গল্পঃ মায়া
গল্পঃ মায়া
লেখকঃ তাসফি আহমেদ
আমি আমার অবাক হওয়া মুখটা চটজলদি ফিরিয়ে নিলাম| হঠাৎ ই মনে হল এ পাড়ের যে কষ্ট গুলো আছে,যে কষ্ট গুলো আমাকে গিলে খাচ্ছে, সে কষ্ট গুলোর ভার না কমতেই যদি অন্য কষ্টের আগমন ঘটে তাহলে আমি নেহাত আর বেঁচে থাকব না। কষ্ট গুলো এক সময় সম্পুর্ন আমাকেই গিলে খাবে। ওপাড়ের শান্তির খোঁজে গিয়ে যদি কষ্টই পাই তাহলে এ মন আর মন থাকবে না। পাথরে পরিনত হবে। খামখা ওদিকে না যাওয়াই ভালো। বরং একে অবহেলা করে তাড়িয়ে দেই। সে কোনো দূর দেশের পরী হোক কিংবা বিশ্ব সুন্দরী হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি নিজের মনোবেদনা দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করি,এই হবে আমার জন্যে উত্তম পন্থা। মেয়ে মানুষ মানেই কোন তীব্র মায়ার নাম। আর কারো মায়ায় পড়তে ইচ্ছে নেই আমার। প্রথম যার মায়ায় পড়ে তাকে প্রচন্ডরকমে ভালোবেসেছিলাম, আজ তার সেই মায়া,সেই ভালোবাসা আমাকে দৈনিক কষ্ট দিয়ে মারছে। একটু একটু করে মারছে আমাকে। এখন আমাকে মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হয়। নিজেকে আড়াল রাখতে হয়; অন্ধকারের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হয় আমার। যেই কষ্টে আমি আজ জ্বলে পুড়ে মরছি সেই কষ্ট আমি আবার পেতে চাই না। মায়া বড় মারাত্মক জিনিস। এটি নিরবে কাউকে খুন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। হঠাৎই যেন একঝাক মৌনতা আমাকে চেপে ধরল। কিছু বলার শক্তিটুকু পাচ্ছি না যেন আমি। পাশের মেয়েটিও যেন নিরব দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমার অস্বস্তি লাগছে এতে। কেউ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে। তারউপর সে যদি অপরিচিত হয় তাহলে তো কথাই নেই। আমি আরেকটু সরে বসলাম। বেঞ্চটার একেবারে কোনায় গিয়ে বসলাম। এই বেঞ্চ এবং এই পার্ক বেশ পরিচিত আমার কাছে। অর্পাকে নিয়ে প্রায়ই আসতাম এখানে। তাই হয়তো বেশি ভালো লাগে। সত্যি বলতে আমার কষ্ট যেন একটু লাগব হয়। তাই বারবার আসা। কিন্তু আগে কখনই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই নি। কি একটা অস্বস্তিকর মূহুর্ত তৈরি হচ্ছে চারপাশে। চারপাশটা যেন বিষন্ন হয়ে উঠছে। কালো মেঘ জমাট বাঁধছে যেন। আমার এই মূহুর্তে উঠে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু অদ্ভুত কোন এক কারণে আমি উঠতে পারছি না। কিছু একটা যেন আমাকে আঠার মত চেপে ধরে রেখেছে বেঞ্চিটার সাথে। আমি উঠবো উঠবো বলেও উঠতে পারছি না।
.
"আপনাকে আমি প্রায়ই দেখি এখানে আসতে। এসে ঠিক এই বেঞ্চেই বসে থাকেন। তাও আবার বেশ নিরব হয়ে। যেন কোন প্রান নেই। নির্জীব হয়ে বসে থাকেন। কেন? এমন করে থাকেন কেন বলেন তো? "
আমাকে একটু অবাক হতে হল। সে আমাকে লক্ষ্য করছে এতদিন। আমি বললাম,
"আপনি আমায় লক্ষ্য করছেন?"
"করছি। বেশ কদিন থেকেই। পার্কের পাশেই আমাদের বাসা। তাই প্রায় বিকেলেই এখানে আসি আমি। এদিক ওদিক হাঁটাহাটি করি। বেশ ভালো লাগে আমার। কিন্তু যেদিন আপনাকে দেখি সেদিনই আমার সব ভালো লাগা উবে যায়। হায়! চারপাশের মানুষজন এত খুশি, চারদিকে এত সৌন্দর্য যেখানে সবাইকে আনন্দ দেয়, সেখানে কেবল একজন মানুষ আছে যে প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে বসে থাকে এখানে। সেই মানুষটাকে দেখে আমার কষ্ট হয়। সেদিনই জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম। কিন্তু পারি নি। কি একটা সংকোচ বোধ যেন কাজ করছিল নিজের মাঝে। তারপর অনেক চেষ্টা করেছি। ফাইনালি আজ সাহস করে বলেই ফেললাম।আচ্ছা আপনি আপনার চারপাশটা এত কষ্টময় করে রাখেন কেন বলেন তো? কি এত কষ্ট আপনার? "
আমি কেবল স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। আশ্চর্য! মানুষ এত কথা বলে কিভাবে? এই মেয়েটা এক সাথে কতগুলো কথা বলে ফেলল। কিভাবে পারল সে!
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম,
"এমনিই"
"এমনিই না। কোন গল্প তো আছেই। সেই গল্পটা শুনতে চাচ্ছি আমি।"
আমি অনেকটা সময় চুপ করে থাকলাম। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটা তো ঠিকই বলেছে। একটা গল্প তো আছেই এই কালো জগৎ এর পিছনে। সেই গল্পটা যদি এই মেয়েকে বলি তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে? আমার মন সায় দিল। যে গল্পটা আজো কাউকে বলা হলো না সেটা আজ ব্যক্ত করার জন্যে উঠে পড়ে লাগল। যেন তর সইছে না তার। আমি বললাম,
"শুনবেন। ধৈর্য আছে? "
মেয়েটা মৃদু হাসল। বলল,
"শুরু করুন।"
আমি কিছু সময় চুপ ককরে থাকলাম। তারপর বলতে শুরু করলাম।
.
"ভার্সিটিতে জিবনে একটা বন্ধু জোটে আমার। মেয়ে বন্ধু। নাম অর্পা। এই গল্পের মূল চরিত্র। যাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি এবং আমার মাঝে যে কষ্ট গুলো আপনি দেখতে পান সেই কষ্ট গুলোর উৎস অর্পার। আমাদের অনেক সময় কাটে এক সাথে। ক্লাস করা,আড্ডা দেওয়া, ঘুরতে যাওয়া এসব আমরা এক সাথেই করতাম। এতকিছুর মাঝে হঠাৎই আমি একদিন অনুভব করলাম যে অর্পা নামের যে মেয়েটি আছে তাকে আমি প্রচন্ড রকমে ভালোবেসে ফেলেছি। যেন তাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব। সেখান থেকেই তাকে আমি বন্ধু থেকে আরো বেশি কিছু ভাবতে থাকি। আমার সমস্ত দুনিয়া যেন চট করেই রঙিন হয়ে উঠল।যেন আমি দ্বিতীয় কোন জগৎ এ প্রবেশ করলাম, যেখানে জগতের সমগ্র ভালোবাসা এসে জড় হয়েছে।আমি আনমনে, মনের অবচেতনে কেবল তার কথাই ভেবে গেলাম। তাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন পর্যন্ত দেখা শুরু করে দিয়েছে। যাা ছিল আমার জীবিনের মস্ত বড় একটা ভুল। যেই ভুলটার কারনে আজ আমায় কষ্ট পেতে হচ্ছে। কারো অনুমতি ছাড়া তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যে কত বড় অপরাধ সেটা সেদিন অর্পা চোখে অঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যেদিন আমি ওকে প্রথম ভালোবাসি কথাটা বলেছিলাম এবং সেই অপরাধেরই শাস্তি সে আমাকে দিচ্ছে।"
এ পর্যন্ত এসে আমি থামলাম। বুকের বাঁ পাশে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত কষ্টটা বিস্তৃতি মেলছে দ্রুত। কষ্ট ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দেহে,প্রতিটি অঙ্গে। আমার এমন মৌনতা দেখে পাশের মেয়েটি বলল,
"প্রপোজ করেছেন তাকে? "
"হ্যাঁ"
"গ্রহন করে নিই "
একটু চুপ করে থাকলাম।তারপর বললাম,
"না "
মেয়েটা চুপ হয়ে গেল এবার। আমি তার দিকে আড়চোখে তাকালাম একবার। সে তীব্র আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি আবার বলতে শুরু করলাম,
"সেদিন রবিবার ছিল। শেষ ক্লাসটা ছিল না। ক্যাম্পাসের ঘাসের উপর পা মেলে বসে অর্পা হাতের বইটা খুলল। বইটার নাম ছিল 'নৌকাডুবি'। রবি ঠাকুরের লিখা। ওর এই একটা বদ অভ্যাস। মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে আসলেও বই পড়ে সে। আমি বাধা দেই না। চুপচাপ বসে থেকে তাকে পড়ার চেষ্টা করি। আর সে 'নৌকাডুবি' পড়ায় ব্যস্ত। আমার হুট করেই কি হল বুঝলাম না। ওকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলাম। বললাম,
"কি পড়িস "
ও আমার দিকে তাকাল বেশ শান্ত ভাবে। তারপর হাসল। বলল,
"রবি ঠাকুরকে পড়ছি।"
"সে তো এখন আর নেই। তাকে পড়ার কি দরকার। বই রাখ। আমার দিকে তাকা। এই চোখের দিকে তাকা। আমাকে পড়।"
ও এবার একটু শব্দ করেই হাসল। বলল,
"কি সব বলছিস। মাথা ঠিক আছে? "
"নারে। কিছুই ঠিক নেইম সব উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে। "
অর্পা আবারো হাসল। বলল,
"তা কে এই মহান কাজটি করল শুনি? "
"এই চোখ দুটোর দিকে তাকা। বুঝতে পারবি।"
অর্পা বইটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি গভীর দৃষ্টিতে। হঠাৎই অর্পার চেহারাটা বিবর্ন হয়ে যায়। ফর্সা মুখটা যেন জলদিই কালো হয়ে যায়। তারপর বইটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াবে ঠিক তার আগে আমি তার হাত ধরে ফেলি। বলি,
"চলে যাচ্ছিস কেন? "
"আমার ভালো লাগছে না।"
"কেন? "
ও কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি বলি,
"আমাকে পছন্দ করিস না তুই?
অর্পা অনেক্ষন কিছু বলল না। তারপর বলে,
"আমি তোকে নিয়ে
তেমন কিছু ভাবি নিই। আমার জগতে অন্য কেউ আছে।আমি যেমন তোর চোখে ভালোবাসা দেখি, তেমনি সেও আমার চোখে ভালোবাসা দেখে।"
আমি চুপ করে যাই। একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি বুকে বাঁ পাশে। চোখে জল জমতে শুরু করে। আমি বেশ কষ্ট করে তা আড়াল করি। বলি,
"আগে তো কখনো বলিস নি। কে সে? "
"আছে একজন। কাল পরিচয় করিয়ে দিব তোর সাথে।"
আমি কি বলবো ভেবে ফেলাম না। চুপ করে থাকলাম কেবল। এছাড়া আর উপায়ও বা কি আছে।অর্পা বলে,
"দেখ তোর এই মন মরা ভাব দেখলে আমার ভালো লাগে না। এমন করিস না। যা হবার নয় তা নিয়ে কষ্ট পাওয়াটা হবে তোর বোকামি। "
আমি মনের অবচেতনে বললাম,
"কিভাবে ভালো থাকবো বল। তোকে নিয়ে যে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছি আমি। আমার জগতটা যে কেবল তোকে ঘিরেই।সেই জগতে তোকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকবো বল। "
"এটা তোর ভুল। আমি কি তোকে বলেছি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে। কারো অনুমতি ছাড়া কেন তুই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবি। এটা তোর অপরাধ। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে। এটা অনিবার্য।"
আমার কিছু বলার থাকে না আর। আমি চুপ করে, মাথা নিচু করে বসে থাকি। অর্পা উঠে দাঁড়ায়। বলে,
"আমি আশা করবো তোর এমন অনুভূতি আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কোন ব্যাঘাত ঘটাবে না। এসব ভুল যা। ভালো থাকিস।"
অর্পা এক পা,দু পা করে হেঁটে চলে যায়। আমি ঠায় বসে থাকি পাথর রূপে। ঠিক সেদিনই আমি আমার অর্পাকে হারিয়ে ফেলি। একেবারের জন্যে হারিয়ে ফেলি। সাদিকের সাথে পরিচয় হয় এর এক সপ্তাহ পর। এই এক সপ্তাহ নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছি। নিজেকে একেবারে আড়াল করতে চাইছি। পারি নি। এটা পারা যায় না। ভালোবাসার মানুষকে ভুলে থাকা যায় না। না দেখে থাকা যায় না।যদি সে নিজের সামনে থাকে তাহলে তো না-ই। এক সপ্তাহ দম বন্ধ করে পড়েছিলা অন্ধকার ঘরে। আমার সত্যিই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অর্পাকে দেখি না। ওকে না দেখায় মনের মাঝে এক প্রকার অস্থিরতা কাজ করতো। বারবার ওকে দেখতে চাইতো আমার এই মন। ওর ছবি দেখতাম। মন ভরে দেখতাম। তবুও যেন শান্তি পেতাম না। এই ছবি দেখে শান্তি পাওয়া যায় না যেন। কোথাও যেন কিছু একটা নেই। এক প্রকার শূন্যতা কাজ করে নিজের মাঝে। তাই এক সপ্তাহ পর নিজেকে আর না ধরে রাখতে পেরে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেদিনই সাদিকের সাথে আমার সাক্ষাত করিয়ে দেয় অর্পা। যাকে দেখে আমার চমকে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। আমি কেবল বাকরুদ্ধ হয়ে তাকে দেখলাম। মেকি হেসে কুশল বিনিময় করলাম।তারপর অর্পাকে আড়াল করে ডেকে নিয়ে এনে বললাম,
"কি রে! করছিস কি? এই ছেলেকে তোর পছন্দ হয়েছে? ওকে তুই ভালোবাসিস? "
অর্পা হাসল। বলল,
"কেন পছন্দ হয় নিই? "
"দেখ তুই ভালো করেই জানিস ও কেমন ছেলে। এর আগেও অনেক প্রেম করেছে। চামড়া সাদা হলেই যে তাকে ভালোবাসতে হবে তা কিন্তু না।"
"শুন, ওর সম্পর্কে সব কিছু জানা আছে আমার।এসব জেনেই ওর সাথে জড়িয়েছি আমি। এখন দেখ,কিভাবে ওকে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে ভালো করবো।"
আমার আর কিছুই বলার থাকল না। আমি কেবল চুপ করে থাকলাম। আর নিজের প্রান প্রিয় বন্ধু কে কোন অন্ধকার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখলাম। অর্পা কেবল সেদিনই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। এরপর আমি ওর থেকে বিন্দুমাত্র ভালো ব্যবহার পাই নিই। একসময় আমাকে দূরে ঠেলে দেয় সে। সাদিক নামক বর্নহীন ছেলেটাকে টেনে নিয়ে আনে কাছে। যে সাদিক কেবল একটা মানুষই না, সে একটা অন্ধকার জগৎ। যে জগৎ নেশা করা আর মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার খারাপ লাগে এটা ভেবে যে আমার ভালোবাসার মানুষটিও সেই জগতে পাঁ দিচ্ছে। এখানে আমার কিছুই করার ছিল না। তবুও করেছি। এতে অপমানিত হয়েছি। রাস্তায় একগাদা লোকের সামনে চড় খেয়েছি কেবল এটা বলার অপরাধে যে 'তুই খারাপ দিকে যাচ্ছিস। ওদিক ভালো নয়।'। এটা নেহাত আমি তার ভালো বন্ধু বলে করেছি।ভালোবাসি বলে না। কিন্তু তখন কি আর আমার কথা তার ভালো লাগে! সে সাদিক নামক রোগে আক্রান্ত ছিল।আমি কিছু বললে সেটা তার কাছে বিষের মত লাগল।তবুও আমি বারবার তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, তবুও তার মোহ কোন মতেই কাটাতে পারি নি। ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত এক মোহের না। আমি যেমন অর্পার মোহে আক্রান্ত তেমনি অর্পা সাদিকের মোহে। দুজনেই এক। তবে ভুলটা হল সে যে মানুষের মোহে পড়েছে সে মানুষ, মানুষ না। একটা পশুর সমতুল্য। এর কয়েকমাস পরের কথা। অর্পার সাথে আমার একদমই দেখা হয় না। আমি তাকে খুঁজে পাই না ক্যাম্পাসে। আমার সময় গুলো তখন কাটছিল তীব্র বেদনায়। কষ্টে জর্জরিত হচ্ছিলাম তখন। খুব মিস করতাম অর্পা নামের মেয়েটাকে। ও যে গাছ তলায় বসত সেখানে বসে 'নৌকাডুবি' বইটা পড়ার চেষ্টা করেছি বহুবার। বিশ্বাস করুন আমি একবারও পড়তে পারি নি। বইটা হাতে নিলেই আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়তাম।মুখ লুকিয়ে কান্না করতাম তখন। বইটা স্পর্শ করতাম খুব যত্ন করে। যেন এখানে অর্পার স্পর্শ লেগে আছে। গাছতলার ঘাস গুলোতে পাগলের মত হাত বুলাতাম। যেন অর্পা আমার পাশে বসে আছে। আমি তার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বসে আছি। কি এক কষ্টময় জীবনজাপন করছিলাম তা বলে বুঝাতে পারবো না। এদিকে আমার এমন ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে বাবা মা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। মা তো অসুস্থই হয়ে যান। ডাক্তার এসে মাকে দেখে যায়। প্রচুর টেনশনের কারনে মায়ের প্রেশার বেড়ে যায়। তাই মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। আমাকে ঔষধ আনতে যেতে হয়। আমার এখনো কেবল মনে হচ্ছে ওখানে না যাওয়াটাই আমার জন্যে উচিৎ ছিল।ওই দৃশ্য না দেখা আমার জন্যে বড় উত্তম হত। তবুও দেখে ফেলি। সাদিক! একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে। যেই মেয়েটার হাত ধরে হাঁটছে তাকে আমার বেশ ভালো করে চেনা আছে। আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে। দ্বিতীয় বর্ষের মেয়ে। যাকে সাদিক আগ থেকেই ভালোবাসতো।হাহা! ভালোবাসা! সে তো একটা ছলনা ছিল সাদিকের কাছে। কে জানি! কতটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে সে। সেদিনই আমি কয়েকটা ছবি তুলি। ছবি তুলে ছুটে যাই অর্পার কাছে। তাকে দেখাই। সে বিশ্বাস করে না। জানেন অর্পা সেদিন কি বলেছে? বলেছে, 'আমাদের ভালোবাসা দেখে তোর হিংসে হয়। তুই সহ্য করতে পারিস না। কি ভেবেছিস, এসব দেখিয়ে ওর সাথে আমার রিলেশন ভাঙবি? ভুল ভাবিস তুই। আমি ওকে ছাড়ছি না। "
বলা বাহুল্য, আমার সত্যিই হিংসে হচ্ছিল। কষ্টও। কিন্তু এসব আমি কষ্ট কিংবা হিংসে থেকে করছি না। এসব কেবল বন্ধুত্ব থেকে করছি। ওকে অনেক বোঝাই। ওকে বুঝে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একগাদা লোকের সামনে অপমান করে আমায়। জীবনে প্রথমবারের মত চড় মারে। আমি মুখ বুজে সহ্য করি। তারপর একেবারে আড়াল হয়ে করে ফেলি নিজেকে। প্রায় সাত আট মাস তার সামনে যাই নি। কেবল এই পার্কে আসতাম কিছু সময়ের জন্যে। ভার্সিটিতে সেমিস্টার ড্রপ দেই। পড়াশোনা শুরু করতে চেষ্টা করি আবার। কিন্তু হয় না। ভেতর থেকে কোন আনন্দ, ফূর্তি করার সায় মেলে না। গম্ভির, মন মরা হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হয় আমার।সাত কি আট মাস পর একদিনের কথা, আমি এই পার্কের এই বেঞ্চিতেই বসে ছিলাম। মনে একগাদা কষ্ট নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলাম কেবল। শুনেছি নীল আকাশ কষ্ট চুষে নিতে পারে। আমি সেই আশায় আকাশ দেখি। সত্যি বলতে এই বিশাল নীল আকাশ একটু হলেও আমার কষ্ট চুষে নিতে পেরেছে। পুরোটা নেয় না। নিতে পারে না। যে কষ্ট আত্মার সাথে মিশে গিয়েছে সে কষ্ট নিতে পারে না সে। সে কষ্ট নিতে হলে আমার এই কষ্টে জর্জরিত আত্মাকে নিতে হবে যা কখনই সম্ভব না। আমি চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঠিক তখনই একটা চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে পাশে তাকাই। অর্পা বসে আছে আমার পাশে। তার চোখের নিচে কালী যেন কেউ মেখে দিয়েছে।চোখ দুটো যেন খাদের ভেতর পড়ে আছে। ফর্সা, উজ্জ্বল মুখটা মলিন হয়ে আছে। ও বলে,
"কেমন আছিস? "
আমি মৃদু হাসি। বলি,
"ভালো।তুই কেমন আছিস? "
ও কিছু সময় চুপ করে থাকে। তারপর উদাসী হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
"হাহ! ভালো থাকা শব্দটা বেশ কয়েকদিন আগেই আমার জীবন গল্প থেকে হারিয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর ভালো থাকা হয় না আমার। দুঃখে থাকা হয়।"
"কেন? কি হয়েছে? আর সাদিক কই? "
অর্পা আর কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। তারপর হুট করেই কান্না করতে থাকে। ডুকরে কেঁদে উঠে ও।আমি ওর হাত ধরি। বলি,
"কি হয়েছে বল? "
ও কিছু বলে না। চুপচাপ আমার হাতটা চেপে ধরে নিজের পেটে হাত রাখে। আমি ভীষন রকমে অবাক হই। অদ্ভুত ভাবে এক প্রকার কষ্ট অনুভব হয় আমার মাঝে। হঠাৎই আমি অনুভব করলা আমি কাঁদছি। চোখে দিয়ে বাধাহীন ভাবে জল পড়ছে।আমি ভেজা কন্ঠে বলি,
"সাদিক?"
"তাকে জানিয়েছি। সে এই বাচ্ছার দায় ভার নিতে প্রস্তুত না। ওকে মেরে ফেলতে বলে। আচ্ছা তুই বল,আমি এটা কিভাবে করি? কিভাবে একটা জীবনেক এভাবে মেরে ফেলি? "
"কেন? পারবি না কেন? তোকে পারতে হবে।ঠিক যেভাবে পেরেছিস চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ হতে, ঠিক সেভাবেই তোকে এই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে হবে।"
অর্পা কিছু বলল না। কেবল আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি লক্ষ্য করলাম যে অর্পা খানিকটা রেগে যাচ্ছে কথাটা শুনে। ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসছে। তবুও কিছু বলছে না। নিজের রাগকে চেপে রাখছে। এখানে আমারও কোন দোষ নেই। কথাটা আমি ইচ্ছে করে বলি নিই। মনের ভেতর পাহাড় পরিমান অভিমান জমে আছে ওর উপর। কথাটা ঠিক সেই অভীমানের জোরেই বলেছি। মনের জোরে না। এই ব্যাপারটা অর্পা কিভাবে যেন বুঝে গেল। তাই আমার দিকে নিজের অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে কোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মূহুর্তেই। মূহুর্তের মঝে নিজেদের চেহারার ভাবমূর্তিটা পরিবর্তন করে ফেলার এক অদম্য ক্ষমতা রাখে মেয়েরা। বিধাতা তাদের এমন অদ্ভুত অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। অর্পা বেশ শান্ত কণ্ঠেই বলল,
"আমার উপর তোর খুব অভীমান জমেছে তাই না। খুব রাগ হয়েছে। আমি কি করবো বল। কি একটা মোহে যে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে বলে বুঝাতে পারবো না। যে মোহ কেবল আমাকে সাদিকের দিকে টানতো। তার প্রতি আকৃষ্ট করতো। সেই মোহটা যে প্রচন্ড অন্ধকার ছিল সেটা জানতে পেরেও সেদিকে পাঁ দিয়েছি। কেন দিয়েছি জানিস? একটু ভালবাসা পাবার আসায়। তখন আমি ভালোবাসা পাবার আসায় বিভোর ছিলাম। একটু ভালোবাসা পাবার আশায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম।যার ফল আমি এখন পাচ্ছি।"
"একটা জিনিস কি জানিস, নিজের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার জন্যে,নিজের ভালোবাসা উপস্থাপন করার জন্যে,নিজের ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্যে যে মেয়ে নিজেকে, নিজের সতীত্বকে চার দেওয়ালের মাঝে, কোন এক নরপিশাচের কাছে বিলীন করে দেয় সেই ভালোবাসা কোন ভালোবাসাই না। যে ছেলে ভালোবেসে নিজের প্রেয়শীকে চার দেওয়ালের ওপাশে অন্ধকার জগতে নিয়ে যায়,অন্তত সেই ভালোবাসা কোন ভালোবাসা না। সেটা ছিল তোমার শরীর পাওয়ার একটা নীল নকশা। মেয়েরা এই জিনিসটা কেন জানি বুঝে না। অন্য ছেলের সাথে রুমে যেতে তারা বিন্দুমাত্র আপত্তি করে না। এই মেয়েরা হয় খুব বড়সড় রকমের ঠকবাজ। বা এদের ঠকবাজও বলা ঠিক হবে না। এরা রুমে যাওয়ার আগে কখনো ভাবে না যে যদি এই ছেলের সাথে তার বিয়ে না হয়, তাহলে কিভাবে বাসর ঘরে নিজের স্বামীর সাথে একান্তে রাত কাটাবে। তার কি শরীর কাঁপবে না যখন নিজের হতে অন্য কারো ছোঁয়া পাবে, যেখানে আগে অন্য কেউ এই হাত ছুঁয়েছে। হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়েছে? তখন তাদের অনুভূতি কেমন হবে? নিজেকে কি একবারের জন্যেও প্রতারক মনে হবে না? অবশ্যই হবে। এই প্রতারকের একটা ভার এবং ছোট্ট এক টুকরো কষ্ট নিয়ে তাদের জীবন কাটাতে হবে। সেই কষ্টের ভাগ সে নিজের স্বামীকেও দিতে পারবে না। একা একা, দিনরাত কষ্ট পেয়ে মরবে সে। এই জিনিসটা যদি সে আগে একবার ভেবে দেখতো,আগে একবার এই কষ্টের ভারটা অনুভব করতো তাহলে কোন মেয়ে কখনই এমন রুমের ভেতরে যেত না। অর্পা তুই ঠিক সেই ভুলটাই করেছিস। এখন তার মাশুল হচ্ছে এই বাচ্চা। যাকে এখন তুই চাইলেই মেরে ফেলতে পারবি। কিন্তু আমি জানি তোর অন্তত সেই শক্তিটুকু নেই।তবে তুই যে কাজ করেছিস, এর জন্যে তোর প্রতি আমার ঘৃণাটা আপনা আপনিই চলে আসবে। কিছু মনে করিস না। ভালোবাসা চার দেওয়ালের ভেতর পাওয়া যায় না। ভালোবাসা কেবল অনুভবে পাওয়া যায়। আমিও তো তোকে গোপনে ভালোবেসেছি। কই কখনো তোকে বিছানায় চাই নি। তোর হাতটা চেয়েছি কেবল। তুই দেস নি। মিথ্যার পিছনে পড়ে ছিলি। মানুষ এমনই। সত্যটা সামনে সামনে রেখে চারপাশে সত্য খোঁজে। আমি তোর মন চেয়েছি। তোকে চেয়েছি। আমার ভালোবাসায় আকাঙ্খা ছিল না,শরীর ছিল না। পাওয়া না পাওয়ার স্বার্থকতা ছিল।"
আমি থামলাম। একটু দম নিলাম।অর্পার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে জল ছলছল করছে। আমার একটু কষ্ট হল যেন। বেশ ভারি কথা গুলো বলে ফেলেছি ওকে। এমন সময় ও আমার দিক হতে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
"ভালো কথা বলতে শিখে গিয়েছিস দেখছি আজকাল? "
"সব সময়েরই খেলা বুঝলি। সময় সব শিখিয়ে দিয়ে যায়।"
আমি চুপ করে থাকলাম।অর্পাও। আমাদের মাঝে,আমাদের আশপাশের পরিবেশে তখন থমথমে একটা মৌনতা তৈরি হয়েছে। পরিবেশটা আমার কাছে যেন কষ্টের মন হল।মনে হলে পাশের বড় হিজল গাছটাও বেশ কষ্টে আছে। অর্পার সাথে দেখা হওয়ার পরই আমার মাঝে কেমন জানি খারাপ লাগা কাজ করছিল। বুকের বাঁ পাশের পরিচিতি চিনচিনে ব্যথাটাও একটু বিস্তৃতি লাভ করল। নিরাবতা ভাঙ্গলো অর্পা নিজেই।বলল,
"তুই খুব ভালোবাসতি আমায় তাই না?"
আমি হ্যাঁ এবং না তেমন কিছুই বললাম না। কেবল ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার নৌকাডুবি বইটা দিয়ে যাস। ওটা পুরো পড়া হয় নি আমার। সাদিকের সাথে কথা বলতে বলতে সব কিছুর উপর একটা অবহেলা চলে আসছিল। তাই আর পড়া হয় নি।"
অর্পা থামল। আমি তখনো ওকে দেখতেছিলাম। হায়! ওর চোখ দুটো কি অসহায় হয়ে আছে। কি কষ্টে তার দিন কাটছে। মেয়েটা একদমই ভালো নেই।ভীষণ কষ্টে আছে। ওকে এভাবে কথা গুলো বলা ঠিক হয় নি।অর্পা আবার বলল,
"একটা জিনিস চাইবো, দিবি? "
"কি? "
অর্পার মুখটা একটু কালো হল।মলিন মুখে বলল,
"আমায় ক্ষমা করে দিবি? অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি তোর সাথে। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে? "
"আমি না হয় ক্ষমা করলাম। কিন্তু তুই তোর বাবা মাকে কি জবাব দিবি। তাদের কাছে কোন মুখে ক্ষমা চাইবি? যারা তোকে এতো কষ্ট করে পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে, এত কিছু করছে তোর জন্যে তাদের কি বলবি? "
অর্পা কিছু বলল না। কথাটা শুনেই কেমন জানি দমে গেল। ভাবনায় ডুব দিল।আমি আবার বললাম,
"থাক, এত ভাবতে হবে না। আমি তো আছি। প্রেয়সী না হতে পারি। একজন ভালো বন্ধু তো হতে পারি। চিন্তা করিস না আমি সব সামলে নেব। সব ঠিক হয়ে যাবে। চল, তোকে হোস্টেলে দিয়ে আসি।"
অর্পা কিছু বলল না। কেবল রোবটের মত উঠে দাঁড়াল। আমি ওর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম।ও কিছু বলল না।তার হাতটাও আজ আমাকে খুব করে চাইলো না। তাই বোধ হয় আমার হাত ধরতে সংকোচ হচ্ছিল ওর। "
আমি থামলাম এবার। আমার পাশে একটা অপরিচিত মেয়ে বসে আছে। যাকে আমি চিনি না। কোন দিন দেখিও নিই।সেই মেয়েটাকেই আমি আমার গল্প বলছি। মেয়েটা বেশ আগ্রহ নিয়ে সেই গল্প শুনছে। মাঝে মাঝে দু এক ফোটা জল ফেলছে। আবার আমি তার চোখে কষ্টও দেখছি। এই কষ্ট আমার জন্যে নাকি অর্পার জন্যে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।মেয়েটা আমার নিরাবতা দেখে বলল,
"তারপর? গল্প শেষ? আচ্ছা আপনি কি অর্পাকে মেনে নিয়েছেন। মেনে নিলে তো আপনার কষ্টে থাকার কথা না।ভালো থাকার কথা। ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেয়েছেন। এই সৌভাগ্য কয়জনেরই বা আছে।"
আমি বললাম,
"আমি তাকে মেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও চায় নি। ও ভাবতো আমি কেবল দয়া দেখিয়ে ওকে আবার ভালোবাসছি। সাদিক ওকে ধোকা দিয়ে চলে গেছে,এটা ও মেনে নিতে পারে কিন্তু কারো সিম্প্যেথী সে মেনে নিতে নারাজ।আসলে ও ঠিকই বলছিল। আমি দয়ার বসতই ওকে আবার চেয়েছিলাম। এই জগতে আমার অনেক গুলো ঘৃণার জিনিস আছে। তার মধ্যে এক দল মেয়ে আছে যারা নিজেদের ইচ্ছায় ধর্ষিত হয়। আমি ঠিক ওই দলের প্রতিটি মেয়েদের চরম ভাবে ঘৃণা করি।অর্পাকেও করেছি। আমাকে যদি বলা হতো তোমার সাথে কোন পতিতার বিয়ে দিবো,তাহলেও আমি সেই পতিতাকে পরম আদরে গ্রহন করতাম,তবুও কোন স্বেচ্ছায় ধর্ষিতকে গ্রহণ করতাম না। তবে এক কালে তার প্রতি আমার যে তীব্র ভালোবাসা ছিল সেটা মায়া রূপ ধারন করে এসেছে আবার। তাই আমি তার আগত বাবুর বাবা হতে চেয়েছি। ওকে চেয়েছি। ওর হাত চেয়েছি পুনরায়। সে জবাবে মৃদু হাসল। বলল,
" আমার একটা সৌভাগ্য কি জানিস? আমি এই জন্মে তোর মত একটা বন্ধুকে পেয়েছি।এটা আমার জন্যে একটা বড়সড় গিফট। তোকে কখনই ভুলবো নারে।"
ওর সাথে এটা ছিল আমার শেষ সরাসরি কথা। আর দেখা পাই নি ওর। পেয়েছি বটে,তবে সেটা ওর লাশের সাথে।"
এই বলে আমি কাঁদতে থাকলাম। অদ্ভুত একটা ব্যাপার কি আমি যেই কান্নাটাকে এতকাল আটকে রেখেছিলাম সেই কান্না আজ একগাদা কষ্ট নিয়ে বের হয়ে আছে।আমি কান্না থামিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম পাশে বসে থাকা অপরিচিত মেয়েটাও কাঁদছে।কাঁদো কাঁদো স্বরে ও বলল,
"অর্পা মারা গেছে? কিভাবে? "
আমি বললাম,
"সেদিন রাতে আমি আবার অর্পাকে খুব করে চেয়েছি। মায়া থেকে নয়। ভালোবাসা থেকে। তার প্রতি আর ঘৃণা করে থাকতে পারি নি। সকল বাধা,সকল ঘৃণার দেওয়াল ভেঙ্গে তাকে আবার নতুন করে পেতে চেয়েছি।তাকে আবার ভালোবাসতে চেয়েছি। এতদিনের এমন বাজে ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চেয়েছি। ও কিছু বলে নি। আমার ফোন কেটে দিয়েছে। আমি একটা উত্তরের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মত মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকলাম।ঘুম ধরে না চোখে। মনের মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। আমি ভাবছি অর্পা কি করছে। আমার ভালোবাসার কথা শুনে ও কতটা খুশি হয়েছে। আমি কেবল একপ্রকার উত্তেজনা নিয়ে বসে থাকলাম। আমার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটে রাত একটা পাঁচ মিনিটে।আমার দু'চোখ তখন তীব্র ঘুমে আবৃত। ঘুম চোখে তার মেসেজটা পড়তে থাকলাম। মেসেজটি ছিল,
" একটা বাবাহীন সন্তানের মা হয়েছি। কথাটা যতটা সহজ আসলে কিন্তু ততটা সহজ না। এর ভেতর রাজ্যের কষ্ট লুকিয়ে আছে। মানুষের কটু কথা মিশে আছে। সমাজের সকলের তীব্র অপমানের গল্প মিশে আছে। আমি এর ভার আর নিতে পারি না। পদে পদে কথা শুনতে হয় রুমমেট দের। আমাদের হোস্টেলের মেম আমার কথাটা জেনে গিয়েছেন৷ কালকের মাঝে বাড়ি চলে যেতে হবে আমায়। খুব গোপনে৷ কাউকে জানানো যাবে না। এ কেমন কথা বল। যে আমার এই অবস্থার জন্যে দায়ী সে কি খুব সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবে? এটা হতে পারে না। আর বাড়ি যাওয়ার কোন মুখ কিংবা ইচ্ছে আমার নেই। আমার ভেতরের যে প্রানটা আছে তাকে আমাদের ফেমেলি তথা এই সমাজের কেউইই মেনে নিবে না। আর বাকি থাকিস তুই। আচ্ছা তুইই বল আমি কিভাবে প্রতারকের মত তোর কাছে গিয়ে উঠি। তুই আমাকে ভালোবাসিস। এটা আমি মানি।বিশ্বাস করি। তাই তোর ভালোবাসাকে অপবিত্র কিংবা অসম্মান করতে পারি না। তোর ভালোবাসা আমার জীবনে একটা তরুন ফুটন্ত গোলাপের মত মিশে থাকবে। তোর কথা আমি ভুলবো না। আমার ভেতরের প্রানটা ভুলবে না। আমায় ক্ষমা করিস। আমি শেষ পর্যন্ত আর তোর হতে পারলাম না। পাপ করেছি এবং এর শাস্তি পাচ্ছি। আমি একা পাচ্ছি। ওই পাপিটা পাচ্ছে না৷ তাই যেহেতু পাপ করেই ফেলেছি তাহলে আরেকটু করি। যাতে পাপিটাও শাস্তি পায়। সুসাইড নোট লিখা শেষ। পাপিটাকে নিয়ে সব লিখেছি। তোকে দেওয়া মেসেজটা ডিলিট করে দিয়েছি এই মাত্র। যখন তোর পড়া শেষ হবে মেসেজটা তখন আমি,তোর প্রিয় বন্ধু, তোর ভালোবাসা আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। এপাশের পাপের শাস্তি সইতে না পেরে ওপাশে চলে যাচ্ছি। সেখানে আর যাই হোক কেউ কথা শোনাবে না৷ খোঁচিয়ে কথা বলবে না। মারের আঘাত সহ্য করা গেলেও কথার আঘাত সহ্য করা যায় না। ভালো থাকিস।'
আমি মেসেজটা পড়ে জলদি ওর রুমমেটকে ফোন দেই। উনি ফোন ধরে বলেন যে উনি এখন উনার গ্রামের বাড়িতে। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। আর কারো নাম্বার নেই আমার কাছে৷ কি করবো ভেবে পাই না। আমি প্রায় পাগলের মত হয়ে যায়। এই রাত দুপুরে ওর হোস্টেলের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে যাই। গিয়ে দেখি কারো একজনের নীথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। একটুও নড়ছে না। আমি জলভরা দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থাকলাম। হঠাৎই আমার চোখ গেল ওর পেটের দিকে। আমার মনে হল ওই পেটের ভেতরের বাচ্চাটা বাঁচার জন্যে তীব্র আর্তনাদ করছে। অক্সিজেন পাওয়ার জন্যে হা করে আছে। কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছে না। আমি দূর থেকে একটা ছোট্ট নিষ্পাপ প্রানের ধুকে ধুকে মরে যাওয়া দেখলাম যেন।আমি দৃশ্য আমায় আজো তাড়া করে বেড়ায়। মাঝ রাতে আমি কোন শিশুর বেঁচে থাকার আর্তনাদ শুনি। আমার কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হায়। "
আমি আর থাকতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার পাশের অপরিচিত মেয়েটাও শব্দ করে কান্না করছে এখন। আমি এবং মেয়েটি বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় কাঁদতে থাকলাম। কাঁদতে কাঁদতে মনে হল আমার পাশের হিজল গাছটাও কান্না করছে। সমস্ত পরিবেশ যেন একটা নিষ্পাপ, নির্দোষ একটা শিশুর জন্যে কান্না করছে।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।