Bangla Golpo: একটা মা কে দত্তক নেবেন? গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
Bangla Golpo: একটা
মা কে দত্তক নেবেন? গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
সাদ আহম্মেদ
বৃদ্ধা আমার দিকে তাকায় থাকে। কিছু
বলেনা, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকায় থাকে।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আম্মাজী কোথাও পৌছায় দিবো?
উনি মাটির নীচে তাকিয়ে শুধু মাথা
নেড়ে আধো আধো করে শুধু বললো, নাহ। এখানেই
থাকমু।সকাল থেকে কিছু খাই নাইতো তাই দুব্বল হয়া পইড়া গেসিলাম।
উনার মুখের ভাষা শুনে চট করে আমার
নানীর কথা মনে পড়লো। বৃদ্ধার হাতে যে সাদা রঙের পাথরের বালা ছিলো, আমার নানীও এমন একটা বালা পড়ে থাকতো। ঠিক এমন করেই নরম নরম করে কথা
বলতো। আমি উনাকে একটু জোর করে একটা খাবার দোকানে নিয়ে গেলাম।জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কি করেন আম্মাজী?
উনি যা বললেন শুনে আমি হতভম্ব হয়ে
গেলাম। নিজের ভাষায় বলি।
Bangla Golpo: এডভান্স প্যারা
বৃদ্ধার নাম সফুরা বেগম। গ্রাম
নোয়াখালীর মাইজদী থানায়। ১৯৬৫ সালের হিমধরানো এক মাঘে উনার বিয়ে হয়েছিলো। উনার
বাবা ছিলেন বেশ অবস্থাপন্ন। জামাইকে বিয়ের পর অনেক কিছু দিয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে।
বিয়ের দুই বছর পর উনার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়। দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই উনার স্বামী
একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কায় মারা যায়। সফুরা বেগমের জীবন এরপর দুর্বিষহ হয়ে উঠে।
তার মেয়েকে গ্রামের সবাই অপয়া বলে ডাকতে থাকে। এমনকি তার শ্বশুর শ্বাশুড়িও ক্ষণে
ক্ষণে তাকে আজে বাজে কথা বলতো। মেয়ে যখন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে বলতো, মা আমারে সবাই ঘৃণা করে কেন?
সফুরা বেগম তার মেয়েকে বলতো, আল্লাহ সবাইরে তো চোখ দেয়নাই মা আলো দেখার জন্য। তুমি হইলা পুরা
জগতের আলো। সবাই তোমারে দেখতে পাইবোনা।
একদিন তার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে
বিছানায় পড়ে গেলে মেয়েটা তার দাদাকে দেখতে যায়। সফুরা বেগমের ননদ তখন মেয়েটাকে
একটা থাপ্পর মেরে বলে আর যেন কখনোও অসুস্থ কারো কাছে এই অলুক্ষুণে মেয়েকে না আনে।
ও একটা অপয়া, যার কাছে যাবে তাকেই খেয়ে ফেলবে।
সফুরা বেগম সেদিনই তার সাত বছরের
মেয়ে নয়নকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। বছর খানেক আগে তার বাবা মারা যাওয়ায়
সেখানে আর যাওয়ার মত অবস্থা ছিলোনা। চলে আসেন ঢাকা শহরে। আরামবাগের বস্তিতে
থেকেছেন অনেক বছর। মানুষের বাসায় যেয়ে যেয়ে কাজ করতেন আর মেয়েটাকে পড়াতেন। মেয়েটা
মাঝে মাঝে তার ক্লান্ত দেহে রাতে আদর করে দিতো আর কাঁদতো। বলতো, মা আমার জন্য এতো কষ্ট করো কেন?
মা বলতেন, মা তোমার আলোটা যেন সবাই দেখতে পায় তাই করি।
মা মেয়ের সংগ্রামের সার্থকতা মিললো
একসময় যখন মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলো। এরপর
মেয়ে আর মাকে কোথাও কাজ করতে দেয়নি। প্রায় দিন মাকে মধুর ক্যান্টিন থেকে সিংগারা কিনে
এনে খাওয়াতো আর বলতো মা যেদিন পাশ করবো সেদিন আমি সবাইরে যায়া বলবো এই পৃথিবীতে
যদি একটা মানুষ সব কিছুতে আলো খুজে পায় সেইটা হলো আমার মা।
১৯৯৩ সালের এক কাঠফাটা রোদ্দুরের
দিনে মেয়ে মাকে নিয়ে যাচ্ছিলো তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজকে তার হাতে সার্টিফিকেট তুলে
দেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সফুরা বেগম মেয়ের হাত ছাড়েন না। কারণ মেয়েটা আজ খুব
চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মেয়েকে উনি বকা দিয়ে বলে রাস্তায় এতো লাফাইস না। মেয়ে হেসে বলে, মা আজকে তোমার মেয়ের আলো সবাই দেখবো। তুমি হইবা গ্র্যাজুয়েট মাইয়ার
মা।
দুপুর ১টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার এক
ঘন্টা আগে যখন মেয়েটার রক্তাক্ত নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে ছিলো সফুরা বেগম একটুও
কাঁদেননি। উনি শুধু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছিলেন, মা যাবিনা? তোর নাম ডাকবো আরেকটু পর।
Bangla Golpo: অকৃত্রিম ভালোবাসা
যেই গাড়িটা তার আদরের মেয়েটাকে চাপা
দিয়েছিলো তার ড্রাইভারকে তখন সবাই ধরে মারছিলো। রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো
গন্ডগোলের জন্য। মানুষজনের চিৎকার, হইহল্লা সবকিছু তখন সফুরা বেগমের সামনে স্থির হয়ে ছিলো। উনার পাশে
ছিলো উনার মেয়ের আদরের শরীরটা। ২৫ বছর ধরে এই শরীরটাকে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে
দেখেছেন তিনি। মেয়ের বুকে শুয়ে উনি খুব পরিচিত ঘ্রাণটা নেয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আফসোস সেটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো।
"
আমি সব শুনে উনাকে বললাম, আম্মাজী কি প্রায়ই এখানে আসেন?
উনি মাথা নেড়ে বলে, না আমি কোথাও যাওয়ার তেমন শক্তি পাইনা। যেখানে ভিক্ষা করি সেইখানে
এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়া পুলারে আমার গল্প কইছিলাম। ও আমারে খুব জোরাজুরি করছে আজকে
যেন ইহানে আসি।
একটু পর দেখলাম একটা ছেলে হন্তদন্ত
হয়ে বৃদ্ধার কাছে এসে বললো, আপনি এখানে আর আমি আপনাকে সেই কোথায়
কোথায় খুজতাছি। আসেন। আমার সাথে আসেন।
সফুরা বেগমকে এরপর ধরে ধরে বেশ কিছু
ছাত্রছাত্রী মঞ্চে নিয়ে যায়। এক মেয়ে তার কালো গাউন আর টুপি খুলে মা সফুরা বেগমকে
পড়িয়ে দেয়। হাত সার্টিফিকেট তুলে দেয়ার পর সফুরা বেগমকে সবাই অনুরোধ করে কিছু বলার
জন্য। উনার কাছে মাইক নিয়ে আসার পর উনি ভেজা চোখে বলেন, আমি মাঝে মইধ্যে ইহানে আসি। ছাত্রছাত্রী দেখি। কেউ কেউ আমাকে
ভিক্ষা দিয়া যায়। কেউ খাওন। আমি তাকায় থাকি ওগো দিকে। মনে হয় আলো দেকতাছি। অনেক
আলো। আমার আলো দেকলে ভালা লাগে। মনে হয় মাইয়াটা বাইচ্যা আছে।
সফুরা বেগম আর কিছু বললেন না। মাইক
ছেড়ে দিতেই কয়েকটা ছেলে মেয়ে উনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেলো। একটা মেয়ে কাছে এসে কাঁদতে
কাঁদতে বললো, আমরা এখানে সব মিলিয়ে সাতজন আছি।
আমাদের কারো মা নেই। আমরা অনেকদিন থেকে একজন মা খুজছিলাম যাকে আমরা সেবা করবো যত্ন
করবো, রাতের বেলা ঘুম পাড়িয়ে দেবো। আপনি
আমাদেরকে আপনার দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ দেবেন কি?
সফুরা বেগম আবার তার অনুভুতিহীন
চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করি। চোখের ডাক্তারের কাছে
অনেকদিন যাওয়া হয়না। চোখটা মাঝে মাঝে এমন জ্বালা করে!
~~~~~~ঘটনা কাল্পনিক, মানুষগুলো আর
তাদের কষ্টগুলো নয়~~~~~
সাদ আহাম্মেদের সকল গল্প পড়ুন-
দারুন কল্পনাশক্তি আাপনার। শুভকামনা🥰🥰