লোম গুলো যেন ছিড়ে যাচ্ছে।গা টা পুরো শিতল হয়ে আসছে।আমি একটু পিছন ফিরে চাইলাম।একটুর জন্যে দেয়ালে বাড়ি খাই নি।দরজার দিকে ফিরে দেখলাম।তারপর সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা একেবারে আমার সামনে।হাত দিলেই যেন আমার গা ধরতে পারবে।আমি দৌড় দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।কিন্তু তার আগেই ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেজেতে পেলে দিল।প্রচন্ড ব্যাথায় আমি ককিয়ে উঠলাম।মেয়েটা দারালো দাঁত গুলো বের করে দৌড়ে আসল আমার দিকে এসেই ঠিক আমার বুকের উপর বসল।ঠিক তারপর থেকেই আমি আমার সব অচল হয়ে গেল হাত,পাঁ নাড়াতে পারছি না।কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মেয়েটা খুনের নেশায় আমার দিকে চাইল।যা দেখেই আমি উচ্চ স্বরে আওয়াজ করে উঠলাম।ঠিক তখনই মেয়েটার মুখ থেকে ক'ফোটা রক্ত আমার গালে পড়ল।
.
চলবে...
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমদ