Bangla Golpo: নামহীন | সাদ আহম্মেদ - ৭
Bangla Golpo: নামহীন
সাদ আহম্মেদ
আম্মার সকাল সকাল খুব মন খারাপ। আমি
ভয়ে ভয়ে কাছে যেয়ে বলি, স্যারের বেতন দিতে হবে। ১২০০ টাকা
দাও।
আম্মা মুখ খারাপ করতে যেয়েও থেমে
গেলো। অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কাছে নাই।
তোর বাপকে ফোন করে তার কাছে টাকা চা। আমার কাছে টাকার কথা বলবিনা আর।
আমি ঝগড়ার প্রিপারেশন নিলাম। জানি
আম্মা বলবে, আব্বু তিনমাস ধরে টাকা পাঠাচ্ছেনা।
বাড়ি ভাড়া দেয়া যাচ্ছেনা। আমার কলেজের বেতন দিচ্ছে এটাই তো বেশি। ফোনের বিল, বাজার অনেক টাকার ব্যাপার।ঝগড়া করলে টাকাটা আম্মু কিভাবে কিভাবে
যেন দিয়ে দেবে তা আমি জানি। আজকে কেন যেন ক্লান্ত লাগছে। গতমাসে আমার আব্বার
দ্বিতীয় বিয়ের ১ম বার্ষিকী পূর্ণ হয়েছে। আম্মা কেমন করে যেন ব্যাপারটা মেনে
নিয়েছে। আমার মানা আর না মানায় অবশ্য কারো যায় আসেনা।
আমি আম্মাকে বললাম, টাকা না দিলে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করবো। এইটাই কি চাচ্ছো নাকি?
আম্মা কিছু না বলে কাঁদতে থাকে।
আমার খুব মায়া লাগে। বাহিরে তখন শরতের মৃদু বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দটা আম্মুর কান্না
শব্দের সাথে মিশে কি বিশ্রি একটা আওয়াজ হয়ে উঠেছিলো। মনে হচ্ছিলো আম্মাকে যেয়ে বলি, টাকা লাগবেনা থাক। মাস তিনেক আগে নতুন হওয়া ভালোবাসার মানুষকে একটা
জন্মদিনে গিফট না করলে এমন কি হবে! দরিদ্র পরিবারের ছেলের প্রেম করা জায়েজ না।
আম্মা অবশ্য টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলো
একটু পর। ২০০৩ সালে ঢাকার অলি গলিতে নতুন নতুন গিফট শপ দেখা যেতো। প্রেমিক প্রেমিকাদের
জন্য তা ছিলো বড়ই আকর্ষনীয় স্থান। কেউ কেউ দোকানে আসতো তার প্রেমিকার সাথে একটু
গুজুর গুজুর করতে। হাত ধরে থাকা তখনও বেশ লজ্জার ব্যাপার ছিলো। একটু বেশি প্রেম
ছিলো যাদের মনে, তারা হয়তো সাহস করে প্রেমিকার থেকে
দুই একটা চুমুও নিয়ে নিতো। লজ্জা লাগলেও সত্যি আমি চুমুর লোভে বারবার আমার
প্রেমিকার সাথে দেখা করতাম। প্রেমিকার নামটা পাঠককে এখন আর বলতে ইচ্ছা হচ্ছেনা।
তার থেকে আমার শখ করে দেয়া নামটাই শুনুন - নবনী। খুব খুব শখ করে এই নামটা ওকে
উপহার দিয়েছিলাম।
সেই সময় হুমায়ুন আহমেদের ভয়ংকর
ক্রেজ। এই নামটা আমি ধার করেছিলাম তার লেখা "তেতুল বনে জোছনা" বইয়ের
পাগল পাগল মেয়েটার থেকে। বইটা খুব প্রিয় ছিলো। উপন্যাসের শেষের দিকে একটা চমৎকার
চিঠি লিখেছিলো নবনী তার প্রেমিকের জন্য। সে কিছু একটা এমন বলেছিলো, "তোমার এক ফোটা চোখের জলের জন্য আমি জনম জনম কাঁদবো "। ১৮ বছর
তিনমাসের আমি তখন ভাবতাম আমার নবনীও আমাকে হয়তো জনম জনম ভালোবাসবে। এই ভালোবাসার
জন্য এতো সমস্যার মধ্যেও মায়ের কাছে মিথ্যা বলে ১২০০ টাকা নেয়া কোন অপরাধ না।
নবনীর জন্য বেলী রোডের এক দোকান
থেকে চমৎকার একটা ঘড়ি কিনলাম। দাম পড়লো ৯৩০ টাকা। বাকি ২৭০ টাকা দিয়ে হালকা খাওয়া
দাওয়া হয়ে যাবে এমনটা ভাবতে ভাবতে নবনীকে দেখলাম হেটে হেটে আমার দিকে আসতে। আমি
গিফট লুকিয়ে বললাম, ভালো আছো?
নবনী হেসে বললো, লুকানোর দরকার নাই। কি আনছো তুমি আমার জন্য?
আমি নবনীকে নিজ হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে
দিলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাকে কেউ এতো
সুন্দর ঘড়ি আগে কিনে দেয়নি। তোমার জন্য আমি অনেক শখ করে একটা জিনিস কিনেছি, জানো।
আমি পিচ ঢাকা কালো রাস্তার উপর
আশেপাশের সব সংকীর্ণ মনকে অবজ্ঞা করে ওর গালে হাত দিয়ে রাখলাম। নবনী লজ্জা পেয়ে
বললো, চলো আজকে তোমাকে গাড়িতে নিয়ে যাবো
এক জায়গায়। তোমার গিফটও গাড়িতে রাখা আছে।
আমি নবনীর গাড়ির কাছে যেয়ে
দীর্ঘশ্বাস ফেলি। V6 3500 মডেলের গাড়ি। গাড়িটার আকার আমার
রুমের সমান হবে কিনা মাঝে মাঝে ভাবি। নবনী সেদিন আমাকে একটা হালকা নীলচে পাঞ্জাবি
উপহার দিয়েছিলো। আমি পাঞ্জাবীটা একটা দিনও গায়ে জড়াইনি। আমার মনে হতো গায়ে চড়ালে
ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধটা চলে যাবে। আমি গন্ধটা জমিয়ে রাখতাম। গন্ধ না বলে ভালোবাসা
বললে কি ভুল হবে?
বছর তিনেক পর একদিন নবনী আমাকে ফোন
করে বলে, "আর সম্ভব না। আমাকে মুক্তি
দাও"।
আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম। ওর এক
বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে বললো, ভাইয়া আপনি ওর ব্যাপারে অনেক
পজেসিভ। ওর জন্য এটা খুব বড় সমস্যা। তাছাড়া ওর বাবার অবস্থা তো জানেন। আপনাদের
মধ্যে কখনও কিছু সম্ভব না এটা আশা করি বুঝতে পারছেন! ওর ফ্যামিলি মেনে নিবেনা!
আমি সেদিনের পর থেকে সব বুঝেছি, শুধু এটা বুঝিনাই নবনীর সাথে জড়িয়ে থাকা অযুত নিযুত স্মৃতিগুলো
কিভাবে ভুলে থাকা যায়। আমার বন্ধু বান্ধব সবাই তখন প্রেম-ভালোবাসা, Cisco/CCNA,
C++, কম্যুনিটি মেডিসিন, বায়োকেমিস্ট্রি এসব নিয়ে ব্যস্ত। খুব ব্যস্ত। আর আমি ব্যস্ত জীবনকে
আরো জানতে বুঝতে শিখতে। আবার ভালোবাসতে ইচ্ছা করতো। এই জগতে ব্যর্থ প্রেমিক
প্রেমিকার হৃদয়ের খালি জায়গা সবসময় পূরণ করে নিতে হয়। যেই মনে একবার প্রেম রঙ
ছড়িয়ে যায়, সেই মনকে বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে
প্রেম করতেই হয়। ইহাই জগতের অমোঘ নিয়ম। পরবর্তী জীবনে তাই আমার আরো অনেককে ভালো
লেগেছে, কারো হাত ছুয়েছি, কারো ঠোটের উষ্ণতা নিয়েছি।কিন্তু কিছু একটা ছিলোনা, বিশ্বাস করুন সেই কিছুটা কি তা আমি জানলেও নিজের সাথে প্রতিদিন
যুদ্ধ করেছি নিজেকে আর বুঝতে না দিতে। এই যুদ্ধটা সহজ ছিলোনা। সবাই তাতে জিততেও
পারেনা। আমি কিন্তু পেরেছি, সফলভাবে পেরেছি।
প্রায় ১৩ বছর পর আমার সাথে নবনীর
দেখা হয় বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের ৮ম তলায় সিনেপ্লেক্সের পাশে। আমি ফুডকোর্টের দিকে
ছিলাম, মুখে এক পিছ দহি ফুচকা। নবনীর
স্বামী কসপ্লেয়ারদের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে নবনীও যোগ দিচ্ছে। হাত ধরে
পাশে ৩/৪ বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটা মনে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে বারবার
ছোট্ট মিষ্টি পানের দোকানটার দিকে তাকাচ্ছে। এই দোকানের মালিকের নাম হাবিব।
হাবিবের একটা হাত নেই। সে একসময় শখ করে মগবাজার ওয়ারলেস মোড়ে ভিক্ষা করতো। আমার
বন্ধু মাহতাবের ছোট ভাই এই সূত্রে তাকে আমি মাঝে মাঝে পাগলামীর জন্য বকাঝকা করতাম।
হাবিব অবশ্য হেসে বলতো, "হাসান ভাই ভিক্ষার মজা আপনারা
বুঝবেনা। মানুষ কত জানোয়ার আবার কত ফেরেশতা হইতে পারে সেইটা একটা ভিক্ষুকের থেকে
ভালো কেউ জানেনা। মন খারাপ হইলেই তাই থালা নিয়া বইসা যাই। দুইঘন্টা ভিক্ষা কইরা যা
পাই তা দিয়ে টোকাই- গাম খাওয়া পোলাপাইনের সাথে ডাল আর ডিম ভাজি দিয়া এক প্লেট ভাত
মাইরা দেই। ভাই শান্তি আর শান্তি"।
হাবিবের এই মজা বেশিদিন টিকে নাই।
ভিক্ষা করতে করতে তার এক মেয়ের সাথে প্রেম হয়ে যায়। মেয়ে কানে ধরে ওকে ভিক্ষার
থালা সরিয়ে মার্কেটের পানের থালা ধরিয়ে দিয়েছে।
নবনীর পাশ দিয়ে আমি ইচ্ছা করে হেটে
গেলাম। তারপর আবার যখন পিছনে যেয়ে ফিরে আসছি তখন দেখলাম ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে আছে।
কি যাচ্ছেতাই ব্যাপার! আমাকে দেখে এতো মন খারাপ করার কি আছে? আমিই বা এমন কেন করছি? কি দরকার আমার ওর কাছে? আচ্ছা আমি কি একবার ওকে জিজ্ঞাসা করবো, অনেক বছর আগে গভীর রাতে যখন ওর জন্মদিনে ও আমাকে টিএনটি ফোনে
বলেছিলো, "হাসান আমাকে বিয়ে করবে? করলে বলো কবুল!" - আমি ছয়বার কবুল বলেছিলাম। আমাকে যখন
ফ্যামিলির স্ট্যাটাস ম্যাচ করেনা, প্রতিদিন
টিউশনীতে ব্যস্ত থাকা একই চেহারা, বেশি বেশি কেয়ার
করা পজেসিভ আচরণ ভালো লাগছেনা বলে ছেড়ে দিলো তখন কি ওর একবার সেই রাতে বলা
"কবুল" শব্দটার আকুতিটা মনে পড়েছিলো? অথবা আমার দেয়া ১১৮ পাতার চিঠিটার কথা মনে আছে? আমি ওকে আমার ছোটকাল থেকে দুঃখ কষ্ট জমিয়ে লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরীটা
পড়তে দিয়েছিলাম। সেই ডায়েরীতে ২০০৩ সাল থেকে লেখা প্রতিটা পাতায় একটা কথা শেষে
লিখা থাকতো, "নবনী আছে না!" সব ভুলে গেছে?
নবনী তোমার সাথে ১৪ই ফেব্রুয়ারী বা
এপ্রিলে যখন ঘুরতে যেতাম তুমি মাঝে মাঝে আশেপাশে তাকিয়ে বলতে, "মেয়েগুলো কি সুন্দর করে সাজছে। তোমার আমার মত শ্যামলা মেয়ে রেখে এই
সুন্দর মেয়েগুলার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছা করেনা?"। নবনী বিশ্বাস করো, তোমার চোখের মায়া
খুজতে খুজতেই আমার দিনটা কেটে যেতো, অন্য কাউকে দেখার সুযোগ পেতাম কোথায়? তুমি প্রায়ই বলতে, জীবনে বাঁচতে হলে
প্র্যাকটিক্যালী চলতে হয়, অনেক কিছু ভাবতে হয়। বিশ্বাস করো, আমি কখনো এই বহুল ব্যবহৃত "প্র্যাকটিক্যাল" শব্দটি
বুঝিনি, মানিওনি। তারপরেও তোমার মিরপুর
কাজীপাড়ায় ফেবার ক্যাসেল পেন্সিলের ব্যবসা করা স্বামীর থেকে আমার অবস্থা বেশ ভালো।
কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রিতে আমার একটা পিএইচডি আছে, দেশের বাহিরে নিজের একটা ডুপ্লেক্স আবাস আছে, একটা R সিরিজের Audi গাড়ি, এমনকি মলি আর বিলি নামে দুটো
ডোবারম্যান কুকুরও আছে।
প্রায় ৬ বছর পর দেশে ঘুরতে এসে কি
সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমার, তোমার সাথে না
চাইতেও দেখা হয়ে গেলো। আমি একটা কাগজে আমার বাংলাদেশে ব্যবহার করা নম্বরটা লিখে
আস্তে আস্তে নবনীর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওর স্বামী তখন সিনেমার টিকেট কিনতে
কাউন্টারের দিকে গেছে। নবনী একা দাঁড়িয়ে ছিলো। আচ্ছা ও কি আমার জন্যই একা দাঁড়িয়ে
ছিলো? আমি মুঠোয় ধরা এক চিলতে কাগজ অথবা
আমার অব্যক্ত আর্তনাদ নিয়ে ওর পাশে এসে দাড়াই। ও আমার দিকে খুব অস্বস্তি নিয়ে
তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে আমি কি বলবো। আমি কাগজটা ওকে দেখিয়ে হাত থেকে ফেলে দিয়ে
পেছনে ঘুরে চলে আসি। ও কি কাগজটা তুলে নেবে? নিশ্চয়ই নেবে।
দুই মিনিটের ভেতর আমি কিভাবে কিভাবে
যেন মার্কেট থেকে বেরিয়ে গেলাম। নবনী ফোন করলে আমি কি বলবো জানিনা। হয়তো বলবো, যেই ফ্যামিলি-স্ট্যাটাস অথবা আর্থিক অসামঞ্জস্যতার জন্য আমি তুচ্ছ
হয়ে ছিলাম আজকে আমার সেখান থেকে উঠে আসাটা কি দেখতে পাও?
আমি নিশ্চিত আশেপাশের শুভাকাংখীরা
বলবে, এতো অবহেলা যে করলো তার সাথে আবার
যোগাযোগ করার অথবা তাকে নিয়ে ভাবার রুচি কিভাবে হয়? আমি তো একদমই ব্যক্তিত্বহীন। তারা কেউ বুঝবেনা, এই নষ্ট জনপদে জন্ম নেয়া হাসান করিম নামে ছেলেটা যেদিন সবকিছু দিয়ে
একজনকে ভালোবাসতে শেখার পরও প্রিয় মানুষটা তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো, সেদিনই তার ব্যক্তিত্বটা হারিয়ে যায়। যেই ভালোবাসাটার নবনী মূল্য
দেয়নি, সেই ভালোবাসার সম্মানটা সবার কাছে
ফুরিয়ে গেলেও আমার কাছে তা অনেক দামী। একে অসম্মান করার অধিকার কারোও নেই, নবনীরও নেই। ওকে জানতে হবে বুঝতে হবে, না আমি না আমার ভালোবাসা কোনটাই মূল্যহীন নয়।
বাসায় যেয়ে আমি দরজা বন্ধ করে জোরে
জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি। আজ খুব গেছে বুকের উপর দিয়ে। আম্মা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে
বলে, "সব ঠিক আছে আব্বু?"
আমি কিছু বলতে পারছিনা। শুধু ফোনটা
শক্ত করে ধরে বসে থাকি। ভাবছি কখন ও ফোন করবে। আচ্ছা করবে তো? আমি শুধু ওকে একবার জিজ্ঞাসা করতে চাই - "তোমার গায়ের মিষ্টি
গন্ধটা এখনো পাই কেন জানো?"
সাদ আহম্মেদ