Bangla Golpo: মেঘের কোনো ঠিকানা নেই।
Bangla Golpo: মেঘের কোনো ঠিকানা নেই।
-চলেন, হাঁটি। আপনার গল্পটা ওখানে গিয়েই শুনবো। কী বলেন?
লোকটা কী অবলীলায় বলে ফেলল কথাটা৷ কী স্পষ্ট প্রসন্ন স্বর৷ মানুষ এতো সহজে কীভাবে মিশে যেতে পারে? রোদের মনে প্রশ্ন জাগে৷ সেই প্রশ্ন মনের ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকে৷ বের হয় না৷ সে বের করে আনতে জানে না৷ এই লোকটা নিশ্চয়ই তা পারে। খুব সহজেই পারে! মনের মাঝে কিছু চেপে রাখে না৷ চেপে রাখলেই যা সমস্যা৷ ব্যাথা বাড়ে৷ ক্ষত বাড়ে৷ ব্যাথা কিংবা ক্ষত, কিছু এক সাথে শেষ হয়ে যায় না৷ চেপে থেকে ছড়াতে থাকে। চেপে রাখার যন্ত্রণা তীব্র। তীব্র অসহনীয় একটা যন্ত্রণা। রোদ জানে সেই যন্ত্রণার কথা৷ সে জানে কীভাবে সয়ে নিতে হয়; সমস্ত ব্যাথা সয়ে নিয়ে কীভাবে হাসতে হয়৷
রোদ লোকটার সাথে হাঁটতে থাকলো৷ রাত সাড়ে বারোটা। এতো রাতে একটা অচেনা লোকের সাথে নির্ভয়ে হাঁটা মুশকিল। ভয় আপনা আপনিই এসে যায়৷ অথচ রোদের ভয় হচ্ছে না। আজ কেন জানি তার কোনো কিছুকেই ভয় হচ্ছে না৷ তার কেমন জানি স্বাধীন লাগছে। আজ যা কিছু হয়ে যাক, তার কিছুই যায় আসে না৷ কেউ তাকে ছিনতাই করে নিয়ে যাক অথবা তাকে খুন করে রাস্তার ধারে ফেলে যাক, রোদের মনে আজ ভয় নেই৷ মৃত্যুর ভয়ও নেই৷ রোদ আনমনে হাঁটতে থাকে। গভীর ভাবনারা তাকে যেন চট করেই ব্যস্ত করে তুলছে। তার ভাবনার সকল অংশ জুড়ে কেবল এই 'অচেনা লোকটি' বিরাজ করছে৷ অদ্ভুত, এই অচেনা মানুষকে নিয়ে এতো ভাবার কিছুই নেই৷ অথচ সে ভাবছে! সে ভাবছে এই লোকটা মানুষকে কীভাবে কাবু করে নেয়৷ কথায় কথায় ঘোরে ধরাতে জানে লোকটি। অদ্ভুত এক লোক!
এই অল্প আগের কথা৷ অন্ধকার গলি। ছোট্ট এই পথটুকুই কেবল অন্ধকার। পার হতে এক মিনিটের মতো লাগে। গভীর এই অন্ধকারে যে মৃত্যু লুকিয়ে থাকে, সেটা বেশ জানা আছে রোদের৷ একটু চালাকি করলেই গলায় ছুরি বসে যাবে৷ ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করবে। একটা সময় হয়তো গভীর অন্ধকারে রোদ মারা যাবে৷ মৃত্যুর সেই ভয়কে মেরে রোদ গলির ভেতর ঢুকে গেল। তাকে আজ বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বেলা শেষে ফিরে যাবার শেষ একটিই আশ্রয়। তাকে সেখান থেকেই আজ বের করে দেওয়া হলো। তাই আজ ফিরে যাবার কোনো তাড়া নেই৷ একেবারে ফিরে না গেলেও হয়তো কেউ কিছু মনে করবে না৷
কিছুদূর আসার পর, অন্ধকারের ভেতর হঠাৎই কে জানি রোদের হাত চেপে ধরে। চমকে উঠে সে। কিছু বলার আগেই লোকটা তার মুখ চেপে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড পরেই রোদ টের পেল তার গলার কাছে একটা ছুরি৷ লোকটা রোদের পেছনে দাঁড়িয়ে, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
-পকেটে যা আছে দিয়া দেন ভাই৷ বেশি তাফাড়লিং কইরেন না৷ পরে কিন্তু উপরে পৌঁছায়া দিমু৷
রোদ জানতো এমন কিছু ঘটবে৷ সে মানসিক ভাবে মোটামুটি প্রস্তুতই ছিল। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কেবল৷ লোকটা রোদের মুখের কাছ থেকে হাতটি সরিয়ে জিন্সের সামনের পকেটে নিয়ে গেল৷ এরপর পেছনের পকেট৷ সেখানে মানিব্যাগ৷ মানিব্যাগে টাকা, ডেভিড কার্ড, আরো কতো প্রয়োজনীয় কাগজ। পাশে অরুর একটি ছবি৷ ছবির কথা মনে পড়তেই তার চোখের সামনে অরুর স্নিগ্ধ চেহারাটা ভেসে উঠল। কী প্রাণবন্ত একটি চেহারা! এ চেহারা দেখে কারোই মন খারাপ থাকার কথা না৷ কারোই না৷ রোদ মনে মনে হাসলো৷ বলল,
-ভাই, মানিব্যাগে একটা ছবি আছে৷ ওই ছবিটা নিবেন না প্লীজ৷ প্লীজ...
লোকটা যেন রেগে গেল৷ চাপা স্বরে বলল,
-চুপ বেডা৷ বেশি কথা কইবি না কইলাম। চুপচাপ থাক।
রোদ চুপ করে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই তার শরীরটা কেমন পাতলা হয়ে এলো। আশ্চর্য! লোকটা নেই। চলে গিয়েছে! মূহুর্তে উধাও হয়ে গিয়েছে! রোদ পেছন ফিরে তাকালো। সব অন্ধকার। দূরে আলো দেখা যায়৷ এদিকটায় কেউ নেই। কেউই নেই। রাতের সমস্ত নিষুতি অন্ধকারেরা যেন আলোর ভয়ে এখানে এসে লুকিয়েছে৷ সেই লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেই যতো পাপ হয়। অনারচার হয়৷
রোদ নিজের পেছনের পকেটে হাত রাখলো৷ মানিব্যাগটা নেই। লোকটা টাকা গুলো নিয়ে মানিব্যাগটা রেখে যেতে পারতো। এতোটা অকৃতজ্ঞ হওয়া ঠিক হয়নি৷ রোদ সামনে এগিয়ে গেল৷ অন্ধকার কাটিয়ে আলোতে আসতেই দেখলো একটা লোক অন্য আরেকটা লোককে ধরে মারছে। চড় দিচ্ছে৷ সে চট করেই দাঁড়িয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকালো সেদিকে। আশ্চর্য! এই মাঝরাতে লোকটা একে মারছে কেন? রোদ সেদিকে এগিয়ে গেল।
ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় সে প্রথমবারের মতো এই অচেনা লোকটিকে দেখলো৷ লম্বাটে, সুদর্শন, ক্লিন শেভ করা একটি ভদ্র চেহারা৷ শরীর মোটামুটি ধরনের। গায়ে একটি ফুল হাতার শার্ট৷ চুল গুলো সুন্দর করে মাথার এক পাশে রাখা৷ রোদকে এগিয়ে আসতে দেখেই লোকটা বলল,
-আপনার মানিব্যাগ এটা?
কথাটা বলে সে একটা মানিব্যাগ তুলে ধরলো রোদের সামনে। রোদ অবাক স্বরে বলল,
-হ্যাঁ, এটা তো আমারই৷
তারপর সে যেন চট করেই সব বুঝে গেল। বলল,
-ওও! তাহলে এই সেই চোর?
লোকটা কিছু বলল না। চোরটাকে দাঁড় করালো৷ রোদ মানিব্যাগ উল্টিয়ে সর্বপ্রথম অরুর ছবিটা দেখলো৷ সেটা ঠিক ভাবেই আছে৷ মনে প্রশান্তি ফিরে এলো তার৷ ছবিটা হারিয়ে যে সুক্ষ্ম বেদনা তার হৃদয়ে আঘাত করছিল সেটা যেন মূহুর্তেই বিলীন হয়ে গিয়েছে৷ অদ্ভুত এক ভালো লাগা যেন আঁকড়ে ধরলো তাকে৷
রোদ মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো অচেনা লোকটা চোরটার কাঁধে একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে আরেকটু কাছে গেল৷ লোকটা এবং চোরের কথোপকথন শুনতে থাকলো,
-নাম কী তোর?
-বসু।
-বসু? শুধুই বসু?
-হ।
-আর নেই। তোর আব্বা আম্মা কি শুধু এই নামই রেখেছিল?
-জানি না সার।
-মানে? তুই জানিস না?
চোরটার স্বর কাঁদো কাঁদো। বলল,
-সত্য কইতাছি সার৷ জানি না৷ বুঝ হওনের পর থেইক্কা সক্কলে আমারে এই নামেই ডাকে৷ আব্বা আম্মারে কখুনু দেখি নাই৷
অচেনা লোকটি হঠাৎ থেমে গেল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো চোরটার দিকে। কিছু সময় পর বলল,
-চুরি করস ক্যান?
-কাজ কাম নাই সার৷ এর লাইগ্যা চুরি করি।
-চুরি করে যা আয় হয় তা দিয়ে কী করিস?
চোরটা হঠাৎ চুপ করে যায়। মাথা নিচু করে নেয়৷
অচেনা লোকটা চোরের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে থাকে৷ চোরটা মাথা নিচু করে হাঁটে। তাদের পিছু নেয় রোদ৷ পিছু পিছু কথা শুনে সে৷ এদের কথা শুনতে বড়ই ইচ্ছে হচ্ছে তার৷ লোকটা আবার বলে উঠে,
-বসু?
-জি সার!
-উত্তর তো দিলি না!
বসু চুপ থাকে৷ কিছু বলে না৷ অচেনা লোকটির স্বর হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে আসে৷ কেমন রেগে যাওয়া স্বর৷ খানিক কঠিন করে বলে,
-বসু?
-জি সার।
-আমাকে তুই চিনিস না। আমি যেমন খারাপ তেমন ভালো। তোকে আমি একবার দেখেছি। আজীবনেও তোর চেহারা ভুলবো না৷ তুই যদি সঠিক জবাব না দিস তবে তোকে আমি পুলিশে দিবো৷ যদি পালিয়ে যাস তবে তোকে আবার খুঁজে বের করবো৷ তোকে খুঁজে বের করা আমার কাছে কোনো ব্যাপারই না৷ বুঝলি রে বদি? ওরফে বদি উদ্দিন!
চোরটা হঠাৎ থেমে যায়৷ ভীত চেহারা নিয়ে অচেনা লোকটির দিকে তাকায়৷ রোদ আরেকটু এগিয়ে যায়৷ চোরটিকে ভালো করে লক্ষ্য করে সে৷ ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখে, চোরটা ঘামছে। তার চোখ ভর্তি ভয়৷ বসু নাকি বদি? লোকটা হঠাৎ একে বদি উদ্দিন বলল কে? রোদ বুঝে উঠে না৷ দাঁড়িয়ে থাকে। চোরটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
-সার, আফনে আমার নাম জানেন ক্যাম্নে?
অচেনা লোকটির স্বর আরো কঠিন হয়৷ সে বলে,
-বদি? আমাকে আগে উত্তর দে৷ তা না হলে তোর খবর করে ছাড়বো আমি৷ জলদি করে বল চুরি করা টাকা গুলো তুই কী করিস?
বদি কান্না করে দেয়৷ সে লোকটার পাঁয়ের কাছে বসে পড়ে৷ পাঁ জড়িয়ে কান্না করে৷ তার কান্নাভেজা স্বর বলে,
-মাফ কইরা দ্যান সার৷ আর কখনই এমুন করতাম না। কখুনই করতাম না। মাফ কইরা দ্যান৷
লোকটা যেন বিরক্ত হয়। স্বর কঠিন হয় তার৷ বলে,
-বদি, উঠে দাঁড়া। আমাকে উত্তর দে৷ আমি শুধু তোর থেকে উত্তর চাই৷
বদি উঠে সে৷ সে পাঁ জড়িয়ে কান্না করে যায়৷ লোকটার স্বর সর্বশেষ কঠিন হয়৷ বলে,
-বদি? উঠ? তোকে উঠতে বলছি৷
রোদ কেঁপে উঠে খানিক। চারদিকে নিষ্প্রাণ। লোকটার কঠিন স্বরটা তাই আরো বেশি স্পষ্ট শোনায়৷ ভয় হয় রোদের। বদি কান্না করা ছেড়ে দেয়৷ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়৷ লোকটা থেকে একটু সরে দাঁড়ায়৷
লোকটার স্বর চট করেই নেমে আসে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা স্বর টেনে বলে,
-বদি, জবাব চাই আমার৷
বদি চুপ থাকে কিছু সময়৷ তারপর কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,
-পাড়ায় যাই সার৷ কাড খেলি৷ জুয়ার আসরে যাই৷ পঁচা মদ গিলি৷
বলতে বলতে কেঁদে দেয় সে। গা কাঁপিয়ে কান্না করে বদি। লোকটা শান্ত স্বরেই বলে,
-তুই কইলি তোর আব্বা আম্মা নেই৷ কথা কি সত্য?
কাঁদতে কাঁদতে বদি জবাব দেয়,
-বাপ নাই৷ তয় মা আছে সার।
লোকটি চট করেই যেন রেগে যায়৷ কষিয়ে চড় মারে চোরের গালে। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় বদি৷ পড়ে গিয়ে তীব্র কান্না ভেঙ্গে পড়ে সে৷ অচেনা লোকটি ফুটপাতের ধারে বসে পড়ে৷ মৃদু স্বরে বলে,
-শালা তার বাপের মতোই হইবো৷ বাপ কা বেটা!
রোদ কী করবে ভেবে পায় না৷ অচেনা লোকটি ফুটপাতের কাছে বসে আছে৷ তার কিছুদূরে রাস্তায় পড়ে থেকে কান্না করছে বদি৷ তার কান্না থামছে না৷ রোদ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলো অচেনা লোকটির পাশে। কিছু বলল না৷ সে একবার লোকটাকে দেখছে তো একবার বদিকে দেখছে। অচেনা লোকটি একবার তাকালো রোদের দিকে। তবে কিছু বলল না। পকেট হাতড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো৷ ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-সিগারেট চলবে?
রোদ কিছু বলল না৷ এগিয়ে গেল৷ সিগারেট ধরিয়ে বসলো লোকটির পাশে। কিছু সময় বেশ নীরবতায় কাটলো৷ বদির কান্নার বেগও কমে এলো। অচেনা লোকটি বলল,
-মেঘ৷
খানিকটা চমকে উঠলো রোদ। বলল,
-কী?
-মেঘ৷ আমার নাম৷
রোদ স্মিত হাসলো। বলল,
-আমার নাম রোদ। অনিক হাসান রোদ।
লোকটা চট করেই হেসে ফেলল। বলল,
-বাহ! তিন তিনটা নাম নিজের অধিনে রাখলেন৷ ভালোই। তিনটা নামই সুন্দর। অনিক, হাসান, রোদ।
রোদ চট করেই হেসে ফেলল। অকৃত্রিম হাসি৷ এই হাসিটা একদম ভেতর থেকে আসে৷ সত্যিকারের খুশি হলে এমন হাসি আসে। অনেকদিন পর, প্রায় অনেক দিন পর রোদ এমন ভাবে হাসলো৷ মন খুলে হাসলো। হাসি মাখা চেহারায় বলল,
-বড় লোক মানুষ। তাই তিনটা নাম নিজের করে রাখলাম।
রোদ শব্দ করে হাসে৷ তার হাসির স্থায়িত্ব বাড়ে এবার৷ এতোটা হাসির প্রয়োজন ছিল না৷ তাও সে হাসে যায়৷ অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসলে হয়তো এভাবেই হাসতে হয়৷ মেঘ কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো। রোদ হাসি থামিয়ে বলল,
-আপনার নাম কি শুধুই মেঘ? আর কিছু নেই?
মেঘ মৃদু হেসে জবাব দেয়,
-গরীব মানুষ। একটা নামেই চলে যায়৷
রোদ এবারে মৃদু হাসলো। কিছু বলল না আর৷ নীরবতা বয়ে যেতে থাকলো চারপাশে।
মেঘ চট করেই বলে উঠলো,
-বদি? এই বদি?
বদি চট করে উঠে দাঁড়ালো। চোখমুখ মুছে নিলো। এগিয়ে এসে সে মেঘের পাঁয়ের কাছে বসলো। মেঘ কঠিন স্বরে বলল,
-এই বেটা ফকির? পাঁয়ের কাছে বসলি কেন?
বদি ফিক করে হেসে দেয়৷ বলে,
-ফকির বইলাই তো পায়ের লগে বইছি।
-ফকির হলে পায়ের কাছে বসতে হয় এটা তোকে বলল কে?
-কেউ কয় নাই৷
-তাহলে বললি যে?
বদি জবাব দিলো না৷ মেঘ বলল,
-এটাই প্রমাণ করে দেয় তুই কতোটা নিচু প্রকৃতির৷ চিন্তাভাবনা কতো নিচু তোর৷ বুঝলি?
-জি সার।
-আবার জি স্যার বলিস! উঠে আয়৷ আমার পাশে বস।
-না সার।
-না মানে? উঠ বেটা৷
-না সার৷ আমি নিচেই বসমু।
মেঘ কিছু বলল না আর। উঠে গিয়ে নিজেই বদির পাশে বসে পড়লো৷ বদি অবাক হয়ে তাকালো মেঘের দিকে। বলল,
-কি করলেন সার?
-আমরা মানুষ। এটাই আমাদের বড় পরিচয়। আমাদের মাঝে উঁচুনিচু বলতে কিছু নেই৷ বুঝতে পেরেছিস?
বদি জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে নিলো। রোদ কী করবে ভেবে পেল না। সে এগিয়ে এসে চট করেই এদের সাথে বসে পড়লো। সে ভাবল, আসলেই তো! আমরা সকলেই তো মানুষ। আমাদের মাঝে তো কোনো উঁচুনিচু নেই৷ মানুষের ভাবনাতেই যা উঁচুনিচু। সেটা ছাপিয়ে আমরা সকলেই এক।
মেঘ সিগারেটের প্যাকেটটা বদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-সিগারেট খা।
বদি সিগারেট ধরালো। মেঘ বলল,
-ঘরের কথা মনে আছে তোর বদি?
বদি জবাব দেয় না৷ মাথা নিচু করে রাখে। মেঘ বলে,
-কতোদিন যাস না?
বদি নিচের দিকে তাকিয়েই বলে,
-মেলা দিন, সার।
-বিয়ে করেছিস?
-বাচ্চা একডা আছে৷
-বয়স কতো?
বদি অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলো সে তার বাচ্চার বয়স জানে না৷ চেহারাটাও তার তেমন মনে নেই৷ সেই ছোট্ট কালে একবার দেখেছিল। তারপর আর দেখে নাই। নিজেই স্ত্রীরে রেখে চলে এসেছে৷ আর কখনই যায়নি৷ বদি খুব চেষ্টা করলো তার বাচ্চাটার চেহারা মনে করতে৷ কিন্তু সে মনে করতে পারলো না৷ সে মলিন চেহারা নিয়ে মেঘের দিকে তাকায়৷ ভেজা স্বরে বলে,
-সার, আমি চাও'টার চেহারা ভুইলা গেছি৷ মনে আহে না৷
বদির চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমে। সেই জল ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়৷ মেঘ বলে,
-তোর মনে পাপেরা এমন ভাবে ভর করেছে যে তুই নিজের সন্তানের চেহারা মনে করতে পারছিস না৷ চোখ বন্ধ করলেই তুই পাড়ার নিলুফার চেহারা দেখিস৷ মদের বতোল দেখিস।
চোখ ভরা জল নিয়ে বদি মেঘের দিকে তাকায়৷ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। বলে,
-সার, আফনে আমার মনের কথা জানেন ক্যামনে?
-আমি এমন অনেক কিছুই জানি৷ অনেক কিছু৷ বদি, তুই আমার মন খারাপ করে দিলি। তুই তোর বাচ্চার চেহারা ভুলে গেছিস? এমন বাপ তুই? বাচ্চার চেহারাও মনে রাখতে পারিস না?
বদি কিছু বলে না আর৷ মাথা নিচু করে রাখে৷ সবার মাঝে চুপচাপ বসে থাকে রোদ৷ সে নিরুত্তর। কথা বলার ইচ্ছে নেই তার৷ সেই এদের কান্ডকারখানা দেখছে৷ এতেই ভালো লাগছে তার। ভীষণ ভালো লাগছে৷
মেঘ চট করেই উঠে দাঁড়ালো৷ বদির পেছনে বসে তার চোখ চেপে ধরলো। বদি বলে উঠলো,
-সার? কী করতাছেন?
মেঘ বলল,
-বদি, চুপ থাক বেটা৷ চোখ বন্ধ করে নে৷ গভীর ভাবে ভাব। তুই পাড়ার নিলুফারে পছন্দ করিস৷ সেটা আসলে পছন্দ নয়৷ সেটা মায়া। নিলুফা তোকে ফাঁসাচ্ছে৷ সে ভালো মেয়ে নয়৷ সে মানুষরে বিয়া করে দেউলিয়া করে। সে রং বদল করে। তুই তাকে চিনিস না৷ সে তোর জন্যে নয়৷ তুই যদি ভেবে থাকিস তাকে বিয়ে করবি তবে সেটা ভুলে যা৷ এক মূহুর্তের জন্যে ভুলে যা৷ ভুলে যা এই পৃথিবীতে নিলুফা নামের কোনো মেয়েকে তুই চিনিস না৷ তাকে বাদ দিয়ে এবার মদের বতলের কথা ভাব৷ একটা মদের বতল, পঁচা ফলমূল কিংবা বাজে জিনিসের তৈরী যে পানীয়টা তুই পান করছিস ওটা তোর ভেতরটা শেষ করে দিবে৷ তাকে জঘন্য এক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে। তুই চোখ বন্ধ করে ভাব, তোর মৃত্যু হচ্ছে। জঘন্য রকম মৃত্যু৷ তুই শ্বাস নিতে পারছিস না৷ তোর দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ চারদিকে অন্ধকার। তোর পানির পিপাসা পেয়েছে৷ অথচ একটু পানি দেওয়ার কেউই নেই। তুই পানি পাচ্ছিস না৷ তুই কাঁদছিস৷ শেষ মূহুর্তে একটু পানির জন্যে কাঁদতে কাঁদতে তোর অবস্থা বেগতিক। তুই...
-সার, মদের কথা বাদ দেন৷ আফনে এমন ভাবে কইতাছেন যে আমার মনে হইতাছে আমি এহনই মারা যাইতেছি৷ মদের কথা বাদ৷ মরার কথা বাদ৷
-ওকে। তাহলে চুপ করে জুয়া খেলার কথা ভাব৷ ধর তোরা পাঁচজন মিলে জুয়া খেলছিস। পাঁচ জনের একজন খুব শক্তিশালী। সে সর্বত্র নিজের জোর খাটায়৷ জোর খাটিয়ে খেলে। তোরা খেলা শুরু করলি। পরপর তুই প্রত্যেক ম্যাচ হারতে শুরু করলি৷ হারতে হারতে তোর সকল টাকা শেষ৷ বাকি দিয়ে খেলা শুরু করলি। শেষ ম্যাচ হারার পর লোকটা তোর কাছে টাকা চেয়ে বসলো। তুই টাকা দিতে পারলি না৷ সে তোকে মারতে শুরু করলো৷ দলের বাকি তিনজনও একই কাজ শুরু করলো৷ মারতে মারতে তোকে এক সময় মেরে ফেললো। তোর চোখ দিয়ে চাকু ঢুকিয়ে দিলো৷ বুকের কাছে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকলো৷ গলা কেটে দিলো। তোর...
-সার? ডর লাগতাছে৷ এসব কী কইতাছেন?
মেঘ হাসলো৷ বলল,
-আচ্ছা এবার ভাব, কল্পনা কর, ছোট্ট একটা টিনের ঘর৷ সেই টিনের ঘরের সিলিংয়ে ছিদ্র৷ সেই ছিদ্র গলে আলো এসে সোজা একটা বাচ্চার উপর পড়ছে৷ ফর্সা, সুন্দর চেহারার একটা বাচ্চা, ছোট ছোট হাত, গোলগাল মুখ, চোখ এবং নাক দেখতে একদম তোর মতো। তুই ভাব তুই সেই বাবুটার পাশে শুয়ে আছিস৷ সিলিংয়ের ছিদ্র গলে আসা আলো বাবুটাকে বিরক্ত করছে৷ ঘুমে বাধা দিচ্ছে৷ তুই ছিদ্রটা বরাবর উপড় হয়ে বসলি৷ আলো যেন বাচ্চাটার মুখে না লাগে সে জন্যে তুই আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলি। আলো পড়লো না আর। তোর মতো দেখতে বাবুটা এখন আর বিরক্ত হচ্ছে না৷ সে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে৷ তুই তাকে দেখছিস৷ উপড় হয়ে দেখছিস৷ এমন সময় বাবুটার ঘুম ভেঙ্গে গেল৷ ছোট ছোট হাত পা নাড়িয়ে নিজের দেহটা মুড়িয়ে নিলো সে। তারপর ধিরে ধিরে চোখ মেলল। মেলতেই তোকে দেখলো। সে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলো তোর দিকে। তুইও তাকিয়ে থাকলি। তোদের চোখাচোখি হয় কিছু সময়৷ তারপর চট করেই বাবুটা হেসে দেয়৷ হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে সে দেখে তোকে। দাঁতহীন হাসি৷ দাঁতের মাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়৷ তুই তাকিয়ে আছিস তার দিকে৷ হাসিটা দেখছিস। তোর চোখে জল। তুই কাঁদছিস। তোর কাছে মনে হচ্ছে এই হাসিটা পৃথিবির শ্রেষ্ঠ হাসি৷ একমাত্র শ্রেষ্ঠ হাসি৷ তোর তখন বাঁচতে ইচ্ছে হয়৷ বেঁচে থাকতে মন চায়৷
বদি চট করেই পেছনে ফিরে মেঘকে জড়িয়ে ধরে৷ পাগলের মতো কান্না করে দেয় সে৷ সে চিৎকার দিয়ে বলে,
-সার, আমি ওরে দেখছি৷ আবার চাও'টারে দেখছি সার৷ অয় প্রথমবার আমার কোলে উইঠা হাসছিল৷ আমি দেখছি সার। আমার মনে আছে৷ আমি আমার চাও'টারে ভুলি নাই।
বদি গা কাঁপিয়ে কান্না করে৷ মেঘ তাকে নিজের ভাইয়ের মতো জড়িয়ে ধরে রাখে৷ কিছুদূরে বসে থেকে নীরব হয়ে এসব দেখে রোদ। তার কাছে পৃথিবী বড় অদ্ভুত লাগে৷ বিচিত্র লাগে৷ বিচিত্র লাগে এই পৃথিবীর মানুষ। এই পৃথিবির একজন মানুষ, যার নাম মেঘ৷ তাকে বিচিত্র লাগে৷ ভিন্ন লাগে। সব থেকে ভিন্ন। কে এই মানুষ? তার সাথে বদির সম্পর্ক কী? বদির ভাই নিশ্চয়ই নয়৷ চেহারায় তো বড় পরিবারের মনে হয়? বড়? বড় পরিবার আছে? তাহলে কি রোদও সব কিছুতে বড় ছোট করে দেখে?
অনেকটা সময় নীরবতায় কাটে৷ বদি বসে আছে স্থির হয়ে৷ তার পাশে মেঘ। সে বলল,
-দেখ বদি, তোকে আমি চিনি না৷ জানি না৷ তোকে দেখে ভালো মনে হলো বলে কথা গুলো বলছি। শুন, তোকে আমি নিলুফার কথা বললাম, মদের কথা বললাম, জুয়ার কথা বললাম৷ প্রতিবারেই তুই ভয় পেয়েছিস৷ বাঁচতে চেয়েছিস৷ কিন্তু তোর যে পথ, সেখানে এভাবে বাঁচা যায় না৷ যারা ওই পথে যায়, তাদের মৃত্যুটা এভাবেই হয়৷ ভয়ানক ভাবে৷ মৃত্যুর আগে এদের কাছে কেউ থাকে না৷ কেউই না৷ একটু পানি দেওয়ার মতো মানুষ থাকে না এদের। তুই যদি চাস তবে এভাবে তুই মরতে পারিস৷ কিংবা চাইলে সুন্দর, ওই পরীর মতো মেয়েটার বাবা হয়ে মরতে পারিস৷ যেই মেয়ে হওয়ার পর, তার ভরণপোষণের ভয়ে তুই ঘর ছেড়ে পালিয়েছিস৷ তারা বাবা, একজন নায়ক হয়ে বাঁচতে পারিস তুই৷ তোর ইচ্ছে৷ তোর মর্জি৷ আমার কিছুই করার নেই৷ আমি তোকে আলো অন্ধকারের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলাম৷ এবার তুই যেদিকে যাস৷ একটা কথা মনে রাখবি, আল্লাহ কারো উপর নির্দয় হোন না৷ যারা মারা যায়, আত্মহত্যা করে, তারা আসলে সঠিক পথটা বেছে নেয় না৷ আল্লাহ দুটো পথই দেখায়৷ আলো এবং অন্ধকারের৷ বেছে নেয়াটা কেবল আমাদের উপর ছেড়ে দেয়। এখন আমরা যে পথ বেছে নিবো, আমাদের পরিনতিও সেই পথ অনুযায়ী হবে৷ কী বলেন রোদ? ঠিক বললাম না?
রোদের ঘোর ভাঙ্গে চট করেই। সে অবাক হয়ে দেখে মানুষটাকে৷ মেঘকে। চোখের ঘোর যায়নি এখনও। ভাবে এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে? ইনি কি আসলেই মানুষ নাকি রূপধারী ফেরেশতা৷ সে বুঝতে পারে না৷ আনমনে মাথা নেড়ে সায় দেয়। খানিকটা হাসে। মেঘও হাসে৷ বলে,
-তা আপনার গল্প কি?
রোদ খানিকটা নড়েচড়ে বলে,
-আমার কোনো গল্প নেই।
মেঘ হাসে। বলে,
-গভীর রাতের পথিকদের এক একটা গল্প থাকে৷ আপনারও আছে। বলতে সাহস পাচ্ছেন না হয়তো৷
রোদ কী বলবে ভেবে পায় না৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কেবল। মেঘ বলে,
-ভাবিকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
অরুর কথা মনে পড়ে তার৷ সিগ্ধ চেহারার কঠিন একটি মেয়ে৷ তাকে দেখে বোঝাই যায় না সে কতোটা কঠিন; তার মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া নেই৷ রোদ সিগারেট ফেলে দিয়ে বলে,
-ভালোবাসা বড় নিষ্ঠুর ভাই৷ এটা মানুষকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যে মানুষটা কল্পনাও করতে পারে না সে এমন জায়গায় নেমে এসেছে৷
মেঘ হাসলো। প্রসন্ন মনের হাসি৷ বলল,
-চা খেতে ইচ্ছে করছে৷ এই সময় এক কাপ চায়ের সাথে আপনার গল্পটা বেশ জমে উঠবে৷ কী বলেন?
রোদ মাথা নিচু করে নেয়৷ মেঘ বলে,
-রাত দুইটা বেজে গিয়েছে৷ এই সময় দোকান খোলা পাবো না৷ তবে...
রোদ ভ্রু কুচকে বলল,
-তবে?
-একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি যেখানে চমৎকার এক কাপ চা পাওয়া যাবে৷
রোদ উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎই সে নিজের মাঝে বেশ আগ্রহ ফিরে পেল৷ জানতে এবং জানানোর আগ্রহ৷ মেঘ উঠে বলল,
-বদি? উঠ বেটা৷ চা খেয়ে আসি৷
বদি অনেকক্ষণ নীরব থেকে বলল,
-সার, আফনে কি আসলেই মানুষ? ফেরেশতা না তো?
মেঘ হেসে ফেললো। বেশ শব্দ করে হাঁসলো। বদি তার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ রোদ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাদের মনে হলো এই লোকটা পৃথিবীর এক মাত্র সুখি মানুষ। এক মাত্র সুখি মানুষ সে৷
-চলেন, হাঁটি। আপনার গল্পটা ওখানে গিয়েই শুনবো। কী বলেন?
হাসি থামিয়ে মেঘ কথাটি বললো। তারপর হাঁটতে থাকলো। রোদ এগিয়ে গেল৷ বসে থাকে বদি উঠে এলো৷ ময়লা জামাকাপড় নিয়ে সে ভদ্রলোকেদের সাথে হাঁটছে, এটা ভাবতেই তার বড় ভালো লাগে। আনন্দ অনুভব হয়৷ পৃথিবীর সব মানুষ যদি এমন হতো! এতো কোমল হতো! হাঁটার সময় বদি চট করেই বলে উঠলো,
-সার, আমার বউ কিন্তু সেই রকম চা বানায়৷ খাইলে মুখে লাইজ্ঞা থায় যেন।
-আরেহ বাহ বদি! বউয়ের চায়ের কথা মনে আছে দেখছি৷
-বড় স্বাদের চা৷ ভুলি কেমনে কন?
মেঘ কথা বলে না৷ রোদ কথা বলে না৷ সবাই চুপচাপ হেঁটে যায়৷ বদি জানে না, রোদ জানে না তারা কোন দিকে যাচ্ছে৷ কোথায় যাচ্ছে। তারা কেবল হাঁটছে৷ হাঁটতে তাদের ভালো লাগছে।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, একটা ছেলে রাস্তার ধারের ছোট্ট একটি ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে৷ জোরে জোরে শব্দ করছে। গালি দিচ্ছে। মেঘ এখান থেকে আঁচ করলো ছেলেটা গালি দিচ্ছে। ছেলেটা মাতাল বোধ হয়৷ কথা স্পষ্ট নয়৷ দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। মেঘ দৌড়ে গেলো৷ তার সাথে দৌড়াতে থাকলো বদি। দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে ধরলো। কষে কয়েকটা দিতেই ছেলেটা দৌড়ে পালালো৷ মাতাল হয়ে দৌড়াচ্ছে সে৷ পড়ে যাচ্ছে, উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবার দৌড়াচ্ছে৷ এবং পড়ে যাচ্ছে৷ মেঘ আর তেমন গা দিলো না৷ বদি হাঁপাতে থাকলো৷ রোদ কিছু করলো না৷ সে কেবল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী হয়েছে৷ কেন এরা এমন দৌড়ে এলো।
বদি বসে আছে৷ হাঁপাচ্ছে৷ মেঘ দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘরটার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক সেই সময় ওই ঘরের দরজাটা খোলা হয়৷ ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসে অল্প বয়সী একটা মেয়ে৷ তার কোলে ছোট্ট একটি বাচ্চা৷ বাচ্চার বয়স এক বছরের মতো হবে৷ মেয়েটা মেঘকে দেখে কেঁদে দেয়৷ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-আকাশ ভাই, ওই বদ পোলাটা আবার আইছে৷ হেয় আমারে শান্তি দেয় না৷ শান্তিতে ঘুমাইতে পারি না ভাই।
মেঘ এগিয়ে যায়৷ মেয়েটার কাছ থেকে বাবুটাকে নিয়ে বলে,
-চিন্তা করিও না আপু৷ ঠিক হয়ে যাবে সব৷ আমি কালই এই ছেলের একটা ব্যবস্থা করবো৷
কথাটা বলে মেঘ ফিরে তাকায় বদির দিকে। বদি তাকিয়ে আছে আবাক চোখে৷ তার চোখে জল। আজ তৃতীয়বারের মতো সে কাঁদছে৷ না চাইতেই কাঁদছে৷ চোখের জল রোখাতে পারছে না সে৷ বদি ভেজা চোখে দেখলো, তার অল্প বয়সি বউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। মেঘের কোলে ছোট্ট একটি বাচ্চা৷ বাচ্চাটা মেঘের মুখে হাত রাখছে৷ মেঘের কান ধরছে। চুল ধরতে চাইছে। বদি আরেকটু ভালো করে তাকাতেই দেখলো দরজার দ্বার ঘেঁষে তার বৃদ্ধ মা দাঁড়িয়ে আছে৷ সেই মায়ের চোখে জল। জল ভরা দৃষ্টিতে মা সন্তানকে দেখছে৷ বদি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কী করবে ভেবে পেলো না। মেঘ বলল,
-বদি, আমি তোকে আলোর পথটা ধরিয়ে দিলাম। তোর যদি বাঁচতে ইচ্ছে হয় তবে এই পথটা ধরিস৷ জীবন অনেক সুন্দর ও সহজ৷ আমাদের দেখার দৃষ্টিটাই আসলে কঠিন৷
বদি চোখমুখ মুছে উঠে আসে। বাবুটাকে কোলে নিতে চায়। মেঘের পাশে থাকা অল্প বয়সি মেয়েটা বাধা দেয়৷ সে বাবুটাকে কোলে নিয়ে বলে,
-এই বদ লোকের কোলে আমার মাইয়ারে দিমু না৷ হেরে যাইতে কন আকাশ ভাই! হের এইখানে কুনু জায়গা নাই।
মেঘ হাসলো। বলল,
-এটা তোমাদের ব্যাপার। আমি জানি না কিছু৷ আমাদের দুই কাপ চা দিও৷ তোমার হাতের চা খেতে ইচ্ছে করছে বুবু৷
মেঘ এগিয়ে এলো রোদের কাছে৷ তারা দুজন রাস্তার ধারে বসলো। রোদ ভ্রু কুচকে বলল,
-আকাশ! আপনার নাম আকাশ?
-নাম দিয়ে কি? নাম কি আর মানুষের পরিচয় বহন করে? করে না৷ যে যে নামে ডেকে আনন্দবোধ করে সে সেই নামেই ডাকে আরকি।
-আমি মেঘ বলেই ডাকি তাহলে?
-ইচ্ছে।
-সিগারেট দিন একটা।
মেঘ সিগারেট এগিয়ে দিলো। রোদ সেটা ধরিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে রেখে বলল,
-আমার গল্পটা আধুনিক ধরনের। সেখানে আপনার 'বদি' নামক এই গল্পটার মতো এতো আনন্দ নেই। বিষাদ, বিষাদ আর বিষাদ। বিয়ে করেছি তিন মাস ঘনিয়েছে৷ বউয়ের আমাকে পছন্দ না৷ এই কথাটা সে আমাকে বিয়ের আগেই জানিয়েছে৷ প্রথম যখন কথাটি বলল তখন খুব মন খারাপ হলো৷ এতোটা মন খারাপ আমার প্রেমিকার ছেড়ে যাওয়াতেও হয়নি। আমি খুবই কষ্ট পাই৷ সে বিয়ে করতে চাচ্ছে না কারণ চারমাস হলো তার সাথে তার বয়ফ্রেন্ডের ব্রেকাপ হয়েছে৷ সে সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না৷ একবার নাকি সুইসাইড এটেন্ড করেছে৷ আমি বললাম, "আপনি সময় নিতে পারেন৷ একটু ভেবে দেখুন।" সে ভেবে দেখেনি৷ স্পষ্টই জানালো সে আমাকে কেন, এই মূহুর্তে কাউকেই বিয়ে করতে প্রস্তুত নয়৷ আমার মন ভাঙ্গে৷ ব্যাথা লাগে৷ বাবাকে বলি৷ বাবাও মেনে নেন৷ আমিও বাস্তবটা সহজ ভাবে মেনে নেই৷ কিন্তু এক মাস গড়াতেই বাবা আবার ওই মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে ফেলেন৷ হুট করেই৷ বিয়ের আগ মুহুর্তে আমাকে জানানো হয়৷ বাবা শেরওয়ানি এনে বলেন, 'পরে নে। আজ তোর বিয়ে৷' ব্যস বিয়েটা হয়ে গেল৷ তবে বউ তখনও আমি দেখিনি। বিয়েতে যখন বউকে নিয়ে আসা হলো তখন তো আমি হতভম্ব। আশ্চর্য! এ কাকে দেখছি আমি? আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। প্রচণ্ড খুশিতে আমার কান্না পেলো তখন। উপস্থিত মজলিসে কেঁদে নিজেকে 'কাঁদু' টাইপ প্রমাণ করতে চাইনি বলেই কাঁদা হয়নি৷ চেপে রাখলাম। বাসর রাতে বউয়ের ঘরে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন বেশ ঝামেলা করছিল মনের ভেতর। অরু মেয়েটা আমাকে কেন বিয়ে করলো? সেই কি আমাকে পছন্দ করে? মনের কোণে সুপ্ত একটি আশা ছিল, 'সে হয়তো আমাকে ভালোবাসে'। আমার সেই আশায় পানি পড়ে যখন সে জানালো সে আমাকে ফ্যামিলির চাপে বিয়ে করেছে৷ তার মনে আমার জন্যেই কিছুই নেই৷ মন ভাঙ্গে আরেকবার। বাসররাতে এমন কথা কতোটা পেইনফুল সেটা হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন না৷ যাই হোক, সেটাও চাপা দিলাম। বুকের ভাঁজে চাপা পড়লো আরো একটি কষ্ট৷
-আকাশ ভাইয়া, চা।
বদির বউ চা নিয়ে এলো৷ তার পেছন পেছন এলো বদি। তার কোলে বাচ্চা৷ স্ত্রীর পিছু পিছু ঘুরছে। মান ভাঙ্গাচ্ছে। মেঘ হাসলো খানিক৷ চা নিলো৷ রোদকে দিলো৷ চায়ে চুমুক দিতেই রোদ বললো,
-ওয়াও! অসাধারণ চা৷ ট্রাস্ট মি, এতো স্বাদের চা আমি আর কখনই খাইনি।
-হ্যাঁ। বুবু চা ভালোই বানায়৷ দারুণ৷ আমি তো তার ফ্যান৷
বদির বউ হাসে৷ লজ্জাময় হাসি৷ সে চলে যায়৷ তার পেছনে পেছন যায় বদি৷ হেঁটে হেঁটে মান ভাঙ্গাবে নাকি? আশ্চর্য! রোদ বলল,
-আপনার আপন বোন?
-নাহ৷
-তাহলে?
-বুবু চা বিক্রি করে রেলস্টেশনে। সেখানেই পরিচয়। ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না৷
-তাহলে এতো কিছু? বদিকে ফিরিয়ে আনা?
-গুছিয়ে দেয়া আরকি৷ গুছানোর কেউ নেই৷ এ জন্যেই। আপনার গল্পের পরের অংশ?
-তাড়া আছে?
-নাহ৷ আমার কোনো তাড়া নেই৷ আমার কাজই তো এটা৷ গল্প শোনা৷
রোদ হাসলো। বলল,
-আমি বউয়ের পিছু লেগে যাই৷ সব কিছু ছাপিয়ে ভাবি, যা কিছু হয়েছে সেটা অতীত৷ সে এখন আমার বউ৷ তাই তাকে ঠিক করার দায়িত্বও আমার৷ নিলাম সেই দায়িত্ব। অফিস থেকে আসার সময় তার জন্যে ফুল, চকলেট, আইস্ক্রিম এমন যা যা পছন্দ করতো তা নিয়ে আসতাম। সে সেগুলোও ছুঁয়েও দেখেনি৷ মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে যেতাম। তার দেহ আমার পাশে থাকতো বটে মন থাকতো না। একবার তাকে একটা আঙটি দিয়ে প্রপোজ করেছিলাম খোলা পার্কে। সে ভ্রু কুচকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, "এটা কোন ধরনের পাগলামি?" সে পেছন ফিরে হেঁটে চলে গেল। আমি আবার ব্যাথা পেলাম। হতাশ হলাম। সেটা চাপাও দিলাম। স্বভাবটাই আমার চাপা দেওয়ার৷ সব চাপা দিয়ে আগের মতো নতুন করে যেতাম। অরুর মনে হলো, আমি বেহায়া৷ এতো অপমান করার পরও ফিরে আসি৷ এমন পুরুষ তার পছন্দ না। আমার আঘাত। আঘাত থেকে ব্যাথা৷ চাপা দেওয়ার স্বভাব৷ দু'মাস সকল চেষ্টার পরও আমি তার মন অবদি পৌঁছাতে পারিনি৷ ব্যার্থ৷ দুঃখ,কষ্টে কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলাম। লেট করে বাসায় ফিরতাম। বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম। ইচ্ছে করেই দেরি করে বাসায় যেতাম। বাসায় গেলেই অরুর চেহারা দেখতে হবে৷ তার চেহারা দেখলেই আমি নিয়ন্ত্রণ হারাই৷ এতো অসাধারণ একটি মেয়ে, অথচ তার সাথে কথা বলতে চাওয়াটাই অপরাধ৷ বাসায় গেলেই এই অপরাধটি হয়ে যাবে৷ অপরাধ হলে শাস্তি৷ শাস্তি গড়ায় ব্যাথা পর্যন্ত। তা চাচ্ছিলাম না আর। এ জন্যেই লেট করে ফেরা। বারোটা কিংবা একটা হচ্ছে কমন সময়৷ সেদিন দেখলাম অরু জেগে আছে। আমি চুপিচুপি ফ্রেশ ফিরে এসে দেখলাম সে বিছানায় বসে আছে লাইট জ্বালিয়ে৷ বলল, "ইদানীং রাত করে ফিরছি কেন?" আমি কথাটার মানে তখনও বুঝতে পারিনি৷ কোনো উত্তর না দিয়েই শুয়ে পড়লাম। সে বলল, "খাবেন না?" আমি "না" উত্তর দিলাম। সকালে বাবা ধরে বসলেন আমি কেন দেরি করে আসছি বাসায়৷ আমি কোনো জবাব দিচ্ছিলাম না। বাবা জোরাজুরি করলেন। শেষমেশ নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলাম না। বলেই ফেললাম, "কাজটাই তো এমন করেছো। যে মেয়ে আমাকে চায় না তাকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছো। আমার পুরো লাইফটাই হেল করে দিয়েছো।ব্লা ব্লা ব্লা।" হলো ঝগড়া। চলে এলাম অফিসে। বাসায় ফিরলাম রাত করে। বাসায় ঢুকেই মনে হলো পরিবেশ অনুকূলে নেই৷ যা ভাবলাম তাই হলো। বাবা রেগে আছেন৷ আবার হলো ঝগড়া৷ সেই একই টপিক। কেন দেরি করে ফেরা। সাথে যুক্ত হলো, অরুর এই বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া। এই ঘরের বউ রাগ করে বাপের বাড়ি গেছে সেটা আমার পিতামহদয়ের আত্মসম্মানে লেগে গেল। অথচ কী যন্ত্রণা আমার দিন যাচ্ছে সেটা তিনি ভাবলানে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে ঝগড়া হলো। বাবা চড় দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেন৷ সেই ঘর আর আমার নয়৷ চলে এলাম। ব্যস। এই তো গল্প। তবে হ্যাঁ, এসে আমার মনে হয় ভুল হয়নি৷ আপনার সাথে একটি চমৎকার রাত কাটানো হলো৷ আমি কিছু জানলাম। যেমন একটা হচ্ছে, "জীবনটা সুন্দর এবং সহজ৷ আমাদের দেখার দৃষ্টিটাই কঠিন।" কথাটা সত্যি৷ সহজ ভাবে দেখলে সহজ৷ কঠিন ভাবে দেখলে কঠিন।
মেঘ হাসলো৷ প্রশান্তির হাসি। বলল,
-তা আপনি কি সহজ ভাবে দেখছেন?
-শুরু করলাম সবে৷
-তাহলে বাসায় ফিরছেন?
-অবশ্যই ফিরবো। তবে রাতটা আজ আপনার সাথেই হেঁটে কাটাবো।
মেঘ কিছু বলল না। হাসলো কেবল।
তারা সেখান থেকে চলে এলো। বদিকে রেখে আসা হলো। তার দায়িত্ব হচ্ছে নিজের বউকে মানিয়ে নেওয়া। মেঘ আর রোদ হাঁটছে। নিশুতি রাত৷ এদের হাঁটতে কোনো ক্লান্তি লাগছে না৷ বরং ভালোই লাগছে৷ তারা ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলো৷ ঠিক সেই মূহুর্তে একটি কালো গাড়ি তাদের পাশ কাটিয়ে গেল৷ অল্প কিছু পরে সেটা আবার তাদের পাশে এসে থামলো৷ মেঘ এবং রোদ দুজনেই দাঁড়িয়ে গেল৷ গাড়ির দরজা দ্রুতই খুলে যায়৷ সেখান থেকে যেন একটা পরী নেমে আসে৷ কালো শাড়ি পরা একটি পরী৷ যার কাজল লেপ্টে আছে৷ চোখ ফোলা। নাকের ডোগা লাল হয়ে আছে৷ মেয়ে গাড়ি থেকে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রোদের দিকে৷ মেঘ পাশ থেকে রোদের কাঁধে হাত রাখলো। ফিসফিস করে বলল,
-আপনি ভালোবাসাকে নিষ্ঠুর বলেছেন৷ ভালোবাসা নিষ্ঠুর নয়৷ আপনার ভাবনাটাই নিষ্ঠুর৷ সব ছাপিয়ে আপনি এটা কেন ভাবছেন না যে আপনি একজনকে সত্যি কারের ভালোবেসেছেন৷ এটাই তো অনেক৷ সত্যিকারের ভালোবাসা ক'জনের মধ্যে ঘটে? ক'জন আসলেই ভালোবাসে একে অপরকে? সেখানে আপনাকে ভাগ্যবান ভাবা উচিৎ। ভালোবাসলেই যে মিলন হতে হবে তা বলল কে? দূরে থেকেও তো ভালোবাসা যায়৷ যেমন মানুষ আকাশকে বাসে। রোদ ভাই, আপনি সহজ ভাবে ভাবেননি। ভাবলে আজ রাতে এখানে থাকতেন না৷ ভাবি সেদিন রাতে জানতে চেয়েছেন "আপনি কেন দেরি করে ফিরেছেন?" তার মানে কী? তিনি আপনাকে খেতেও বলেছেন। সবচে বড় কথা তিনি জেগে ছিলেন। আপনার জন্যে জেগে ছিলেন৷ এই ব্যাপারটা সহজ ভাবে ভাবলেই আপনি একটা দারুণ উত্তর পেতেন৷ একটা মেয়ে হঠাৎ কেন জানতে চাইবে আপনি কেন দেরি করে ফিরছেন অথবা খেতে বলবে? যেখানে সে আজ পর্যন্ত আপনার সাথে ভালো বিহ্যাভটা করেনি? একটু ভালো করে ঘাঁটলে একটা জটিল সমস্যা সমাধান হতো৷ যাই হোক, যেহেতু ভাবি এখানে, সেহেতু সমস্যার সমাধান ঘটেছে নিশ্চিত। অল দ্য বেস্ট।
মেঘের কথা গুলো কেমন ধীরে ধীরে শোনাতে লাগলো। রোদের মনে হলো চারপাশের সব নিস্তব্ধ হয়ে আছে৷ সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না৷ সে কেবল সামনের মেয়েটিকে দেখছে৷ তাকে দেখে যাচ্ছে কেবল। তার সব কিছু অবশ লাগছে৷ অন্য রকম লাগছে তার। সে তাকিয়ে থাকলো৷ তার চোখে ঘোর ধরলো৷ পেছন থেকে কে জানি ধাক্কা দিলো। সে খানিকটা এগিয়ে এলো৷ কালো শাড়ি পরা, কাজল লেপ্টে যাওয়া, চোখ এবং নাকের ডগা লাল করে ফেলা অরু মেয়েটা ধীরে পায়ে আরো কিছুটা এগিয়ে এলো। এতোক্ষন তার দম বন্ধ লাগছিল৷ রোদকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে শোনার পর থেকে সে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। তার গা কাঁপা শুরু হয়েছিল৷ দম বন্ধ লাগছিল। হাঁসফাঁশ লাগছিল৷ শুন্য শূন্য লাগছিল বুকের ভেতর। সে আর অপেক্ষা করে না৷ নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রোদকে খুঁজতে। এই ছেলেকে আজ খুঁজে না পেলে মেয়েটা যেন মারা যাবে৷ সে তার বাবার বাড়ি গিয়েছে তার সব জামা কাপড় নিয়ে আসতে। একেবারে রোদের বাসায় চলে আসতে। অথচ রোদের বাবা ভুল বুঝে এমন কিছু করে ফেলবে সেটা ভাবতেও পারেনি৷ এমন জানলে সে এই কাজটা মোটেও করতো না৷ সে চায় না আবার নতুন করে কাউকে ভালোবেসে হারাতে৷ সে এবার আঁকড়ে ধরতে চায়৷ রোদের বুকে মাথা রেখে বাঁচতে চায়। অরু এগিয়ে যায়৷ তার চোখে জল৷ বুকের ভেতর কাঁপছে। সে কেবল এই মুহুর্তে রোদকে জড়িয়ে ধরতে চায়৷ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায়৷ তার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। সে আর অপেক্ষা করে না৷ দৌড়ে যায়৷ পাগলের মতো আঁকড়ে ধরে রোদকে। পাগলের মতো চিৎকার দিয়ে কাঁদে মেয়েটা৷ রোদ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না৷ শক্ত করে আগলে নেই অরুকে৷ তার বুকের ভেতর হঠাৎই যেন রাজ্যের প্রশান্তি এসে বাসা বাঁধে৷ শরীর সময় অদ্ভুত এক শরশিরে অনুভূতি তাকে পাগল করে তোলে। সে অরুর চুলের মাঝে মুখ লুকিয়ে কান্না করে দেয়৷ চেপে থাকা সব ব্যাথা আজ বেরিয়ে যায়৷ সব কিছু খোলাসা হয়৷ ব্যাথা রং বদলায়৷ সেগুলো আনন্দে রূপ নে দ্রুত৷ ঠিক সেই মুহুর্তে রোদের মনে পড়ে মেঘের কথা৷ একবার পেছন ফিরে তাকায়৷ কেউ নেই৷ কোথায় কেউ নেই৷ মেঘ নেই৷ চারপাশে দেখে৷ ছেলেটার ছায়াও নেই৷ রোদের আবার মন খারাপ হয়৷ ছেলেটা বলেছিল, গভীর রাতের পথিকদের এক একটা গল্প থাকে৷ রোদের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে, তার গল্প কী? সেও তো গভীর রাতের পথিক৷ তার কী গল্প? সে এখন কোথায় যাবে? তার গন্তব্য কী? খানিক বাদেই সে হাসলো। ভাবলো, ছেলেটা সহজ করে ভাবতে বলেছে। সহজ এবং সঠিক ভাবি৷ তার সাথে আমার আবার দেখা হবে। অবশ্যই হবে৷ তখন না হয় জেনে নিবো৷ রোদ প্রবল প্রশান্তিতে অরুকে আঁকড়ে ধরে রাখলো৷ এই নিষুতি রাতে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, গাছে ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেরা কী ভীষণ আগ্রহে দু'জন প্রেমিক প্রেমিকাকে দেখছে সেটা হয়তো তারা জানেই না। তারা জানেই না তাদের আনন্দে অন্ধকার রাজ্যে আজ আবার নতুন আনন্দ শুরু হয়েছে৷ অন্ধকার আজ হাসতে শিখেছে৷ তারাও হাসছে৷ প্রাণ খুলে আসছে৷
ভুলত্রুটি মার্জনীয়