Bangla Golpo: আমার একজন মিহিন আছে
প্রশ্নটা করে আমি নিজেই খানিকটা বোকা বনে গেলাম। এই সময় ও নিশ্চয়ই বাসায় থাকবে। তাহলে প্রশ্নটা করলাম কেন? ওপাশ থেকে মিহিন খানিকটা রুক্ষ মেজাজে বলল,
-গাধার মতো প্রশ্ন করবা না তো! এই মূহুর্তে যে আমি বাসায় থাকি সেটা কি তুমি জানো না?
-জানি তো।
-তাহলে গাধার মতো এই প্রশ্নটা করলা কেন?
-আচ্ছা বাবা আমার ভুল হয়েছে। ঠিক আছে? এই মাপ চাচ্ছি আমি। সরি!
-আচ্ছা ঠিক আছে।বাদ দাও। তা এই অবেলায় ফোন দিলে যে?
-একটু আসবে?
-আসবো? কোথায় আসবো?
-এই যে তোমাদের বাসার পিছনে যে পার্কটা আছে না,ওখানে।
-তোমার মাথা ঠিক আছে? এই সন্ধ্যা বেলায় তুমি ওখানে কী করো?
-এই যে পুকুরের পানিতে পাঁ ডুবিয়ে বসে আছি।
-সাদিক, তোমার এসব পাগলামো না আমার অসহ্য লাগে। একদমই ভালো লাগে না। ধ্যাত! অসহ্য একটা!
মিহিন ফোন রেখে দেয়। আমার খারাপ লাগে। বুক ভার হয়। চোখে জল জমে। মেয়েটা এমন কেন? আমার সাথে সব সময় এমন বিহেভ করে কেন? কী দোষ আমার? একটু বেশি ভালোবাসি, এই তো! আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে ভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে পুকুরের টলটলে পানি দিকে চেয়ে থাকলাম। পাশ থেকে সেই প্রিয় ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসতে থাকল। আমি চোখে বুঁজে সেই ঘ্রাণ নিজের করে নিতে চাইলাম। নিজের ভেতরে তাকে ঠাই দিলাম।
এখানে এসেছি খানিক আগেই। তখন খানিকটা আলো ছিল। এখন আলো মরে এসেছে। অন্ধকার দানবীয় আকার ধারণ করছে দ্রুত। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। মাঝে মাঝে সেই প্রিয় ঘ্রাণ আমি চোখ বুঁজে উপভোগ করতে থাকলাম। আহা! কি মধুময়, লোভনীয় একটা ঘ্রাণ। সাথে শান্ত,কোমল, মিষ্টি বাসাত আমায় শিহরিত করে। আমি মুগ্ধ হই ভীষণ। অদ্ভুত এক আনন্দ আমার চারপাশটায় ভরে উঠে। সমস্ত কিছু যেন আমার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
হঠাৎই ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। আমি চোখ খুলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাই। মিহি নামটা দেখে আমার মনে ভীষণরকমে অভিমান জমে। আমি ফোন ধরি না। কেটে দেই। আবার বাজে। আমি ফোন সাইলেন্ট করে দেই এবার। চুপচাপ বসে থাকি। মনে তখন অভিমানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো গুলো একত্রিত হয়। তীব্র আন্দোলন করে তারা। মোটেও ফোন ধরা যাবে না। আমি বসে বসে সন্ধ্যার এই মনোরম, শান্ত, হিমশীতল পরিবেশটা উপভোগ করতে থাকি। আমার আনন্দ হয় তখন। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই। বেশ স্বার্থক মনে হয় নিজেকে।
আমি বসে থাকলাম। কারো জন্যে তীব্র অপেক্ষা করছে এই মন। আমি জানি মিহিন আসবে। তাকে আসতেই হবে। না আসলে আমাকে কঠিন হতে হবে। এতক্ষণ বসে থেকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। ও যদি আজ না আসে তাহলে আমি আসবো না আর। মিহিন নামক পাহাড়টার কাছে গিয়ে কখনই বলব না 'ভালোবাসি'। আমি আসবো না আর এ ধারের নৌকার মালকিনের কাছে। খুব দূরে কোথাও হারিয়ে যাবো প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে। কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে খাক! মিহিনের এমন ভাবে কথা বলার চেয়ে এই কষ্টই ভালো। মিহিন! আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বলা যেতে পারে। যাকে আমি প্রচণ্ডরকমে ভালোবাসি। যাকে ছাড়া আমার প্রচণ্ড একা লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেই মিহিন। আমার প্রিয়তমা। ভীষণ রকমের রাগি একটা মেয়ে। ভ্রু জোড়া সব সময় কুচকে থাকে। মুখ ভরা বিরক্তির ছাপ। বেশ কঠিন,পাথর টাইপের একটা মেয়ে। কাউকে কষ্ট দিতে কুন্ঠিত বোধ করে না। মুখের উপর কথা বলে দেয়। আমি এই মেয়েটিকে ভালোবাসি। দু'জন দু'কূলের হলেও আমাদের ভালোবাসাটা এক কূলেই আবদ্ধ। আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি।মিহিন ভালোবাসা দেখাতে পারে না। নিজের ভালোবাসা সে উপস্থাপন করতে পারে না। আমি বুঝি তাকে। তার ভালোবাসা বুঝি। তাই তো আজো লেগে আছি তার সাথে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণকে ছাপিয়ে অন্য একটা ঘ্রাণ আমার হৃদয়ে তোলপাড় তুলে। আমি নিজেকে কন্ট্রোল রাখি। পেছনে তাকাই না৷ তাকালেই দেখবো মিহিন দাঁড়িয়ে। তার চোখে জল। আমি কেন তার ফোন ধরি নি এই অপরাধে আমার সাথে অভিমানি কথা বলবে সে। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকি পুকুরের পানে। পিছনের ঘ্রাণটা তীব্র হয় দ্রুত। একেবারে পাশে চলে আসে। কেউ একজন বসে পড়ে। তার পাঁয়ের নুপুরের ঝনঝন শব্দ হয়। তারপর হাতের চুড়ির। তার গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে আসে। আমি তার দিকে তাকাই একবার। সে চোখে জল নিয়ে মুগ্ধ নয়নে আমাকে দেখে। আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। সে অভিমানী গলায় বলে,
- ফোন দিয়েছি। ধরলে না যে!
আমি দূর পানে চেয়ে থেকে বলি,
- এমনি!
- রাগ করেছো খুব?
- নাহ৷ রাগ করবো কেন?
- করেছ। আমি জানি তুমি রাগ করেছ। তুমি তো জানোই আমি এমন। রুক্ষ মেজাজি।
- তুমি মোটেও তেমন না মিহি। তুমি ঠিক তোমার নামটার মতোই। বেশ মিহি। তোমার মাঝে স্নিগ্ধতা দেখি আমি। কিন্তু তুমি সেটা দেখাতে চাও না। তুমি সব সময় নিজেকে রুক্ষ রাখ। নিজের আশপাশটা কঠিন করে রাখো। তাই তোমাকে বেশ কঠিন দেখায়। অথচ কেউ জানেই না যে এই কাঠিন্যের পেছনে বেশ কোমলতা আছে। একটা কোমল হৃদয় আছে। যে হৃদয় একটা পাগলেকে বড্ড ভালোবাসে।
- বুঝো তো তুমি। তাহলে রাগ করলে কেন? তুমি কি জানো না যে তুমি রাগ করলে আমার ভালো লাগে না।খারাপ লাগে! এটা কি জানো না?
-আমি রাগ করিনি
মিহিন আমার হাত ধরে। বলে,
- আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি তুমি রেগে আছো।
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। মিহিন আমার পাশে আরেকটু সরে এলো। আমার গালে হাত রেখে বলল,
-খুব অভিমান জমেছে তাই না!
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াই। সে আমার কলার টেনে নেয়। আমাকে নিজের দিকে ফিরায়। আমি ওর চোখে চোখ রাখি। তার চোখে জল খেলা করে তখন। বলে,
- সরি!
নিজের মুখে বেশ অপরাধী একটা ভাব এনে শব্দটা উচ্চারণ করে ও। এতেই কাজ হয়৷ আমার মন গলে যায়। আমি তার চোখ মুছে দেই। বলি,
-কাজল দিয়েছো কেন?
সে আমার চোখে চোখ রেখে বলে,
-তোমার জন্যে।
-কান্না করবা না। কাজল লেপ্টে যাচ্ছে।
-যাক না। সেটা তো তোমার আরো বেশি পছন্দ।
-আমার পছন্দের বেশ খেয়াল রাখো মনে হয়।
-তুমি রাখ না?
আমি হাসি। সেও হাসে। মুগ্ধ করার মতো তার হাসি। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মুগ্ধ হই ভীষণ। সে লজ্জা পায় এতে। কথা খুঁজতে থাকে৷ বলে,
-তা এই সন্ধ্যায় আমায় এখানে দাওয়াত দেওয়ার কারণ?
আমি হাসলাম কেবল। বললাম,
-চোখ বন্ধ করো।
সে চোখ বন্ধ করে। আমি বলি,
-ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে থাকো। একটা ঘ্রাণ এগিয়ে আসবে তোমার দিকে। তোমাকে জড়িয়ে ধরবে। ঘ্রাণটা ছাতিম ফুলের। কড়া ঘ্রাণ। অনেকের অপছন্দ। তবে আমার খুব পছন্দ। ঘ্রাণটা কি তোমার নাকে লাগছে?
মিহি কিছু বলে না। কেবল চোখ বন্ধ করে মাথা উপর নিচ করে। আমি বলি,
-খুব জলদিই একটা হিমশীতল বাতাস তোমাকে ছুঁয়ে দিবে।বাতাসটা শরৎ-এর। মনমুগ্ধকর একটা বাতাস। এটি একটু একটু করে গরমের বিদায় বার্তা নিয়ে আসে। তুমি কি সেটা অনুভব করছো?
মিহিন কথা বলে নাম। সে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
-সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ। একটা পরিবেশ।
সে চোখ বুঁজেই কথা গুলো বলতে থাকে। বলার সময় তার ঠোঁট জোড়া খানিকটা কেঁপে উঠে। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি।আহা! কি সুন্দর গোলাপি দুটো ঠোঁট! আশ্চর্য! মেয়েটা এত সুন্দর কেন?
মিহিন চোখে খোলে। আমার দিকে তাকায়। আমি চট করেই চোখ ফিরিয়ে নেই। সেই খানিকটা এগিয়ে আসে আমার দিকে। আমি তার দিকে তাকাই আবার। তাকাতেই সে চট করে আমার ঠোঁটে চুমু খায়। অনেকক্ষণ লেগে থাকে সেই চুমুর রেশ। আমি শিহরিত হই। মিহি বলে,
- আমি এমন কিছু চাই সাদিক। এমন অদ্ভুত কিছু চেয়ে আসছি অনেক আগ থেকেই। তুমি কিভাবে বুঝো এসব। কিভাবে টের পাও যে আমি এসব অপছন্দ করি?
আমি হাসি। সে আলতো করে আমায় জড়িয়ে ধরে। বলে,
-আমাকে ছেড়ে যেও না। কোন দিনও ছেড়ে যেও না। তা না হলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি মারা যাবো। প্লিজ কখনই আমাকে ছেড়ে যেও না।
আমি কিছু বলি না৷ চুপ করে থেকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করি তাকে। আমার মাঝে শান্তি লাগে তখন। অদ্ভুত এক আনন্দে আমার হৃদয় মন্দির ফুরফুরে উঠে। শান্ত,কোমল,হিমশীতল বাতাস বয়ে যায় সেখানে। আমি তা অনুভব করি। আমার অনুভবে তখন এক গুচ্ছা ছোট ছোট সাদা ছাতিম ফুল,সেই হিমশীতল পরিবেশ আর আমার প্রিয়তমা বিরাজ করে।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
আরো পড়ুন
অসম্ভব সুন্দর ভাইয়া
ধন্যবাদ।