গল্পঃ কে খুনি

বাংলা ছোট গল্প Bangla Love Stories Bangla Choto Golpo  Bangla Valobashar Golpo Bangla Golpo.


গল্পঃ কে খুনি

লেখকঃ তাআসফি আহমেদ



শফিকের ফোনটা বেজে উঠলো। বেশ ঝাঁঝালো একটা রিংটোন। প্রথমবার বাজতেই ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একটা বিশ্রি গালি দেয় ফোনকে। ততক্ষণে ফোনটা কাটা যায়। আবার বেজে উঠে। শফিক চরম মাত্রায় বিরক্ত হয়। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আরিফের  নাম্বার। ওর মেজাজটা যেন আরেকটু চড়ে যায়। এত রাতে এই ছেলে কেন ফোন দিবে। সে কি জানে না যে এত রাতে কাউকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করা মস্ত বড় অন্যায়। আর কী এমন প্রয়োজন হলো যে এত রাতে ফোন দিতে হবে? শফিক বেশ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ফোন ধরে ওপাশের মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বেশ বিশ্রি একটা গালি দেয়। আরিফ সেই গালি উপেক্ষা করে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,
"ভাই, রানাকে কেউ মেরে ফেলেছে। খুব বাজে ভাবে মেরেছে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছে। স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে বুকের উপর অনেক গুলো ছিদ্র করে..."
আরিফ আর বলতে পারে না। বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠে। ওর কান্নার স্বরে একটু বিরক্তও হয় না শফিক। সকল বিরক্তি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। সে যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ের মতো কিছু সময় স্থির হয়ে বসে থাকে। মুখ কালো হয় ওর। বুকের ভেতর কষ্ট জমাট বাঁধে। চোখ দুটো অজান্তেই ঘেমে উঠে। বিশ্বাস করতে পারে না । বলে, 
"এই!  এই আরিফ!  কি বলছিস তুই। মাথা ঠিক আছে। মজা করছিস আমার সাথে?"
আরিফ ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে, 
"ভাই,আমি মজা করছি না। সত্যি বলছি। আপনার বিশ্বাস না হলে আপনি ওর বাসাতে আসেন। এসে দেখে যান। নিজের চোখে এসে দেখে যান।"
শফিকের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।তাড়াহুড়ো করে বলে,
"আরে ও তো একটু আগেই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। এই অল্প সময়ের মাঝে কিভাবে হলো এসব? "
"আমি জানি না ভাই। আমি ঘুমানোর জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই একটা কল আসে আমার ফোনে। বলে কেউ নাকি রানাকে মেরে চলে গিয়েছে। আমি দৌড়ে ওর বাসায় যাই। গিয়ে দেখি ওর মৃত দেহ ঝুলে আছে সিলিং ফ্যানের সাথে। মাথা বিহীন একটা শরীর ঝুলে ছিল।"
আরিফ আবারো বেশ উচ্চ স্বরে কান্না করতে থাকে। শফিক কিছু বলতে পারে না। চুপ করে থাকে কিছু সময়। ওপাশ থেকে আরিফ কল কেটে দেয়। শফিক বেশ অবাক হয়। আশ্চর্য!  কি থেকে কি হয়ে গেল। ছেলেটা একটু আগে কত হাসিতামাশা করেছে, 'শফিক ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে' বলে কত স্লোগান দিয়েছে, বিয়েতে কিভাবে আনন্দ করবে,কিভাবে সব কিছু সাজবে এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে গিয়েছে। আর এর ঘন্টা খানেক পরই শুনতে হলো সেই ছেলেটি মারা গেছে! এই পৃথিবীতে সে আর নেই। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! খুব সহজভাবে নেওয়া যায়! শফিক নিতে পারে নি। সে কিছু সময় রোবটের মতো বসে রইলো। ভাবতে লাগলো কথা গুলো। ওকে কেউ কেন খুন করবে। কি করেছে ও। ওর সাথে তো কারো গোপন শত্রুতা নেই। তাহলে! কেউ কেন ওকে মারতে যাবে। শফিক আর ভাবতে পারে না। মাথা ভার হয়ে আসে ওর। প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
.
একটি পুরনো বাড়ি। অনেক পুরনো। কেউ থাকে না এখানে। এটা ওদের গোপন আস্তানা। এখানেই ওদের সব গোপন মিটিং এবং কাজের প্ল্যান হয়।
সেই পুরনো বাড়িটির একটা রুমে শফিক বসে আছে। তার সামনে চেয়ারে বসে আছে আরিফ আর রুবেল। সবার মন খারাপ; মুখ ভার করে বসে আছে। কেউ কথা বলছে না। একটু শব্দও করছে না কেউ। মাথার উপর এনার্জি বাল্বটা নির্দ্বিধায় আলো দিচ্ছে। বাল্বের শুভ্র আলো সবার কালো হয়ে থাকা চেহারায় পড়ে ফ্যাকাশে আভা সৃষ্টি করছে চেহারায়। তাদের সবার মুখ এখন খুব ফ্যাকাশে লাগছে। শফিক একটু নড়ে বসলো।আড়চোখে রানার চেয়ারটার দিকে তাকালো। ওই চেয়ারে সব সময় একটা যুবক বসতো। বেশ হাসিখুশি প্রানবন্ত একটা যুবক। নাম রানা। আজ ছেলেটি নেই। ছেলেটির যায়গা আজ শূন্য হয়ে আছে। সেই শূন্যতা আজ ভোগাচ্ছে শফিককে। শফিক ভাবতেও পারে নি যে এমন একটা কান্ড ঘটবে। কেউই ভাবতে পারে নি। অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর শফিক বলল,
"আচ্ছা তোরা তো আমার চেয়ে বেশি রানার সাথে থাকতি।তাহলে বলতো ওর সাথে কারো কোনো শত্রুতা ছিল। এমন কেউ কি ছিল যে রানাকে খুন করতে পারে বা খুন করার মতো কোনো শত্রু কি ছিল?"
আরিফ মাথা নাড়ে। বলে,
"না ভাই। ওর সাথে কারো কোনো শত্রুতা ছিল না।"
শফিককে একটু চিন্তিত মনে হলো। সে বেশ চিন্তিত গলায় বলল,
"কারো সাথে কি ইতোমধ্যে কোনো হাতাহাতি কিংবা মারামারি হইছে?"
আরিফ বলল,
" না ভাই। আমাদের জানা মতে ও কারো সাথে মারামারি করে নাই। করলে আমাদের একবার হলেও বলতো।"
শফিকের মুখটা আরেকটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,
"তাহলে কেউ কেন ওকে মারবে। আরো কি বাজে ভাবেই না মেরেছে। যেন অনেক দিনের জমে থাকা সব রাগ ক্ষোভ ওর উপর ঝেড়েছে। শালা কি মানুষ! কেউ কাউকে এভাবে খুন করে! আমি এই জীবনে কত খুন করলাম। কাউকে এমন কষ্ট দিয়ে মারি নি। সহসই হয় নি। আর এই খুনি কি নির্মমভাবেই না খুব করল।"
শফিক যেন প্রচন্ড ঘৃণা জানালো খুনির প্রতি। খুনিকে জানোয়ার মনে হলো ওর। প্রচন্ড রাগ হলো খুনির প্রতি।হাতের সামনে কিছু থাকলে এখুনি ছুড়ে ফেলতো। ভাগ্যিস কিছু নেই ওর সামনে। শফিক চোখমুখ লাল করে বসে থাকলো।  রানার মৃত শরীরটার কথা মনে হতেই রাগে শরীরের চামড়া ফেটে যেতে চায় ওর।  যেন খুনিকে সামনে পেলে আস্ত গিলে খাবে। শফিক তীব্র রাগ নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। ঠিক তখনই এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা রুবেল বলল,
"আচ্ছা ভাই, এটা সাদিকের দলের কারো কাজ নয়তো?  তারা তো সব সময় আপনার পিছনে পড়ে থাকে। হয়তো এমনও হতে পারে যে তারা আপনাকে এবং আপনার সাথে যারা চলাফেরা করে তাদের মেরে ফেলতে চায়। কোন বদলা নিতে চায় হয়তো। "
শফিকের মেজাজটা যেন আরো বেড়ে গেল। গা যেন জ্বলে উঠল ওর। চোখমুখ লাল হতে লাগলো দ্রুত। কানের গোড়া যেন দ্রুতই গরম হতে থাকল। 'আসলেই তো। সাদিকের কথা তো ভেবে দেখি নিই। সে তো আমাকে না পারতে মেরে ফেলে। তাহলে কি এটা ওরই কাজ?' শফিক কিছু সময় ধরে কথা গুলো ভাবলো।তারপর চট করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পাঁয়ে একটা টেবিলের দিকে এগুলো। ড্রয়ার খুলে ওখান থেকে ওর কালো চকচকে পিস্তলটা নিয়ে পিছন ফিরে এমন ভাবে হাঁটা দিল যেন কোন বদ্ধ উন্মাদ হেঁটে যাচ্ছে। আরিফ ওর দিকে দৌড়ে গেল। রুবেএলও। আরিফ বলল,
"ভাই, কই যাচ্ছেন ভাই। এখন এসব বাদ দিন। আর দুদিন পর আপনার বিয়ে খামখা ভেজালে ঝড়াবেন না এখন। ভাই দাঁড়ান। ভাই!"
শফিক দাঁড়ায় নি। সে দ্রুত হাঁটতে থাকলো। প্রচন্ড রাগে অস্ফুট স্বরে কিছু কথা বের হয়ে এল ওর গলা দিয়ে। আরিফ বা রুবেল সেটার কিছুই বুঝতে পারলো না। রুবেল সামনে গিয়ে শফিককে জড়িয়ে ধরে বলল,
"ভাই,এখন এসব বাদ দিন প্লিজ। এখন না। আমরা পরে ওকে দেখে নিবো। এখন না। প্লিজ ভাই। এখন না। আরিফ ঠিক বলেছে। দু'দিন পর আপনার বিয়ে। এখন এসবে জড়ালে..."
শফিক এক ঝটকায় রুবেল ফেলে দেয়। রুবেল তিন চার হাত দূরে গিয়ে মেজেতে পড়ে।আরিফ চোখ বড়বড় করে সেই দৃশ্য দেখলো। সে অবাক হয়ে একবার রুবেলের দিকে তাকাচ্ছে আবার শফিকের দিকে। শফিক চোখমুখ লাল করে বলল,
"আরে তোরা আমাকে বাধা দিচ্ছিস কেন? ও আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর আমি চুপচাপ বসে থাকবো? তোরা তো জানতি আমি রানাকে কতটা আদর করতাম। কত ভালোবাসতাম। নিজের ভাই ভাবতাম ওকে।আর ওর খুনি আমার সামনে দিয়ে নির্দ্বিধায় হেঁটে যাবে, আমি সেই দৃশ্য দেখে যাবো? কিছুই করবো না? এতটা অচল হই নি এখনও। আজ শালাকে মেরেই ফেলবো।"
শফিককে আর বাধা দেওয়া গেল না। সে তীব্র রাগ নিয়ে বাড়ির মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেল। আরিফ এবং রুবেলও বের হয়ে আসলো। শফিক বাইক স্টার্ট দিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করলো। ততক্ষণে আরিফ নিজের বাইক স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। রুবেল উঠে বসলো ওর পিছনে। শফিকের বাইক তখন চলতে শুরু করেছে। 
.
শফিক বেশ উত্তেজিত এবং প্রচন্ড রাগ রাগ ভাব নিয়ে ওসি সাহেবের রুমে ঢুকলো। ওর পিছন পিছন আরিফ আর রুবেল ঢুকলো। শফিকের মতো  ওদেরও মন মেজাজ ভালো নেই। এতক্ষণ কেবল সন্দেহ করেছে যে সাদিক খুন করতে পারে। কিন্তু সেই সন্দেহ সত্যিতে পরিণত হলো যখন জানা গেলো যে সাদিক নেই। যে রাতে রানা মারা গিয়েছে ঠিক সে রাত থেকেই সেই উধাও। কেউই ওর খবর দিতে পারে নিই। এতেই শফিকের মেজাজ যেন লিমিট ক্রস করে ফেলল। সে কোন ভাবেই নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।প্রচন্ড রাগে সে রাস্তার একটা কুকুরকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। নিজেকে সে কোন ভাবেই সংযত রাখতে পারছে না। ওসি কামরুজ্জামান শফিককে দেখে মৃদু হাসলো।কামরুজ্জামানের বয়স খুব একটা বেশি না। বয়স বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে। তবে তাকে দেখলে মনে হয় সে এখনো পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক। সে বেশ হাস্যরসাত্মক মানুষ। হাসতে ভালোবাসে। আচার আচরণ বেশ মার্জিত। সে বেশ শান্ত স্বরে শফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
"কি খবর শফিক সাহেব। দিনকাল কেমন যাচ্ছে? "
শফিক বেশ রুক্ষ দৃষ্টিতে ওসির দিকে তাকালো। তারপর বলল,
"আপনি কি আমার খোঁজ খবর নিতে এখানে ডেকে এনেছেন?"
কামরুজ্জামান আবারো হাসলো। বলল,
"ঠিক তা না। একটু সৌজন্যতা দেখানো আর কি।আমি জানি আপনার মন মেজাজ ভালো নেই।এর কারনও আমি জানি।তবে আমি আপনাকে এমন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যাকে দেখলে আপনার মন একটু হলেও হালকা হবে এবং যে আপনাকে এমন মূহুর্তে সাহায্য করতে পারবে।"
"কে? "
কেবল এতটুকু বলে সে ওসির দিকে সেই রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কামরুজ্জামান এটা দেখে মজা পেলো যেন। সে মৃদু হেসে বলল,
"আপনি বোধহয় বেশ রেগে আছেন। তাই আশেপাশের কাউকে দেখা প্রয়োজনবোধ করছেন না। যার কথা বলছিলাম সে আপনার পাশেই আছে। পাশে দেখুন৷ উনার নাম তীব্র হাসান।"
শফিক পাশে তাকাতেই দেখলো একটা যুবক ছেলে  তার একদম পাশে বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে। সে হতভম্ব হয়ে কিছু সময় যুবকটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। বেশ শান্ত কোমল তার দৃষ্টি। চেহারায় কঠোরতা না থাকলেও প্রচুর রহস্য লুকিয়ে আছে।  শরীরটা একদম মোটাও না আবার একেবারে চিকুনও না। মাজারি গড়নের বেশ তাজা দেহ। যেন প্রতিদিন জিমে যায়। পাতলা ঠোঁট। সরু,তীক্ষ্ণ চোখ । যার সাথে একবার চোখাচোখি হতেই মনে হয় সে কারো মনের সব কথা চট করেই পরে ফেলতে পারে। শফিকের ভেতরটা হঠাৎই যেন কেঁপে উঠলো। কি এক ভয়ে যেন সে দ্বিতীয়বার ছেলেটির দিকে তাকাতে পারলো না। তীব্র বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই বলল,
"হাই,আমি তীব্র হাসান। "
শফিক সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। সে কামরুজ্জামানের দিকে তাকালো। তবে পূর্বের মতো সেই রুক্ষতা তার চোখে দেখা গেল না। কামরুজ্জামান বলল,
"ইনি এই ক'বছর ধরে বাংলাদেশ গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করছেন। অল্প বয়সে বেশ সুনাম কুড়িয়ে  সবার নজর কেঁড়েছেন যারা তাদের মধ্যে ইনি অন্যতম। তবে উনাকে কেউই চেনে না। কারন উনি টিভির পর্দায় কখনো আসেন নি এবং আসতেও চান না। গোপনে কাজ করে বেড়ান। বড় বড় সব মিশন কম্পলিট করে এসেছেন তিনি। আশা করি উনি আপনাদের যথার্থ সাহায্য করতে পারবে। "
শফিক উঠে দাঁড়ালো। কড়া স্বরে কিছু বলতে চেয়েও কেন জানি বলতে পারলো না।তবে মুখটা বেশ গম্ভীর রেখে বলল,
"খুশি হলাম।কিন্তু আমাদের কোন গোয়েন্দা ফোয়েন্দা লাগছে না। আমরা আসল খুনিকে পেয়ে গেছি এবং খুব জলদিই সেই খুনির লাশ আপনাকে আনতে যেতে হবে।গেলাম।"
শফিক পিছন ফিরে হাঁটতে যাবে ঠিক তখনই  কামরুজ্জামান বলল,
"খুনিকে পেয়ে গেছেন? কে সে?"
শফিক ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো। বলল,
"সেটা শুনে আপনার কাজ কি? আপনি আপনার কাজ করেন। খুন একটা হয়েছে আবার এজন্যে গোয়েন্দাও নিয়ে এসেছে।হেহ!"
শফিক তিরস্কার করলো কামরুজ্জামানকে। কামরুজ্জামান কিছু যে মনে করেন নি সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সে বেশ হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বলল,
"আচ্ছা ঠিক আছে। মানলাম আমার যোগ্যতা কম এবং একটা ছোট খুনের কেস সমাধান করতে পারি নি যেটা আপনি পেরেছেন। আমি সে নিন্দার কথা মেনে নেই।তবে আপনি চাইলে এই মূর্খকে খুনির নামটা বলতে পারেন। আচ্ছা আপনিই বলেন,কেস সমাধান না করতে পারি, অন্তত খুনির নামটা তো জানার অধিকার আমার আছে। বলুন আছে না?"
শফিক কিছু সময় কিছু একটা ভাবল।তারপর বলল,
"হ্যাঁ সে অধিকার তো আছেই।"
কামরুজ্জামান বেশ দ্রুত বলল,
"তাহলে বলে ফেলুন না!"
"সে আর কেউ না। আমাদের এলাকার সাদিকই। যে সব সময় আমার পিছন লেগে থাকতো।আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতো। আপনি কি চিনতে পেরেছেন তাকে?"
কামরুজ্জামান এমন ভাবে হেসে উঠলো যেন শফিক মস্ত বড় একটা জোক্স বলেছে। তার হাসি দেখে শফিকের গা যেন জ্বলে গেল। কামরুজ্জামান হাসতে হাসতে বলল,
"আপনাকে বেশ বুদ্ধিমান ভেবেছি। কিন্তু আপনি আসলেই ততটা বুদ্ধিমান নন।"
শফিক কপাল ভাঁজ করে ভ্রু কুচকে বলল,
"মানে?"
"এদিকে আসুন। মানের উত্তর পাবেন।"
এই বলে কামরুজ্জামান নিজের রুম থেকে বের হলেন। তার পিছনে শফিক, রুবেল এবং আরিফ গেল। তীব্র গেলো না। সে চুপচাপ বসে থাকলো। যেন কোনো এক গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। 
শফিকের অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। সে কেবল অবাক দৃষ্টিতে সাদিকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাদিক হাজতের এক কোনায় ছোট্ট একটা খাটে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। কামরুজ্জামান বলল,
"রানা যে রাতে খুন হয়েছিল সে রাতে আমি এই লম্পটকে মাঝ রাস্তায় মাতাল অবস্থায় পাই। মাতাল হয়ে কাকে যেন মারছিল। তাই ধরে এনে হাজতে ঢুকাই। ওকে যখন ধরেছি তখন সময় নয়টা বা তার একটু বেশি। আর পোস্টমর্টেমে'র রিপোর্ট অনুযায়ী রানার খুন হয়েছে বারোটা কি সাড়ে বারোটার মধ্যে। তাহলে আপনিই বলুন সাদিক কিভাবে রানাকে খুন করবে।"
কামরুজ্জামান বেশ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে শফিকের দিকে তাকায়৷ শফিক সেদিকে তাকায় না। সে যেন বেশ দূর্বল বোধ করে।তার সমস্ত রাগ যেন পানি হয়ে একগাদা দূর্বলতা সৃষ্টি করেছে নিজের মাঝে। সে বেশ হতাশ হয়ে বেরিয়ে এসে আবার পূর্বের যায়গায় বসে। তারপাশে সেই অদ্ভুত শান্ত দৃষ্টিওয়ালা যুবকটি বসে আছে। সে অবাক হয়। একটা মানুষ এতটা শান্ত কিভাবে হয়। সে আড় চোখে তীব্রকে দেখে। তীব্র তখনো গভীর ভবনায় মগ্ন ছিল। কামরুজ্জামান এসে বেশ কোমল স্বরে বললেন,
"আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো। চিন্তা করবেন না৷ খুনি পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। বিশ্বাস রাখুন আমাদের উপর। আমাদের আপনার সাহায্য খুব প্রয়োজন হবে। তীব্র আপনার সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে যাবে৷ ও যা বলবে আপনি ঠিক সেটার উত্তর দিবেন। দেখবেন, কোনোটি যেন মিথ্যা না হয়। মিথ্যা বলে খুনিকে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।"
শফিক মাথা নাড়িয়ে সায় দিল যে সে বুঝতে পেরেছে।সেখানে কিছু সময় কথাবার্তা হলে ওদের মাঝে। তীব্রর সাথে শফিক কুশল বিনিময় করেছে শেষ পর্যন্ত। তবে তীব্রর সাথে কথা বলে সে খুব একটা স্বস্তি অনুভব করতে পারে নি। কেমন জানি ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল ওর মাঝে। যাক সেসব ছাপিয়ে সে তীব্রকে বেশ শান্ত স্বরে বলেছে যে, 
"যা জানতে হবে, আমি আপনাকে জানাবো।আপনি প্লিজ খুনিকে বের করে দিন। প্লিজ!" 
 ব্যস! এতটুকু বলে সে বেশ দ্রুত কামরুজ্জামানের রুম থেকে বের হলো। বের হওয়ার সময় তার  পিছনে থাকা আরিফেকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"এমপি সাহেবকে ফোন লাগা!"
আরিফ ফোন বের করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কামরুজ্জামান নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে তীব্রর দিকে তাকিয়ে হাসলো। তীব্রও অনেকক্ষণ পর ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো। তারপর বেশ কোমল স্বরে বলল,
"তুই পারিসও বটে।"
কামরুজ্জামান এবার একটু শব্দ করেই হাসলো। 
.
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।রুবেল বাসার পথে যাচ্ছিল। হঠাৎই কিছু একটার শব্দে সে চমকে পিছনে তাকায়। তার হার্টবিট যেন দ্রুত বাড়ছিল। পিছন ফিরে তাকিয়ে কাউকে না দেখে মনের ভুল বুঝতে পারে। তারপর ভারি প্রশান্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও।আবারো বেশ শান্ত ভাবে হাঁটতে থাকে। গুন গুন করে গান গায়। তারপর আবারো সেই আগের মতো শব্দ এবং পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। রুবেল এবার সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গেল। সে দ্রুত পাঁ চালাতে লাগলো। ঠিক তখনই পিছন থেকে তৃতীয়বারের মতো কিছু একটার  শব্দ শোনা গেল। সে আর পিছন ফিরে তাকালো না। এক দৌড়ে বাসায়  চলে আসলো। এসেই দরজা আঁটকিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলো। বাসার লাইট সব তখন বন্ধ ছিল। সে বেশ ধীরে ধীরে সুইচ বোর্ড খুঁজতে লাগলো। লাইটের সুইচ টিপ দিতেই লাইট জ্বলে উঠলো। ঠিক তখনই সে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলো। একটা ছেলে ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। চোখ দুটো যেন খুনের নেশায় কাতর। ছেলেটি হাতে একটা লোহার রোল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুবেল বেশ অবাক হলো। আরো অবাক হলো এটা দেখে যে সে এই ছেলেটাকে চেনে৷ খুব ভালো করেই চেনে৷ আরে এ তো... রুবেল চিন্তা করার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলে। শরীরের সব শক্তি যেন নিমিষেই পানি হয়ে যায় একটি লোহার রোলের আঘাতে।
.
আরিফ ঘুমাচ্ছিল। ঠিক তখনই ওর ফোন বেজে উঠে। বেশ ক'বার বাজল কিন্তু সে ঘুম থেকে উঠলো না। কিছু সময় পর আবার বাজলো। এবার আরিফের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে উঠে বেশ তাড়াহুড়ো করে কল ধরে। ওপাশের বক্তার কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আর। চিৎকার করে বলে উঠে,
"কি?"
.
শফিক চেয়ারে বসে আছে। যেন একটা রোবট বসে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। সে ঠিক নিতে পারছে না ব্যাপার গুলো। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আরিফ। সে প্রচন্ড ভয়ে চুপশে আছে। কামরুজ্জামান তার ফোর্স নিয়ে চারপাশটা দেখছে। তীব্র লাশটা দেখে এসে শফিকের পাশে বসলো। কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, 
"বেশ পুরনো শত্রুত। অনেক ক্ষোভ জমে আছে খুনির। সাধারণত এই ধরনের খুন জমে থাকা ক্ষোভ থেকেই করা হয়। বিকেলে আপনার বাসায় যাবো একবার। কিছু কথা বলতে হবে।"
শফিক কিছু বলল না। চুপচাপ বসে থাকলো। 
.
আরিফ নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ওর বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তারা বেশ মমতা ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ দরজার কাছে চলে গেল। পিছন থেকে ওর মা বলল,
"কত বার করে বলেছি। শফিকের সাথে না হাঁটতে।তুই শুনিস নি আমাদের কথা। শুনলে আজ অন্তত এই দিন দেখতে হতো না।"
আরিফের মা কেঁদে উঠেন। ওর বাবাও। আরিফ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ওর চোখে জল জমে।যে ভুল সে করেছে সেই ভুল শুধরানোর সময় সে কবেই পেরিয়ে গেছে। এখন কেবল সেই ভুলের মাশুল দিতে হবে। আরিফ সেই মাশুল দিতে নারাজ। তাই সেই রাতের অন্ধকারে এই এলাকা ত্যাগ করতে চাচ্ছে। দূরে কোথাও গিয়ে শান্তিতে বাস করতে চায় ও। আরিফ বেরিয়ে গেল। ওর পিতামাতা  অশ্রুসজল দৃষ্টিতে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
.
আরিফ ভীন্ন পথে যাচ্ছে।সে পথে গেলে কারো চোখে পড়বে না ও৷ কেউ বুঝতে পারবে না যে রাতের গভীর অন্ধকারে ও বিদায় নিচ্ছে এই নির্মম শহর থেকে। যেখানে কারো খুন করা হয় বেশ নির্মম ভাবে। আরিফ বেশ বুঝতে পারছে যে এবার তার মৃত্যুর পালা। একে একে ওর খুব আপন দু'জন বন্ধু মারা গেছে। এরা সবাই শফিক ভাইয়ের কুকর্মের অংশীদার ছিল। সে নিজেও ছিল। তাই প্রচন্ড ভয়ে সে এই শহর ছাড়ছে। কিছু দূর যেতেই আরিফ অনুভব করলো ওর পিছনে কেউ একজন আছে। ওকে ফলো করছে। পিছনে তাকাতেই সে কাউকে দেখলো না। হঠাৎই ওর মনের মাঝে  তীব্র একটা ভয় ঢুকে গেল। রুবেল এবং রানার মৃত দেহের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ওর সমস্ত গা যেন শিউরে উঠে। সে ধীর পাঁয়ে হাঁটতে থাকে। কিছু সময় পর আবার সেই অনুভূতি। সে পিছন ফিরে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। ওর ভয় বাড়তে থাকে। প্রচন্ড ভয় নিয়ে সে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হেঁটে চলছে। কিছু দূর যেতেই থমকে দাঁড়ায় সে। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার অবয়ব দেখতে পাচ্ছে ও। খুব চেনা মনে হলো। কিন্তু অন্ধকারের কারনে ঠিক চিনতে পারলো না ও। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ধীর পাঁয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আরিফও পিছু হটতে লাগলো। আর অদ্ভুত এক ভয়ে ওর সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল।যেন সে আর হাঁটতে পারবে না। পিছন ফিরে দৌড় দেওয়ার  শক্তিটুকুও যেন ওর নিজের মাঝে নেই। হঠাৎই ওর কেন জানি মনে হলো ও আর বাঁচবে না। একটু পরই ওকে কেউ একজন মেরে ফেলবে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবে। বুকের উপর স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে গর্ত করা হবে। মাথাকে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে থেতলে দেওয়া হবে। একটু একটু শাস্তি দিয়ে মারবে ওকে। এর চেয়ে নিজেই মরে যাওয়া ভালো। রানা আর রুবেলের মতো এত কষ্ট পেয়ে মরার চেয়ে নিজেই নিজেকে খুন করে মেরে ফেলা অনেক ভালো। আরিফ হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল। সামনের মানুষটি দাঁড়ালো না। সে এগিয়ে এলো। তার হাতে একটা লোহার রোলের মতো কিছু একটা দেখলো আরিফ। আরিফ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। শেষবারের মতো রুবেল আর রানার  মৃত দেহের কথা মনে করতে চাইলো ও। মনে করতেই ওদের মৃত দেহের ছবি ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে। ও দ্রুত ব্যাগের সাইড পকেট হাতড়িয়ে ধারালো চাকুটা বের করলো। নিজের গলায় লাগাতে যাবে ঠিক তার আগে ওর চোখের সামনে  ওর বৃদ্ধ বাবা মায়ের চেহারা ভেসে উঠলো। তাদের ভেজা চোখ আর  চেহারাটা ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে।আরিফ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বললো, "আমায় ক্ষমা করে দিও মা। আমায় ক্ষমা করে দিও।" এই বলে ওর নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দিল। ধারালো ছুরি গলায় লাগতেই একেবারে অনেকটা কাটা যায়।আরিফ তাল সামলাতে না পেরে দ্রুত মাটিতে পড়ে গেলো। নিজের গলা দু'হাতে চেপে ধরে লাফাতে লাগলো ও। গোঁ গোঁ শব্দ আসলো ওর গলা দিয়ে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হতভম্ব হয়ে দেখল কেবল। দ্রুত কাছে এসে বলল,
"এই! এই তুই মরলি কেন? নিজেকে মারলি কেন? আমি তোকে মারতাম। তোকে মারতাম আমি। তোকে মেরে এই বুকের জ্বালা মেটাতাম। তুই মরলি কেন? বল তুই মরলি কেন?  তোর সাথে আমার কথা আছে অনেক। অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আমার। তুই মরিস না। মরিস না তুই।"
আরিফ চোখ দুটো বড়বড় করে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। অস্ফুট স্বরে বলল,
"আপনি!"
.
হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ হয়৷ শফিক চমকে উঠে। ভ্রু জোড়া কুচকে আসে ওর। আশ্চর্য!  কে আসবে এখন? এত রাতে ওর কাছে আসার মতো তো কেউ নেই? কেউই বেঁচে নেই। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। ওর বাবা মাও ওর সাথে যোগাযোগ করে না। তাহলে কে আসবে? হঠাৎই শফিকের ভাবনা থমকে দাঁড়ায়। সেই খুনি নয় তো যে ওর তিন জন সঙ্গিকে খুন করেছে? তাহলে আজ কি তাহলে ওর পালা? শফিক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পাঁয়ে শোবার  ঘরে গিয়ে আলমারির ড্রয়ার খুলে কালো চকচকে পিস্তলটা বের করে নেয়। দরজায় তখনো কেউ অস্থির হয়ে ঠক ঠক শব্দ করছিল। শফিক পিস্তলটা ডান হাতে শক্ত করে ধরে। দরজা খুলবে ঠিক তার আগে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
"কে?"
ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,
"আমি। ডিটেকটিভ অফিসার। তীব্র আহমেদ। "
শফিকের মাথা থেকে যেন ভারি কিছু একটা সরে গেল। বেশ হালকা অনুভব করল ও। পিস্তলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর দ্রুত দরজা খুলে দিয়ে বলে,
"আসুন। ভেতরে আসুন।"
তীব্র ভেতরে ঢুকলো। হাতের ছোট্ট ব্যাগটা সোফার পাশে রেখে সোফায় বসলো। শফিকে দরজা লাগিয়ে এসে বিপরিত পাশের সোফাতে বসতে বসতে তীব্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
"কি ব্যাপার। হঠাৎ এত রাতে এলেন যে?"
তীব্র মৃদু হাসলো। বলল,
"খুব বিরক্ত করে ফেললাম না তো।"
শফিক হেসে উত্তর দিলো,
"নাহ। মোটেও বিরক্ত করেন নিই। বরং ভালোই হয়েছে। আমি একা একা বোর হচ্ছিলাম। আপনি এসেছেন এখন গল্প করা যাবে।"
"আমি কিন্তু মোটেও গল্প করতে আসি নিই। কেসটার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। দারুণ একটা খবর দেওয়ার আছে আপনাকে। এ জন্যেই তো এতো রাতে ছুটে আসা।"
শফিক যেন ভীষণ খুশি হলো। মুখটা বেশ উজ্জ্বল করে বলল,
"কি খবর? খুনিকে পেয়েছেন?"
"না ঠিক পাই নিই। তবে এমন একটা ক্লু পেয়েছি যেটা দ্বারা খুনিকে ধরা সম্ভব।"
"ক্লু? কিসের ক্লু? আর ক্লু পেলে খুনিকেই না ধরতে যাবেন? আমার কাছে কেন আসছেন?"
"আপনার কাছে এসেছি কারণ আপনার দ্বারাই খুনিকে ধরা সম্ভব।"
শফিক যেন একটু থতমত খেয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
"আমার দ্বারা? "
"হ্যাঁ আপনার দ্বারাই। "
"বেশ। তবে বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে? "
"বলছি৷ তার আগে বলুন আপনি কি দুই কাপ চায়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন? আসলে এতক্ষণ ফাইল ঘাটাঘাটি করছিলাম তো তাই খুব টায়ার্ড লাগছে। আচ্ছা ভালো কথা,ভাবি কই? দেখলাম না যে?"
শফিক যেন একটু আহত হলো। মুখ কালো করে বলল,
"আর ভাবি!  একটা বিয়ে যাও করতে চেয়েছিলাম তাও হলো না। এর মাঝেই খুনাখুনি শুরু হয়ে গেলো। হাহ! ভাবি আসার আগেই চলে গেলো। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন, এত বছর রাজনীতি করেছি, কিন্তু কখনই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই নিই। এতটা ভয় কখনই পাই নিই। বিশেষ করে ওই তিন জনের লাশ যখন দেখলাম না তখন থেকেই আমার চোখের ঘুম উধাও। ছিহ! এত বাজে ভাবে কেউ কাউকে খুন করে?"
"হ্যাঁ ব্যাপারটা আমার কাছেও বেশ বাজে লেগেছে। এমন দয়ামায়াহীন ভাবে কেউ কাউকে খুন করে?তবে ভাই, খুনির সাহস আছে বলতে হবে।"
"তা ঠিক। আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না স্যার, আমি আসলে চা টা বানাতে পারি না। ঘরে বিস্কুট আছে।দিবো?
" নাহ। চা হলেই চলতো। তবে আপনি কি চা পান করেন না?"
"করি। তবে সেটা সকালে বুয়া বানিয়ে দিলে আরকি। আমি সাধারণত এসব বানাতে পারি না।"
তীব্র এবার হাসলো। বললো, 
"আচ্ছা এমন করলে কেমন হয়,আজ আমি আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াই!"
শফিক অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
"আপনি চা বানাবেন?"
"হ্যাঁ। অনেক আগেই শিখেছি। আপনার ভাবির কাছ থেকে।"
"বেশ তো। হয়ে যাক চা।"
তীব্র হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে কিচেনের দিকে গেল। শফিক সিগারেটে আগুন ধরিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল।
.
শফিকে চায়ে চুমুক দিয়েই বলল,
"বাহ! বেশ ভালো চা বানান তো।"
"আপনার ভাবিও বানাতো। কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? আপনার ভাবি না আজকাল চা বানায় না।"
"কেন? কি হয়েছে?”
" কি জানি। আচ্ছা বাদ দিন। কাজের কথায় আসি। আচ্ছা আপনি কি কখনো উত্তরাতে গিয়েছেন?"
"হ্যাঁ গিয়েছি তো। অনেক বারই গিয়েছি।"
"আমি ওখানকার একটা ফাইল পেয়েছি। যেখানে একটা মামলায় আপনাকে দোষী করা হয়েছিল। মনে আছে কিছু সেটার সম্পর্কে?"
শফিক কিছু সময় কিছু একটা ভাবল।তারপর আমতা আমতা করে বলল,
"হ্যাঁ মনে আছে। আচ্ছা এসব বাদ দিন। কেসের কথা বলুন।"
"সেটাই তো বলছি। আচ্ছা আপনার কি রহমান মঞ্জিলের কথা মনে আছে কিংবা সেই বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটের সদ্য প্রেগন্যান্ট মেয়েটার কথা মনে আছে যাকে আপনারা ছয়জন মিলে রেপ করেছেন?"
শফিকের ভ্রু এবার কুচকে আসে। সে বেশ সন্দেহ দৃষ্টিতে তীব্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আপনি এত কিছু ক্লিয়ারলি বলছেন কিভাবে?"
"ওই ফাইলেই পেয়েছি। আচ্ছা রেপ করেছিলেন কেন বলেন তো?"
"দেখুন এসব আজেবাজে প্রশ্ন করবেন না। কি সব বলছেন?অন্য প্রশ্ন করুন।"
"আপনি কিন্তু আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আপনি সব ক্লিয়ারলি বলবেন। প্লিজ হেল্প মি। এছাড়া আমি আর উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।"
শফিক কিছু সময় চুপ করে থাকলো। কিছু একটা ভাবলো। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আসলে তেমন কিছু না। ওই মেয়েটা এখানকার একটা কলেজের প্রফেসর ছিল। একদিন আমি আর আমার বন্ধুরা মিলে কলেজের একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম কলেজের পিছনের দিকটায়। সেখানে আমরা মেয়েটাকে রেপ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা কিভাবে জানি ওই মহিলা দেখে ফেলে। তারপর সেটার ভিডিও করে আমাদের কাছে এসে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায়। কয়েকটা পোলাপান জড়ো হয় সেখানে। যাওয়ার সময় বলে যায় যে এই ভিডিও পুলিশের কাছে যাবে। কলেজ কিংবা পুলিশের লোকে জানলে প্রব্লেম হতো না। আমাদের ভয় ছিল এটা মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া নিয়ে। তাই সেদিন রাতেই আমরা উনার বাসায় গিয়ে..."
শফিক চুপ হয়ে যায়। কিছু বলে না আর। তীব্র বলে,
"যাই হোক কাজটা করা আপনার ঠিক হয় নিই। সরকারের চাকরি করি বিদায় আপনার এই কেসে কাজ করছি। নচেৎ  এই কাজ আমি জীবনেও করতাম না। বাদ দিন। আচ্ছা আপনি কি জানেন ওই প্রফেসর মেয়েটির স্বামী স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে লাপাত্তা। কেউ কোথাও খুঁজে পায় না। বাই এনি চান্স যদি এই খুনি সেইই হয়! দেখুন সে কিন্তু খুঁজে খুঁজে আপনাদের দলের তিন জনকে মেরেছে যারা ওই কাজের সাথে জড়িত ছিল। এবার আপনার পালা..."
তীব্র শেষ করতে পারলো না। ঠিক তখনই দরজায় কেউ ঠক ঠক শব্দ করলো। শফিক এবং তীব্র দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। সেই খুনি আসে নিই তো? শফিক জলদি করে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে গুঁজে থাকা পিস্তলটা বের করে ফেলে।সোজা তাক করে রাখে দরজার দিকে। যেন খুনিকে দেখা মাত্রই গুলি করে দিবে। তীব্র নিজের পিস্তলটা বের করে রাখল। তীব্র খুব আস্তে করে শফিককে বলল,
"আরে! আপনার কাছে পিস্তল আসলো কোত্থেকে?"
শফিক কপালের ঘাম মুছে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,
"এই খুনির ভয়েই নিজের সাথে পিস্তল রাখতে হচ্ছে।"
তীব্র হাসলো। শফিকে একেবারে কাছে এসে বলল,
"চিন্তা করবেন না। আমার পিস্তলের বুলেট মিস যায় নি আজোও।"
শফিক কিছু বলল না। কেবল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করল। তবে শফিক ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। যেন একটু হেলতে ছিল। যেন সদ্য মদ পান করেছে সে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
"কে?"
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
"আমি। কামরুজ্জামান। "
শফিক এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"উফফ্!  ওসি সাহেবে এসেছেন। আমি তো ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম।"
তীব্র হাসলো। বলল,
"হ্যাঁ আমিও।"
এই বলে সে দরজা খুলতে চলে গেল। শফিক তখন হুট করে সোফার উপর বসে পড়লো। তার সমস্ত শরীরে একটু শক্তিও যেন বেঁচে নেই। সব পানি হয়ে গিয়েছে। সে নিজের মাঝে অদ্ভুত এক অস্বস্তি অনুভব করল।কামরুজ্জামান রুমে এসে রুমে এসে শফিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
"মালটাকে বশে আনতে পেরেছিস তাহলে?"
পাশ থেকে তীব্র বলল,
"এরচেয়ে কত বড় বড় সন্ত্রাসীকে বশে নিয়ে এসেছি। এ তো কিছুই না।"
"কিভাবে করেছিস?"
"ওই যে চায়ে ঘুমের ঔষধ দিয়ে।"
এই বলে হাসলো ও। কামরুজ্জামানও হাসলো। দু'জনকেই বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। আর শফিক অবাক দৃষ্টিতে বাকরুদ্ধ হয়ে তা দেখছে। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তীব্র দ্রুত সোফায় বসে টি টেবিলের উপর নিজের ছোট্ট ব্যাগটা রাখল। সেটা খুলতেই দেখা মিললো একটা ধারালো ছুরি,একটা স্ক্রুড্রাইভার, একটা ছোট্ট হাতুড়ি এবং আরো ক্ষুদ্র কিছু যন্ত্রপাতি। এগুলো মেলে ধরলো শফিকের সামনে। সে তখন চোখ বড় বড় করে তীব্রের দিকে তাকালো। তীব্র তা দেখে হাসলো কেবল। বলল,
"বলেছি না তোর ভাবি আমাকে আর চা খাওয়ায় না। কেন খাওয়ায় না জানিস? কারণ তাকে তুই মেরেছিস। তার পেটে থাকা আমার ভবিষ্যতকে মেরেছিস। ছিহ! কী নির্মম ভাবেই না মেরেছিস। এখন তুইই বল আমি তোকে এত সহজে কিভাবে মারি। আমি তার স্বামী, যে কিনা দেশের একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ, সে কিভাবে এত সহজে তার স্ত্রীর খুনিকে মারে? তোকে তো কষ্ট দিয়ে মারবো। অনেক কষ্ট দিবো। এখন ঘন্টা খানেক মন দিয়ে ঘুমা। তারপর তোর মরার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই বলে তীব্র হাসতে থাকলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি কামরুজ্জামানও বেশ হাসলেন। যেন এর চেয়ে ভালো জোক আর হয় না।
তীব্র আবার বললো, 
" তোর ওই তিন চ্যালারে একটু কম কষ্ট দিয়েছি। বাট ইউ ডোন্ট ওরি। তোমার বেলায় একটুও কম হবে না। বরং বেশিই হবে। হাহাহাহা।"
তীব্র উন্মাদের মতো হাসে। হাসতে হাসতে কান্না করতে থাকে ও। তার একটা ছোট্ট সংসার হতো।  একটা ফুটফুটে বাচ্চা হতো। আনন্দ হতো। আজ কিছুই হচ্ছে না। আজ প্রতিশোধ নিতে হচ্ছে। এক উন্মাদের ভালোবাসার মানুষ হারানোর প্রতিশোধ। অগত সন্তান হারানোর প্রতিশোধ। তীব্র স্থির থাকতে পারে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কামরুজ্জামান তা দেখে। তার চোখেও জল জমে। বন্ধুর এমন কষ্ট সহ্য হয় না ওর। একটুও সহ্য হয় না। সে তীব্রের দিকে এগিয়ে যায়।শফিক তখন জীবনের শেষ বারের মতো ঘুমাচ্ছিল।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url