Bangla Golpo: আর্ট অফ টলারেন্স ৬

 

Bangla Golpo-Bangla New Golpo-Bangla Choto Golpo-Bangla Love Story-Bangla Valobasar Golpo-বাংলা গল্প


Bangla Golpo:  আর্ট অফ টলারেন্স


সাদ আহম্মেদ


মার্সের আবহাওয়া এতোটা নিষ্ঠুর কিভাবে হলো আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। আমার আজকের হন্টন সঙ্গী বাবু ভাই ঠকঠক করে কাপতে কাপতে বললো, অর্ক ভাই একটা সিগারেট খাবেন? আমি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালাম। আমার মাথায় এবং হৃদয়ে তখন শুধু গ্রেট আমেরিকান বিয়ার Pale Aleকাল রাতে তাহমিদ বেশ কয়েকটা কোথা থেকে যেন জোগাড় করে ফেলেছিলো। প্রথমবার এর স্বাদটা একটু কটু লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু আস্তে আস্তে এটা আপনাকে গিলে ফেলবে। তবে আপনাকে বেশ কিছু ingredientযোগ করতে হবে বরফ কুচি, ছোট ছোট করে কাটা চেরি ফল একটি এবং আশ্চর্য হলেও সত্য কিছু ভিনেগার। কাল রাতে Pale Ale খাওয়ার পর থেকে নিজেকে কেন যেন ১৭০০ দশকের ইংলিশ রাজপুত্র মনে হচ্ছিলো। মূল ঘটনায় ফিরে আসি।চ্যাম্প দ্য মার্সে আজকে আসার অন্যতম কারণ “The Art of Tolerance”. United Buddy Bears নামে একটি আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী এইবছর মার্সে আয়োজিত হচ্ছে।এই বছরের প্রদর্শনীটা মূলত ফ্রান্স এবং জার্মানীর ভ্রাতৃত্ববোধের একটা গালা। জাতিসংঘের সদস্য এমন প্রায় ১৪০টি দেশ থেকে বিখ্যাত সব চিত্রকাররা এখানে উপস্থিত হয়েছেন নিজের দেশকে সবার সামনে তুলে ধরতে।আনন্দের ব্যাপার এবছর আমাদের দেশ থেকে যে মানুষটিকে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে সে আমি নই, সেটা আমার বন্ধু ও বড়ভাই ইব্রাহীম মীর্জা।মীর্জা ভাইকে আমি সবসময় তার কাউয়ার ছবি আকা নিয়ে খেপাই।তিনি সময় সুযোগ পেলেই আমাদের অতি পরিচিত এই কৃষ্ণ পাখির ছবি একে ভাষা ভাষা চোখে তাকিয়ে বলেন, “দেখতো এই ছবিটা কেমন হইছে?” আমি প্রায়দিন একটাই উত্তর দেই, “এইটা দেখতে একেবারে আপনার মত হয়েছেএবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক আফসার উদ্দিন সাহেব যখন উনাকে ডেকে পাঠালেন ভালুক চিত্র প্রদর্শনীতে তাকে অংশগ্রহণ করার জন্য উনি কাচুমাচু মুখ করে বললেন, “স্যার আমি তো শুধু কাকের ছবি আকতে পারি।ভালো ভালো ছবি আকা বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছিআফসার সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “মীর্জা তোমার প্রতিভা আছে, নিজের জন্য সেটা নাহয় উন্মুক্ত না করলে।দেশের জন্য করো।এবার প্রথম জাতিসংঘ আমাদের দেশ থেকে চিত্রশিল্পী নেবে।আমি সারারাত চিন্তা করেছি কাকে নেয়া যায়। তোমার ২০০২ সনে আকা Agitation 1971 ছবিটা ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু আসেনাই।তুমি অবশ্যই এবছর প্যারিসে যাবে এবং আমাদের দেশের নাম উজ্জ্বল করবেমীর্জা ভাই মাথা চুলকিয়ে বললেন, আচ্ছা, দোয়া রাখিবেন। মীর্জা ভাইয়ের সাথে সর্বমোট ৫ জনের একটি দল ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো।এরমধ্যে তিনজন গুরুতর পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়ে ফ্রান্স ও তার ঐতিহাসিক আধা কাচা খাবারের ২৮ গুষ্টি উদ্ধার কাজে নিয়োজিত।আমি আর বাবু ভাই নিরাপদ আছি, আমাদের দিনে তিনবারের বেশি বাথরুম যেতে হয়না।মীর্জা ভাই কিছু খান না তেমন।পাঠককে আমার সাথে মীর্জা ভাইয়ের পরিচিয়ের শুরুটা বলা দরকার। আমি মীর্জা ভাইকে চিনি মিরপুর সাড়ে এগারো পল্লবীর লালদীঘির মাঠে।ওই মাঠে আমি নিয়মিত ক্রিকেট খেলার আম্পায়ার হিসেবে কর্মরত।প্রায় ২৫ বছর পার করলাম আজও কেউ আমাকে খেলাধূলায় নেয়না। লোকে বলে আমার মধ্যে নাকি একটা বিলি বাউডেন ভাব আছে।যাই হোক হেমন্তের এক ধানপাকা শুক্রবারে আমি বিকেলে মাঠে হাটাহাটি করছিলাম, ঠিক তখন দেখি একজন লোক গভীর মনোযোগ দিয়ে মাঠের উপর আয়েশ করে শুয়ে আছে আর ঘাস চিবাতে চিবাতে কাউয়ার ছবি আকছে।আমি মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, “ভাই কাকের ডানাটা আরো ২ মিমি বড় হবে পেছন দিকে, আপনি ওয়াইড শটে যান একটুমীর্জা ভাই মাথা ঝাকিয়ে বললেন, “ঠিক বলছেন।কিন্তু আমি এইভাবেই আকবো।আপনার কথা শুনে আকলে তো আপনার ছবি হবে, আমার ছবি হবেনা। আর হ্যা ২ মিমি কেন ০.১ মিমি ডানাটা যদি ওয়াইড করি তাহলে ছবির এঙ্গেলটা নষ্ট হয়ে যাবে।আমার পাশে বসেন, ভালোভাবে বুঝে যাবেনআমি সেই ভদ্রলোকের পাশে বসলাম এবং নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।তার সাথে আরো কথাবার্তায় আমি অসাধারণ কিছু মিল খুজে পেলাম তার সাথে আমার। মীর্জা ভাই আমার মতই একজন প্রাক্তন চারুকলার ছাত্র।উনি ১৯৯৬ সনে বের হয়েছেন আর আমি ২০০৮ সনে।উনার সময়ে চারুকলার একজন অন্যতম শিক্ষক ছিলেন শিল্পী আবেদীন ফারুক। উনি মীর্জা ভাইয়ের মাথায় একদিন হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন, “বাবাজী তুমি শিল্পী না,তুমি শিল্পআরেকটা মিল ছিলো আমাদের মধ্যে। তা হলো আমরা দুইজনই এতিম। মীর্জা ভাই আমাকে কেন তার সাথে নিয়ে এসেছিলেন তা আমি জানিনা।কিন্তু অজ্ঞাত কারণে উনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।আমাকে যখন উনি প্রথম ফ্রান্সে যাওয়ার কথা বললেন, আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে চারটা ঢোক পরপর গিলেছিলাম।তারপর দাত বের করে বলেছিলাম, “ভাই অবশ্যই যাবো।মার্সের সবুজভূমিতে পপ কর্ণ চিবাবো আর সুযোগ মত আইফেল টাওয়ারের লে জুলস ভার্ণে একটা সাদা মাইয়ার হাত ধরে প্রপোজ করে বসবোমীর্জা ভাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তোকে একজন চিত্রশিল্পী বলতে আমার খুব দ্বিধা হয়আমাদের সাথে আরো যোগ দেন দ্বিতীয় আলো পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক বাবু ভাই, রেডিও তোমার-আমার এর তাহমিদ, চ্যানেল ১০ এর ক্যামেরাম্যান আতাহার বাচ্চু এবং একই চ্যানেলের সাংবাদিক আলী জাফর।আলী জাফর ভাইকে আমরা প্রায়ই মীর জাফর বলে খেপাই।উনি বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “সব তেলাপোকার দলআজকে রাতে বাবু ভাইকে নিয়ে বের হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য দূর থেকে আইফেল টাওয়ারটা একবার দেখবো।১৮৮৯ সালের মার্চে এই বিখ্যাত টাওয়ার প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পর তা ভেঙ্গে ফেলার কথা থাকলেও কেন যেন তা আজও অক্ষত আছে।প্রতিবছর কত লক্ষ লক্ষ মানুষ এই টাওয়ারে উঠে তাদের প্রেয়সীকে ভালোবাসা জানায়। আমরা যখন টাওয়ারের সামনে পৌছালাম তখন শীতের দাপটে আমাদের প্রায় বরফপ্রায় অবস্থা।কিন্তু টাওয়ারের শৈল্পিকতা আমাদের নড়তে দিচ্ছিলোনা।বাবু ভাই হা করে তাকিয়ে দেখছিলো, আমি মুখ বন্ধ করে।একসময় বাবু ভাই কাপতে কাপতে বললেন, “আপনার ভাবীকে নিয়ে অনেকবার এখানে আসতে চাইছিলাম। কিন্তু সামর্থ্য হইলোনাআমি বাবু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ছবি তুলে নিয়ে যান। ভাবীকে দেখাবেনবাবু ভাই হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার ভাবীর চোখ একটু সমস্যা আছে। ও চোখে প্রায় দেখেনা।ঘরে যখন হাটে তখনও আমার হাত ধরে হাটতে হয়। কিন্তু আমি ওকে অনেক আইফেল টাওয়ারের গল্প বলি ।তখন ও আমার হাত ধরে মনোযোগ দিয়ে শুনে।গল্প শেষে বলে, আমি দেখতে পাইনা তো কি হয়েছে তুমি আমাকে একবার নিয়ে যায়ো।আমি একটু অনুভব করে দেখবো কেমন লাগে।আমি তো এবার আসতেই চাচ্ছিলাম না।সে জোর করে আমাকে পাঠাইলো।যাওয়ার আগে বলছে যেন আমি সব ঘুরে ঘুরে দুচোখ ভরে দেখিতাহলেই ওর দেখা হয়ে যাবে আমি চুপ করে শুনছিলাম। বাবু ভাইয়ের চোখ ভরা পানি আর মুখে হাসি।আমি

জানি এই হাসি ভাবীর জন্য।হঠাৎ করে তখন আমার খুব কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করছিলো।তার হাত ধরে সারাটা আইফেল টাওয়ার ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করছিলো। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন আমাদের গরীব দেশের অতি সাধারণ এই বাবু ভাইরা জীবনে একটিবারের জন্য হলেও যেন তাদের ভালোবাসার মানুষকে পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিগুলো দেখাতে

নিয়ে যেতে পারে, হাত ধরে প্রেয়সীকে বলতে পারেন তুমি এর থেকেও সুন্দর।

এবার ঘুরে আসা যাক ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১১ তারিখের এক

মনোরম সন্ধ্যায়। পিয়েরে ম্যাটিগনন নামে এক বিখ্যাত দ্বিচক্রযান চালকের জন্ম হওয়ার ঘন্টাখানেক পর ক্যাথি ক্যাটিনান নামে এক ১৯ বছর

বয়সী আত্নহত্যা করে। ক্যাথি ক্যাটিনানের বাবা ডুমাত্রে ছিলেন সেসময় প্যারিসের অন্যতম ধনী একজন ব্যক্তি। মন্টমার্টের কাছে পিগালেতে তার সাদা পাথর দিয়ে বানানো প্রাসাদোত্তম বাড়িটি আজও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তার একটাই শখ ছিলো, নিজের ছবি আকানো। সেসময়ের সব গুণী চিত্রকরদের দিয়ে উনি নিজের এবং নিজের পরিবারের ছবি আকাতেন। ক্যাথি

এমনি এক চিত্রকরের প্রেমে পড়েছিলো ক্লদে বনিন পিসারো। পিসারোর সাথে ক্যাথির যখন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেসময়টা ছিলো বসন্তকাল। মার্সেইলের বিখ্যাত যুদ্ধটা ঠিক সেসময় শুরু হয়েছিলো।পিসারো সেই ভয়ংকর রক্তযজ্ঞের মধ্যে প্রায় দিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতো ক্যাথির সাথে, তার ছবি আকতো। মাঝে মাঝে মন্টমার্টের পাহাড়ে, কখনোবা মউলিন রোজে মঞ্চনাটক দেখতো তারা। এমনি এক লোভ জাগানো বসন্তে ক্যাথি পিসারোর হাত ধরে ছিলো সবুজ পাহাড়ের এক ছোট্ট কোণে।একসময় তার ঘাড়ে মুখ গুজে রাখা ক্যাথি বললো,

তুমি আমার ছবি আকতে ভালোবাসো কেন?”

পিসারো তার দিকে তাকিয়ে  বললো,

তুমি জানোনা তুমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চিত্র? আমি কখনো আঁকতে

ভালোবাসতাম না জানো, কিন্তু এখন ভালোবাসি। আমি যখন তোমাকে আঁকি তখন চোখ বন্ধ করে থাকি, তখনই শুধু তোমাকে আরো ভালো দেখতে পাই

ক্যাথি চুপ করে শুনছিলো ভালোবাসার কথা, তার অনেক ভালো লাগতো এই কথাগুলো পিসারোর মুখ থেকে শুনতে। একসময় সে বললো,

আমার ভেতরে একটা নতুন অস্তিত্ব তৈরী হয়েছে জানো। আমি জানি ও তোমার মত চিত্রকর হবে, ঠিক তোমার মত করে আকবে। পিসারো আমাকে বিয়ে করো

পিসারো হাসিমুখে বললো,

হ্যা করবো। কিন্তু তার আগে তোমার একটা ছবি আকবো।ঠিক এই পাহাড়ের ওপর। একটু অপেক্ষা করো, আমি কিছু আঁকার কাগজ নিয়ে আসি। আজ আমি এতোটাই খুশি যে তোমার সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা নিমেষে একে ফেলবো। আমার সব ভালোবাসা দিয়ে আঁকবো

পিসারো সেদিন সত্যিই সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা একেছিলো ক্যাথির জন্য। কিন্তু

এরপর ক্যাথি আর পিসারোর সাথে দেখা করেনি অনেকদিন। প্রায় দু মাস ১৭ দিন পর একদিন পিসারোর সাথে সবুজ পাহাড়ে আবার দেখা করলো ক্যাথি। তাকে বললো,

আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা হয়না পিসারো। বাবা আমার জন্য একজন বর ঠিক করেছেন দ্য স্টেইল। জানো ও তোমার মতই আমার ছবি আঁকে। আর যখন আমাকে আঁকে তখন ওর নীল চোখগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়। আমি ওর চোখগুলো খুব ভালোবাসি, ওকেও হয়তো ভালোবাসি।

পিসারো ক্যাথিকে শুধু বলেছিলো,

আমার নীল চোখ নেই।কিন্তু এই অর্ধ বাদামী চোখ দিয়ে আমি সারাজীবন

তোমাকে ভালোবাসবো

এর কিছুদিন পর ক্যাথি আত্নহত্যা করে। কেন করেছিলো কেউ জানেনা।কেউ

না। গল্পটা আমি পড়ছিলাম প্যারিসের সেইন নদীর পাশে অবস্থিত আর্ট মিউজিয়াম মুসি দ্য অর্সেতে। মিউজিয়ামটি প্যারিস শহরের অন্যতম আলোচিত সেই ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্নহত্যার সময়টাকে জাগ্রত রাখতেই হয়তো পিসারোর আকা ক্যাথির ছবিগুলো একটা ছোট্ট কোণে সাজিয়ে

রেখেছিলো। আমি মিউজিয়ামে কাজ করা অল্পবয়সী একটা ছেলেকে কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, “এই মিউজিয়ামে ১৯১৫ সালের পরবর্তী

কোন ছবি নেই। ক্যাথির জন্য তাহলে এভাবে আলাদা একটা জায়গা বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে কেন বলতে পারেন?”

ছেলেটা একটু ভেবে বললো,

ক্যাথি বাবা এই মিউজিয়ামের জন্য অনেক অর্থ দান করেছিলেন। উনি চাননি উনার মেয়েকে কেউ ভুলে যাক

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,

 কিন্তু ছবির পাশে যে ছোট্ট গল্পটি লিখা সেটা তো উনার মেয়ের জন্য ভালো কিছু নয়...

আমি কথা শেষ করার আগেই ছেলেটি বললো, “এই গল্পটা আমাদেরকে কিছুদিন আগে মনসিওর পিসারো জানিয়েছিলেন।উনি কিছুদিন আগে এই শহরে এসে আমাদের মিউজিয়ামটি পরিদর্শন করেছিলেন।পাহাড়ে আকা ক্যাথির ছবিটা দেখে উনি আমাদের গল্পটি জানান।সাথে এও বলেছেন, ক্যাথি শুধু তাকেই ভালোবেসেছিলেন।আর কাউকে নয়। আর মজার ব্যাপার উনি এখন দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকরদের একজন আমি আবার ক্যাথির ছবির দিকে তাকালাম।তার সব কয়টা ছবি আরেকবার মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। কি অপূর্ব একজন নারী ছিলো।মীর্জা ভাই একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন, “অর্ক এই ভদ্রমহিলা অনেক আগে মারা গেছেন। এর সাথে তোমার কিছু হবেনা।এমন প্রেমিক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে লাভ নেই

আমি মীর্জা ভাইয়ের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না।ক্যাথির নিষ্পাপ মুখটা থেকে আমার চোখ সরতে চাইছিলোনা। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো কিছু একটা ভুল হয়েছে। কি যেন একটা নেই এই ছবিতে।আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমি সেই তরুণ ছেলেটিকে আবার ডেকে বললাম,

আচ্ছা ক্যাথির সত্যিকারের কোন ছবি নেই সেই সময়ের?”

ছেলেটি হেসে বললো,

আছে।তবে এখানে না।আপনার কি তাকে খুব ভালো লেগেছে?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,

আমি কি তার একটা ছবি দেখতে পারি?”

আমি ক্যাথির ছবিটা দেখি এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমি ওর

প্রেমে পড়ে গেছি।যে ছবিগুলো পিসারো একেছিলো একটাও ওর না। একটা ছবিতেও ক্যাথির চোখগুলো সে আঁকতে পারেনি।ওর নীল চোখের গভীরতা ফুটিয়ে তুলে এমন ক্ষমতা পিসারোর ছিলোনা।আমি বিশ্বাস করিনা।তন্ময় হয়ে যখন ওর ছবিগুলো দেখছিলাম ঠিক তখন চিত্রলেখা আমার পাশে এসে দাড়ালো। আমি একবার চিত্রলেখার দিকে একবার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি বুঝলাম কেন ক্যাথির ছবিগুলো আমার এত ভালো লেগেছিলো। ক্যাথির চোখগুলো ঠিক চিত্রলেখার মত, সেই চিত্রলেখা যাকে আমি একসময় খুব চেয়েছিলাম।এই দূরদেশে এসে যাকে না দেখার জন্য প্রতিদিন

প্রার্থনা করেছি। সৃষ্টিকর্তা এতো নিষ্ঠুর কেন আমি জানিনা। চিত্রলেখার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। বিয়েটা ঠিক করেছিলো আমার দূরসম্পর্কের খালা। উনি মা বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে দেখাশোনা করতেন, এমনি এমনি অবশ্য করতেন না। আমার বাবা অত্যন্ত ধনী একজন মানুষ ছিলেন। উনার প্রচুর সম্পত্তির একটা নির্দিষ্ট অংশ উনাকে বুঝিয়ে দিতে হয়েছিলো। চিত্রলেখা ছিলো আমার খালার বান্ধবীর মেয়ে।প্রায় বছর তিনেক আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো।প্রায় বছর তিনেক ধরে আমি তাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো ভাবিনি। যেদিন তার সাথে আমার বিয়ের কথা  তুলেছিলো খালা আমি সেদিন হ্যা বলেছিলাম শুধু ওর নামটা শুনে। জাদুকরী নাম, মনে হয় যেন এই নামের মানুষটাকে দেখলেই একে ফেলতে ইচ্ছা করবে।আমি যেদিন তাকে প্রথম দেখতে যাই সেদিন তাকে বলেছিলাম, “আচ্ছা যদি আপনাকে প্রতিদিন নিজের মত করে আঁকতে চাই, দেবেন?”

চিত্রলেখা খুব অসহায় দৃষ্টিতে  তাকিয়ে বলেছিলো, “জানিনা

তার সাথে আমার এরপর প্রায়  মাসখানেক ফোনে কথা হয়েছিলো। আমি নিয়মিত তাকে ফোন দিয়ে  বলতাম, “খুব বিরক্ত করছি তাই না?” 

সে ক্লান্ত ঘুমন্ত কন্ঠে বলতো, “আচ্ছা বলুন

তারসাথে আমার বেশ কয়েকবার  দেখাও হয়েছিলো বিয়ের তারিখের  আগে। একদিন আমার জন্য সে যখন  অপেক্ষা করছিলো নীল ময়ূরকন্ঠী শাড়িটা পড়ে, আমি তার হাত ধরেছিলাম সাহস করে।ও অবশ্যই হাতটা সরিয়ে নিয়েছিলো। আমাকে বললো,

একটা কথা বলি

আমি হেসে বললাম, “বিয়ে করতে চান  না?”

চিত্রলেখা আমাকে বললো, “না। আমি  একজনকে খুব ভালোবাসি।সেই ছেলেটাও আমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু ও এই দেশে থাকেনা, ফ্রান্সে

পরিবার নিয়ে থাকে।ও আমাকে বিয়ে করতে চায়।আমিও ওকে বিয়ে

করতে চাই ।ও কাল দেশে আসবে আমাকে নিয়ে যেতে।আমাদের কালই

প্রথম দেখা হবে

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আজকে ওকে প্রথম ভালোবাসি কথাটা বলবো ভাবছিলাম। নিঃশব্দের বেশ কিছু মুহূর্ত পার করলাম।একসময় ওই বললো,

কিছু বলবেন না?আমি এখান থেকে আর  বাসায় যাবোনা।একটা বান্ধবীর

বাসায় যাবো।ওখান থেকেই ওর সাথে  দেখা করবো।মাসখানেকের মধ্যে

আমি হয়তো ওর সাথে চলে যাবো। এই দেখেন আমার সাথে একটা ট্রাভেল

ব্যাগও আছে

আমি ওর হলুদ রঙের ট্রাভেল ব্যাগটা দেখলাম।তারপর ওকে বললাম, “আচ্ছা

চিত্রলেখা চলে গিয়েছিলো।যাবার আগে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

এত্তগুলো মিথ্যা কথা কেমন করে বললেন?”

ও কোন উত্তর দেয়নি।হুট করে উঠে চলে  গেলো। অনেক অনেকদিন

ভেবেছিলাম কেন ও এভাবে মিথ্যা কথাগুলো বলেছিলো? একসময় বুঝতে

পারলাম কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়না। উত্তরের জন্য আশা করারও প্রয়োজন নেই। অনেকদিন পর আজ চিত্রলেখাকে দেখে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম।

আমাদের মধ্যে কখনো এমন কোন সম্পর্ক হয়নি যে তাকে দেখে আমার লজ্জা পাওয়া টাইপ ব্যাপার হওয়া উচিত। কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে

পারছিলাম না। আমি নিজেই তার পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “তুমি

একা?”  চিত্রলেখা আমার দিকে তাকিয়ে মনে হয় চেনার চেষ্টা করছিলো,

তারপর চিনতে পেরে বেশ অসাধারণ একটা হাসি দিয়ে বললো, “আপনি

এখানে।আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই নিয়ে খুব ভালো আছি।আমার

পিছনে ঘুরে তো লাভ নাই

আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।এমন কিছু একটা শুনে কি বলা

উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমি খুক খুক করে কাশতে কাশতে বললাম,

আচ্ছা কালকেই দেশে ফিরে যাবো চিত্রলেখা এবার স্বাভাবিকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “কিছু মনে করবেন না।আমি মজা করেছি।

কেমন আছেন? এখানে কি মনে করে?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “Art of Tolerance”.

চিত্রলেখা আমার দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে বললো, “তাই? আঁপনি

আকতে পারতেন জানি, কিন্তু এত  ভালো জানতাম না তো আমি চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি আরেকজনের সাথে এসেছি।উনার একটা ছবি দু দিন পর প্রদর্শনীতে দেখানো হবে।এসব বাদ  দিন।আপনি কেমন আছেন?আপনার সাথেআগে যখন দেখা হতো আপনি কিন্তু  এতোটা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কথা বলতে পারতেন না

চিত্রলেখা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এই শহরটা আমাকে বদলে দিয়েছে।অনেক বদলে দিয়েছে।আমি ভালো আছি অর্ক।আপনার সাথে যে

আবার দেখা হবে আমি জানতাম।কিন্তু  এখানে এই শহরে এমন করে তা

ভাবিনি

চিত্রলেখার সাথে সেদিন আরো  আরো অনেকটা সময় জুড়ে রংধনুর শহর

প্যারিস আর জীবন নিয়ে কথা হলো। চিত্রলেখা নিজের কথা তেমন কিছুই

বলেনা।শুধু আমার কথাই জানতে চাইলো।তার কথা জিজ্ঞেস করলে শুধু

এটুকুই বলে, “বেশ ভালো আছি।বেশ ভালো অর্ক

রাতে হোটেলে ফিরে এসে অনেকদিন পর আমার প্রিয় বেরল তুর্কিজ

পেন্সিলটা হাতে নিলাম।আজ  আমাকে আকতে হবে, আকতে হবে ক্যাথির সেই সুন্দর চোখগুলো যা আগে কেউ কখনো এত্ত যত্ন নিয়ে আকেনি।ইশ ক্যাথিকে যদি তার ছবি একে  দেখাতে পারতাম।কেন যেন মনে হচ্ছিলো সে কখনো এমন করে তার ভালোবাসাকে ছেড়ে যায়নি।কখনো এমন হতে পারেনা।

প্যারিসে রাত ৩টা মানে ভয়ানক ব্যাপার। আমি স্কেচ আকা শেষ হলে

লাল চোখ নিয়ে বারান্দায় চাঁদ দেখতে গেলাম।আমাদের দেশের মত

প্যারিসেও খুব সুন্দর চাঁদ দেখা যায়।  শুনেছি প্যারিস থেকে সবচেয়ে

কাছের সমুদ্র সৈকত নরম্যান্ডিতে নাকি গভীর রাতে পরী নেমে আসে।

সেই পরীদের গায়ের রঙ নীলচে হয়।  আমার খুব সেই সব পরীদের দেখতে ইচ্ছা করছিলো, তাদের গান শুনতে ইচ্ছা  করছিলো।রুপালী চাঁদে ডুব দেয়া

অস্তিত্বহীন আমি, পাশে সিন্ধুর উত্থাল কলোরব এক জীবনে আর কিছু

কি চাওয়ার ছিলো?

যখন এসব ভাবছিলাম তখন হঠাৎ করে কেউ একজন আমার পাশে এসে দাড়ালো যেন।আমি যখন পেছনে ফেরলাম তখন সেখানে সেই গাঢ় নীল চোখগুলো দেখতে পেলাম।ক্যা থির ভালোবাসার ডাক দেয়া নিষ্পাপ নীল চোখগুলো।আমি হয়তো খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম।ক্যাথি খুব কাছে  এসে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাকে সারারত ধরে আঁকতে অনেক কষ্ট

হয়েছে?”

আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “আমার বোধহয় বিভ্রম হচ্ছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার  কথা না।আমি আপনাকে ঠিক এই মুহূর্তে  দেখতে পাচ্ছি কেন?”

ক্যাথি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

তুমি দেখতে চাচ্ছিলে তাই।আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

আমি ভালো স্কেচ আকতে পারিনা মেয়ে, আমাকে ক্ষমা করো।তুমি এতোটা সুন্দর  যে তোমাকে আঁকার মত ক্ষমতা আমার মত সাধারণ আঁকিয়ের এখনো হয়নি

ক্যাথি নীল পরীদের মত গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একসময় বললো, “আমাকে  কেউ এভাবে ভালোবেসে কিছু একে দেয়নি। কেউ হয়তো আমাকে ভালোও বাসেনি।আমি জানতাম তোমরা  শিল্পীরা শুধু সৌন্দর্যকে ভালোবাসো। মানুষটাকে ভালোবাসো না

আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, “আমি শিল্পী না।আমি ফুল ফল ভালো আকতে

পারি, আর কিছু না

ক্যাথি আমার কাছে দাঁড়িয়ে এসে বললো, “একটা কথা বলবো?মন দিয়ে

শুনবে।আমার খুব কষ্ট লাগে যখন মানুষ  আমাকে প্রতারক বলে, অভিশাপ দেয়।  তুমি একটু মনোযোগ দিয়ে আমার  সত্যিকারের ছবিটা দেখো।খুব

মনোযোগ দিয়ে।ছবিটা ভিয়ের সাথে শেষবার দেখা হওয়ার একটু পর তোলা

আমি কিছু না বলে ক্যাথির দিকেতাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ও

কি বলতে চাচ্ছে। ওর চোখে কি গভীর বেদনা। ছোট্ট জীবনে ওর এমন কি

ব্যাথা ছিলো জানিনা, কিন্তু নীলচে চোখের ছায়া যেন ওর সারা

মুখে।আমি মাথা ঘুরে সেখানে পড়ে যাই।পরদিন সকাল দশটার আগে আমার হুশ আসেনি। নরম্যান্ডিতে আমি চিত্রলেখার সাথে বসে ছিলাম।কাল চিত্র

প্রদর্শনী আর এরপর আমার দেশে ফিরে  যাওয়া।সুন্দর এই দেশটাতে হয়তো আর আসা হবেনা। চিত্রলেখার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।তাই তাকে

সকালে ফোন করেছিলাম।আমি আশা করিনি ও দেখা করবে।প্যারিস থেকে

দুঘন্টা লেগেছে নরম্যান্ডির সমুদ্র সৈকতে আসতে। সেখানেই একটা হোটেলে চিত্রলেখা চাকরী করে। অনেকক্ষণ ধরে আমরা সমুদ্র সৈকতে বসে  আছি। এইসময়টায় ট্যুরিস্টদের আনাগোনা কম থাকে। তারমধ্যে এখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। আমি চিত্রলেখাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি একজনকে খুব ভালোবাসতেন তাই না?”

চিত্রলেখা কথাটার জবাব দিলোনা। মাথার চুল ঠিক করতে করতে বললো,

আপনি কি আমাকে একথাটা জিজ্ঞাসা করতে এখানে আসতে বলেছেন?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “পরশু চলে যাবো।আপনার সাথে আর দেখা  হবে না। আমি কখনো জানতে পারবোনা আপনি আমাকে সেদিন কেন ওই কথাগুলো বলেছিলেন।আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে কেন আপনি

এভাবে একটা দূর দেশে চলে আসলেন?” চিত্রলেখা হাসতে হাসতে বললো,

আপনি কিভাবে বুঝলেন বলেন তো আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছি?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ঠিক ওর মত করে হেসে বললাম, “তোমার ঠোট খুব কাপছিলো সেদিন কথাগুলো বলার  সময়। তুমি পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলে,

আমি বুঝেছিলাম। যদি সত্যি এমন কোন ব্যাপার হতো তুমি আমাকে কখনো এভাবে বলতেনা চিত্রলেখা কিছু না বলে পাশের নীল

সমুদ্রের শব্দ শুনতে লাগলো। আমাকে বললো, “ক্যাথির ছবিগুলো কেমন যেন

জীবন্ত লাগে। অনেকে বলে মিউজিয়ামে ওই ছোট্ট কোণে যেখানে ওর ছবিগুলো রাখা আছে সেখানে মাঝে মাঝে একটা নিঃসঙ্গ মেয়েকে একা একা

দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মেয়েটাকে কেউ কেউ কাঁদতে দেখে খুব। আপনার কি মনে হয় অর্ক, ক্যাথি মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষকে

কখনো ছেড়ে গিয়েছিলো আসলেও?”

আমি মাথা নেড়ে বলে, “নাহ মনে হয় না

চিত্রলেখা বললো, আমার মনে হয় কি জানেন মানুষ ভালোবাসতেই জানে

শুধু। ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে  জানেনা।ভালোবাসাটা হলো ঠিক  আমাদের সামনের সমুদ্রস্রোতের মত। বারবার ফিরে আসে, ধাক্কা দিয়ে

যায় ভেতরটাকে।সমুদ্র কখনো শুকিয়ে যাবেনা, স্রোতটাও কখনো

হারাবেনা। আমার ভালোবাসার মানুষটা যখন আমাকে এই সৈকতে বসে

চিঠি লিখতো, ছোট্ট ছোট্ট কবিতা লিখতো তখন আমি ঠিক এমন করেীই

সমুদ্রের শব্দ শুনতে পেতাম আমার ছোট্ট অগোছালো ঘরটা থেকে।আপনার

খালা হয়তো আপনাকে বলেনি।কিন্তু আমার একটা বিয়ে হয়েছিলো।

আমাদের একটা ছয়মাসের সংসার ছিলো। মাত্র কয়েকটা দিন ও দেশে

ছিলো, বাকি সময়টা পড়াশোনার জন্য ও এই দূর দেশে পড়ে ছিলো।কিন্তু তখন ও আরো অনেক কাছে ছিলো আমার, একদম কাছে

আমি কিছু না বলে চিত্রলেখার  দিকে তাকিয়ে থাকলাম।হঠাৎ করে ও

ভয়ংকরভাবে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

ও প্রতিদিন আমার ছবি আকতো। আমাকে যেভাবে যেই রূপে

ভালোবাসতো ঠিক সেই রূপটা ছবিগুলোতে কেমন করে যেন ছেপে

ছেপে বসিয়ে দিতো।কেউ এমন করে আর আমাকে আঁকতে পারবেনা।

আমাকে গভীর রাতে ফোন করে বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলবেনা, চিত্রা তোমার ছবি আকতে আকতে আকতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।তুমি এই দেশেএসে পড়ো।আমার আর ভালো লাগেনা।

আমি কাউকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি।মাথা নিচু করে ওকে বললাম,

তারপর

চিত্রা একটু কান্না থামিয়ে বললো,

আমার বয়স তখন মাত্র ১৮ ছিলো।আমি ভালোবাসা ব্যাপারটা খুব একটা

বুঝতাম না।কিন্তু আমার দেহের সমস্ত কোষে ও জীবন্ত ছিলো।ও যখন ফোন

করে কাঁদতো আমি তখন চিৎকার করে  বলতাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই জীবনে কাউকে আর এমন করে চাইবোনা।কাউকে না।তবুও তুমি কষ্ট  পেওনা।

ও কথা দিয়েছিলো আমায় এসে নিয়ে  যাবে।বছর শেষ হওয়ার আগেই নিয়ে

যাবে।কেউ আসে নাই অর্ক।ওর মৃত  দেহটাও আসেনি।এই দেশের সরকার

আমাকে শুধু ছোট্ট করে একটা চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলো, আমার  ভালোবাসার মানুষটা ট্রেনে চাপা পড়েছে, মেট্রো ট্রেনে।তার শরীরের অংশগুলো সব খুজে পাওয়া যায়নি

চিত্রলেখা বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে কাদছিলো।আমি ওর মাথায় হাত

দিয়ে বললাম,

চিত্রলেখা শান্ত হোন। আমরা সবাই কাউকে না কাউকে

হারিয়েছি। তবুও আমাদের বাচতে হয়।  শ্বাস নিতে হয়। নাহলে প্রিয়

মানুষগুলোকে কে মনে রাখবে এত যত্ন করে যেভাবে আপনি মনে

রেখেছেন?”

চিত্রলেখা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,

আমার পক্ষে কাউকে গ্রহণ করা সম্ভব  ছিলোনা অর্ক।আপনার কাছে আমি

দুঃখিত।আমার রাজপুত্র সবসময় আমার সাথে থাকে।এই যে যেখানে বসে

আছি ঠিক এইখানটায় বসে ও দিনের পর  দিন আমার কত্ত ছবি একেছে।কিন্তু  আমি ছবিগুলো কাউকে দেখাবোনা।  আমি প্রতিদিন ছবিগুলো নিয়ে  এখানে এসে বসে থাকি।আমি যতদিন বেচে থাকবো ততদিন এখানে এসে বসে থাকবো।আমার অনেক শান্তি লাগে জানেন।আমি জানি ও এখনো

আমার ছবি আকে।আমি অনেক রাত পর্যন্ত বসে বসে ওর ছবি আকা দেখি। রাত ফুরিয়ে যায় অর্ক, কিন্তু ওর মাথায়  আমি হাত বুলিয়ে বলতে পারিনা আমি সারাজীবন শুধুই তার।বলতে না  পারার এই কষ্টটা কি কেউ আকতে পারবে বলেন তো?"

আজকে মীর্জা ভাইয়ের চিত্র প্রদর্শনী। উনি তার ছবিটা একটা সাদা কাপড়ে

মুড়িয়ে রেখেছেন।একটু পর পরিদর্শক  আসলে উনি ছবিটা বের করবেন। তার আগে কাউকে দেখতে দেবেন না। আমরা প্রায় জনাদশেক বাংলাদেশী

এই ব্যাপারটায় খুব আহত বোধ করছি।  মীর্জা ভাই ব্যাপারটাকে পাত্তা

দিচ্ছেনা।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অর্ক পা কাপতাছে ঠান্ডায়।

দুইটা মোজা পায়ে দিছি তবুও ঠান্ডা যাইতেছে না

একটু পর পরিদর্শক এলো, মীর্জা ভাই তার ছবিটা বের করলেন।আমি দেখলাম মীর্জা ভাইয়ের সারা চোখে পানি ছবিটা বের করার সময়। আমাদের

প্রত্যেকটা বাংলাদেশীদের চোখেও টুপ করে পানি এসে পড়লো।মীর্জা ভাই

খুব সাধারণ একটা ছবি একেছেন।যে ছবিতে একটা ছোট্ট কুড়েঘরের

জানালায় একটা মা মাথা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছেন।বাহিরে  বাধ না মেনে চলা বৃষ্টি ভেজা মাঠে কয়েকটা ছোট্ট ছেলেমেয়ে খেলা করছে।সবগুলো ছেলের মুখে হাসি।কি সাধারণ একটা ছবি, কিন্তু  এতো মায়া কেমন করে আসলো পুরো ছবিটাতে আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না।পরিদর্শক ছিলেন

রুস্তাভো দেল।উনি চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন ছবিটা।তারপর মীর্জা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে ইংরেজীতে অনেকটা এমন বললেন, “তুমি যেই দেশটায় থাকো সেই দেশটার মায়েরা কি এমন করেই উদাস হয়ে বৃষ্টি দেখে?”

মীর্জা ভাই মাথা নেড়ে বললেন,

মাননীয় রুস্তাভ আমার দেশের  প্রতিটি মা বৃষ্টিকে এমন করেই আপন

করে দেখে।এই মায়ের ছবিটা দিয়ে আমি আমার পুরো দেশটাকে একেছি

রুস্তাভ মাথা নেড়ে বললেন, “সব বুঝলামকিন্তু তুমি কাঁদছো কেন?”

মীর্জা ভাই চোখ মুছে বললো, “এই প্রথম আমি কোন মায়ের ছবি একেছি।আমার মা নেই, কিন্তু আমি একজনকে সবসময়  মায়ের মত করে কল্পনা করেছি।আজকে সেই মায়ের ছবি একেছি এজন্য খুব আনন্দ লাগছে

রুস্তাভ মীর্জা ভাইয়ের মাথায় হাত

দিয়ে বললেন, “সমস্যা কি আমারও  চোখে পানি এসে পড়ছে। আমি এই কিছুদিন আগে আমার মাকে হারিয়েছি।সেও ঠিক এমন করে তাকিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতো  হয়তো।আমি তার সাথে শেষ জীবনে  খুব অন্যায় করেছি।আজ এই ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছি আমার খুব ভুল হয়েছে। আমি জানিনা তার কাছে কেমন করে ক্ষমা চাইতে হবে। মীর্জা তুমি আরোছবি আকবে, কিন্তু নিজের জন্য আকবে ঠিক এই ছবিটার মত।আর তোমার ছবি নিয়ে মন্তব্য করার মত ক্ষমতা আমার নেই।ভা  লো থাকো

সেইদিন রাতে আমি আর মীর্জাভাই  সারারাত হোটেলের ব্যালকনিতে

বসে ছিলাম।দুজনই লুকিয়ে লুকিয়েকাদছিলাম।আমি একসময় মীর্জা ভাইকে বললাম, “ভাইজান দেশে যাইতে ইচ্ছা করতেছে। নিজের দেশের  মত আর কোন দেশ কি হয়?”

মীর্জা ভাই তার বাবড়ি চুল দোলাতে দোলাতে বলছিলেন, “তা কি হয়  নাকি গাধা?”

খুব সকালে উঠে আমি পিসারোকে ফোন করলাম।তার ফোন নম্বরটা আমার খুব কষ্ট হয়েছে খুজে বার করতে।এক্ষেত্রে মীর্জা ভাই আমাকে ব্যপক সহায়তা

করেছে।উনি উনার চিত্রশিল্পী পরিচয়টা কাজে লাগিয়ে এই ফোন নম্বরটা জোগাড় করে দিয়েছেন। আমি প্রায় ৮৮ বছর বয়স্ক লোকটাকে যখন ফোন

দিলাম তখন সে খুব বিরক্ত গলায় ফোন ধরে বললো, “আমি ইংরেজী ভালো

জানিনা।কেন কথা বলতে চেয়েছো আমার সাথে

আমি তাকে বললাম, “পিসারো তুমি যখন ক্যাথিকে অস্বীকার করেছিলে

তখন কি জানতে ও তোমাকে কতটা ভালোবাসতো?  তুমি কি জানতে ওর

মধ্যে তখন তোমার অস্তিত্ব ছিলো?”

পিসারো ঘাবড়ে গিয়ে বললো, “তুমি কে?”

আমি ফোন রাখার আগে বললাম,

তোমাকে ও ভিয়ে বলে ডাকতো।এই শব্দটার অর্থ জীবন।যে তোমাকে তার

জীবন মানতো, তোমার প্রত্যাখানে যে তার জীবনটাকে নিজ হাতে শেষ

করলো তাকে তোমার এমন অসম্মান  করাটা ঠিক হয়নি।তুমি পৃথিবীর চোখে যত বড় শিল্পীই হও, আমার মনে হয় তুমি শিল্পের অপমান।একজন শিল্পী সৌন্দর্য অনুভব করতে পারে, তাকে  ভালোবাসে।কিন্তু তার থেকে বেশি ভালোবাসতে পারে সেই  সৌন্দর্যের আধারকে।তুমি কেমন করে শিল্পী হবে বলো?”

ক্যাথির ছবিটা চোখে ভাসছে।আমি সেই ছবিটার একটা কপি নিয়ে  এসেছি। বারবার দেখি আর মেয়েটার চোখে গভীর কষ্টটা চোখে পড়ে।কত আগের পুরনো একটা ছবি অথচ মেয়েটার  অনুভূতি ছবিতে কি অসাধারণ হয়ে ফুটে

আছে।মনে হচ্ছে এই একটু পরেই কেঁদে দিবে। চিত্রলেখার সাথে আর আমার দেখা হবেনা এটা জানতাম।সেদিন  চিত্রলেখার সাথে দেখা হওয়ার পর  থেকে আমি আরো একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম, আমি এখনো ভালোবাসতে শিখিনি। হয়তো একদিন আমিও পারবো ভালোবাসার  রঙগুলোকে ছুয়ে ছুয়ে দিতে ।সেদিন আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার খুব মন দিয়ে একটা ছবি আঁকবো। তাকে চিত্রলেখার গল্প বলবো, একজন ক্যাথি ক্যাটিনানের গল্প  বলবো। তাকে জিজ্ঞাসা করবো,

"আচ্ছা এমন করে ভালোবাসবে আমাকে?"

 

 

মাঝে মাঝে কিছু গল্প লিখার পর বেশ আনন্দ বোধ করি। কারণ আমি যাহা মনে  চায় তাহাই লিখেতে পেরেছি, নিজের জন্য লিখতে পেরেছি। এই

গল্পটার আসলে শেষ ছিলোনা। এমন গল্পের শেষ হয়না।

 

সাদ আহম্মেদ


    Next Post Previous Post
    No Comment
    Add Comment
    comment url