গল্পঃ পরিচিত গল্প - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ পরিচিত গল্প - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ পরিচিত গল্প

তাসফি আহমেদ

আমার খানিকটা মায়া হলো বৃদ্ধ মহিলাটির প্রতি। তার এমন অসহায় দৃষ্টি আমার মাঝে এক প্রকার খারাপ লাগার সৃষ্টি করে। সে খানিকটা কুঁজো হয়ে আমার সামনের সিট টি ধরে দাঁড়িয়ে আবার সেই অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাসের প্রথম থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত। কোথাও একটি সিটও খালি নেই। তাকে দাঁড়িয়েই যেতে হবে। এভাবে লোকালবাসে, একগাদা ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে একজন বৃদ্ধার যাতায়াত করা কতটা কষ্টকর সেটা আমি খানিকটা হলেও টের পাই। বাসে এভাবে একগাদা লোকের ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা আসলেই কষ্টকর। বৃদ্ধার এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আমার মায়া হয় ভীষণ। আমি চট করেই উঠে দাঁড়াই। বৃদ্ধাকে নিজের সিটে বসতে বলি। সে আমার দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে অবাক আর বিস্ময় লেগেছিল। আমি বলি,
"বসুন। আপনার এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হবে।"
উনি বসে পড়েন। বসতেই তার মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। আমি সেটা অনুভব করি। এটা দীর্ঘশ্বাস ছিল না। এটা কষ্ট ছিল। এতে অনেক বেদনা লুকিয়ে আছে । আমি বৃদ্ধের দিকে তাকাই। উনি তখন আমার দিকে জলভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমি অবাক হই। আশ্চর্য!  উনার চোখে জল কেন? এরপর বৃদ্ধা অদ্ভুত একটা কান্ড করে বসলেন। উনার সামনের সিটের উপর আমার হাত রাখা ছিল। উনি নিজের হাত আমার সেই হাতের উপর বার কয়েক বুলিয়ে দিলেন। আমাকে দোয়া করে দিলেন। সত্যি বলতে তার হাত শুষ্ক ছিল। মলিন ছিল। চামড়ায় বেশ ভাঁজ ধরেছে। তার হাতে বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু তার সেই ছোঁয়ায় বিশেষ ছিল। উনার হাত আমার হাতে লাগতেই আমার সমস্ত শরীর শিহরিত হয়। বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠে। মনে হয় আমার মা এই মাত্র আমায় ছুঁয়ে দেখলেন। বেশ ভালোবেসে বললেন,
"খোকা? ভালো আছিস?"
আমার চোখে জল জমে। মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। আমার কষ্ট হয়। এই একটা জিনিস আমায় দিনরাত কুড়ে কুড়ে খায়। আমি বুকের ভেতর একগাদা অভিমান, কষ্ট জমিয়ে রেখে, সেগুলোকে বুকের ভেতর আটকে রেখে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার তখন মায়ের কথা বেশ মনে পড়ে। আমি মায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার বিশেষ কিছু মনে পড়ে না।
.
বৃদ্ধার পাশের সিট খালি হতেই উনি আমাকে সেই সিটে বসতে দিলেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো বসে যাই। উনি আড়চোখে আমাকে দেখে। আমি সরাসরি উনার চোখে চোখে রাখি। বলি,
"আপনার খুব কষ্ট তাই না?"
বৃদ্ধা আচমাক এমন প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলে,
"কে বলল আমার খুব কষ্ট। "
"আপনার চোখ দুটো চিৎকার করে বলছে আপনি অনেক কষ্টে আছেন। আপনি একদমই ভালো নেই।"
"তুমি ভুল দেখছো বাবা। আমি একদমই কষ্টে নেই। বেশ ভালো আছি। আর কেনইবা কষ্টে থাকব?"
"এই বয়সে কষ্ট কেবল একটা জিনিসেরই। সেটা হলো নিজের হাতে লালন পালন করা ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে তীব্র অবহেলা  কিংবা তাদের কাছ থেকে যথার্থ ভালোবাসা না পাওয়া। এর থেকে বড় কষ্ট আর কিইবা হতে পারে।"
বৃদ্ধা চুপ করে থাকে কিছু সময়। আমি বৃদ্ধাকে আরেকটু দেখি। ইশ!  আমার যদি একটা মা হতো!  আচ্ছা কেমন হতো উনি? এই বৃদ্ধার মতো হতো?বৃদ্ধা বলে,
"তা ভুল বল নিই। তবে সত্যি বলতে আমি আমার সন্তানদের কাছ থেকে যথার্থ ভালোবাসা পাই। ওরা আমার অনেক যত্ন করে। ওদের বউরা কী যে ভালো তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। শোনো, সকাল বেলা বড় বউ এসে চা দিয়ে যায়। তারপর নাস্তা নিয়ে আসে আমার ছোট বউ। বিকেল বেলার নাস্তা পানিটা মেজো বউই দেয়। এর মাঝে আমার মাথার চুল ঠিক করে দেওয়া,গোসল, শাড়ি কোনটা পরবো এসব থেকে রাতের ঔষধ খাওয়া পর্যন্ত সব কিছুর দেখাশোনা ওরাই করে। আমার কাজ কি জানো? আমার কাজ হচ্ছে ওদের বাচ্চাদের সাথে খেলা করা,ওদের চোখেচোখে রাখা। আমি ওদের সাথে খেলি। আমার ভীষণ আনন্দ হয়। আমার বড় ছেলের দুইটা বাচ্চা। একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে। মেয়েটা ছোট। তিন বছর বয়স। ছেলেটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওদের ছোট্ট মেয়েটা সারাদিন আর কাছে পড়ে থাকে। কী সুন্দর করে আমাকে দাদু বলে ডাকে! আমার মন জুড়ে যায়। সে মাঝে মাঝে আমার পাশে ঘুমায়। আমি তার চুলে বিলি কেটে দেই। সে আমার কোলের সাথে লেপ্টে গিয়ে ঘুমিয়ে যায়। আমার আনন্দ হয় এতে। বুক ভরে উঠে শান্তির আবেশে। তুমি বুঝবা না এটা কত আনন্দের। আমার মেজো ছেলের একটা মেয়ে মাত্র। তার বয়স তিন বছরে দুই মাস। কথা ঠিক মতো বলতে পারে না। তোতলায়। 'ত' শব্দটা বেশি ব্যবহার করে। সে আমার কাছে এসে যখন দেখে নিলু(বড় ছেলের ছোট মেয়ে) আমার কোলে শুয়ে আছে, সে যা রাগ দেখতো! আমার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিতো। আমি কি করতাম জানো? আমি ওরেও বুকের মাঝে নিয়া নিতাম। আমার বুকের দু'পাশে আমার দুইটা কলিজা ঘুমায়। আমার কী যে ভালো লাগে! এত শান্তি লাগে যে বলে বোঝানো যায় না৷ জানো আমার মাঝে মাঝে মন চায় এই পৃথিবীতে থেকে যাই। এদের ছেড়ে আমার যেতে একদমই ইচ্ছে হয় না। আমার ছোট্ট দাদুভাইরা যখন আমার কাছে আসে, আমার পাশে ঘুরাঘুরি করে, তখন আমার কী যে আনন্দ হয় সেটা বলে বোঝানো যাবে না কিংবা বললে কেউ বুঝবেও না।"
বৃদ্ধা এই পর্যন্ত এসে থেমে যান। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। সে কান্না করে তখন। আমি তার কান্নায় কষ্ট দেখি। সাথে অদ্ভুত এক আনন্দ দেখি। কষ্ট আর আনন্দ মিলে মিশে আছে তার চোখে। আমার কাছে অবাক লাগে। আশ্চর্য!  কারো চোখে একসাথে আনন্দ কিংবা কষ্ট দেখা যায়? আমি বলি,
"আপনার ছেলেরা?"
উনি চোখে জল রেখে হেসে উঠেন। বলেন,
"ওরা আমার রক্ত। আমার জান। আমি এবং ওরা এক। অমিল নেই। আমাকে যে কত ভালোবাসে সেটা বোঝানো দায়। আমার তিন ছেলে। তিন জনই চাকরি করে। বড় বড় অফিসে চাকরি করে। এটা আমার এবং ওদের বাবার স্বপ্ন ছিল। আমরা স্বপ্ন পূরণ করি। তারা আমার খেয়াল রাখে খুব। আমার বিছানার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল আছে। সেখানে নানা রকমের ফল থাকে। সব সময় থাকে। কোন দিন কমে গেলে পরের দিন আবার বেড়ে যায়। আমি সেখান থেকে ফল খাই। রাতের বেলা আমার পাঁ টিপে দেওয়া, তিন ছেলে মিলে মজা করা, আমোদ করা আমাদের দৈনিকের রুটিন ছিল। আমাদের আড্ডায় আমার বউরা থাকে। আমার ছোট্ট ছোট্ট ফুটফুটে দাদুভাইরা থাকে। আমার আনন্দ হয় এতে। আমি ভালোবাসা পাই অনেক। তুমি ভুলে দেখেছো আমার চোখে। ওখানে কষ্ট নেই। তীব্র আনন্দ খেলা করে।"
.
এতটুকু বলে আমি সামনের দিকে তাকাই। আমার সামনে তিনজন পুরুষ নামের কাপুরুষ বসে আছে। তাদের পিছনের তাদের বিলাসি স্ত্রী-রা দাঁড়িয়ে। আমি তাদেরকে একদিনের বাসের গল্প বলেছি এতক্ষন। তারা সেটা বেশ মনযোগ দিয়ে শুনেছে। আমি আবার বলি, 
"বিশ্বাস করুন সেদিন আমার প্রচন্ডরকমে হিংসা হয়েছিল। ইশ! কি সুন্দর পরিবার। কত আনন্দ এখানে। আমার কেন এমন কোন পরিবার নেই? এমন একজন মা নেই কেন? আমি সেদিনের পর থেকে প্রায় দিন ওই বাস স্ট্যান্ডে যাই। কারনে কিংবা অকারণে, আমি সেই বৃদ্ধাকে খুঁজি। যার ছোঁয়ায় আমি মায়ের মমতা উপলব্ধি করতে পারি। সেদিনের সেই বিশেষ ছোঁয়া আজো আমার হাতে লেগে আছে। আমি আবার তার ছোঁয়া পেতে চাই। আমার ইচ্ছে হয়,যদি আর একবার দেখা হয়,আমি তাকে নিয়ে যাব। আমার সাথে নিয়ে যাবো। আমার মা বানাবো। কিন্তু সত্যি বলতে আমার এমনটা আশা ছিল না যে আমি তাকে আবার দেখব, আমি যে হাসপাতালে চাকরি করি সেই হাসপাতালের কোন এক পাব্লিক কেবিনে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে বেশ অবহেলায় পড়ে থাকতে। আমার এমনটা আশা কোন কালেই ছিল না। অন্তত কোন পাব্লিক কেবিনে তাকে দেখার ইচ্ছে ছিল না আমার।"
আমি থেমে যাই। সামনের গ্লাসে থাকা পানির সবটা খেয়ে ফেলি। তিন ছেলে আর তিন বউ তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল তখন । আমি আবার বলি,
"আফজাল সাহেব,আপনি সংসারের বড় ছেলে। আপনি অন্তত আপনার মাকে বুঝতেন। হায় কপাল! যে মা তার বড় বউয়ের প্রশংসায় সেদিন  ভাসিয়ে দিয়েছিল, সেই বড় বউ আজ যখন আমি বললাম, 'আপনাদের মা কে আমাকে দিয়ে দিন। আমি নিয়ে যাবো।' তখন হেসে উঠে নিজের স্বামীর দিকে তাকায় তখনই বুঝা যায় আসলে তার বড় বউ তাকে কতটা ভালোবাসে। কতটা স্নেহে ভাসিয়ে দেয় উনাকে। অথচ আমার এমন প্রস্তাব শুনে সবার উচিৎ ছিল চমকে যাওয়া।আমার সাথে জোর গলায় কথা বলা। আমার কলার চেপে ধরে বলা উচিৎ ছিল,'স্টুপিড! তুই আমাদের মাকে কেন নিবি? আমরা নেই?'। অথচ আপনারা কেউই তেমন কোন কিছুই করেন নি। বরং যেন খুশি হয়েছিল অনেক। যাক ভোজা কমে গেছে। আসলেই কি ভোজা কমে গেছে? ভোজা কমে নি। ভোজা বেড়ে গিয়েছে। আখিরাতে এর ভোজা বয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না মিস্টার রাফি। এত পড়ালেখা করে আজ লাভটা হলো কি বলেন তো? কি লাভ হয়েছে? হাতের কাছে যে এমন মূল্যবান একটা জিনিস আছে সেটা জানার চেষ্টা করেছেন কেউ? কখনও কি মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে মনে হয়েছে যে এই পৃথিবীতে জন্মে আমি সত্যিই স্বার্থক হয়েছি। আমরা মূল্যবান জিনিস খুঁজতে কোথায় না কোথায় চলে যাই। অথচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মূল্যবান জিনিস তো আমাদের কাছেই থাকে। কাছে থাকে বলে এই জিনিসটার মূল্য বুঝি না আমরা মানুষেরা। আমরা আজ আধুনিক। মা বাবাদের খেয়াল রাখার সময় কই?তারা ফ্যাশন করবে নাকি মায়ের খবর রাখবে। এত সময় কি তাদের আছে?  মিরাজ সাহেব, যার চোখ নেই সেই-ই বুঝে চোখের মূল্য কত। আমার মা নেই। আমি আমার মাকে কখনই দেখি নিই। বুঝ হবার পর থেকে নিজেকে অনাথালয়ে আবিষ্কার করি। এরপর বড় হতেই মাকে খোঁজার চেষ্টা করি। পাগলের মতো খুঁজি মাকে। সাগরের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি,'আমার মাকে ফিরিয়ে দাও। একবারের জন্যে হলেও দাও। আমি মায়ের কোলে একবার ঘুমাবো কেবল। তারপর আর চোখ খুলবো না।' সাগর মাকে দেয় না। আমি পাহাড়ের কাছে যাই। সেও নিরাশ করে আমায়। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি,'আমার মাকে দাও'। সেও দেয় না। প্রচন্ড নিষ্ঠুর সে। আমি কান্না করি। দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করি। তারপর একদিন মাকে পাই। একটি বাসে সেই মায়ের সাথে দেখা। যার স্পর্শে আমি উপলব্ধি করি আমার মাকে।"
আমি থেমে যাই। সামনে তাকাতেই দেখি উনাদের চোখে জল। আমি আবার বলি,
"যখন খুব ছোট ছিলেন, তখন কি আপনার আম্মু আপনার দেখাশোনার জন্যে কাজের মেয়ে রেখেছিলেন? রাখেন নিই নিশ্চই। যত কাজই থাকুক না কেন নিজেই নিজের সন্তানকে লালন পালন করেছেন। মা-রা এমনই। নিজের সন্তানদের নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পছন্দ করেন। অথচ দেখুন, আজকে আপনারা তার দেখাশোনার জন্যে কাজের লোক রেখেছেন।  নিজে এসে একবারও দেখছেন না! কিভাবে পারেন এত পাষাণ হতে। এত নির্দয় কিভাবে হোন।"
আমি উঠে যাই। এখানে, এদের সামনে কথা বলতে আর ইচ্ছে হয় না আমার। এদের সাথে কথা বললে আমার ঘৃণায় গা জ্বলে যায়। আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। আমি বৃদ্ধার কাছে চলে যাই। তার পাশে গিয়ে বসি। তার হাতের ভাঁজে নিজের হাতটাকে লুকিয়ে রাখি। আমার আনন্দ হয়। মনে হয় এই তো আমার সামনে শুয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে। বলছে,"কিরে খোকা!  ভালো আছিস?" আমি বৃদ্ধার হাতটা নিজের করে ফেলি। বৃদ্ধাকে বলি,
"আপনাকে আমি নিয়ে যাবো মা। আমি আর আপনাকে ওই পশু গুলোর সাথে রাখবো না। ওরা আপনাকে খুব কষ্ট দেয় তাই না?"
বৃদ্ধা ভেজা চোখে আমার দিকে তাকায়।বলে,
"তুমি বড্ড পাগল ধরনের একটা ছেলে। আমি জানি তোমার মা নেই। আচ্ছা যাও,তুমি আমাকে মা বলে ডেকো। আমাদের সাথে থেকো। আমার কোলে মাথা রেখো। রাখবে? আমাদের সাথে থাকবে? "
"আমি আপনাকে ওদের সাথে থাকতে দিব না মা। আমি আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। অনেক দূরে চলে যাব।"
"মায়েদের এক বয়স কাটে সন্তানদের মায়ায় আর শেষ বয়স কাটে নাতি আর নাতিনদের মায়া। এই মায়ার বাঁধন ভেদ করা সম্ভব নয় বাবা।"
"আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না মা। আমাকে এসব বলিও না। আমি তোমাকে নিয়েই যাবো।" 
"পাগলামো করিও না বাবা। আমি এদের ছেড়ে থাকতে পারব না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমার দাদুভাইদের ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা একদমই অসম্ভব।"
আমি এবার চরম রকমে অবাক হই। এত কষ্ট পায় ওখানে,তবুও সেখানে যেতে চায়। একেই বুঝি মা বলে।আমি বৃদ্ধার হাত ধরে রাখি। ঠিক তখনই উনার ছেলে বউরা রুমে ঢুকে। বড় ছেলে বলে,
"মা, তোমাকে দিয়ে এই বয়সে দিনরাত কাজ করিয়েছি। তোমার খেয়াল রাখি নিই। তোমার তো  বিছানাই ছিল না, বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটা কোত্থেকে আসবে। এই ডাক্তার ছেলেকে সেদিন কি সুখের বর্ননাই না দিলে,অথচ সুখ তোমার আশেপাশেও ঘেঁষে নিই। তোমার ছেলের বউরা তোমার চুল ঠিক করা তো দূরে থাক,তোমার চেহারাও দেখত না। তোমার নাতি আর নাতিনদের কখনই কাছে পাও নি।আরা তাদের তোমার কাছে ঘেঁষতে দেই নি। অথচ তুমি এদের নিয়েই কি আনন্দের গল্প করলে। সুখের গল্প করে। মা তুমি এমন কেন? মা-রা কি এমনই হয়?"
বৃদ্ধার চোখে জল খেলা করে।বলে,
"ওটা গল্প না রে বাবা।ওটা আমার স্বপ্ন ছিল। একসময় খুব করে স্বপ্ন দেখতাম আমি। হায় কপাল। ওটা কেবলই স্বপ্ন ছিল। কোনো দিন পূরণ হয় নি আর হবেও না!"
বৃদ্ধা কান্না করে। তার ছেলে ও ছেলের বউরা কান্না করে। তারা লুটিয়ে পড়ে পৃথিবীর সব চেয়ে মূল্যবান জায়গা মায়ের পদতলে। ক্ষমা চায় তারা। আমি পাশে বসে অস্রু সিক্ত চোখে তা দেখি। আমার আনন্দ হয় তখন। অদ্ভুত এক আনন্দ।
.
বৃদ্ধ জাহানারা বেগম, বড় একটা খাটের মাঝখানে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন। তার চারপাশের তিন পাশে তিন ছেলে বসে আছে। ওরা মায়ের সাথে গল্প করছে। কেউ পাঁ টিপে দিচ্ছে। কেউবা হাত ধরে বসে আছে। জাহানারা বেগমের বুকের মধ্যেখানে লেপ্টে আছে নিলু। তা দেখে তোতলাতে তোতলাতে ঝগড়া করছে ইরা। মেজো বউ এবং ছোট বউ বসে আছে। তারা কথার মাঝে হেঁসে উঠছে।হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে শাশুড়ির গায়ে । বড় বউ চা বানাতে ব্যস্ত। আমি মায়ের দিকে এগিয়ে যাই। চার পাশের তিন পাশ দখল করেছে তার তিন ছেলে। আমি চতুর্থপাশ দখল করে দাড়াই। আমার আনন্দ হয় এতে। এই তো আমার পরিবার। সুখি পরিবার।


আরো পড়ুনঃ গল্পঃ আমি এবং গল্প




ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url