গল্পঃ বেলা ফুরিয়েছে
তাসফি আহমেদ
রফিক সাহেব বারান্দায় এসে বসলেন। বসতেই উনার মনে হলো,উনি যেন কোনো ঝাপসা গোলকের মাঝে বসে আছেন। কুয়াশা পড়ছে ভীষণ। ঘন কুয়াশা লেপ্টে আছে চারিপাশে। বাড়ির সামনের গাছ গুলোর ঢালের ফাঁকে ফাঁকে দলা ধরে লুকিয়ে আছে তারা। বারান্দার চেয়ারটাতে বসতেই একঝাঁক শীত আলিঙ্গন করে নিলো উনাকে। তিনি সেটা ঠিক টের পেলেন না। গায়ের ভারী সোয়েটার সে আলিঙ্গনকে টের পেতে দিলো না। উনি সোয়েটারটার দিকে তাকালেন একবার। নতুন সোয়েটার। অনিম সেদিন কিনে দিয়েছিল। আজ পরেছেন। শীতটা বেশ তীব্রভাবে পড়ছে। এমন শীতে থুরথুরে রোগা বুড়ো গুলো ওপারে চলে যায়। উনি অবশ্য থুরথুরে বুড়ো নন। তবে দিনদিন যে বুড়িয়ে যাচ্ছেন সেটা ঠিক টের পাচ্ছেন। এমনভাবে হয়তো একদিন থুরথুরে বুড়ো হয়ে যাবেন তিনি। তা তিনি আজকাল মৃত্যুটাকে খুব করে চাচ্ছেন। এই পৃথিবীর প্রতি উনার বিষাদ জমে গিয়েছে অনেক। ভালো লাগে না আর। অসহ্য লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এখন কেবল বিধাতার দিকে মুখিয়ে আছেন মৃত্যুর জন্যে। তার অপেক্ষায় বেলা পার হয়। এদিকে এই শীতের কষ্টটা উনার সহ্য হচ্ছিল না। কাশি একবার ধরলে ছাড়তে চায় না। ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে যায়। নাকের পানি পড়ে। চোখ জ্বালা করে। চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। মাথা ভার হয়ে থাকে। এই অশুভ রোগ গুলো ধরলেও আর ছাড়তে চায় না সহজে। উনার শরীরটা ইদানিং বেশ রোগা হয়ে গিয়েছে। হাঁটতে চলতে বল পান না। রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা একেবারেই মরে গেছে। অথচ যৌবনে এসব রোগকে ঠিক রোগ বলে গন্য করতেন না। হেসে খেলে উড়িয়ে দিতেন। আর এখন কাশি এলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। পেটের নাড়ি বুড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। এসব ভালো লাগে না আর। তাই বাধ্য হয়ে সুয়েটারটা পরলেন। তবে এই সুয়েটারটা পরার কোনো ইচ্ছেই উনার মাঝে ছিল না। কেবল দায়ে পড়ে পরেছেন। না পরতে চাওয়ার কারণটা মনে পড়তেই উনি বারান্দার একগাদা শীতের ভীড়ে বসে খানিকটা উষ্ণতা অনুভব করলেন। রাগের চোটে কানের গোড়া গরম হয়ে যাচ্ছিল। নিজে না খেয়ে না পরে ছেলেকে খাইয়েছেন,পরিয়েছেন। আজ সেই ছেলেই কী না উনার সাথে এমন করছে? এমন খারাপ আচরণ করছে? মুখের উপর কথা বলছে? আচ্ছা আজ যদি উনার কাছে অনেক টাকা থাকত তাহলে কি অনিম এমন করত? এত হেয় করত? আজ বুড়ো হয়ে গিয়েছেন বলে কি এমন করছে? নিজেদের বোঝা ভাবছে? তাহলে কি এই ছিল উনার এত কষ্টের ফল? ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে কি খুব ভুল করে ফেললেন? উনি আর ভাবতে পারলেন না। কষ্টে উনার বুক ফেটে আসতে চাইছিল। খুব কান্না আসছিল। এক বুক কষ্ট নিয়ে উনি সামনে তাকালেন। সামনের দিকটা তখন ভীষণ ঝাপসা লাগছিল উনার কাছে। ঘোলা ঘোলা লাগছিল। সেটা কুয়াশা নাকি নিজের চোখে জল জমে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেটা তিনি ঠিক টের পেলেন না। ইদানিং তিনি চোখে খানিকটা ঝাপসা দেখেন।
.
সেদিন সন্ধ্যের কথা। রফিক সাহেব নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। পাশে উনার স্ত্রী সেলিনাও ছিল। সেলিনাও ইদানিং রোগা হয়ে গিয়েছেন। খুব একটা হাঁটতে পারেন না। যাও পারেন তাতে কুঁজো হতে হয়। কুঁজো হয়ে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। কোমরে যন্ত্রণা করে। আবার না হাঁটলে ডায়াবেটিস সীমারেখা লঙ্গন করে। তাই কষ্ট করে হলেও হাঁটেন। কাজ কর্ম করার চেষ্টা করেন। এতে একটু হলেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। অবশ্য আজকাল তাও ঠিক ভাবে হয়ে উঠে না। রফিক সাহেব যখন স্ত্রীর সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে কথা বলছিলেন তখন অনিম ঘরে ঢুকে। ওর হাতে তখন দুটো সুয়েটার ছিল। একটা মায়ের জন্যে, অন্যটা বাবার জন্যে। অনিম হাসি মুখেই সুয়েটার দুটো দিল। উনারাও নিলেন। ছেলের সাথে খানিকক্ষণ খোশগল্প করলেন। এতে দুজনেরই ভালো লাগছিল। অনিমের কেমন লাগছিল সেটা বুঝতে পারছিলেন না রফিক সাহেব। তবে ছেলের মুখের হাসি দেখে বুঝলেন যে সে খুশি আছে। তাই খানিকটা হেসেই বললেন,
"বাবা,তোর মায়ের ডায়াবেটিস আর প্রেশারের ঔষধ গুলো শেষ হয়ে গিয়েছে। আর শ্বাসকষ্টের জন্যে যে ঔষধ গুলো ছিল তাও ফুরিয়ে গিয়েছে। কাল যদি এনে দিতি!"
কথাটা শোনা মাত্রই অনিমের মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। ওর ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেল দ্রুত। ভ্রু কুচকে এল।
"কী ব্যাপার বাবা, সেদিন না ঔষধ আনলাম?"
"তা এনেছিস। তবে সেদিনটা মাসের এক তারিখ ছিল। আজ ত্রিশ তারিখ। ঔষধ এনেছিস পনেরো দিনের। সে পনেরো তারিখেই শেষ। আজ পনেরো দিন হলো ঔষধ নেই। তোর মায়ের শ্বাসকষ্টটা বেড়ে গেছে। এখন ঔষধটা খুব দরকার।"
"ধ্যাত! কথাটা আগে বলতে পারতা না বাবা। আমি সুয়েটার না এনে ঔষধ নিয়ে আসতাম। এখন ঔষধ আনি কীভাবে?"
উনি খানিকটা হেসে দুষ্টুমির স্বরে বললেন,
"তোর কি টাকার অভাব নাকি রে?"
অনিম মুখ বিকৃতি করে চোখ গরম করে তাকায় বাবার দিকে। রফিক সাহেবের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা চট করেই পরিবর্তন হয়ে যায়। উনি হতভম্ব হোন ছেলের এমন চাহনি দেখে। সত্যি বলতে উনার খানিকটা ভয়ও হচ্ছিল।
"অভাব মানে? এই যে খাও,পরো- এসবের টাকা দেয় কে? তুমি দাও? কোনোদিন দিয়েছো দু'টাকা? কেবল বোঝা হয়ে বসে আছো মাথার উপর।"
রফিক সাহেবের তখন খুব খারাপ লাগছিল। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল বারবার। তিনি বোকার মতো চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। যেন এতদিনের চেনা ছেলেকে বড্ড অচেনা লাগে। অনিমটা আগে এমন ছিল না। হুট করেই কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে ও। উনি বুঝতে পারেন না। ছেলেকে বোঝাতে পারেন না। ছেলে বুঝতে নারাজ। রফিক সাহেব ভাবলেন একবার বলবেন যে আমার সব টাকা তো তোর পিছনেই শেষ হয়েছে। জমানো সব টাকা তুই নিজ হাতে খরচ করেছিস। আর আজ বলছিস আমি এক টাকাও দেইনি? কীভাবে ভুলে গেলি সব? উনি বলতে পারলেন না। চুপ করে থাকলেন। অন্যদিকে ফিরে তাকালেন। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা কথা গুলো একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। বললেন,
"দেখ, বাবা কী করতে পারিস। পারলে দ্রুত নিয়ে আসিস ঔষধ গুলো। মা বাবা তোর আর পর না। আর চাইলেই তো তাদের ফেলে দেওয়া যায় না।"
"এখানেই তো সমস্যা বাবা। চাইলেই ফেলে দেয়া যায় না।"
এই বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল অনিম। রফিক সাহেব রোবটের মতো বসে থাকলেন। উনার নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হলো। নির্লজ্জ মনে হলো। নিজের সন্তানের কাছে এই বয়সে এমন ভাবে অপমানিত হতে হবে সেটা ভাবতেও পারেননি উনি। উনার চোখটা খানিকটা ভিজে আসল। সেটা মুছে আধশোয়া স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সেলিনা বেগম তখন একদৃষ্টিতে স্বামীকে পরক্ষ করছিল। তাঁর বৃদ্ধ চোখ গুলো স্বামীকে বুঝতে চাচ্ছিল। স্বামীর কষ্টের ভাগ নিতে চাইল। সেলিনা বেগমের বড্ড মায়া হলো এই বৃদ্ধটির জন্যে। ছেলের এমন ব্যবহার তাঁর ভালো লাগেনি। অনিম এভাবে কেন বাবার সাথে বলল? উনি ভেবে পেলেন না। কষ্টে উনার চোখ দুটো ভিজে আসতে চাইলো। উনি খানিকটা উঠে বসতে চাইলেন। ঠিক তখনই উনার কাশি শুরু হলো। রফিক সাহেব উনাকে ধরে বসাতেই বললেন,
"পানি খাবে?"
উনি মাথা নাড়লেন। কাশির কারণে কথা বলতে পারছিলেন না। রফিক সাহেব পাশের টেবিল থাকা জগে হাত দিতেই দেখলেম তা সম্পূর্ণ খালি। উনি পানির জন্যে রুম থেকে বের হলেন। ডাইনিং রুমের পাশেই ছেলের রুম। ওখানে যেতেই শুনলেন,অনিমের স্ত্রী ইশা বলছে,
"ভালো হয়েছে। একদম ভালো হয়েছে। কে বলেছি পন্ডিতি করতে। এতো দাম দিয়ে সুয়েটার কিনার কি দরকার ছিল? কে বলল কিনতে? উনাদের আগের গুলো তো ভালোই আছে। কেন কিনতে গেলে? এখন বোঝো? বোঝো কীভাবে কী করেব।"
ছেলে বলল,
"আশ্চর্য, আমি কী জানতাম এমন হবে? ঔষধের কথা তো আমার মনেই নেই।"
"তা থাকবে কেন? কোনো দিকে খেয়াল রাখো? মাসের শেষ হলো এখন। বাজার-সাজার যে লাগবে তার খেয়াল আছে?"
"বলছি তোমার গহনাটা পরে কিনলে হয় না? আমি পরের মাসে কিনে দিবো শিওর। তখন কোনো সমস্যা হবে না।"
"তুমি আর তোমার বাপ,একেবারে একই রকম হয়েছো।কুঞ্জুসের মতো। হাড় কিপ্টে। আর কত মাস ঘোরাবে? সারাদিন তো দাসির মতো খাটাও। কিচ্ছু বলি না। এখন কেবল একটা আবদার করেছি তাও যদি পূরণ করতে পারো তাহলে তুমি কেমন স্বামী হলে? শোনো,আমি অতশত বুঝি না। আমার নেকলেস লাগবেই। কালকের মাঝেই কিনে দিতে হবে। তা না হলে এই সংসার এখানেই থেমে যাবে দেইখো।"
"কী জ্বালায় পড়লাম। এখন যে কী করি!"
"যেটা করতে বলি সেটা শুনলে আজ এমন হতো না। আরো ভালো কিছু হতো।"
অনিম কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,
"কী করতে বলছো?"
"ওই আপদ দুটোকে বিদায় দাও। দেশে বৃদ্ধাশ্রম আছে অনেক। পাঠিয়ে দাও। বোঝা কমবে।"
অনিম খানিকটা সময় চুপ থেকে বলে,
"দেখি,কী করা যায়।"
.
শেষের কথাটা মনে হতেই উনার গা কেঁপে উঠল। গা জ্বলে গেল যেন। অসহায় দেখে আজ প্রতিবাদ করা হয়নি। দূর্বল দেখে সন্তানকে চড় দিয়ে বলা হয়নি ভুল করছিস। উনাকে নড়তে দেখেই পাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
"কী হয়েছে?"
উনি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলেন উনার স্ত্রী পাশের চেয়ারে বসে আছেন। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রফিক সাহেব ঘন কুয়াশার ভীড়ে চোখ রেখে বললেন,
"কিছু না। তুমি এখানে কী করছ? ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো?"
"আর ঠাণ্ডা! লাগুক না। কীবা হবে আর।"
"এসব বলো না। রোগ হলে বুঝবে। যাও, রুমে গিয়ে শুয়ে থাকো।"
"এত বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকার অভ্যাস নেই আমার।"
"এত বেলা মানে? ক'টা বাজে?"
"নয়টা বাজে দেখলাম।"
"বল কী! এত সময় হয়ে গেল? আজ কুয়াশাটা বেশিই পড়ছে। টেরই পেলাম না যে কখন এত বেলা হয়ে গেল। এদিকে সেই কখন বউ মাকে চা দিতে বললাম। দিয়ে গেল না!"
"ব্যস্ততার কারণে ভুলে গেছে মনে হয়। দাঁড়াও আমি দেখছি।"
এই বলে সেলিনা খানিকটা কুঁজো হয়ে চলে গেলেন বারান্দা থেকে। রফিক সাহেব বসে থাকলেন চুপ করে। সেলিনাকে রাতের কথাটা বলা হয়নি। শুনলে ওর মন খারাপ হবে। খাওয়া মুখে নিবে না। রফিক সাহেব নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলেন। উনার কিছুই ভালো লাগছে না। এই পৃথিবীটাকে বড্ড পর পর লাগছে। মনে হচ্ছে একটা কষ্টের গোলকের ভিতরে বাস করছেন উনারা। অসাড় লাগছে সবকিছু। হঠাৎই বউমার ভয়ার্ত গলা ভেসে এল।
"আরে এতো চা চা করছেন কেন? দিতে সময় লাগে না? কত কাজ করতে হয়। পুরো সংসারের কাজ করতে হয় আমার একা। এরপরেও কী এক কাপ নিজে বানিয়ে খেতে পারেন না? সব কি আমাকেই করতে হবে? আমাকে দাসি পেয়েছেন? দাসি মনে হয়?..."
কথা গুলো কানে আসতেই রফিক সাহেব অনুভব করলেন যে উনার চা খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গিয়েছে। খেতে মন চাইছে না। উনি উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পাঁয়ে ভারী শরীর টেনে নিয়ে গেলেন আলমারির কাছে। আলমারি খুলতে খুলতে উনার মনে হলো এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকলে উনার দম বন্ধ হয়ে আসবে। উনি মারা যাবেন।
.
বৃদ্ধাশ্রমে এসে সময় ভালো কাটলেও পরিবেশটা পছন্দ হয়নি রফিক সাহেবের। স্বভাবতই উনি খুঁত খোঁজার মতো মানুষ। অনিয়ম পছন্দ নয়। পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু এখানে এসে এসব জলাঞ্জলি দিতে হলো। যাক তবুও আজকাল বউমার কড়া কথা শুনতে হয় না,ছেলের চোখেমুখে তীব্র অবহেলা দেখতে হয় না। নিজেকে কারো বোঝা মনে হয় না। এই তো! বেশ ভালোই চলছে। তা রেহানা বেগম মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি করেন। এক মাত্র নাতিকে না দেখে থাকতে উনার কষ্ট হচ্ছে। রোহানকে না দেখে রফিক সাহেবও কষ্ট পান। তবুও কী আর করার। ভাগ্যকে মেনে নেয়াই যে শ্রেয়। তা এখানে শীতটা খুব একটা অনুভব হয় না। একটা ছোট্ট রুমে থাকেন উনার। একটা জানালা কেবল। তা বন্ধ করে দিলে শীতেরা আর ঢুকতে পারে না। তাই শীত অনুভব হয় না। অবশ্য অনিমের দেওয়া সোয়েটারটা নিয়ে এসেছে সাথে। একবার ভাবলেন রেখে আসবে। পরে আবার কী ভেবে জানি রেখে এলেন না। এখানে মাঝে মাঝে একটা মেয়ে আসে। নাম তনিমা। তনিমা ডাক্তারী পাস করেছে বছর হলো। সে প্রায়ই আসে এখানে। এই পনেরো দিনে প্রায় পাঁচ বার এসেছে। সেলিনাকে দেখে যায় প্রতিবারই। ঔষধ দিয়ে যায়। মেয়েটা ভীষণ ভালো। ভদ্র স্বভাবের। রফিক সাহেবদের খেয়াল রাখে খুব। বেশ মিশুক। যাক! ভালোই যাচ্ছে উনাদের দিন গুলো। কেবল মাঝে মধ্যে সন্তানের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিদানে কথা মনে পড়লেই বেশ মন খারাপ হয় উনার। কষ্ট জমাট বাঁধে বুকে। তা কেবল মুখ বুঁজে সহ্য করে যান তিনি।
.
বিকেল বেলা। সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। অনিম বারান্দায় বসে আছে। বসে বসে কিছু একটা ভাবছে। কিছু সময় পর ইশা এলো দু'কাপ চা নিয়ে। অনিমের পাশে বসল। বলল,
"এই নাও চা।"
অনিম ভুলো মনে চায়ের কাপটা হাতে নিল। সেটা ইশা চোখে বাধলো। ও বলল,
"কী ব্যাপার অনিম? কী হয়েছে?"
অনিম অবচেতনে উত্তর দেয়,
"হু?"
"কী হয়েছে?"
"নাহ! কিছু না। রোহান কই?"
ইশা কেমন করে যেন তাকাল। সেভাবে তাকিয়ে থেকে বলল,
"ঘুমোচ্ছে।"
"এখন কেন ঘুমাচ্ছে?"
ইশা পূর্বের ন্যায় তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। তা দেখে অনিম বলল,
"কী ব্যাপার? এভাবে কী দেখছো?"
ইশা সেই কেমন করে তাকিয়ে থেকে বলল,
"তোমার কিছু একটা হয়েছে। যা নিয়ে তুমি খুব চিন্তিত। কী হয়েছে, আমাকে কি তা বলা যায়?"
অনিম কিছু সময় ইশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকালো। বলল,
"বাবা-মাকে মিস করছি খুব।"
ইশা এবার সরল দৃষ্টিতে তাকাল। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনিম বলল,
"তোমাকে আমার দাদ-দাদীর কথা বলেছিলাম না একদিন। সেই গল্পটা আমায় ভোগাচ্ছে আজ।"
ইশা এবার চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎই ওর চোখেমুখে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিল। অনিম আবার বলল,
"যদি আমাদের সাথেও এমন হয়? ধরো আমার বাবা-মায়ের স্থানে আমি আর তুমি এবং আমাদের স্থানে রোহান এ তার স্ত্রী, তখন গল্পটা কেমন হবে? আচ্ছা রোহান যদি তার আগত বোনটাকেও এমন অবহেলা করে কিংবা ওরা দু'ভাইবোন এক হয়ে আমাদের সাথে এমন করে? তাহলে কেমন হবে? রোহান নিশ্চয়ই তখন বলবে বাবা তুমি যা করেছ আমিও তাই করেছি। এখন সেটা যদি ভুল হয় তাহলে সমান দোষে তুমিও দোষী। অতএব এটা তোমাদের শাস্তি বাবা!"
কথা বলেই অনিম ভয় পেয়ে গেল। ইশা তখন গভীর ভাবনায় মগ্ন। তার মুখটা অসম্ভব কালো দেখাচ্ছে। অনিম আবার বলল,
"দেখো না রোহানটা হুট করেই কেমন হয়ে গিয়েছে? কেমন নিশ্চুপ। এই যে এখন অবেলায় ঘুমোচ্ছে! অথচ ও কখনো এত বিকেল পর্যন্ত ঘুমাতো না। আমাদের সাথেও খুব একটা কথা বলত চায় না । ইশা, তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না তবে আমার সাথে ঠিক এমনটাই হয়েছে। আমিও এমন হয়ে গিয়েছিলাম। আজ এতো বছর পর নিজেকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করালাম যেখানে একসময় আমার সেই স্বার্থপর বাবাটা দাঁড়িয়ে ছিল। দেখো আজ তার কী হাল!"
অনিমের গলাটা ধরে এলো। চোখ জোড়া ঘামতে থাকলো। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে এখন। ছিহ! এটা কী করল ও? ইশা চুপচাপ বসে আছে। তার চেহারায় এমন পরিবর্তন বেশ ভাবনীয়। তাহলে কী ইশা অপরাধবোধে ভুগছে? নিজের ভুল টের পেয়েছে?
.
"বাবা, ভুল তুমি করেছো। আমি না। হ্যাঁ,দোষ আমার আছে। তবে আমার চেয়ে তোমার দোষ বেশি। আসল ভুলটা তুমিই করেছো।"
রফিক সাহেব ভ্রু কুচকে তাকালেন। সকাল সকাল ও কী বলছে এসব! হঠাৎই আজ সকালে অনিম আসল এখানে। এই বিশ দিনে কোনো খবর কিংবা যোগাযোগ করেনি ও। তাই ওকে দেখে খানিকটা অবাক হয় রফিক সাহেব। কিন্তু এখন উনি আরো বেশি অবাক হচ্ছেন এটা দেখে যে তাঁর ছেলে তাকে দোষী বলছে। কত বড় সাহস!
"কী বললি? আমি দোষী? আমি? "
খানিকটা কড়া স্বরেই বললেন কথাটা। মনের কোথাও একটা জায়গা থেকে বল পাচ্ছেন তিনি। ছেলের অধীনে এখন আর থাকেন না। তাই চাইলেই যাচ্ছেতাই বলে দিতে পারবে না ও। এ অধিকার সে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অনিমের চেহারা দেখে তিনি অবাক হলেন। অনিম মাথা নিচু করে আছে। চুপচাপ। আচ্ছা তাহলে কি ভয় পাচ্ছে! কিছু সময়পর অনিম বলল,
"হ্যাঁ বাবা। দোষটা তোমারই। একটু পিছন ফিরে তাকাও। তোমার বাবা মার কথা চিন্তা করো।"
রফিক সাহেবের মুখটা শক্ত হয়ে এলো অজানা কারণে। পাশ থেকে সেলিনা বললেন,
"তুই আমাদের ওই কারণে এত কষ্ট দিলি?"
"আমি দেই নাই মা। এটা তোমাদের ফল। কর্মের ফল। পাপের ফল।"
"মানে?"
"মনে আছে সেই কথা। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম। একদিন আমার সামনে দাদা আর দাদীকে কি বাজে ভাবে অপমান করেছো। তখন তাদের সাথে যে বাজে ভাবে কথা বলতে,ঝগড়া করতে সে কথা কী মনে আছে? তাদের খাওয়া দাওয়ার খেয়াল রাখতে না। অবহেলা করতে। তুমি জানো তখন প্রায়ই দাদু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতেন। তাদের কান্না দেখে আমিও কাঁদতাম। মা তুমিই তো আমাকে বারণ করতে ওদের সাথে না মিশতে। কেন করতে? এর উত্তর আমি আজোও পাইনি। তারপর একদিন কী করলে, ওদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলে। আর খোঁজ নাওনি। ওর কি বেঁচে আছে না মারা গেছে তারও খোঁজ নিতে না। বাবা,মনে পড়ে? এসব কথা মনে পড়ে এখন? সেদিন থেকে আমার তোমাদের প্রতি ঘৃণা শুরু হয়। এটি বাজে ভাবে প্রভাব ফেলে আমার উপর। তুমি জানো দাদা কত কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন? কষ্টে ভুগতে ভুগতে তোমাকে চিঠি লিখতেন। অথচ তুমি তার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না। গিয়ে দেখেও এলে না। আমি যেতাম। গল্প শুনতাম। দাদু তোমার গল্প বলতেন। মানুষ দুটো তোমার জন্যে কতো কিছু করল অথচ তুমি তাদের সাথে প্রতারণা করলে! ছিহ! কীভাবে পারলে বাবা?"
একাধারে কথা বলে খানিকটা দম নেয় অনিম। রফিক সাহেব তখন মাথা নিচু করে কান্না করছিলেন। সেলিনা বেগমের চোখে জল টলমল করে। অনিম বলে,
"বাবা মায়ের প্রতি তোমার এমন আচরণ আর ওদের কষ্টে ভরা গল্প গুলো শুনে আমি কেমন যেন হয়ে যাই। পাষাণের মতো। যার পরিনতিতে তোমরা আজ এখানে। যা আজ আমায় আবার তোমার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল। বাবা আমি আমার সন্তানের চোখে খারাপ হতে চাই না। দোষী হতে চাই না। আমি ভালো বাবা হতে চাই। সন্তানদের তাদের দাদা দাদীকে ফিরিয়ে দিতে চাই। বাবা চল। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। রোহান কান্না করছে ভীষণ। ইশা খুব চিন্তিত তোমাদের নিয়ে। প্লিজ বাবা চল। আমাকে আর দোষী বানিয়েও না। তুমিও আর দোষী হইও না।"
বাবা কান্না করতে থাকে। অনিম তা দেখে। বাবার কান্না সহ্য হয় না ওর। ও কাছে যায়। বাবার নরম দেহটা জড়িয়ে ধরে। রফিক সাহেব তখন হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন। সেলিনা বেগম পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেন। রফিক সাহেব বললেন,
"এতদিন কেবল মারা যাওয়ার চিন্তা করতাম। আজ বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইব। যদি কিছু পাপ মুছে যায় এই প্রত্যাশায়।"
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ