Bangla Golpo: সে জন চায় যারে৷
Bangla Golpo: সে জন চায় যারে৷
তাসফি আহমেদ।
নিতু বেশ কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-উনি নিশ্চয়ই উনার ওয়াইফকে খুব খুশি রাখেন তাই না?
আমি নিতুর মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম৷ একটি ছেলে তার বউকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ছেলেটিকে আমি চিনি। আরো অনেকেই হয়তো চিনে৷ একজন জনপ্রিয় লেখককে 'অনেকেই চিনবে না' তা হয় কী করে! আমার অস্বস্তি লাগলো৷ নিতুর এই ব্যাপারটা বড়ই যন্ত্রণার। প্রায়ই সে এই লেখকের নানান প্রসংশা করে৷ নানা ভাবে তার গুণাবলি আমার সামনে তুলে ধরে৷ আমার অসহ্য লাগে৷ তাকে বেশ কয়েকবার বলেছিও যে এসব আমার সামনে যেন না বলে। এই মেয়ে আমার কথা শুনে কই? সারাদিন এই লোকটার ফেসবুক প্রোফাইলে পড়ে থাকে। একদম সারাটা দিন। আমাদের ব্যক্তিগত কথপোকথনেও এই লোকটার আলোচনা হয় বিষদ। কে জানে হয়তো আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারটাই এই লোকটাকে ঘিরে। আমি চুপ করে থাকলাম৷ কিছু বললাম না৷ নিতু ভদ্রলোকের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাটছে৷ আমি বললাম,
-নিতু?
নিতু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
-বলো।
-ফোনটা রাখো না!
-কেন? ফোন তোমার কী ক্ষতি করেছে।
-ক্ষতি করছে না? তুমি আমার দিকে মনোযোগ দিচ্ছো না৷ তোমার সমস্ত মনোযোগ ওই ফোনের দিকে।
নিতু হাসলো। বলল,
-তোমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো কী আছে?
নিতু মনে হয় একটু হাস্যরসের সাথেই কথাটা বলেছে। কিংবা মজা করে৷ অথচ কথাটা আমার ভেতরে এমন ভাবে আঘাত করলো যে আমার ভেতরটা হঠাৎ যেন চুরমার হয়ে গেল। আমার সমস্ত অনুভূতি যেন আকাশের মেঘের সাথে উড়ে গিয়েছে৷ আমার বারবার মনে হচ্ছে, 'নিতুর কাছে আমি কিছুই না? তার একটু মনোযোগ পাওয়ার মতোও না?' কিছুটা সময় পর আমি একটু অভিমানী স্বরে বললাম,
-মোবাইল দেখাটা কি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
নিতু খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-মোবাইল দেখাটা নয়। মোবাইলে কাকে দেখছি সেটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। নিতু মোবাইলটা ব্যাগের ভেতর রেখে বলল,
-কী বলবে বলো?
আমি চুপ করে থাকলাম। তাকে এই মূহুর্তে বলার মতো কিছুই আমার মনে আসছে না৷
.
নিতুকে আমি প্রায় দু'বছর থেকে চিনি। বলতে গেলে এই মেয়েটাকে বেশ পছন্দ আমার। আমার জীবনে দেখা এই একটি মাত্র মেয়ে যাকে দেখার পর আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটির চেয়ে সুন্দরী আর কেউই হতে পারে না৷ কিংবা অন্য কিছুও না। আমি যেন এক প্রকার বুদ হয়ে যাই মেয়েটার মাঝে। অথচ মেয়েটি ধপেধপে সাদা কোনো হুরপরী নয়৷ গায়ের রংটা উজ্জ্বল। তবে একদম ফর্সা নয়৷ অথচ আমার এতো ভালো লাগে!
তারউপর তার পরনে শাড়ি, কপালে ছোট্ট একটি টিপ এবং চোখের কাজল দেখলেই আমি যেন 'নাই' হয়ে যেতাম৷ বুকের ভেতর ধপধপানি বেড়ে যেতো৷ কপালে ঘাম জমতো। অদ্ভুত অথচ তীব্র একটি শীতল স্রোত বয়ে যেতো সমস্ত শরীর বেয়ে। সত্যি বলতে আজও আমার সেই অনুভূতি হয়৷ আমি নিত্যনতুন ভাবে তাকে উপলব্ধি করি। অথচ সে? সে অন্যকোথাও বুদ হয়ে থাকে৷ অন্য কারো প্রোফাইল ঘাটে। অন্য কারো ছবি দেখে মুগ্ধ হয়৷ আমি যে মাঝে মাঝে দু'একটা নতুন শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতে আসি তা যেন সে দেখেও দেখে না৷ কিংবা মাঝে মাঝে একটু দেখে বলে,
-নতুন শার্ট নিয়েছো নাকি? আরেহ! এমন একটা শার্ট তো ভাইয়ার পরনেও দেখেছিলাম। একদম সেইম শার্ট। ভাইয়াকে এতো ভালো লাগছিল না!
তার এই 'ভাইয়া'টি বড় যন্ত্রণা দায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জন্যে৷ কোথাকার কোন লেখক অথচ তার সকল আকর্ষণ কেবল ওই ভদ্রলোকের জন্যেই৷ আমার জন্যে নেই।
.
নিতু বলল,
-এই? রাগ করেছো নাকি?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম কেবল। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম। নিতু বলল,
-হুটহাট রেগে যাওয়া ভালো না৷ এতো রাগ পুরুষদের মানায় না।
আমি তার দিকে তাকালাম একবার। বললাম,
-মানায় না?
-উহু।
-কেন?
-তা জানি না।
-এই কথাটি কি তোমার ওই লেখক ভাই বলেছেন?
নিতু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। আমি চুপ করে থাকলাম। নিতুর চেহারা চট করেই কঠিন হয়ে গেল। সে খানিকটা কঠিন স্বরে বলল,
-কী মীন করেছো তুমি?
আমি বেশ শান্ত স্বরেই বললাম,
-কিছুই মীন করিনি। জাস্ট জানতে চেয়েছি কথাটা কি তোমার ওই লেখক ভাই বলেছেন?
-কথাটা এভাবে বললে কেন?
-কীভাবে বললাম?
-তুমি বোধহয় জানো না কীভাবে বলেছো তুমি?
আমি চুপ করে থাকলাম। কিছু বললাম না। আর কিছু বললে এই মেয়ে রেগে আটখানা হয়ে যাবে৷ একটা অস্বস্তিকর মোমেন্ট ক্রিয়েট হবে৷ যা আমি এই মূহুর্তে মোটেও চাচ্ছি না৷
.
নিতুর সাথে আমার প্রেমটা হতে একটু সময় লেগেছিল। সে আমাকে বুঝতে সময় নিয়েছিল। আমি তাকে স্পষ্টই বলেছিলাম যে,
-যদি আমাকে তোমার পছন্দ না হয় তবে তুমি সেটা বলে দিতে পারো। আমাকে যে তোমার পছন্দ হতেই হবে এমন তো না! হলে ভালো। না হলে আমার ব্যাড লাক।
নিতু কিছুদিন পর জানালো সে প্রথমে বন্ধুত্ব চায়৷ তারপর যদি প্রেম হয় তাহলে তো ভালো। না হলে আজীবন বন্ধুই থাকতে হবে৷ তখন 'প্রেম' কথাটাও উচ্চারণ করা যাবে না৷ আমি মেনে নিয়েছিলাম। এবং বন্ধুত্বের আদলেই আসলে এই সম্পর্কটি গড়ে উঠেছিল। কী ছিল না? সবই ছিল। দু'জনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, কিছু শিরশিরে শীতল অনুভূতি, চাঁদের রাতে পাশাপাশি হাঁটা, ফুটপাতে আড়াল হয়ে চট করেই তার ঠোঁটে চুমু খাওয়া, তাকে মাঝে উপহার দেওয়া, নানান উপমায় তাকে বিশেষায়িত করা এমন অনেক কিছুই ছিল। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। এই 'লেখক ভাইটি'কে যে তার তীব্র পছন্দ তাও সে প্রথমে জানিয়েছিল। আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি তখন। কারণ ব্যাপারটা তখন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ইদানীং যেন কোনো কিছু স্বাভাবিক নেই৷ যা হচ্ছে বাড়াবাড়ি রকমের হচ্ছে৷
নিতু বলল,
-কী ব্যাপার? কথা বলছো না কেন?
-কী বলবো?
-কিছুই বলার নেই? তাহলে আমাকে এখানে অযথা ডেকে এনেছো কেন?
আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়। তারপর বললাম,
-তুমি দেখছি রেগে যাচ্ছো৷ রেগে যাওয়ার কী হলো?
-তুমি আমাকে অযথা এখানে এনে বসিয়ে রাখবা, তারউপর কোনো কথা বলবে না, এসব দেখে কোনো মানুষ কি স্বাভাবিক থাকতে পারে? তার কি রাগ উঠবে না?
-অযথা ডেকেছি মানে? নিতু তোমার সাথে আমার এক সপ্তাহ দেখা হচ্ছে না৷ তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বলেই তো ডেকে আনলাম। আচ্ছা সত্যি করে বলতো, আমাকে কি তোমার এই কয়দিনে একবারও মনে পড়েনি? আমাকে দেখতেও ইচ্ছে হয়নি?
নিতু বেশ কঠিন স্বরে বলল,
-দেখার লোভটা পুরুষের থাকে৷ জন্মগত ভাবেই থাকে। মেয়েদের তেমন থাকে না৷ আর তুমি তো কোথাও একেবারে চলে যাচ্ছো না যে তোমাকে শেষবার দেখার জন্যে আমি পাগল হয়ে যাবো।
আমি চুপ করে থাকলাম। একজন লোভী পুরুষের এই মূহুর্তে চুপ করে থাকা ছাড়া হয়তো আর কিছুই করার নেই৷ কে জানে এই পৃথিবীতে ভালোবাসার মূল্য হয়তো খুব একটা নেই৷ কেউ একটু ভালোবাসা পাবার জন্যে কাতরায়, আবার কেউ অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে বিরক্ত হয়। নিতুর ক্ষেত্রে কোনটা ঘটলো? আমি কি তাকে অতিরিক্ত ভালোবেসে ফেলেছি? এ জন্যেই কি সে বিরক্ত? অতিরিক্ত ভালোবাসাটা কি অন্যায়? কে জানে! এই পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত কিছুই না হয়৷ এটা হওয়াটাও অস্বাভাবিক না৷ আমি নিতুকে বললাম,
-বাসায় চলে যাবে?
নিতু অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-হ্যাঁ, যাবো৷
আমি উঠতে উঠতে বললাম,
-আসো
নিতুর চেহারা স্বাভাবিক হয়ে এলো৷ তার মুখের বিরক্তির ছাপ গুলো মুছে যেতে থাকলো৷ আমি অবাক হয়ে ভাবলাম মেয়েটা আমার সঙ্গ'তে বিরক্ত হচ্ছে? আমাকে কি তার ভালো লাগছে না? আগে তো এমন ছিল না। এখন কেন এমন হয়ে যাচ্ছে? আমি একটা রিক্সাকে ডেকে নিলাম। নিতু বেশ স্বাভাবিক ভাবেই রিক্সায় উঠে বসলো। আমিও তার পাশে বসলাম। দু'জনের মাঝেই নীরবতা। কেবল রিক্সা চালানোর কিছু শব্দ এবং আশপাশের ছুটে চলা মানুষ-গাড়ির কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দ৷ সবটাই যেন আমার কাছে বিরক্তির, যন্ত্রণার। ভাবনায় ব্যাঘাত ফেলে৷ চিন্তায় অস্থির আমি। আমাদের সম্পর্কে কি মরিচা ধরেছে? নিতু কী ভাবছে? এতো মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছে সে? তার ভাবনায় তো আমি নেই৷ তার মনোযোগ পাওয়ার মতো কিছুই তো নেই আমার মাঝে। কে জানে! আজকাল তাকে বুঝতে পারি না আমি। হয়তো বুঝার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছি।
নিতুর একটা ঘটনা চট করেই মনে পড়ে গেলো আমার। আমার জীবনে কারো কাছেই আমি এতোটা ছোট হইনি। কেবল এই মেয়েটার জন্যেই হতে হলো। দোষটা অবশ্য কিঞ্চিৎ আমারও ছিল। তাকে নিয়ে বই মেলায় যাওয়ার কথা ছিল। বিকেল বেলা। বলেছিলাম সন্ধ্যার পর নিয়ে যাবো৷ ব্যস্ততা ছিল আমার। সেই ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠতে সন্ধ্যার কিছুটা পর হয়ে গেলো। তার ফোনের উপর ফোন। আমি আসছি না কেন? আর কতো দেরী? তার কাছে আজ যাওয়াটা নাকি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রিয় সেই 'লেখক ভাইয়ের' আজ একটি নতুন বই আসবে৷ সেই বইটি আজই তার নিতে হবে অটোগ্রাফ সমেত৷ লেখক সাহেব রাত আটটা পর্যন্ত থাকবেন মেলায়৷ তারপর চলে যাবেন। নিতুকে নিতে আসতেই আমার কিছুটা দেরিই হয়ে গেলো৷ ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে। আমাকে দেখেই রেগে মেগে যাচ্ছে তাই অবস্থা৷ বেশ কঠিন স্বরে বলল,
-আজ যদি বইয়ের সাথে অটোগ্রাফ না পাই তবে তোমার খবর আছে। দেখিও।
এই মেয়েটার 'খবর আছে' মানেই মারাত্মক কিছু। কথা বলা এবং দেখা করা ছেড়ে দিবে৷ আমাকে চিনেই না এমন একটা ভাব করবে। সে ভালো করেই জানে তাকে ছাড়া আমি ঠিক থাকতে পারি না। তাই সে ইচ্ছে করেই এমন করবে৷ আমাকে কষ্ট দিবে৷ তাকে নিয়ে দ্রুতই রওনা হলাম মেলার দিকে। মনের মধ্যে একটু আশা ছিল যে আজ নতুন বই এসেছে বলে লেখক সাহেব সময়া বাড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ থাকবেন হয়তো। তার পাঠকপ্রিয়তা অনেক। নিশ্চয়ই আজ সকলকে অটোগ্রাফ দিয়েই যাবেন৷ আমার এই সুপ্ত আশায় পানি ঢাললো রাস্তায় লেগে থাকা জ্যাম। বড় ঝামেলায় পড়ে গেলাম। এমনিতেই দেরি। তারউপর পড়লাম জ্যামে। আজ আর রক্ষা হবে না হয়তো। জ্যামটাকে এই মূহুর্তেই লাগতে হলো?
ভীষণ দুশ্চিন্তা গ্রস্থ আমার মন। পাশে রাগে আগুন হয়ে থাকা আমার মানুষ। যাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ অটোগ্রাফ না পেলে বেশ হতাশ হয়ে পড়বে সে৷ কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিল না৷ সেই কাজটাও যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মেলায় পৌঁছালাম সাড়ে নয়টায়। লেখক সাহেবের বই পেলাম তবে লেখককে পেলাম না। নিতু জলভরা দৃষ্টিতে আমায় দেখছে। তাকে দেখে আমার বুকের ভেতরটা তীব্র হতাশ৷ দুঃখে যেন আমার বুকটাও ফেটে যাচ্ছে। মেয়েটা কতো আশা করে এসেছিল। আমি নিতুকে বললাম,
-প্লীজ রাগ করো না। আমি তোমাকে আজকের ভেতরই অটোগ্রাফ নিয়ে দিবো। প্লীজ।
নিতু ভেজা স্বরে বলল,
-আমার লাগবে না অটোগ্রাফ। থাকো তুমি।
নিতু আমায় ফেলে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার সময় কান্না করছিল সে। আমি তার পেছন পেছনে গেলাম। বললাম,
-নিতু? এভাবে কান্নার কী আছে? আজ অটোগ্রাফ নিতে পারিনি তো কী হয়েছে? কাল নিবো৷ এটার জন্যে এতো মন খারাপ করলে হয়?
নিতু পেছন ফিরে বেশ কঠিন স্বরে বলল,
-খবরদার আর যদি একটা কথা বলেছো! বেশি বেশি করে ফেলছো তুমি। তুমি যদি জানতে এটা আমার জন্যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তবে কখনই এমন কথা বলতে না৷ আর প্লীজ পেছন পেছন আসবে না৷ অসহ্য লাগে আমার।
নিতু চলে গেল। আমি কী করবো ভেবে পেলাম না৷ নিজে স্টলে গিয়ে লেখকের ঠিকানা জানতে চাইলাম। তবে কিছুটা অন্য উপায়ে। মিথ্যার সাহায্য নিয়ে। এমনি জানতে চাইলে বলবে কি না তা নিয়ে খানিকটা সন্দেহ ছিল৷ তাইই এই ভিন্ন উপায়৷ প্রকাশক ব্যাটা প্রথমে বলতে চাইলো না। সে কেবল জানতে চাইলো কেন আমি লেখক সাহেবের বাসার ঠিকানা খুঁজছি। সেখানে পড়লাম এক ঝামেলায়। বললাম, "আমি একটা নাটক বানাবো। এ জন্যে লেখক সাহেবকে একটু দরকার।" এটা বলতেই ব্যাটা একটু নড়ে বসলো। কিছুক্ষণ এটা ওটা বলে লেখকের ঠিকানা দিলেন৷ সেই ঠিকায়নায় গিয়ে জানা গেল লেখক সাহেব অসুস্থ৷ দেখা করা যাবে না। আমি দারোয়ানের পাঁয়ে পড়লাম। বললাম,
-ভাই, প্লীজ ভাই৷ একটু ব্যবস্থা করেন না। উনার সাথে দেখা করার খুব প্রয়োজন৷
দারোয়ান মানলো না। সে নাছোড়বান্দা। আমাদের আলোচানার শব্দে লেখক নিজেই বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। বিরক্তি মুখে বললেন,
'রাত দুপুরে এ কোন মুসিবত ভাই?'
আমি লেখক সাহেবকে অনেক মিনতি করলাম। তাকে সবটা খুলে বললাম। তারপর তিনি অটোগ্রাফ দিলেন। সাথে এক কাপ চাও খাওয়ালেন। ইয়াং বয়সি এই লেখকটাকে আমার দারুণ লাগলো। মানুষটা এতো বন্ধুপূর্ণ!
সেই রাতেই বই নিয়ে আমি নিতুদের বাড়ির সামনে যাই৷ তাকে বারবার কল দেই৷ সে ফোন ধরে না৷ চিন্তায় অস্থির আমি। এদিকে কারো বাড়ির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না৷ মানুষজন কী ভাববে! আমি তাকে ফোন দিতে থাকলাম। মেসেজ দিতে থাকলাম। প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে নিতুদের বাড়ির গেট খোলার শব্দ হলো। গেট গলে বেরিয়ে এলো আমার সেই কাঙ্ক্ষিত চেহারাটি৷ যার জন্যে আজ আমার এতো কষ্ট৷ নিতু কাছে আসতেই আমি বললাম,
-এতো কান্নাকাটি করার কী আছে? চোখমুখ ফুলে কী একটা অবস্থা!
নিতু কোনো কথা বলল না। আমার হাত থেকে বইয়ের ব্যাগটা নিলো৷ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলো অটোগ্রাফ আছে কী না৷ অটোগ্রাফ দেখেই সে আড় চোখে দেখলো আমায়। বইটা বুকের সাথে মিশিয়ে বলল,
-আগামী এক সপ্তাহ তোমার সাথে কথা না বলার প্ল্যান করেছিলাম। তবে এখন অটোগ্রাফ নিয়ে আসায় সময় কমিয়ে তিনদিনে আনা হলো। এই তিনদিনে তুমি আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না৷ ঠিক আছে?
আমি অবাক এবং হতভম্ব হয়ে তাকালাম তার দিকে৷ বললাম,
-কী বলছো নিতু? এতো কষ্টের পরও তুমি এই কথা বলবে?
-শাস্তি কমিয়েছি এতেই খুশি থাকো।
কথাটা বলেই নিতু চলে গেল। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। কান দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল যেন৷ এতো রাগ উঠলো যা বলার মতো না। এরপর টানা তিন দিন নিতু আমার সাথে কথা না বলেই ছিল। এবং এরপর আমাদের দেখা হওয়ার সময় সে বেশ স্বাভাবিকই ছিল। আমি যারপরনাই অবাক হলাম৷ আমার মনে হলো নিতু বদলে যাচ্ছে৷ আসলেই বদলে যাচ্ছে। এতোদিনে তো আরো বদলে গিয়েছে এবং আমার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে নিতু সম্পূর্ণই বদলে গিয়েছে৷
পুরোটা পথে কেউই কোনো কথা বললাম না। নিতুদের বাসার সামনে যাওয়া গেল না। সে গলির মাথাতেই নেমে গেল। তার বাসার মানুষ দেখে ফেললে সমস্যা৷ রিক্সা থেকে নেমেই নিতু বেশ রুক্ষ ভাবে বলল,
-সরি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। অনেক গুলো কথা বলার ইচ্ছে ছিল। বললাম না৷ কেবল একটা কথাই বললাম,
-তোমার ওই ভদ্রলেখক সাহেব একটা কথা বলেছিলেন। ব্যস্তদের কখনই প্রেম করতে নেই৷ আমার মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই বলেছেন৷
কথাটা হাসি মুখেই বললাম। নিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কেবল। আমি বললাম,
-তুমি ব্যস্ত মানুষ। আমার সাথে তোমার দেখা করাটাও আজকাল কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাই হোক, রাতে ফোন দিবো৷ ধরিও। যে কথা গুলো বলা ছিল সে গুলো বলবো।
কথাটা বলেই রিক্সাওয়ালা মামাকে রিক্সা চালাতে বললাম। নিতু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কেবল। কিছুই বলতে পারলো না। আমি ভাবলাম একবার পেছন ফিরে তাকাই। কিন্তু মন থেকে বিশেষ আগ্রহ পাইনি৷ অবাক কান্ড! নিতুর প্রতি আমার আগ্রহ কমে গেল নাকি?
.
রাত দশটার দিকে নিতুকে ফোন দিলাম। রিং হতেই ধরলেন মহাশয়া। আমার কেন জানি মনে হলো তিনি ফোনের কাছেই ছিলেন। ফোন ধরতেই বললাম,
-হ্যালো?
-হু
-কী করছো?
-কিছু না।
-সত্যিই কিছু না?
-তোমার কি মনে হচ্ছে আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি?
-সরি। আমি সেভাবে বলিনি।
-আজ যাওয়ার সময় যে কথা গুলো বলে গেলে সেসবের মানে কী? খুব ভাব বেড়ে গিয়েছে দেখছি। অন্য কাউকে পেয়েছো নাকি?
আমি হাসলাম। বললাম,
-আমার প্রশ্নটা তুমি নিজেই করলে?
-মানে?
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-নিতু?
-বলো?
-তুমি আমাকে শেষ কবে আই লাভ ইউ বলেছো বলতে পারবে?
-এই প্রশ্ন কেন করছো?
-আমার প্রশ্ন গুলোর সঠিক জবাব দাও৷ তারপর সব ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে৷
-আমার মনে নেই৷
-আমি শেষ কবে বলেছি সেটা জানো?
-জানি না।
লাস্ট কবে তুমি আমার শার্টের কালার পছন্দ করেছো?
-আশ্চর্য! কী সব প্রশ্ন করছো?
-আহা! বলো না?
-শার্টের প্রশংসা করতে হয় নাকি? জানা ছিল না। জানলে করতাম।
-আচ্ছা। শেষ কবে আমরা ঘুরতে গিয়েছি?
-অনেকদিন যাইনি।
-রাত জেগে কথা বলা?
নিতু এবার জবাব দিলো না৷ আমি বললাম,
-রিক্সায় ঘুরতে যাওয়া? এখন আর প্রায়ই ঘুরতে যাওয়া হয় না। কালেভাদ্রে হয়৷ তাই না?
নিতু জবাব দিলো না। কেন দিলো না? ও জানে না নাকি? আমি আবারও বললাম,
-পূর্ণিমার রাতে যে পিচঢালা পথে হাঁটতাম, ফুটপাতের কাছে বসে মশার কামড় খেতাম সে সব কি ভুলে গেছো? মনে আছে এখনও?
নিতু জবাবহীন।
-ইসহাক নামের এক লোকের দোকানে গিয়ে ফুচকা খেতে তুমি৷ আমি প্রায়ই নিয়ে যেতাম৷ ওই যে কৃষ্ণচূড়াটির নিচে। মনে আছে নিতু?
নিতু এবারও নিরুত্তর। আমি বললাম,
-নিতু? শেষ কবে তুমি আমায় দেখেছো? আমায় কবে দেখে বলেছো শার্টটিতে আমাকে দারুণ লাগছে?
নিতু আজ নিশ্চুপ। আমি বললাম,
-আজ যে আমাদের প্রনয় সম্পর্কের দু'বছর পরিপূর্ণ হলো তাও তুমি ভুলে গিয়েছো নিতু৷ রাত বারোটায় উইশ করার ইচ্ছে ছিল। করিনি৷ ভাবলাম একটা সারপ্রাইজ দিবো৷ একটা রিং কিনেছি। আজ তোমাকে আবার পুনোরায় প্রপোজ করবো৷ সোজা বিয়ের প্রপোজাল। একটু সেজে আসতে বলেছিলাম। আসোনি। যাক, তুমি এসেছো, তাই অনেক। তবে এসেই কী করলে? ওই লেখক সাহেবের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে পড়লে। কেন? এমন কেন হয়ে গেলে তুমি?
নিতুর কাঁপাকাঁপা স্বরে জবাব এলো,
-তুমি ভুল বুঝছো...
আমি তাকে থামিয়ে বললাম,
-লক্ষিটি! প্লীজ। আমি বলি৷ আমাকে অন্তত বলতে দাও৷ দু'মাস ধরে চুপ করে আছি। আমাকে এই দু'মাসের কথা গুলো বলতে হবে। প্লীজ!
নিতু কিছু বলল না আর৷ আমি বললাম,
-একদিন রিক্সায় বসে বলেছিলে, ওই লেখকটা কতো রোমান্টিক। কতোটা ভালোবাসে সে তার স্ত্রী কে। তার স্ত্রীর জন্যে এটা করে, সেটা করে, তাকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরতে যায়৷ তাকে চোখের মণি করে রাখে৷ নিতু, তুমি সত্যি করে বলো তো, আমি কি তোমার জন্যে তেমন কিছুই করিনি? রাত বারোটায় তোমার বাসার নিচে এসে কেক কাটিনি? তুমি যেমন চেয়েছো আমি তেমনই তো করেছি। তোমার একটা বই এবং একটা অটোগ্রাফের জন্যে কী কী করতে হয়েছে তা কি তুমি জানো? কখনও জানতে চেয়েছো? তাও তো তুমি খুশি হওনি। আমি যা করলাম সবটায় অপূর্ণতা খুঁজলে। এটা ঠিক হয়নি, ওটা ঠিক হয়নি৷ সবাই তো পার্ফেক্ট হয় না। হয়?
নিতু এবারেও কিছু বলল না। ওপাশে পিনপতন নীরবতা। আমি আবারও বললাম,
-নিতু, তুমি জানো না, সেলিব্রেটিদের জীবন কতোট কঠিন। কতোটা বেদনা দায়ক। এরা জোরে একটা নিশ্বাস নিলেই পরের দিন নিউজ হবে 'শ্বাস কষ্টে ভুগছেন অমুক'। ওই যে সেদিন অটোগ্রাফ নিতে গেলাম তোমার প্রিয় লেখকের কাছ থেকে? তিনি নিজেই জানালেন কেমন আছেন তিনি। নিজ থেকেই বললেন, ফেসবুকটা হচ্ছে একটা আবরণ যেখানে কেবল স্বচ্ছ জিনিস প্রদর্শন করা হয়৷ আড়ালের গল্প গুলো কেউই জানে না৷ তাদের হাসি মাখা ছবিটা দেখে তুমি ভেবেছো তারা কতো সুখি। অথচ এর আড়ালে কী ঘটছে তা জানলে তুমি অবাক হবে৷ তাদের দু'জনের কারোই তেমন সময় হয় না খোলা হাওয়ায় বসে গল্প করার৷ হলেও তা কম৷ অথচ তুমি কী না কী ভেবেছো! তাদের থেকে তো আমি উত্তম ছিলাম। তোমার জন্যে ছিলাম অন্তত। খোলা হাওয়ায় গল্প করার মতো একজন ছিলাম। অথচ আমি তা হতে পারিনি। আমার ব্যর্থতা।
-তুমি কী বলতে চাইছো বলতো?
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-তুমি আমাকে শেষ 'ভালোবাসি' বলেছো চারমাস আগে৷ রিক্সা থেকে নেমে গিয়ে তখন কী ভীষণ লজ্জা মাখা স্বরে বললে। মনে আছে।
নিতু আবার চুপ করে গেলো। আমি বললাম,
-আমি দু'মাস তোমাকে ভালোবাসি বলিনি৷ আর বলা হবেও না হয়তো৷ কেন বলিনি শুনতে চাও?
নিতুর জবাব নেই৷ আমি নিজ থেকেই বললাম,
-কারণ ঠিক দু'মাস আগে তুমি বেশ ক্ষুদার্ত কণ্ঠে বললে, "ইশ, ওই মানুষটার কাছ থেকে যদি 'ভালোবাসি' শব্দটা শুনতে পেতাম তবে ধন্য হতাম"। আমি সেদিনই আঁটকে গিয়েছিলাম। আমার 'ভালোবাসি' শব্দটার অপেক্ষায় তুমি থাকো না। তুমি অন্য কারো অপেক্ষায় থাকো৷ আমার 'ভালোবাসি'তে প্রভাবিত হও না তুমি৷ অন্য কারো কণ্ঠে প্রভাবিত হতে চাও। আজ আবার বললে 'আমার মাঝে মনোযোগ দেওয়ার মতো কিছুই নেই।' এসব কোন দিকে ইঙ্গিত করে তা কি তুমি বুঝো না? নাকি আড়ালে তাই বোঝাচ্ছো? নিতু? তুমি লাস্ট দুই মাস এবং সেটা বাদে বাকি বাইশ মাসের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাও?
নিতু জবাব দিলো না। আমি বললাম,
-বলো না প্লীজ।
নিতু একটু সময় নিয়ে বলল,
-আমি বুঝতে পারছি না।
-পারবে৷ অবশ্যই পারবে। তুমি এমন ছিলে না। চট করেই এমন হয়ে গিয়েছো। কেন হয়েছো?
-জানি না৷
-এভাবে কী একটা সম্পর্ক চলে?
-তাও জানি না৷
-আমার মনে হয় আমাকে ছাড়া তুমি ভালোই থাকবে৷
-থাকবো হয়তো।
-তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসতেই পারোনি।
-কে জানি।
-এভাবে তো সম্ভব না নিতু।
-চলে যেতে চাচ্ছো?
-সেটাই কি ভালো নয়?
-তোমার কাছে ভালো মনে হলে ভালোই।
-আজ ফোন কাটার পরই সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। তা কি তুমি বুঝতে পারছো?
-পারছি।
-খারাপ লাগছে না?
-জানি না।
-ফোন রাখবো?
-রাখো।
-তুমি কেটে দাও প্লীজ৷
-তুমি কাটলে সমস্যা কী?
-অস্বস্তি লাগছে৷
আমি চুপ করে গেলাম। ওপাশের মানুষটি নিশ্চুপ। সে কি ফোন কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে? কে জানে! নিচ্ছে হয়তো৷ এরচে বরং আমিই কেটে দেই৷ অন্তত একটি সুপ্ত আশা বেঁচে থাকবে৷ নিতু ফোন কেটে দেয়নি তা বলা যাবে৷ নিতু ফোন কেটে দিলেই বোঝা যেতো সে আমায় আর পছন্দ করছে না। ভালোবাসছে না৷ এটা ভেবে আমি আরো কষ্ট পেতাম। এতো কষ্ট কে চায় পেতে! ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে বিছানার কাছে রাখলাম। এরপর চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকলাম। চারপাশে অন্ধকার। ঘন অন্ধকার। নিতুর মনেও কী এমন অন্ধকার? সেও কি অন্য কাউকে কিংবা ওই লেখককে আড়াল থেকেই ভালোবেসে ফেলেছে? কারো লেখা পড়ে তাকে ভালোবাসা যায়? সত্যিই কি যায়? কে জানে! এই পৃথিবী বড় অদ্ভুত। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে এমন কতো কিছু না ঘটে৷ হয়তো আমার সাথে প্রেম সম্পর্ক হবার পর নিতু বুঝতে পেরেছে যে সে আসলেই ওই লেখককে ভালোবাসে৷ তীব্র রকম ভালোবাসে। এ জন্যেই তার এমন পরিবর্তন। তাহলে? তাহলে আমি এতোকাল একটা খোলসকে ভালোবাসলাম? একটা দেহকে? যে স্পষ্টই আমার সাথে চলতো, হাসতো, কাঁদতো! সে সব? মিথ্যা? মেকি? কে জানে। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগছে আমার। কেমন যেন একটা আনন্দ হচ্ছে! কেমন আনন্দ এটা? সেকি? চোখে জল কেন? গালটা ভিজে গেল! এটা কি আনন্দের? নাকি বেদনার? নিতু বিয়োগের? আমি কাঁদছি কেন? আশ্চর্য, পুরুষ মানুষদের কাঁদতে হয় না৷ আনন্দের সময়ও না৷ বেদনার সময়ও না৷
Bangla Golpo: সে জন চায় যারে৷
ভুলত্রুটি মার্জনীয়