গল্পঃ মিরু

বাংলা ছোট গল্প Bangla Love Stories Bangla Choto Golpo  Bangla Valobashar Golpo Bangla Golpo (2)


গল্পঃ মিরু

তাসফি আহমেদ


এখানে এসে মিরুকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম।কিছুটা না।পুরোই অবাক হলাম।ওকে ঠিক এখানে আশা করি নি আমি।একটু আনইজিও ফিল করছি।তবুও জড়সড় হয়ে বসে রইলাম।অনেক গুলো গোপন কথা নিয়ে।গোপন ব্যাথা নিয়ে চুপচাপ স্টেজে বসে রইলাম।কিছু সময় পরই মিরু আমার সামনে আসল।চেহারায় অনেকটা রাগ রাগ ভাব।তবুও সেটা লুকানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।আমি আমার মতই চুপচাপ বসে রইলাম।সে বলল,
:দেখি সোজা হয়ে বসুন।চেহারাতো ব্যাঙের মত করে রেখেছেন।একটু হাসুন!
এই বলে সে মোবাইলটা আমার দিকে ফিরাল।ছবি তুলতে চাইছে বোধ হয়। আমি কোন রকমে ওর দিকে তাকালাম।ঠিক ওর দিকে না।ওর পিছনে গিপ্ট হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি।মিরু বেশ কয়েকটা ছবি নিয়ে চলে গেল।ঠিক যেভাবে এসেছে সেভাবেই গেল।
পিছন থেকে সাদিক উঠে এল স্টেজে।এসেই আমার পাশে বসে বলল,
:সপ্তম আশ্চর্যের পর যে এমন ভাবে অষ্টম আশ্চর্য দেখব বলে আশা করি নি।প্রেমিক এর বিয়েতে প্রেমিকা আসল।আবার এসেই প্রমিকের ছবি তুলে নিয়ে গেল ভাবতেই কেমন জানি লাগছে।
সাদিক থামল।আমি কিছু বললাম না।কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখ গুলো কেমন জান ঝাপসা হয়ে আসছে।মিরুর সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত যেন চোখের সামনে ভাসছে।ওর রেগে যাও চাহনিটা বারবার চোখের সামনে ভাসছে। কান্না করতে করতে লাল হয়ে যাওয়া নাকে ডোগাটা ভীষন ভালো লাগত আমার।রেগে গিয়ে কতবার যে আমায় মেরেছে তার অন্তঃ নেই।মিস করছি ওর সাথে কাটানো সময় গুলো।আর কখনও ওর সাথে এমন ভাবে সময় কাটানো হবে না ভাবতেই ভিতরটা যেন তলিয়ে যাচ্ছে।কষ্টে আবেশিত হয়ে আছে হৃদয়টা।দুজনে মিলে যে স্বপ্ন গুলো দেখেছি সেগুলো আর বাস্তবায়ন হবে না।স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।আচ্ছা আমার পাশে অন্য মেয়েকে দেখে কি মিরুর খারাপ লাগবে না।একটুও লাগবে না? ওর পাশে কোন ছেলেকে দেখলেই আমার মাথাটা গরম হয়ে যায়।যেন! যেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে ওকে আমার থেকে। ও আমার! শুধু আমার! ওকে ছোঁয়ার কিংবা দেখার অধিকার কেবল আমার আছে। অন্য কারো নেই।কিন্তু এখন! এখন তো আমি অন্য কারো হতে চলেছি।সেও অন্য কারো হবে।অন্য কেউ ওকে ছুঁয়ে দেখবে।ওর নরম তুলতুলে হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিবে।এগুলো ভাবতেই আমার খারাপ লাগা বেড়ে যায়।অস্থিরতা কাজ করে হৃদয় মাঝে।ওর পাশে অন্য কেউ থাকবে এটা ভাবতেই ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দেই।ওর পাশে অন্য কেউ?কোন মতেই এটা সহ্য করার মত নয়।একদম না।
:কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি? অ্যাই তাসফি! অ্যাই! কই হারাই গেলি?
:হু...
:কি হু...!
:কিছু বলছিস?
ও কিছুসময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।একটু সময় নিয়ে বলল,
:খুব ভালোবাসিস ওকে।তাই না?
:তুই জানিস। সবটা তুই জানিস।আমার কতটা জুড়ে মিরু রয়েছে সেটা তোর থেকে ভালো আর কেউ জানে না সাদিক।
:হুম।তা বুঝলাম।কিন্তু এখানে তোর কিংবা আমার কিছুই করার নেই।আমার ভাবতেই অবাক লাগে মিরা এমনটা করেছে।তাও আবার তোর সাথে।যাকে ও মন প্রান দিয়ে ভালোবাসে।আমি বেশ ক'টা জায়গায় তোদের রিলেশন নিয়ে প্রশংসাও করেছি।কিন্তু এখন...!ছিঃ মিরা এটা কিভাবে করল?
:থাক বাদ দে।দুঃখ কষ্ট জীবনে থাকবেই।সেগুলো নিয়েই আগামির পথ চলতে হবে।
সাদিক আমার হাতটা ধরল।নিজের হাতের উপর রেখে বলল,
:দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।মিতুও বড্ড ভালো মেয়ে।আমার বিশ্বাস তুই অবশ্যই ওর সাথে সুখে থাকবি।
:আমি কিভাবে সুখে থাকব সাদিক।কিভাবে থাকব।আমার সব সুখতো মিরুর সাথে ভাগ করা।
:অ্যাই! অ্যাই ছেলে! বিয়ে করতে এসেছিস। একদম কান্না করিস না।লোকে কি ভাববে। চুপ! একদম থাক।বোকা ছেলে।কাঁদিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না।প্লিজ!
আমি কিছু বললাম না আর।কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে আমার।চুপচাপ বসে থাকলাম। মা ব্যস্ত।বাবা ব্যস্ত। ছোট বোনটা ব্যস্ত বান্ধুবিদের সাথে।ছোট ভাইটা আছে তার বন্ধুদের নিয়ে।সবাই খুশি।আনন্দের ছায়া পড়ল যেন এখানে।সবাই খুশি।বেশ খুশি।এত খুশির মাঝে কারো চোখে পড়ে আমাকে।আমি যে ভালোবাসার জ্বালায় দগ্ধ সেটা কেউ জানে না।একমাত্র সাদিক ছাড়া।আচ্ছা! মিরুকি জানে? আমি যে ভালো নেই সেটা কি ও জানে?
.
সাদিককে দেখলাম বিষন্ন মুখে আমার দিকে এগিয়ে আসতে।বাবাকে দেখছি না।মাকেও না।সাদিকে আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছু সময়।ছোট্ট বোন আর ভাইটা হাসি মজা করছে না।কমিউনিটি সেন্টারে যেন একরাশ নিস্তব্ধতা নেমে এল।কেউ কেউ ফিস ফিস করছে কেবল।আমি সাদিকের দিকে তাকালাম।বললাম,
:কিরে! কি হয়েছে? মুখটা এমন করে রেখেছিস কেন?
সাদিক কিছু বলল না।চুপ করে থাকল।আশ্চর্য! আমি এমন সাদিককে কখনই দেখি নি।এতটা বিষন্ন কখনও সাদিক হয় নি।নিশ্চই খুব জঘন্য কিছু হয়েছে।খুব খারাপ কিছু! সাদিক আমার হাত ধরে বলল,
:উঠে আয়!
আমি একটু অবাক হলাম।বললাম,
:কোথায় যাব?
ও ভারি গলায় বলল,
:আমার সাথে একটু ঐদিকে আয়।কিছু কথা আছে।
আমি সাদিকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ভয়ংকর কিছু শুনতে হবে আমাকে।নিশ্চই খুব ভয়ংকর!
সাদিক সামনে।আমি পিছন পিছন যাচ্ছি।একটু দূরে মিরুকে দেখলাম।ভীষন খুশি সে।পুরো কমিউনিটি সেন্টারে ও একা হাসছে।আর কারো মুখে হাসি নেই।বিন্দুমাত্র হাসি নেই।মিরু আবার হাসল।সাধারণ গলায় বলল,
:সব লোকের বিয়ে হয় না।সবাই বিয়ের যোগ্যও নয়।
এই বলে আবার হাসল মিরু।সাদিককে দেখলাম কপট রাগ নিয়ে মিরুর দিকে তাকাল।তবে কিছু বলল না।আমার হাত ধরে মিরুর সামনে থেকে নিয়ে এল।এখানে কোন ভিড় নেই।মাঝে মাঝে দু'একজন লোক আসে যায় কেবল।সাদিক আমাকে ওর দিকে ফিরাল।নিজের ডান হাতটা আমার কাঁদের উপর রাখল।বলল,
:দেখ তাসফি! কত মেয়ে আসে যায়।আর কত মেয়ে আসে যাবে।তা নিয়ে যদি আমরা পড়ে থাকি, তাদের দেওয়া কষ্ট গুলো নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না।আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।কারো না কারো জন্যে বেঁচে থাকতে হবে।
আমি কিছুটা অবাক হলাম।এসব কথা ও আমাকে বলছে কেন? বললাম,
:তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু তুই এগুলো আমাকে বলছিস কেন?
:বলছি।আগে আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুন।ভেঙে পড়বি না একদম।প্লিজ ! জীবনে মেয়ে পাবি অনেক।আমরা তোর জন্যে আরো ভালো একটা মেয়ে দেখব।মিতুর চেয়ে ভালো।আজ বাসায় চল।আরো একটা ভালো মেয়ে দেখে তোকে বিয়ে দিব।
সব যেন খুব জলদি পরিষ্কার হয়ে গেল।বাবা মায়ের আমার সামনে না আসার কারন।সবার এমন নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া।আমি এখন ঠিকই টের পেলাম কি হয়েছে।
আমার হৃদয়ের ক্ষত স্থানটি যেন আরেকটু ক্ষত হল।তারউপর কিছুটা মরিচের ছিটকে পড়ল।আমার চোখ দুটো খুব তাড়াতাড়ি ঝাপসা হয়ে গেল।ক'ফোটা জল গাল বেয়ে পড়ে গেল। সাদিকের চোখ ছলছল করছে।ভাঙ্গা কন্ঠে বললাম,
:মানে।সাদিক! মিতু! মিতুও...
সাদিক চোখ ঝাপসা করে বলল,
:সেও চলে গেছে।তার নাকি রিলেশন ছিল।
আমি একটা ধাক্কা খেলাম।দেয়ালের সাথে পিঠা ঠেকে গেল।
:মিতু কেন এমনটা করল।ওকে তো আমি আগেই বলে দিয়েছি ওর পছন্দ থাকলে বলতে।এমনকি ওকে আমার আর মিরুর রিলেশন সম্পর্কে বলেছি। তাহলে! কেন? কেন ও সেদিন আমাকে এ কথা বলল না।বললে হয়ত আজ এমন দিন দেখতে হত না।
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।সাদিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।সেও কাঁদছে।প্রিয় বন্ধুর এমন কষ্ট সইতে পারছে না বোধ হয়।আমি কান্না করছি সাদিককে জড়িয়ে ধরে।এমতাবস্থায় চোখ গেল সামনের দিকে। দেখলাম মিরু দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখ দুটো ছলছল করছে।ও কাঁদছে কেন? ওর তো হাসার কথা।ও কাঁদছে কেন?
.
মিরুর সাথে আমার পাঁচ বছরের রিলেশন।বেশ শক্তপোক্ত। আমাদের বাসার পাশেই ওদের বাসা।সেই সূত্রে আমাদের প্রতিনিয়ত দেখাও হয়।আমি চাকরি করি আর ও পড়াশুনা করে।অনার্স থার্ড ইয়ারে।হঠাৎ-ই আমার পরিবার থেকে বিয়ের জন্যে খুব চাপ দেয়।পরিবারের বড় ছেলে বলে কথা! একবার না! দুইবার না! বারবার আসছে।মানে আমার সাথে দেখা হলেই,
"বাবা বিয়েটা করে ফেল।ঘরটা কেমন জানি খালি খালি লাগছে।"
আরো কত কি?
.
মিরুকে বিয়ের কথা বলতেই ও কেমন জানি মুখ গোমরা করে বসে থাকল। বেশ কিছুদিন মিরুর মন খারাপ ছিল।আমার সাথেও ঠিক মত কথা বলত না।কেমন জানি! উদাস! উদাস! এর মাঝে আমি হুট করেই একটা কাজ করে ফেলি।বাবা মাকে মিরুর কথা বলি।তারাও বেশ খুশি।দেখতে শুনতে ভালো। এমন কি চেনাজানাও আছে।তাই তারা অমত করে নি।বিয়ের কথা পাকা করতে গেলেন মা-বাবা।মিরুর বাবাও অমত করে নি।সব ঠিক।সবার মত আছে।সবাই খুশি।ভীষন খুশি।আমি! আমি তো খুশিই।যাক অবশেষে আমার স্বপ্ন গুলো পূরন হতে চলেছে।বাসর রাতে ওকে একটা চমক দিব।একটা স্বর্নের রিং কিনেছি ওর জন্যে। ওকে দিব।নিশ্চই খুশি হবে।তারপর! তারপর শুরু হবে আমাদের ভালোবাসায় সমৃদ্ধ সংসার। ওহ! আগ থেকেই কেমন জানি উত্তেজনা কাজ করছে আমার মাঝে।
এর পরের দিন মিরু আমাকে জরুরি তলব করল।আমিও খুশি খুশি মনে গেলাম দেখা করতে।কিন্তু সেখানে গিয়ে যে এমন বিবৎস কিছু বাণী শুনতে পাব তা আমার ভাবনার অনুকুলে ছিল।আমি ঠিক মিতুর কাছ থেকে এগুলো আশা করি নি।একদম না।যার সারমর্ম হল মিতু এখন বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়।সে তার কেরিয়ার গঠন করতে চায়।নিজেকে তুলে ধরতে চায়।সে এখন বিয়ে করতে একদম প্রস্তুত নয়।কথা গুলো ও আমাকে এমনি বললেও পারত।কিন্তু এর সাথে এমন কিছু কথা বলল যে যা শুনে আমার ব্রেক আপ নেওয়ার কথা চিন্তা করতে হল।তারপর বিয়েটা আর হয়ে উঠল না।
এর পরের দিন গুলো আমাদের ভালো যায় নি।আমি ফোন দিলে ও বিজি থাকত আর ও ফোন দিলে আমি।তারউপর জগড়া তো আছেই।রিতিমত জগড়া করত ও।কিছু একটা পেলেই হয়েছে। আগে তো এমন ছিল না।এখন কি হল।অতি প্রিয় মানুষটা এখন বিষাদে পরিনত হল।আমার পক্ষ্যে আর সম্ভব হয়ে উটে নি ওর সাথে সম্পর্ক রাখার।বাধ্য হয়ে ব্রেক আপ নিলাম।আশ্চর্যের ব্যাপার হল এতে ও বিন্দুমাত্র দুখিও হয় নি।বরং যেন অত্যধিক খুশি।ব্যস! এখানেই শেষ পথ চলা।থমকে দাঁড়াই আমি।সামনে আমি। আর পশ্চাৎ-এ হাজারো সৃতি। কিছু কষ্ট। কিছু অভিমান। অঘোর ভালোবাসা।হাজারো মায়া।ভালোবাসার কিছু খন্ডকালীন সময়।তারা আমাকে তাড়া করে।আঘাত দেয়।আমি তা সয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলি।
.
সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই।সূর্যটা পশ্চিম আকাশে।রক্তাক্ত হয়ে আছে।যেন অস্ত যেতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। তারপর সন্ধ্যা হবে।আকাশের বুকে, পৃথিবির তরে নেমে আসবে একরাশ বিষন্নতা। ঘন কালো হয়ে আসবে।দিনের পুরোটা সময় ভালো কাটে প্রকৃতির। গৌধুলির শেষ লগ্নে এসে হাজারো বিষন্নতা চেপে ধরে তাকে।যেতে ইচ্ছে হয় না।তবুও যেতে হয়। সূর্য ডুবে।সন্ধ্যা হয়।এমনটা হবেই।এটা প্রকৃতিক নিয়ম।কেউ এটাকে বদলাতে পারে না।তবুও প্রকৃতি হতে দিন টা বিদায় নিতে অনেক কষ্ট হয়।ভীষন কষ্ট। দিন যেতে চায় না।তবুও তাকে যেতে হয়।হাজারো কষ্ট হলেও যেতে ওকে হবেই।তাই সন্ধ্যা এতটা বিষন্ন হয়।সূর্য দিনের এমন কষ্ট দেখে নিজেকে রাঙিয়ে ফেলে।তারও যেতে কষ্ট হয়।এ পাশের প্রকৃতির মায়ায় পড়ে যায় সূর্য।তবুও তাকে যেতে হয়।তাই একেবারে রক্তাক্ত লাল হয়ে বিদায় নেয় এপাশের প্রকৃতি হতে।চলে যায় ওপাশে।ভোরের জন্যে অপেক্ষারত আরেক প্রকৃতির জন্যে।নতুন সূর্য হয়ে।এ পাশের সকল মায়া, ভালোবাসা ত্যাগ করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় অপাশের প্রকৃতিতে।কারো ভোরের সকাল হয় সে।কারো জীবনে আলো।
আমাদের মানুষদের কেও এমন কষ্ট সহ্য করতে হয়।অনেকগুলো কষ্ট সহ্য করে এপাশের মানুষটার দেওয়া সকল কষ্ট হতে বিদায় নিয়ে ওপাশে অপেক্ষারত অন্য কারো আলো হয়ে যেতে হয়।অন্য কারো ভোরের আলো হয়ে।কারো জীবনের আলো হয়ে যেতে হবে।
সূর্যটা এখনও অস্ত যায় নি।আর তিন কি চার মিনিটের মধ্যে অস্ত যাবে।আমি সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছি।কি অদ্ভুত। সকালে তার কি তেজ।তাকানোই যায়।কিন্তু শেষ লগ্নে?শেষ লগ্নে একেবারে তেঝহীন হয়ে বিদায় নিতে হয়।আমি কথা গুলো ভাবছিলাম সূর্যের দিকে তাকিয়ে।প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে থাকলাম।আমাকে সত্যিই আমার ওপাশের মানুষটির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।তার ভোরের আলো হতে হবে।কষ্ট থাকবেই।
এমন সময় খুট করে একটা আওয়াজ এল।আমার চোখ গেল শব্দের উৎসের দিকে।মিরুদের ছাদ থেকে শব্দটা এসেছে।দেখলাম ছাদের দরজা ঠেলে কেউ একজন এল।মিরু! কানে ফোন। কারো সাথে কথা বলছে নিশ্চই। আমাকে দেখতেই ফোনটা নামিয়ে ফেলল।আমার ঠোটের কোন মৃদু হাসি ঠাই পেল।কথা বলছে বলুক না।আমাকে দেখে আবার লুকিয়ে ফেলার মানে কি? ফোন কেটে আমার দিকে ফিরল।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। সূর্যটা প্রায়ই অস্ত চলে গেছে।এপাশ থেকে বিদায় নিল সে।ওপাশের তীক্ষ্ণ আলো হয়ে।আমি বিদায় নিলাম।এপাশের মানুষটার কাছ থেকে।অন্য পাশের কারো আলো হতে।চলে এলাম ছাদ থেকে।
.
আর যাই নি ছাদে। আর যাওয়ার ইচ্ছেও হয় নি। সেখানে কিছু সৃতি আছে।গেলেই কেবল কষ্ট দিবে।তাই যাওয়ার চেয়ে না যাওয়াই ভালো।সূর্যের লাল কষ্ট দেখি অনেক দিন।সন্ধ্যা প্রকৃতির কালো বিষন্নতা দেখি না আর।প্রিয় কিছু যায়গা ছিল।সেখানেই যাই নি অনেক দিন হয়েছে।সকাল বেলা অফিস যাই।ফিরি রাত আটটায়।বাকি সময়টা আবদ্ধ চারদেয়ালের মাঝে কাটে।পরিবারের সকলের সাথে ঠিক মত কথা হয় না।রাতে খুট করে দরজায় আওয়াজ হয়। আমি চোখ মুছে ফেলি।বালিশের উপর মাথা দিতে ঘুমের ভান করি।দরজা খুলে একজন প্রবেশ করে। যার গায়ের গন্ধটা আমার চিরচেনা।যার গায়ের গন্ধ আমার গায়ে লেগে আছে।মা এগিয়ে আসে।আমার পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আমি স্পষ্ট শুনতে পাই মায়ের মুখে আঁচল গুঁজে চাপা কান্নার আওয়াজ। আমার চোখ ভিজে আসে।আটকে রাখি।মা চলে গেলেই কান্না শুরু হয়।শব্দহীন কান্না।
সকালের শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি দেখি না অনেক দিন।ভোরের আলো গায়ে মাখি নি আর।ভোরের বাতাসও মাখা হয় নি গায়ে।দিন গুলো যেন কেমন করে কেটে যায়।
.
বাসার গেইট দিয়ে বের হতেই দেখলাম মিরুকে।নিজেদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রিক্সার জন্যে নিশ্চই।আমিও দাঁড়ালাম কিছু সময়।অফিস যাব।রিক্সার প্রয়োজন। আমি তাকালাম না মিরুর দিকে।তবে সে যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তিতে তো পড়বই।এর কিছু সময় পর মিরু আমার দিকে আসতে থাকল।আমিও আর দাঁড়ালাম না।হাঁটতে থাকলাম।বিপরিত দিকে।আর যাই হোক ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।ও কিছুটা দৌড়ে আমার সামনে আসল।আমি তখনও ওর চোখের দিকে তাকালাম না।নিচের দিকে তাকিয়ে অন্য পাশদিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।তাও হল না।মিরু সামনে এসে দাঁড়ায়।আমি যেদিকেই যাই ও সেদিকেই আমার পথ আগলে দাঁড়ায়।আমি স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।সেও স্থির হল।আমি ওর দিকে তাকালাম এবার। বললাম,
:সমস্যা কি আপনার? এমন করছেন কেন?
ও কিছু বলল না।আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল।আমি আবার বললাম,
:কি হল কথা বলছেন না যে?
এবারেও কোন উত্তর পেলাম না।আমিও আর কথা বললাম না।চলে আসতে চাইলাম।এবারেও পারলাম না।ও আমার পথ আগলে দাঁড়াল আবার।আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেল এবার। নিজেকে কোন ভাবেই স্থির রাখতে পারলাম না।ঠাশ করে একটা চড় মেরে দিলাম।ও গালে হাত দিয়ে আমার দিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি হয়ত।খুব কড়া স্বরে বললাম,
:দ্বিতীয় বার যেন আমার সামনে না দেখি।মাইন্ড ইট!
.
দিপার হুট করেই এমন আবদার করাটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগে নি।ও ঠিক কি করতে চাইছে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না।ওকে তো আমার সম্পর্কে সব বলেছি।তাহলে?
:কি হল! কি ভাবছ? চল!
দিপার কথাতে হুস ফিরে এল আমার।বললাম,
:হুম।চল!
দিপা একটা হাসি দিল।তারপর আমার হাত ধরে
সামনের দিকে এগুলো।রিক্সা পেতেই দুজনে উঠে গেলাম।ও তখনও আমার হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিল।
আসলে দিপা একটা আবদার করেছে।আজ সারা দিন ওর সাথে ঘুরতে হবে।ও আমার অফিসের কলিগ।আর আমার সম্পর্কে সব কিছুই ও জানে।তারপরেও ওর এমন আচরণ আমায় সত্যিই ভাবাচ্ছে।আমি জড়সড় হয়ে রিক্সায় বসে রইলাম।ও আমার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরল।আমাকে টেনে একেবারে ওর কাছে নিয়ে এল।খুব কাছে।একেবারে আমার গা ঘেসে ও বসল।তারপর আমার বাহুতে মাথা রাখল।ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা জিনিস চলে এল।দিপা কেন এমন করছে তার কারন এখন আমার কাছে স্পষ্ট। তাহলে কি দিপা আমার প্রতি উইক? নাহ্! এ হতে পারে না।তারপরেই একটা অবাক করা কান্ড ঘটল। এটাকে ঠিক কাকতালীয় বলা চলে। মিরু! মিরু এখানে কেন? এই সেরেছে।দেখে ফেলেছে আমাকে। রিক্সা চলছে।ঠিক তখনই দেখলাম মিরুকে।কোথা হতে যেন আসছে। আমাকে দেখার পরেই ওর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেল।দৌড়ে রিক্সার কাছে এল।রিক্সা থামাল আমার দিকে একটা রাগি লুক নিয়ে তাকাল।আমি একটুও নড়লাম না।ঠিক যেভাবে ছিলাম সেভাবেই বসে রইলাম।নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখলাম। যথাসাধ্য নরমাল থাকার চেষ্টা করলাম।আমাকে দেখে যেন মনে হয় আমিও বেশ খুশি।
এমন সময় মিরু বলে উঠল,
:এসব কি তাসফি?
আমি কিছু বলতে যাব আগেই দিপা বলে উঠল,
:এসব কি মানে? মাথায় কি সমস্যা আছে? কোত্থেকে আসছেন আর কি বলছেন?
:চুপ! একদম চুপ। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি নি।ওকে জিজ্ঞেস করেছি।ও উত্তর দিবে।
:ও যা বলবে আমিও তা বলব।আমিও যা বলব ও নিজেও তা বলব।তাই না তাসফি?
এই বলে আমার হাতের উপর হাত রাখল।এই দেখে মিরু তো আরো রেগে গেল।বলল,
:এই আপনি ওর হাত ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি। এই হাত ধরার অধিকারি কেবল আমি।আর কেউ না।ছাড়ুন!
:আমি ওর হাত ধরেছি।আর ধরেও রাখব।আপনি বলার কে!
:তাসফি ওকে হাত ছাড়তে বল।তা না হলে কিন্তু আমি লোক জড় করব।
নাহ্! অবস্থা বেগতিক। মিরুর যা রাগ।কি কান্ড বাধিয়ে ফেলে কে জানে? কিছু একটা করতে হবে।নিরুর দিকে বেশ কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
:সেই কখন থেকে আপনার এমন মিস বিহেব দেখে যাচ্ছি।কিন্তু সেটা আর সহ্য হচ্ছে না।পথ থেকে সরে দাঁড়ান।আমাদেরকে যেতে দিন।
:তাসফি তুমি...?
:স্টপ! অনেক হয়েছে।আমি আপনাকে চিনি না।হয়েছে? এবার তো পথ হতে সরে দাঁড়ান।মাম চলেন!
মিরু যেন শক খেল। আশ্চর্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না।ঠিক আমার সাথেও এমনটা হয়েছে সেদিন।আমার সেদিন ঠিক বিশ্বাস হয় নি কিছু।ভালো হয়েছে।উচিৎ শিক্ষা হয়েছে।
.
দিনটা বেশ ভালোই গেল।মন খানিকটা ফ্রেশ হল।কিন্তু সমস্যা হল মিরু! ওর জন্যে খুব খারাপ লাগছে।ওর সাথে এতটা বাজে বিহেব আমি আগে কখনই করি নি। তাই একটু খারাপ লাগছে।আফটার ওল আমি তাকে ভালোবাসি।ঠিক তখনই ফোনে একটা কল এল।খুব অবাক হলাম।মিরুর ফোন।মিরু কেন আমাকে ফোন দিবে? ওর তো আমাকে ফোন দেওয়ার কথা না।কলটা কেটে গেল।আবার এল! কলটা কেটে দিলাম।টুপ করে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম।ওর শিক্ষা হওয়া দরকার।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ওর সাথে তো আমার ব্রেক আপ হয়েছে।এটা ও নিজেও জানে।এমনকি আমিও জানি তাহলে এমন করছে কেন? এমন সময় আমাদের কলিংবেল বেজে উঠল।কিছু সময় পর কারো গলার আওয়াজ পেলাম। মোটেও স্থির মনে হল না।কিছু একটা হয়েছে।যিনি এসেছেন তিনি ঠিক মত কথা বলতে পারছেন না।আমি বসার রুমে গেলাম।মিরুর বাবাকে দেখলাম।তার গা ঘামে ভিজে আছে।খুব অস্থির দেখাচ্ছে উনাকে! আমি কিছুটা অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম।বাবা মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আমি মিরুর বাবার সাথে এলাম।মিরুদের বাসায় প্রবেশ করলাম একসাথে! মিরুর মাকে দেখলাম মুখে আঁচল গুজে সোফায় বসে আছে।রুমের বাইরে কজন লোককে দেখলাম। এই বাড়িরই নিশ্চই।
মিরু নাকি সেই দুপুরে যে রুমের দরজা আটকিয়েছে এখনও খোলে নি।কিছু খায়ও নি।ফোনটাও বাইরে রেখে গেছে।ওর একটাই কথা! আমি আসলে নাকি দরজা খুলবে।এর আগে নো দরজা খোলা নো খাওয়া দাওয়া।
আমি এমন কথা শুনার পর আশ্চর্য হলাম ভীষন। যেই মেয়ের সাথে আমার ব্রেক আপ হল সেই মেয়েই আজ আমার জন্যে না খেয়ে আছে।না খেয়ে থাকার কারনটা জানি।তবে ওর এমন আচরণে অবাক হচ্ছি।আজকে দিপার সাথে দেখে হয়ত সহ্য করে পারে নি।মেয়েটার শিক্ষা হওয়া উচিৎ। মিরুর বাবা বলার কারনে এখানে আজ আসলাম।তা না হলে মিরুর প্রতি আমার যে রাগ তা এত সহজে শেষ হবার নয়।আমার দ্বায়ীত্ব হল মিরুকে ডাক দেওয়া এবং দরজা না খোলা অব্ধি আমাকে এখানে থেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা কর।এত টুকুতেই নাকি মিরুর বাবা খুশি। তিনি মেয়েকে একবার ফিরে পেলেই হয়েছে।
মিরুর মা-বাবা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।আমি দরজায় বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিলাম। বললাম,
:মিরু...!
এর পরে হুট করেই একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল।আমি শুধু "মিরু" বলে ডাকতেই দরজা খুলে গেল।মনে হচ্ছে ও দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।আমি ডাকতেই দরজা খুলল।কিছু বুঝে উঠার আগেই মিরু আমার শার্টের কলার টেনে রুমের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলল।ওর বাবা-মা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিরু তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
:বাবা জলদি করে কাজী সাহেবকে ডাক দাও। আমি আজই বিয়ে করব।আর তা যদি না হয় তাহলেই এই দরজা আজীবনেও খুলবে না।এই বলে দিলাম কিন্তু।
তারপর ঠাশ করে দরজা বন্ধ করে দিল।আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল।কি হচ্ছে কিছুই মাথায় খেলছে না।ও দরজা আটকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমাকে একেবারে চিবিয়ে খাবে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।ও যতই এগিয়ে আসছে আমি ততই পিছিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ ই আমার পিঠ দেয়ালের সাথে ঠেকে গেল।আমার পিছনে যাবার উপায় নেই। মিরু একেবারে এগিয়ে এসে একেবারে আমার সামনে দাঁড়াল। হুট করে আমার গলা চেপে ধরল।আমার তো দম আটকে যাবার উপক্রম। ও গলা চেপে ধরে বলল,
:আমাকে আপনি করে বলিস তাই না! আমাকে চিনিস না! এমন একটা ভাব করলি যেন আমাকে আগে কখন দেখিসই নি। রিক্সায় মেয়েদের সাথে গা ঘেসাঘেসি করে বসা।খুব চালাক হয়েছিস না!এসব কেন করেছিস বল।কেন আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।দাঁড়া
এই বলে ও আমাকে মারতে শুরু করল।আমি ওর দুহাত ধরে ওকে থামিয়ে দিলাম। ওর দিকে খুব রুক্ষ মেজাজে তাকালাম।বললাম,
:এসব কেন করছ? প্রশ্নটা আমার করা উচিত!আপনার না। কেন? এমন করছেন আপনি? কেন আমার পিছন পড়ে আছেন? একদিন আপনিই তো বিদায় নিলেন।তাহলে আজ কেন আবার ফিরে আসতে চাইছেন?
:চুপ! একদম চুও।আমাকে যদি আর আপনি করে বলছ তাহলে একেবারে খুন করে ফেলব।
:পর কে আপনিই করেই বলতে হয়।
:কে পর! আমিই?
:জি! আপনি পর।
:প্লিজ! তাসফি এমন করিও না।আমার কষ্ট হয়।প্লিজ! তুমি জানো তুমি আমার জন্যে কি! বল! তুমি জান না?
:আপনি আমার কেউ না।পথ ছাড়ুন।আমাকে যেতে দিন।
:কোথায় যাবে? ওই মেয়েটার কাছে? হুহ! এত সহজ না।এখান থেকে এক পাও এদিক সেদিক করবে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।আর বেশি তালবেতাল করলে কিন্তু খবর আছে।
:হাহ! দেখি আপনি কি খবর করতে পারেন।আমি যাবই?
এই বলে আমি সামনে কেবল এক পাঁ দিলাম।ঠিক তখনই ও আমাকে এক ধাক্কা দিল। আমার পিঠ ঠেকল গিয়ে দেয়ালে। তারপর হুট করে আরেকটা অবাক করা কান্ড ঘটে গেল। মিরু আমাকে চট করেই একটা চুমু খেল।কতক্ষণ যে ঘোরের ভিতর ছিলাম তা আমার ঠিক জানা নেই।কেবল মনে হতে থাকল যে কারো ঠোট জোড়ার মাঝে যে এত স্বাদ লুকিয়ে থাকে। এ আমার জানা ছিল না। সত্যিই জানা ছিল না।চুমু খেয়েই ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ঠিক তখনই আমি একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম।মিরু আমাকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
:তাসফি ! আমি কেবল চেয়েছি তোমাকে যেভাবেই হোক প্রথমে বিয়ে করতে।তারপর নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে আমার করে নিতে।
:যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে কেন আমার সাথে এমন করলে? কেন? কেন আমার স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিল সেদিন।আমার রঙিন স্বপ্ন গুলো কেন তুমি জ্বালিয় ছাই করে দিলে।তারপর! তারপর আমাকে আমার পরিবার থেকে আলাদা করলে।চার দেয়ালের মাঝে আমাকে বন্ধি করে রাখলে কেন? কেন আমায় এত কষ্ট দিলে।এই ছিল তোমার ভালোবাসা? আর এখন? এখন যেই না রিক্সায় আমার সাথে কাউকে দেখলে অমনি জ্বলে উঠল তাই না।আমি সুখে আছি এটা সহ্য করতে পার না। তাই না? কেন? কেন এমন হবে।কেন আমার সুখের বাধা হয়ে দাড়ালে তুমি।আমি ভালো থাকি এটা কেন তোমার সহ্য হয় না?
:কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি তাসফি! ভীষন ভালোবাসি তোমাকে।
:হুহ! ভালোবাসা? এমন ভালোবাসাকে আমি ঘৃনা করি।
:প্লিজ তাসফি? এসব বলিও না।আমি মানছি আমি ভুল করেছি।আসলে সেদিন প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলাম।রেগে গিয়ে কি না কি বলেছি সেটা আমি নিজেও জানি না।তুমিও তো জানো রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।সব আবোলতাবোল বলা শুরু করে দেই। প্লিজ তাসফি! আমাকে বোঝার চেষ্টা কর?
আমি কিছু বললাম না।মিরুর ছলছল করতে থাকা চোখ গুলোর দিকে তাকালাম কয়েকবার। সেই চোখ স্পষ্ট বলছে সে আমাকে ভালোবাসে।আমি ওর চোখের ভাষা ঠিকই বুঝতে পারছি।ও আবার বলল,
:তুমি জানো না এর পর থেকে আমার দিন গুলো কিভাবে কেটেছে।নিজের প্রতি এতটা ঘৃনা হল যে ভয়ে তোমার সামনেও আর আসি নি।কোন মুখ নিয়ে আসতাম বল? কোন মুখ নিয়ে।আমি প্রতিটা মূহুর্তে তোমাকে মিস করেছি।তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো মনে পড়ত কেবল।তোমার গালের টোল গুলো কে মিস করতাম।তোমার হাসিটাকে।আর সবচেয়ে মিস করতাম তোমার "মিরু " বলে ডাকটা।জানো সেদিনের পর থেকে কেউ আমাকে এই নামে ডাকে নি।আমার এই নামে ডাকটা শুনতে খুব ইচ্ছে হত। কিন্তু কেউ ডাকয় না।
আমি আর চুও থাকলাম না।বললাম,
:তুমি যদি সেদিন আমার সাথে এমনটা না করতে,যদি একবার বুঝিয়ে বলতে তাহলে আমার ওই মিতু কে বিয়ে করতে যেতে হত না।সেখানে গিয়ে এত কষ্ট নিয়ে ফিরে আসতে হত না।আর মিতু! বেয়াদব একটা মেয়ে! প্রেম করে আমাকে আগে বললেই তো পারত।না! ও সেটাও করে নি।হাতের কাছে পেলে দিতাম একটা। আজ যদি সে বিয়ে করতে তাহলে আমরা আজ থাকতাম হানিমুনে।
:চুপ! একদম চুপ! তোমার হানিমুন হবে আমার সাথে।না মিতুর সাথে আর না ওই রিক্সায় থাকা মেয়েটার সাথে।এত দূর এসে আমি হেরে যেতে চাই না!
:মানে?
:তুমি কি ভেবেছ! সকল কষ্ট বুকে নিয়ে ওই মিতুকে বিয়ে করে সুখে থাকবে আর আমি এখানে বসে
বসে তামাসা দেখব? এতটা বোকা আমি নই। নিজের কুবুদ্ধির কারনে আমি তোমার ভালোবাসা হারাতে চলেছি।তোমাকে হারতে চলেছি।তারউপর তুমি বিয়ে করবে মিতুকে! যে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাবে।আমি কখনই তোমার পাশে কোন মেয়েকে মেনে নিতে পারি নি আর পারবও না।তোমার পাশে থাকব কেবল আমি।আর কেউ না।তুমি আমার।আর তোমার সাথে বাসর হবে আমার।আর তাই যখন নিজের সুবুদ্ধি উদয় হল তখন আর চুপ থাকি নি।সময় মত কাজটা সেরে ফেলি।
এই বলে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।একটু থামল।আমি আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।বললাম,
:মানে? কি বলতে চাইছ একটু ক্লিয়ার করে বল! কি কাজ সেরেছ?
:মিতুকে সরিয়ে দেই।
:মানে?মিতুর বফের কাছে তুমিই ওকে পঠাইয়েছ।ওদের পালিয়ে যেতে তুমিই সাহায্য করেছ?
:হুম। আমার পথের কাটাও দূর হয়ে যায়।কিন্তু আজকের ওই বজ্জাত মাইয়াটা আমার সব কিছু বিগড়ে দিল।তারউপর তোমার এমন ব্যবহার! আমার সহ্য হল না।আমার মনে হতে থাকল যে আমি যদি তোমায় এখন বিয়ে না করি তাহলে তোমাকে হারিয়ে ফেলব।সারা জীবনের জন্যে হারিয়ে ফেলব।তাই আজকের এই পরিকল্পনা।
:তুমি কি ভেবেছ।আমি আজ বিয়ে করব। তাও আবার তোমাকে? তুমি এটা ভাবলে কি করে?
:মানে? তাসফি তুমি এসব কি বলছ?
:যা শুনছ তাই! খাঁটি বাংলায় বলেছি। আমি তোমাকে বিয়ে করব না।করতে পারব না।তোমার জন্যে আমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।এখন তুমি কষ্ট পাও! শিক্ষা নাও।
ও আমার সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে গেল।বলল,
:প্লিজ। এমন করিও না তাসফি। প্লিজ! আমি সহ্য করতে পারব না।
:তোমাকে সহ্য করতে হবে মিস. মিরা।
:প্লিজ...
এই বলে ও কান্না শুরু করে দিল।ঠিক তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠল। দিপা! দিপা ফোন করেছে।আমি মিরুর সামনে ফোনটা ধরলাম।বললাম,
:দেখ!
এটা দেখার পর তো তার অবস্থা খারাপ। চিৎকার দিতে কেঁদে উঠিল।আমি বললাম,
:চুপ! একদম চুপ।জোরে কান্না করিও না।আশেপাশের মানুষ খারাপ ভাববে।হা হা হা!
এই বলে আমি ওর সামনে থেকে উঠে এলাম।ফোনটা ধরলাম।মিরু আমার পিছনে কান্না করছে।হাত পাঁচেক দূরে হবে।ফোন ধরতেই,
:হ্যালো! ভাইয়া কেমন আছেন?
:ভালো তোমার কি অবস্থা?
:বেশি ভালো না।আমি আপনার কাজটা করেছি।কিন্তু আপনি আমার কাজটা এখনও করেন নি।বাই দা ওয়ে ভাবির কি অবস্থা! কাজ হয়েছে?
:আরে! প্লানটা কার দেখতে হবে না।কাজ না হয়ে কই যাবে? বিয়ে করতে চলেছি কিছুক্ষনের মাঝে।
:ভাইয়া! আপনার তো একটা হিল্লে হয়ে গেল।আমার জন্যে কিছু করেন না।সাদিককে বলেছেন?
:তুমি এক কাজ কর দিপা। আমি তোমাকে একটা এড্রেস মেসেজ করছি। এই এড্রেসে চলে এস।এখানে আমার বিয়ে হবে।সাদিকও আসবে।আর আমার মনে হয় সাদিকও তোমাকে ভালোবাসে।
:আল্লাহ যেন আপনার কথাটা কবুল করে।আমিন।রাখি ভাইয়া।জলদি মেসেজ পাঠান।আমি আসছি।
:বাব্বাহ! তা তুমি কি ওকে খুব ভালোবাস?
:প্রমন দিতে হবে?
:হা হা হা।আচ্ছা রাখি।
.
আমি ফোন কেটে মিরুর দিকে তাকাতেই দেখিলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম যে ওর ডান হাতে একটা ব্লেড! আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম।হস্তদন্ত হয়ে ওর দুই হাত দেখলাম।নাহ্ ! এখনও হাত কাটে নি।যাক।বাঁচা গেল।মিরুর দিকে তাকাতেই দেখলাম সে চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বললাম,
:এএএভাবে তাকিয়ে আছে কেন? কি হয়েছে?
ও দুহাত ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
:আমাকে ভালোবাস না।আমাকে ঘৃনা কর?।আমাকে বিয়ে করবে না।
এগুলো তো তুমিই বলেছ তাই না! 
এই বলে ও আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল।
:এএএভাবে বলছ কেন?আর এভাবে এগিয়ে আসছ কেন?
ও সেটা ভ্রুক্ষেপই করল না।বলল,
:তাহলে এগুলো সব তোমার প্লান ছিল।
:আরে নাহ! মাথা খারাপ নাকি।আমি কোন প্লান টান করি নি।যা করেছে ওই সাদিক করেছে।আর তাছাড়া  আপনি যদি প্লান করতে পারেন তাহলে সাদিক পারব না কেন?
:আবার আপনি?
:সরি সরি।তুমি।এই দেখ! তুমি করে বলছি।
:হুহ।কেবল বিয়েটা করে নেই।তারপর দেখ তোমার কি হাল করি।আমার সাথে টক্কর দিছ তাই না।দেখ এবার।কেবল বিয়েটা হতে দাও।
এই বলে ও আমার হাত ধরে বসার ঘরের দিকে এগুলো। দরজা খুলতেই দেখলাম বাবা মা আর মিরুর বাবা মা কি মজা করছে।হাসি তামাসা করছে।বেয়াই বলে ডাকছ।হুট করেই চোখ গেল টুপি, পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার উপর।তার সামনে একটা বিশাল বই।সরি খাতা।না! আমি জানি না ওটা কি।তবে এটা যে ছেলেদের জিবন তেজপাত করার প্রথম ধাপ সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না।
মিরুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছে কেবল কবুল বলতে বাকি।তারপরই সে আমার উপর আক্রমন করবে।আল্লাই জানে।সামনে কি হবে।তবে মিরুকে দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যিই আমার খবর করে ছাড়বে। অবশ্য এটা খারাপ কিছু না।বউয়ের আদর পাওয়া যাবে বেশি।খবর করলে করুক।তার বদলে যদি একটু ভালোবাসা পাই তাহলে ও আমার যতই খবর করুক না কেন এতে বিন্দুমাত্র অনিচ্ছা নেই। বরং আমিও চাইব যেন সে আমার খবর করুক।


ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমদ

Next Post Previous Post
4 Comments
  • Shawal Hossain Tamim
    Shawal Hossain Tamim ৫ অক্টোবর, ২০২০ এ ৩:১০ AM

    Amazing

    • Author
      Author ৫ অক্টোবর, ২০২০ এ ৮:০৮ AM

      ধন্যবাদ

  • Unknown
    Unknown ৭ অক্টোবর, ২০২০ এ ৯:২৭ AM

    দারুন একটা গল্প ছিল, লেখকের প্রতি অনুরোধ এরকম আরো গল্পের লিংক শেয়ার দিলে ভালো হবে।

  • Author
    Author ৭ অক্টোবর, ২০২০ এ ১০:৩৫ PM

    ধন্যবাদ

Add Comment
comment url