গল্পঃ ঘৃণিত পুরুষ
সেদিন বাসে উঠতে একটু কষ্টই হল আমার। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল বাস স্টপে। কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসে উঠে সিট পেলাম একেবারে পিছনের সিটের আগের সিটে। আমি সেখানে বসতে যাব ঠিক তার আগেই চোখে গেল অন্য পাশের যুগল সিটের ডান পাশের সিটে। কেউ একজন বসে আছে ওখানে, বাইরে দ্রুততম গাড়ি গুলোর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে মুগ্ধ হয়ে। যার টানা টানা চোখ জোড়ায় গাঢ় কাজল দেওয়া। ফর্সা মুখ, কপালের ঠিক মাঝখানে একটি বিন্দুর মত কালো টিপ রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে বসে আছে। তার কানের পাশের চুল গুলো সামনে চলে এসেছিল। সে হাত দিয়ে সেই অবাধ্য চুল গুলো সরিয়ে দেয়। ততক্ষনে আমি অনুভব করলাম যে আমি এই পৃথিবীতে নেই। যেন রঙিন কোন পৃথিবী কিংবা কোন গ্রহে পা দিলাম, যেখানে শত শত ভালবাসা এসে জমাট বেধেছে মাত্র। আমি কেবল মুগ্ধ হলাম তা দেখে। হায়! লোকাল বাসে এমন মোহময় দৃশ্য দেখবো তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। কি ভাবছেন! এই যে সিটে বসে থাকা যে ব্যক্তির অল্প বর্নান দিলাম মাত্র সে কে হতে এটা নিয়েই তো ভাবছেন তাই না! ইতোমধ্যে অনেকে মনে মনে ব্যক্তিটিকে মেয়ে বলে কল্পনা করে, কল্পনা রাজ্যে পদার্পণ করেছেন, দেখছেন যে সে এখন বাসে বসে আছে। বাসের কোন এক সিটে জানালার পাশে বসে আছে একটা একটা মেয়ে যার টানা টানা চোখে কাজল দেওয়া এবং কপালের মাঝে একটি বিন্দুর মত কালো টিপ যেখানে রাজ্যের মায়া মিশে আছে। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি যে আপনাদের এরূপ ভাবনাটা একদম ঠিক না। দয়া করে কল্পনা থেকে বের হয়ে আসেন এবং শুনেন যে ব্যক্তিটি কে। যে ব্যক্তিটির কথা বলেছি তাকে চিনতে আমার একটু কষ্টই হল। বুঝেনই তো! আমার এখন যে বয়স, এ বয়সে সবই রঙিন লাগে। তাই তাকেও রঙিন লাগছিল। ভেবেছি যে সে একটা মেয়ে, যার পরনে শাড়ি। মুখে মেকআপ এর প্রলেপ বেশ গাঢ় ভাবে। থাক না। বেশি সেজেছে। ক্ষতি কি! কিন্তু হায়! সবাইকে দেখলাম এরূপ রূপসীকে তিব্র ভাবে এড়িয়ে চলছে। তার পাশের সিটে কেউ বসছে না। অনেকেই কেবল তাকে দেখছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ আড় চোখে। আমি ভাবলাম, আহারে! মানুষ কি একটা চান্স মিস করছে। একটি সুন্দরীর পাশে বসছে না। আমি ভাবলাম গিয়ে বসি তার পাশে। কি ভেবে পরে আর যাই নি। এক বৃদ্ধকে দেখলাম বেশ কষ্ট করে তার পাশে বসেছে। ডাবল সিট। এক সিটে বর্ননার ব্যক্তিটি। বাকি যে সিট খালি তার অর্ধেকে বৃদ্ধ বেশ জড়সড় হয়ে বসেছে এবং অন্য এক সিট খালি হতেই তিনি ওখানে চলে গেছেন দ্রুত। আমি ভাবলাম, আরে এত অবহেলার কি আছে। একটা মেয়েই তো। নিজের মেয়ের মত! বসলে ক্ষতি কি! ইতোমধ্যে আমার পাশে বসে থাকা কালো মোচওয়ালা ব্যক্তিটি মেয়েটাকে চোখ দিয়ে গিলে ফেলেছে। কি নেশা কাতুর হয়ে যে দেখছে বলে বুঝাতে পারবো না। চোখ দিয়েই উনি মোটামুটি মেয়েটিকে ধর্ষন করে ফেলেছেন।কেবল আমার পাশের ব্যক্তিই নন। বাসের বেশ কিছু ব্যক্তিই তা করছে। ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লাগল। এক মূহুর্তের জন্যে আমি নিজে পুরুষ হয়ে পুরুষ জাতিকে তীব্র ঘৃনা করলাম। ছিহঃ এত নিচু হতে পারে মানুষ! পরের স্টপেজ থেকে এক মহিলা উঠেছেন এবং তিনিও বেশ দ্বিধা নিয়ে মেয়েটির পাশে বসেছেন। মহিলারা একটু বেশি কথা বলে বা কথা না বলে থাকতে পারে না এমন। এই কথাটা আবার প্রমানিত হল। যে মহিলাটি উঠেছেন উনি কথা জুড়ে দিলেন মেয়েটার সাথে এবং মেয়েটিও কথা বলছে। তবে মেয়েটির কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সেই মুহুর্তে তাকে এত অবহেলা করার কারনটা জানতে পারলাম এবং নিজের ভ্রম ভাঙ্গল। তার কন্ঠস্বর ছিল ভীষন রকমের মোটা। পুরুষালী কন্ঠ। ততক্ষনে বুঝে গেলাম যে সে আসলে কোন মেয়ে নয়। সে একজন হিজলা।যেটা আপনারা এতক্ষনে কল্পনা করে ফেলেছেন। সে মেয়ে না, হিজলা, এটা ভেবে খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেলাম। আসলে সে যে হিজলা এটা কেউ তাকে প্রথম দেখেই বলে দিতে পারবে না। আর হিজলারা একটু অন্য রকম হয়। ইনি একদমই তাদের মত না। যাক আমি নিজের ভুল বুঝতে পারলাম এবং চুপ করে বসে থাকলাম। কিন্তু আমার পাশের লোকটি কেবল তাকেই দেখে যাচ্ছে। হায়রে পুরুষ! তোরা একজন হিজলাকেও ছাড়িস না। এত থার্ড ক্লাস কিভাবে যে হয় বুঝি না। আমি লোকটার দিকে তাকালাম প্রচন্ড ঘৃনা নিয়ে। আমার এমন চাহনি দেখে লোকটা মাথা নিচু করে ফেলল। আমার নেমে যেতে হবে। স্টপেজ খুব বেশি দূরে না। ঠিক তখনই একটা কান্ড ঘটল। হঠাৎই হিজলাটা দাঁড়িয়ে গেল। পিছনের সিটের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কিরে। এমন করিস কেন!
ততক্ষনে প্যান্টের চেইন খুলে বসে থাকা ছেলেটা থতমত খেয়ে চেইনের ভেতর থেকে হাত বের করে জড়সড় হয়ে বসে থাকল। হিজলাটা আবার বলল,
-কি রে মা*। হাতাহাতি করতে ভালো লাগে তাই না। শালা লুইচ্চা! সিটের নিচ দিয়ে গুতাস কেন? তোর কি গুতানির বেরাম আছে!
কথা গুলো ঠিক এভাবে বলেছে। ছেলেটা আরেকটু জড়সড় হয়ে বসল। বলল,
-কই। আমি কি করছি। ফাউল কথা বলেন কেন?
এবার হিজলাটা ছেলেটার কলার চেপে ধরে বসল। বলল,
-কিচ্ছু করিস নি! তোর আঙ্গুল দিয়ে তুই সিটের নিচ দিয়া আমায় গুতো মারিস নি?
হিজলাটা যখন ছেলেটার কলার চেপে টানাটানি করছিল তখন আমি সহ আরো কজন দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই চেঁচামমেচি শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ছেলেটাকে মারতে গিয়েছে। আমি একটা চড় দিবো ভাবছি কিন্তু দিতে পারলাম না। আমার স্টপেজ চলে এসেছে। হেল্পার সাহেব পারলে আমাকে দুচারটা ঘা দিয়ে বলত,
"বেটা, নামিস না কেন?"
তাদের এরূপ অবস্থা। টাইমের গাড়ি। যথাসময়ে না গেলে জরিমানা হবে। অগত্যা ছেলেটাকে না মেরে নামতে হল আমার। তবে আমি একটা দৃশ্য দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম। বাসের মহিলা সিটে ক'জন হিজলা বসে আছে, যারা প্রস্তুসি নিচ্ছে পিছনের দিকে যেতে। কি হয়েছে তারা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। এরা গেলে নেহাত ছেলেটার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। মার তো খাবেই, সাথে সাথে নিজের চেইনের ভিতরের অস্রটাও হারাতে পারে। হিজালারা এসব কিছুই গন্য করে না। আমি নামার আগে আমার পাশে যে বসেছিল তার দিকে তাকালাম। সে বেশ শংকিত দৃষ্টি নিয়ে এসব কান্ড দেখছে। জিবনে হয়তো আর সাহস পাবে না কোন হিজলার দিকে এভাবে তাকাতে। আমি নেমে পড়লাম। ততক্ষনে বাসের ভেতর চেঁচামেচি শুরু হয়েছে তিব্র ভাবে। তবুও বাস থামছে না। চাললকে যথাসময়ে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে জরিমানা হবে। গাড়ির ভেতর কি হল সেটা তার ভাবার বিষয় না। বাসটি চলে গেল। আর আমি পুরুষ জাতির প্রতি তীব্র ঘৃনা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
.
এই কাহিনিটি সত্যি এবং এটি আমার চোখের সামনের দৃশ্য। নেশা কাতুর ছেলেটির প্রতি একটি ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে এসেছি সেদিন। ভাবুন,যে দেশে হিজলারা নিরাপদ না,সে দেশে মেয়েরা কিভাবে নিরাপদ হবে হবে। ছিহ! কি একটা জঘন্য কাজ এটা। কিভাবে পারে এরা! নিজেরও তো মা বোন আছে। এটা ভেবে কি তাদের মনে বিন্দু মাত্র লজ্জা হয় না! এদের পাষানের মত হৃদয়টা কি একটুও ভাবে না যে আমারো তো মা বোন আছে। তাদের সাথে যদি এমন হয়! হিজলাটার জয়গায় নিজের বোনকে,আর নিজের জায়গায় যদি অন্য কোন পুরুষকে রেখে একবার চিন্তা করে যে তার বোনের সাথেও যদি এমন হয় তাহলে কেমন হবে। কেমন অনুভুতি হবে তখন! এসব দেখে আমার কেবল ঘৃনা হয়। পুরুষের প্রতি ঘৃনা জাগে।ছিহ। কি নিচু মনের কাজ এটা। হায়! লোকাল বাসে এমন ফালতু,ঘৃনীত দৃশ্য দেখব তা আমার ভাবনার অনুকুলে ছিল না। এরা পুরুষ না। ঘৃণিত পুরুষ।