Bangla Golpo: মুমু কেমন আছে? ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
Bangla Golpo: মুমু কেমন আছে? ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
সাদ আহম্মেদ
সেদিন রাতে ভালো ঘুম হলোনা। বারবার
শুভর মার খাওয়ার সময় যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো সেটা মনে হচ্ছিলো। কি নির্লিপ্ত
পাশবিক একটা দৃষ্টি ছিলো। আমি প্রথম যখন ওর সাথে কথা বলি তখন খুব অবাক হয়ে
গিয়েছিলাম। রাস্তার টোকাই একটা ছেলে কি চমৎকার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। আমি শুভকে
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পড়াশোনা করিস না?
শুভ ফিক করে হেসে দিয়ে বলে, ভাইয়া আমি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছি, আমাকে কেউ একটা চাকরী দেবেন?
থানায় নিজাম ভাইয়ের সাথে দেখা করতে
গেলাম। আমাকে দেখে উনি অনেকটা না চিনার ভান করলো। সেদিন আমি মেসের রুমমেট শাহেদ
ভাইয়ের থেকে একটা শার্ট ধার করে পড়ে গিয়েছিলাম। শাহেদ ভাইয়ের শার্টের নিচের
বোতামটা ছিলোনা। পড়ার সময় খেয়াল করিনি। নিজাম ভাই আমার মত ছেড়া শার্টের কাউকে দেখে
না দেখার ভান করবেন এটাই স্বাভাবিক। ভাই দুদিন আগে বাড্ডার সাতারকুলে একটা বাড়ি
কিনেছেন। তিনতলা বাড়ি, পুরোটা টাইলস করা। বাথরুমের
মোজাইকটা খুব সুন্দর। উনার ছোট ভাই রাদিন আমাকে বাথরুম দেখায় বললো, দোস্ত বাথরুম দেখলেই খালি মুত আসে। তুই চাইলে হাল্কা করে মুতে আসতে
পারিস।
নিজাম ভাইকে আমি ভাই ডাকতে খুব
অস্বস্তি বোধ করছিলাম। উনি থানার এক এস আই এর সাথে কি নিয়ে যেন পান মুখে গল্প
করছিলেন। আমি সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সুযোগ খুজছিলাম কখন উনাকে একটু হাত কচলে
তেল দিতে পারবো। প্রায় আট মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পরে উনি থানার বাহিরে পানের পিক
ফেলে আমার দিকে খুব অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তোমার নাম ফরিদ না?
আমি মাথা নাড়লাম। যদিও আমার নাম
ফরিদ না, আমার নাম রুমন। রুমন রায়হান। এখন
সেটা সংশোধন করতে ইচ্ছা করছিলোনা। নিজাম ভাইকে বললাম, ভাইয়া অনেকদিন আপনাদের বাসায় যাইনা। পত্রিকার চাকরী, সারাক্ষণ দৌড়াতে হয়।
নিজাম ভাই আমার কথা না শুনে সামনে
হাটা দিলেন। গাড়িতে ওঠার আগে আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম, ভাইয়া যদি একটু অনুমতি দেন তাহলে কালকে দুপুরে যে একটা ছেলেকে
থানায় ধরে আনা হয়েছিলো, তার সাথে একটু কথা বলতে চাই। ঢাকা
শহরের এইসব অপরাধী কিশোরদের সংশোধনে পুলিশের সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে একটা ছোট্ট
রিপোর্ট লিখতে চাই। ভাইয়া আরেকটা আবদার প্লিজ। আপনার একটা হাসিমুখ ছবি এই রিপোর্টে
যোগ করতে চাই। আপনারা আমাদের অহংকার ভাইয়া। আপনাদের ব্যাপারে মানুষ জানুক এটা
অনেকদিনের ইচ্ছা।
নিজাম ভাই গাড়িতে বসে আমার দিকে
হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, আর তেল দিওনা। সারাদিন তেল খায়া
খায়া বদহজম হয়ে গেছে। থানার ভিতরে যায়া কনস্টেবল রফিকের সাথে কথা বলো। ওই পোলাটা
এখন দুই নাম্বার সেলে আটকায় আছে। কথা বলো। আর ছবি যদি তুলতেই চাও কালকে বাসায় আসো।
তোমার ভাবীর সাথে ছবি তুইলো। একা তুললে সে মাইন্ড খাইতে পারে।
বুঝলাম তেল কাজে লাগছে। এই
বাইঞ্চোতের ছবি তোলার টাইম আমার নাই, কারণ আমার আসলে কোন ক্যামেরাই নাই। স্টাফ রিপোর্টার হতে পারলে সাথে
একজন ফটো সাংবাদিক থাকতো। এখনো এতো বড় লেভেলে পৌছায় নাই। অফিসের এক সহকর্মী আপার
ভাষায় আমি হলাম ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। সেই আপার নাম বলা যাবেনা। উনি ফেসবুকের
বড় সড় সেলিব্রেটি এখন, মাঝে মাঝে টকশোতে আসেন। শেষ
শুক্রবারে একটা রিপোর্ট করতে যেয়ে পায়ে হোন্ডা চাপা খেয়ে মেজাজ খুব খারাপ ছিলো।
শনিবারদিন অফিসে গেলে আপা আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললো, কি তিন নম্বর বাচ্চা। রাস্তাঘাটে হাটাচলাও তো শিখলানা। বড় হবা কবে?
সেদিন প্রথমবার উনার দিকে তাকিয়ে
হাসিমুখে উত্তর দিলাম। বললাম, আপা বড় হলে অফিসে
একটা রুম পাবো। তারপর দেখা যাবে আপনি খসরু ভাইয়ের রুমে যেমন মাঝে মাঝে অফিস খালি
হলে সন্ধ্যার দিকে যেয়ে মিউমিউ করেন, আমার সাথেও এমন করতে চাইবেন। কি দরকার এতো বড় হওয়ার বলেন?
আমার পাশে তখন হেলাল দাঁড়িয়ে ছিলো, ও অফিসে সবাইকে চা দেয়। ছেলেটা নির্বিকার হয়ে আমার দিকে একবার
তাকিয়ে চিকচিক আওয়াজ করে চলে গেলো। আপা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমিও চিকচিক
আওয়াজ করে চলে গেলাম।
থানার ভেতরে রফিক সাহেবের সাথে কথা
বলতে গেলে মহা মুসিবতে পড়লাম। উনি কনস্টেবল হলেও ক্ষমতায় এসপি সাহেবের ওপরে। আমি
প্রথমে যখন ২ নম্বর সেলের শুভর সাথে কথা বলতে চাইলাম উনি মাথা নেড়ে বললেন, প্রটোকল নাই। আমি এরপর হাত কচলিয়ে ইনিয়ে বললাম, ভাইয়া আমার পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠাতে হবে। একটু যদি সুযোগ দিতেন
ভাইয়া।
রফিক সাহেবের মন গললোনা। আমাকে উচু
গলায় শাসিয়ে বললেন, ধুর শালা ভাগ।
এক ধাক্কায় তুই পর্যায়ে যাওয়ায় মন
খারাপ হলেও কিছু করার ছিলোনা। ছেড়া শার্ট পরিহিত মেসনিবাসী এই চ্যাংড়া বালককে খুব
বেশি সম্মান দেয়ার দরকার নাই সেটা শহরের কাকটাও জানে। অবশেষে আমি তাকে চা নাস্তা
খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিলাম এবং শুভর সাথে কথা বলার অনুমতি পেলাম। এই পঞ্চাশটি টাকা
লোকসান যাওয়াতে মনটা খুব বেশি বিষন্ন হলো, বেশ কয়েকদিন রাতের বেলায় আড়মোড়া ভাঙ্গা চা টা খাওয়া হবেনা। কিন্তু
শুভর সাথে কেন যেন খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো। আমি বুঝতে চাচ্ছিলাম এইটুকু একটা
বাচ্চা কিভাবে এমন নৃশংস কাজটা করতে পারলো।
শুভ গরাদখানার এক কোণায় চুপ করে
শুয়ে ছিলো। আমাকে দেখে একটু হাসিমুখে তাকালো। তারপর কাছে এসে বললো, এখানে খেতে দেয়। আমি বাহিরে যাবোনা। একটু মার দেয় আশেপাশের
আঙ্কেলরা। তাতে ব্যথা লাগেনা।
আমি হতবাক হয়ে ছেলেটার মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকলাম। এই বয়সে কেমন একটা জীবনহীন মুখাবয়ব। ১১ বছরের একটা বাচ্চার এমন
জীবনহীন চাহনী মেনে নেওয়াটা কষ্টকর ছিলো। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার আব্বু আম্মু জানে তুমি থানায়?
ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আঙ্কেল আম্মু নাই। আমার এক আঙ্কেল আম্মুকে এসে নিয়ে গেছে। এরপর
আম্মু আর কখনোও বাসায় আসেনাই। আদর করেনাই।
আর তোমার আব্বু? – আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
ও একটু ইতস্তত করে বললো, আব্বু ঘুষ খেতো। তাই পুলিশ ধরেছে। আমার এখন মুমু ছাড়া কেউ নাই।
আঙ্কেল মুমুকে হোসনা আন্টি খেতে দিয়েছে কিনা দেখবেন একটু? ও কালকে থেকে মনে হয় কাঁদছে আমাকে না দেখে। ওর অনেক জ্বর।
আমি হোসনা নামে কোন মহিলাকে চিনিনা।
এটা এখন শুভকে বলতে ইচ্ছা করছেনা। আমার একটা ভালো রিপোর্ট বানাতে হবে। শুভকে আস্তে
আস্তে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন সে অপরাধটা করেছিলো।
আমি গরাদের ফাক দিয়ে শুভর মাথায় হাত
বুলিয়ে বলি, শুভ সবাই বলছে তুমি নাকি একজনের
চোখে আঘাত করেছো? কথাটা কি ঠিক?
শুভ মাথা নাড়ে। আমাকে বলে, আঙ্কেল আমাকে আমার বন্ধুরা শিখায় দিছে। ওই খারাপ লোকটা আমাকে আর
মুমুকে সারাদিন বলতো আমাদের মেরে কুত্তাকে খাওয়ায় দিবে। আমাদের অনেক কষ্ট দিছে।
পরের প্রশ্নটা কি হতে পারে বুঝতে
পারছিলাম না। আমি জানি, রাস্তায় বাস করা এই বাচ্চারা নানান
রকম বাজে পরিস্থিতি, অত্যাচারের শিকার হয়। উঠতে বসে গালি, মার খাওয়া এই ব্যাপারগুলো খুবই সাধারণ। হয়তো সেই লোকটাও এবিউস
করাদের মধ্যে একজন ছিলো। সেদিন আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা। কাল পরশু
এসে ওর সাথে কথা বলে বাকি বিষয়টা জানবো। যাওয়ার আগে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, শুভ তোমার বোন মুমুর জন্য আমি খাবার কিনে নিয়ে যাবো আমি, চিন্তা করোনা।
শুভ একটু লজ্জা পেয়ে বললো, আঙ্কেল ওর জন্য বুদবুদ খেলনা নিয়ে যাবেন একটা। আমি আপনাকে টাকা
দিয়ে দেবো। ও খুব বুদবুদ খেলা পছন্দ করে। আমার বন্ধু সাজাহান ওকে একবার কিনে
দিয়েছিলো। আমি বুদবুদ বানাতাম, আমার বোন বুদবুদের
পিছনে পিছনে দৌড়ায় ধরে ফেলতো। প্লিজ আঙ্কেল ওকে একটা কিনে দিয়েন। ও তাহলে আর
কান্না করবেনা।
বাসায় এসে মনে হলো, শুভর জীবনে একটা জমজমাট গল্প আছে। চমৎকার একটা রিপোর্ট হবে।
নিঃসন্দেহে ও ছোটকাল থেকে রাস্তায় বড় হয়নি। ও ভালো পরিবারে থাকতো, কিন্তু কিছু একটা হয়েছিলো। এই ছেলেটাকে নিয়ে বেশ কয়েকদিন রিপোর্ট
করে পত্রিকায় চালিয়ে দেয়া যাবে। মুমু নামে ওর যে বোনটা আছে কালকে একবার তার খোজ
করবো। ওর বন্ধুদের সাথে একটু গল্প করা যেতে পারে, সাথে হোসনা নামের সেই মহিলা। সবার থেকে তথ্য জেনে পরিপূর্ণ একটা
আর্টিকেল লিখে ফেলবো। লেখার শিরোনাম হবে „ভাগ্যহীন এই কিশোরদের শেষ পরিণতি কি তবে গরাদখানা“।
রাতে স্বপ্ন দেখলাম। চমৎকার একটা
শুরু সেই স্বপ্নের। ১২ বছর আগে মারা যাওয়া মা আমার হাত ধরে রাস্তায় হাটছেন। আমার
দিকে তাকিয়ে বলছেন, আব্বু সকাল সকাল প্রতিদিন এভাবে
হাটবা। দেখবা শরীর একদম ফিট থাকবে।
আমি আম্মুর হাত ধরে শক্ত করে ধরে
ছিলাম। বললাম, আম্মু তুমি প্রতিদিন এভাবে হাটবা তো?
আম্মু হাটতে হাটতে থেমে গেলো। হাত
তুলে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার পাশের খেলা করা দুটো বাচ্চাকে দেখলো। আমাকে বললো, দেখ দেখ কি সুন্দর বাচ্চা দুটো। মেয়েটার স্বাস্থ্য মাশাল্লাহ কি
সুন্দর।
আমি মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
ছেলেটাকে দেখে অবাক হলাম। এটা তো শুভ। শুভ আমাকে দেখে হেসে বললো, আঙ্কেল মুমু খুব দুষ্ট। ওকে একটু ধরবেন?
আমি কিছু বলার আগে মুমু দৌড় দিয়ে
মেইনরোডের দিকে উঠে গেলো। রাস্তার মাঝ দিয়ে মেয়েটা অবুঝের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কেমন
একটা ভয় লাগা শুরু হলো। চারপাশে বড়বড় ট্রাক, বাস সাইসাই করে ছুটে চলছে। মুমু কি দেখছেনা? আমি চিৎকার করে ওকে ডাকতে যেয়েও পারছিনা, গলার স্বর আটকে যাচ্ছে। মেয়েটার চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছিনা। অনেক
চেষ্টা করছি, কেন যেন পারছিনা। আম্মু আমার হাত
ধরে বললো, রুমন দৌড়া মেয়েটাকে ধর। যা দৌড়া!
আমি দৌড়াতে চাচ্ছি, পারছিনা, একটা ট্রাক মুমুর দিকে তেড়ে আসছে।
আমি ওকে বাঁচাতে পারছিনা। শুভর তখন কোনদিকে নজর নেই। ও আমার দিকে একবার তাকায়, একবার মায়ের দিকে। মুমুকে যখন ট্রাকটা চাপা দিতে যাচ্ছে, আমি অসহায়ের মত চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। তারপর মুমু আর আমি একসাথে
চিৎকার করলাম।
ঘুম ভেঙ্গে গেলে বেশ অনেকটা সময়
ঘোরের মধ্যে ছিলাম। খেয়াল করলাম আমার সারা শরীর ঘেমে একপ্রকার গোসল হয়ে গেছে।
শাহেদ ভাই বিছানা থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, রুমন পানি খাইবা?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। তারপর
স্যান্ডেল পড়ে রাস্তায় বের হয়ে গেলাম। জোরে জোরে হাঁটতে থাকি আমি। চারদিকে কেমন
গুমোট অন্ধকার। আর একটু পরেই অন্ধকারগুলো হারিয়ে যাবে, নতুন সূর্যে গতদিনের বিষাক্ত, নষ্ট, পঙ্কিল প্রশ্বাসগুলো নিঃশেষ হয়ে
একঝাক মুক্ত বাতাস উপহার দেবে। আমি, আমরা তার মাঝে আরেকটা নতুন ব্যস্ততার খোজে পৃথিবীটাকে চষে বেড়াবো।
কিন্তু কিসের টানে প্রতিনিয়ত আমাদের নিজেকে ব্যস্ত রাখা? কেউ কেউ বলবে, এক থালা খাবারের
জন্য কেউবা বলবে আরো কিছু কাগজ উপার্জনের জন্য। দিনশেষে এরা কেউ আর মানুষ হতে
পারেনা। অর্থ, সম্মান, খাদ্য এসবের পেছনে ছুটতে ছুটতে কবে যে মনটা স্থবির হয়ে যায় তার খোজ
কেউ রাখেনা। আমি খুব চাইতাম মনটাকে ব্যস্ত রাখতে, সমাজ সংসারের চাপে পারিনি। ঘর ছেড়েছি, পরিবার ছেড়েছি – কিন্তু নিজেকে
বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছাটা ছাড়তে পারিনি। একসময় উপলব্ধি করলাম এই গরীব দেশের নষ্ট
সমাজে মানুষ বেঁচে থাকে না, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বাঁচিয়ে
রাখার সংগ্রামে হেরে যায় শুভ, মুমু অথবা
রুমনেরর মত হাজারটা সত্ত্বা। তাতে কার কি?
সকাল বেলা থানায় শুভর জন্য একটা
ছয়টাকা পিস কেক আর কলা নিয়ে গেলাম। রফিক সাহেব আমাকে দেখে বললো, কালকে রাতে পোলাটা মইরা গেছে। লাশ কেউ নিতে আসেনি। আপনে চাইলে
কাগজে সাইন করে নিয়ে যাইতে পারেন। দাফনের খরচ সরকার দিবেনা। নিজের পকেট থেকে দিতে
হবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিভাবে মরে গেলো?
রফিক সাহেব বললো, জ্বর আসছিলো। মা মা করতে করতে মইর্যা গেলো। আমরা টের পাইনি। লাশ বাহিরে রাখছি, ঝামেলা না কইর্যা নিয়ে যাইতে
চাইলে নিয়ে যান। নাইলে লাশ মেডিকেলে যাইবো।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, আপনাদের থানায় মারা গেছে? আপনাদের কোন দায়িত্ব নাই?
রফিক সাহেব বেজার হয়ে বললো, আমরা জনগণ থিকা ওরে প্রটেকশন দিয়া থানায় রাখছি। দুইরাত থাকতে দিছি, খাওয়াইছি। কালকেও ওরে আমি কলা কিনা খাওয়াইছি। আর কি দায়িত্ব নিমু? ওরে দুইদিন পরে কোর্টে চালান দিলে কিশোর সংশোধানাগারে পাঠায় দিতাম, তার আগে মইর্যা যায়া আরো
ঝামেলা বাড়াইছে। ঝামেলা কমানোর জইন্য তোমারে কইলাম লাশ অবিভাবক হিসাবে নিয়া যাইতে।
এইরকম অনেক রাস্তার পোলা পত্যেকদিন রাস্তায় মইরা পইড়া থাকে। এতো হিসাব কেউ রাখেনা।
আমারে আর ত্যাক্ত কইরোনা। লাশ নিলে নাও নাইলে বাড়িত যাও।
শুভর লাশ দাফন করতে সর্বমোট ৭৩০
টাকা খরচ গেলো। এই টাকাটা আমার ধার করতে হয়েছে অনুর থেকে। অনু আমার গার্লফ্রেন্ড
টাইপ। বাট পুরোপুরি গার্লফ্রেন্ড না, একটু বউ বউ টাইপ ব্যাপার আছে। মেয়েটা হোমইকোনমিক্স কলেজে থার্ড
ইয়ারের ছাত্রী। ঢাকায় একটা মহিলা হোস্টেলে থাকে। টাকাটা দুইদিন আগে ধার করেছিলাম
ওকে একটা গিফট কিনে দেবো বলে। ও বললো, আমার থেকে টাকা নিয়ে আমাকে গিফট কিনে দেবে?
আমি হেসে বললাম, হ্যা। একদিন যখন অনেক টাকা হবে তখন টাকা ফেরত দিয়ে দেবো।
অনু হেসে দিলো। আমাকে লম্বা একটা
চুমু খেয়ে বললো, টাকা ফেরত দিতে হবেনা। মাঝে মাঝে
আমার পাশে এভাবে বসে থাকবে। আমাকে একটা সংসারের গল্প শুনাবে। আমার সাথে বাচ্চাদের
নাম ঠিক করবে। তাহলেই হবে। আচ্ছা আমাকে বিয়ে করবে তো?
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, জানিনা।
অনুর মন খারাপ হয়। আমি জানি, বুঝতে পারি। তাও ওকে সত্যিটাই বলি। আমাকে আহত কন্ঠে বলে, তুমি একটা ভালো চাকরী যদি পাও? এমন আর্থিক সমস্যা যদি না থাকে তাহলে করবে?
আমি ওর গালটা ছুয়ে দিয়ে বলি, হ্যা করবো।
প্রিয় পাঠক, আজকের এই লেখাটা অনুকে নিয়ে নয়। কিভাবে অনু আমাকে না জানিয়ে আমার
বন্ধু হাসিখুশি রাজিবকে বিয়ে করে ফেলে সেটা নিয়ে আরেকদিন বলবো। আজকে মুমু আর শুভকে
নিয়ে আরেকটু নাহয় বলি।
শুভর আন্টি হোসনাকে খুঁজে বের করতে
আমার খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। জাহানারা গার্ডেন পার হয়ে আনন্দ সিনেমাহল আসার আগে
কিছু অপটিকসের দোকান আছে। সেখানে কয়েকটা টোকাই প্রতিদিন দৌড়ছাপ দিয়ে বেড়ায়। আমি
শুভর সাথে ওদেরকে মাঝেমাঝে দেখেছিলাম। সেখানে যেয়ে হোসনা নামে কাউকে চিনে কিনা
জিজ্ঞাসা করতেই দুইজন আমাকে খামারবাড়ির পাশের একটা বস্তিতে নিয়ে যায়। পলিথিন দিয়ে
বানানো বেশ কয়েকটা ঘর রাস্তায়। এমন একটা ঘরে ৪৫-৫০ বছরের এক মহিলা চুপ করে বসে
ছিলো। আমি তার কাছে যেয়ে সালাম দিয়ে বললাম, আপনি শুভকে চিনেন?
মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হ চিনি। এক বেটারে দুইদিন আগে মাইরা লাইছে। থানায় গেছিলাম। দেখা
করবার দেয়নাই।
আমি উনাকে বললাম, আপা শুভ তো মরে গেছে। আমি সাংবাদিক। ওর মত বাচ্চাদের নিয়ে পত্রিকায়
লেখালিখি করি। আপনি যদি ওর ব্যাপারে একটু বলতেন!
মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
বহুদিনের অবহেলায় ক্লান্ত চোখে আমি তার বেদনাটা ঠিকই স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কিন্তু
কান্নার জলটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে উনিও হয়তো জানেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পোলাটা ভদ্দরঘরের আছিলো। ভালো পোলা। বাপে খারাপ আছিলো, পুলিশে ধইর্যা নিয়া গেছে। মারে অন্য ব্যাডারা
বিরক্ত করতো। একদিন মায়ে পলায় যায়। কই যে যায় বাচ্চাগুলারে রাইখা কেউ জানেনা। মনে
হয় মইর্যা গেছে। পোলা আর মাইয়ারে ওর খালা
মামা চাচায় কেউ দেহেনাই। বাপ খারাপ আছিলো তো তাই। পোলাটা সবাই মারতো, তাই ওর বোনরে নিয়া বাসা থিকা পালায় গেছিলো। এক বচ্ছর ধইর্যা রাস্তায় খাইতো, ঘুমাইতো। আমি থাকবার দিছিলাম।
আমি উনার কথা শুনে অবাক হইনি, কারণ এমনটাই ধারণা করেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ওর একটা ছোট বোন ছিলো। বাচ্চাটা কোথায়?
হোসনা মাথা নাড়ে। আমারে বলে, আল্লাই জানে। আমি একমাস ধইর্যা দেখিনা। ওইযে বৃষ্টি হইলোনা অনেক, সেইদিন শুভ ওর বোনরে লয়া রাস্তায় খেলতেছিলো। আমি কাম করতে যাইগা।
বাসায় আইসা দেখি ওরা নাই। ওগো বন্ধুদের জিগায় দেখেন। আমি বহুবার জিগাইছি শুভরে।
শুভ কয়, বইন আছে আশেপাশেই। আমরা গরীব মানুষ, কত পোলা মাইয়া হারায় যায়। কেউ খবর রাহে, কন? আমি খুজছিলাম দুই একদিন, খুজ্যা পাইনাই। মুমুরে পাইলে আমারে দিয়ে যাইয়েন, পরানটা পুড়ে!
দুপুরে আমার ক্ষুধা মেটে দুইপিস
পুরী, মাঝে মাঝে হয়তো অতিরিক্ত একটা সমুচা
খেয়ে। আজকে হোটেলে যেয়ে দেখি এসবের কিছুই নেই। মন খারাপ করে বাসায় ফেরত যাচ্ছিলাম।
তারপর মনে হলো অনুর হোস্টেলে যাই। ওর আলুভাজি খেতে খুব মজা হয়। ভাগ্য ভালো থাকলে
আজকে হয়তো ওকে হোস্টেলে পেয়ে যাবো।
অনু হোস্টেলে ছিলো আজ। কিন্তু কোন
আলু ছিলোনা। আমি একবার বললাম আলু কিনে এনে দেবো। ও না করলো। বললো, আরো মজার খাবার আছে। আজ দুপুরে সে আমাকে ফাস্টক্লাস একটা খিচুড়ি, সাথে ডিম আর বেগুন ভাজি খাওয়াবে। গতকাল টিউশনীর টাকা পেয়েছে, আজকে সেলিব্রেট করবে।
দুপুরে খেতে খেতে অনুকে বললাম, এভাবে যে মাঝে মাঝে হোস্টেলে চলে আসি কেউ কিছু বলেনা?
অনু মুখের খাবার শেষ করতে করতে বললো, বলে হয়তো। আমি জানিনা, পাত্তা দেইনা। সবার কাছেই মানুষ আসে। আমি সবাইকে বলেছি তুমি আমার ছোট
চাচা। শুধু আমার রুমমেট রুমকী জানে তুমি আমার প্রাণসখা।
আমি হেসে দেই। ওর হাত ধরে বলি, আজকে একটা সত্যি কথা বলি। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিলো বলি।
ও কাছে এসে বললো, বলো। শুনি সত্যি কথা। সব সময় তো মিথ্যাই বলো।
আমি ওর কানে কানে বললাম, আমার তোমার সাথে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা।
ও আমার সাথে হাসলো। ভ্রূ উচিয়ে বললো, কেন?
আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম, এইজন্য। ইচ্ছামত তোমাকে চুমু খেতে চাই তাই।
অনু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন
বিষন্ন হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বললো, হঠাত একদিন যদি হারিয়ে যাই, আমাকে আর না দেখতে পাও তুমি কি কষ্ট পাবে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা।
ও ওর খালি প্লেটটা মেঝে থেকে তুলে
নিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, বেশি কষ্ট পেওনা জান। কিন্তু শোন, আমি যদি কখনো কিছু না বলে চলেও যাই তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে এভাবে
ভালোবাসবে না। প্রমিজ করো?
সেদিন প্রথমবার অনুভব করলাম, এই মেয়েটা আসলেও আমার গার্লফ্রেন্ড না। সে আমার জীবনের একটা অংশ।
বিদায় নেবার আগে ও জিজ্ঞাসা করলো, আজকাল খুব ব্যস্ত থাকো। কি নিয়ে লেখালিখি করছো?
আমি শুভর কথা ওকে বললাম। মুমুর কথা
বললাম।
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আশ্চর্য, ভালো ঘরের দুটো বাচ্চা এভাবে
রাস্তায় রাস্তায় জীবন কাটাচ্ছে। একজন নিখোজ, আরেকজন মারা গেলো। কারো কোন যায়ই আসেনা? কেউ একটা খোঁজও নেয় নাই?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, এইরকম কত বাচ্চা রাস্তায় ধুকে ধুকে মরছে। কেউ খবর নেয়ার নাই। আমরা
জানিও না। সেইদিন এক হোটেলে ৬ বছরের একটা বাচ্চাকে দেখলাম মানুষের টেবিলের যেয়ে
যেয়ে পানি দিচ্ছে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত টাকা পায় দৈনিক যে বাপ মা এমন কাজ করতে দিয়েছে এইটুকু বাচ্চাকে।
কি বললো জানো? দিনে দুইবেলা খাবার। রাতে শাটার
বন্ধ করে ঘুমাইতে পারে, কারণ ঘর বাড়ি নাই, বাপ নাই। আমরা প্রতিদিন এই বাচ্চাগুলোকে দেখি। এটা আমাদের চোখে খুব
স্বাভাবিক ঘটনা, কারণ বাচ্চাগুলোর পরনে ভালো জামা
নেই। ওরা আমাদের মত ভালো করে কথা বলতে পারেনা তাই ওরা আমাদের সমাজের অংশ না। কেউ
ওদের শিশু মনে করাতো দূরের কথা, মানুষই মনে
করেনা। ওরা মরলো, বাঁচলো - এই ব্যস্ত শহরে কারো তাতে
যায় আসেনা অনু।
অনু হতাশ কন্ঠে বললো, জানি। আমি তুমি সবাই তো আসলে এমনই। ওর বোনটাকে কি খুঁজে দেখবে
একবার। হয়তো কোন এতিমখানায় দেয়া যাবে।
আমি বললাম, হ্যা খুজবো অনু। আমার জানা লাগবে ছেলেটা এমন হিংস্র হলো কিভাবে। ওর
টোকাই বন্ধুদের সাথে কাল একবার যেয়ে কথা বলে দেখবো।
শুভ যেখানে রাস্তায় থাকতো সেখানে
কিছু টোকাই ছেলেকে ওর কথা জিজ্ঞেস করলে কেউ তেমন কিছু বলতে পারলোনা। ওরা বললো, শুভর ভালো বন্ধু ছিলো সাজাহান। ও হয়তো কিছু জানতে পারে। সাজাহানকে
খুঁজে বের করতে আমার প্রায় তিন সপ্তাহ লেগে যায়। ও এখন ঢাকাতে থাকে না। বাধ্য হয়ে
ছেলেটাকে খুঁজতে খুজতে আমি ময়মনসিংহ চলে যাই। সেখানের এক ছোট্ট গ্রাম আঙ্গলদীতে
অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে আমি সাজাহানকে খুঁজে পাই। সেখানে ও আর ওর মা থাকে। কিছুদিন আগে
ওরা শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসে। ওদের বাড়িতে গেলে সাজাহানের মা প্রথমে আমাকে ওদের
পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। এরপর আমি যখন বললাম, শুভ ছেলেটা মারা গেছে থানায় তখন সাজাহান ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে
আসে। এতো ক্ষণ ছেলেটা লুকিয়ে ছিলো। আমি জানিনা ও কেন এতো ভয় পাচ্ছে।
আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওরে মাইর্যা ফেলছে?
আমি ওদের ভাঙ্গা বাসাটা ভালো মত
দেখি।চারদিক কেমন স্থবির। ছোট্ট একটুকরো জায়গা। আশেপাশে ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়িয়ে
আছে, দেখে মনে হয় যেন এমনটাই স্বাভাবিক। আমি কোনরকমে উঠোনের পাশে একটা
বসার জায়গা খুঁজে পাই। সেখানে সাজাহানকে পাশে বসিয়ে আদর করে বলি, ভাইয়া আমাকে তো চেনো তুমি। আমরা মাঝে মাঝে দোকানে একসাথে রুটি
খাইতাম। মনে আছে? আমিও তোমাদের মত গরীব। আমাকে বলো
শুভ কেন একটা লোকের চোখ এভাবে থেতলে দিলো? তুমি ওর পাশে ছিলে যখন এমন খারাপ কাজ করে?
সাজাহান চোখ মুছে বলে, আমি ছিলাম। আমি ওই ব্যাটার মাথাত চেল্লা দিয়া
বাড়ি দিছিলাম। ওয় তখন পেন্সিল দিয়ে গুতাইয়া চোখ তুইল্যা দিছিলো।
সাজাহানের মা হঠাত আমার পা ধরে বলে, ভাই আমাদের ক্ষতি কইরেন না। আপনেগো মত মাইনষের ভয়ে আমরা ঢাকা
ছাইড়্যা পালায় আসছি। আমার পোলায় কিছু বুঝেনা। ওর বয়স কম। আমাগোর আর ক্ষতি কইরেন
না। আমরা আর ঢাকায় যামুনা।
আমি উনাকে আশ্বস্ত করে বললাম, কেউ কিছু জানবেনা। আমি পত্রিকায় লিখি। শুভর কথা লিখলে হয়তো কেউ না
কেউ শুভর মত যারা রাস্তায় থাকে তাদের জন্য কিছু করবে। আমি সাজাহানের কথা কাউকে
বলবোনা আপা। কিন্তু আপনারা যা জানেন বলেন।
সাজাহান চুপ করে বসে থাকে। আমি ওকে
জিজ্ঞাসা করি, আমাকে বলো। কি হয়েছে।
সাজাহান ভয়ে ভয়ে একবার আমার দিকে, একবার ওর মায়ের দিকে তাকায়। আমাকে ঢোক গিলে বলে, ওই ব্যাটায় ইস্কুলে কাম করতো দারোয়ানের। আমাগোরে রাস্তায় দেখলে
ইস্কুলের ভিতর ডাইকা লয়া যাইয়া পেন্ট খুলাইতো। খারাপ কাম করাইতো। কিন্তু আমাগোরে
এইসব করলে ২০ টাকা দিতো। শুভ এইসব করতোনা। তাই ওরে মারছিলো। হেরপর একদিন শুভর অসুক
করে। আমাগোর টাকা ছিলোনা ডাক্তার দেহানের। ওর বোন তখন ওই ব্যাটার লগে যায়গা। রাতে
আইসা আমাগোরে টাকা দেয়। ওই ব্যাটায় মুমুরে অনেক মারছিলো।
আমি সাজাহানের কথা শুনছিলাম আর
লিখছিলাম। আমার হাত কাপছিলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এইজন্য শুভ রাগ করে ওই লোককে মারে।
সাজাহান মাথা নাড়ায়, না হেই লাইগ্যা না। শুভ খুব কানছিলো ওর বোনরে দেইখা। ওর বোন ওরে
বুঝাইছে, ভালা আছে। কিন্তু আমরা বুঝছি, মাইয়াটা খুব কষ্ট পাইছে। ও তো আমাগো থিকাও ছোট্ট।
আমি জিজ্ঞাসা করি, তারপর?
সাজাহান কিছু বলেনা। সামনে তাকিয়ে
থাকে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইলে ও ছ্যাত করে সরে যায়। আমাকে চিৎকার করে
বলে, আপনেরা ধনী লোকেরা খালি কতা কন, কতা আর কতা। আপনেরা সব সার্থপর। আমাগো বয়সী বাচ্চারা বাপ মায়ের
কোলে চইড়্যা স্কুলে যায়। স্কুলের বাহিরে চায়া চায়া দেখি বাচ্চাগুলোরে কেমনে আদর
কইর্যা খাওয়া দেয়, ক্রিম মাইখ্যা
দেয়, গুসল করায়। আমার হাতের দিকে চাইয়া দেহেন, চুলগুলা দেহেন, চামড়া দেহেন।
আমার মায়ে বান্দীর কাম করে, কেউ আমারে তাই ভালাবাসেনা, গোসুল করতে কয়না। আমি রিশকা ঠেইলা, মাইনশের বাজার মাথাত লয়া দুই তিন টাহা পাই। আমারে পুলিস মারে, মস্তানী কইরা হগলে পয়সা লইয়া যাই। আপনেরা আমাগোরে দেখলে ঘিন্না
করেন, রাস্তায় বইয়া থাকলেও কুত্তার লাহান
আমাগোরে লাত্থি মারেন। ক্যান? আমি মানুষ না? আমি আপনাগোরে অভিশাপ দেই, আপনাগো সরকাররে অভিশাপ দেই। আমি আপনাগোরে বিশ্বাস করিনা।*
সাজাহানের কথা শুনে আমার কলম বন্ধ
হয়ে যায়। নিঃশ্বাসটা স্থির হইয়ে আসে। অভিশপ্ত আমি তবু সাহস করে জিজ্ঞাসা করি, ভাইয়া মুমু কোথায়?
সাজাহান কান্না থামিয়ে বলে, হেদিন দুপুর বেলা খেলতাছিলাম। ওই বেটায় আরেক বেটারে লইয়া আইলো
আমাগোর বস্তিতে। শুভরে কয় ওর বোনরে ওগো লগে দিতে। ওরা নাকি পাশের ইস্কুলে লয়া ভালো
খাইতে দিবো। শুভ যাইতে চায়না। ওর বোনটায় তখন পাইপের ভিতরে শুইয়া আছিলো। অসুখ করছে।
ওই বেটার কথা শুইনা বাইরে আইসা আমাগোরে পেট দেখায়। হেরপর ওর ভায়ের পেটে হাত দিয়া
বুঝায় ওর আর ওর ভায়ের ক্ষুধা লাগছে। বৃষ্টির লাইগা হকাল থিকা আমরা কিছু খাইবার
পারিনাই। ওয় ওর ভাইয়ের লেইগা বেশি কানতো। আমাগোরে বুঝাইলো ওয় ওর ভাইয়ের লেগ্যা
খাবার কিন্যা আনবো। ও হেরপর দুই বেটার লগে যায়গা, কইছিলো একটু পর আয়া পরবো। খাওন নিয়া আসবো। শুভ যাইবার দিতে চায়নি।
ওর বোন ওরে বুঝায় যায়গা। মাইয়াডার জর আছিলো। তাও যায়গা।
তোমরা ওকে আর পাওনি? – আমি ভয়ে ভয়ে বললাম।
সাজাহান কেঁদে ফেলে বললো, আমরা পরে ইস্কুলের ওইহানে যায়া দাড়ায়া ছিলাম। ওই বেটায় ইস্কুলের
দারোয়ান আছিলো। ইস্কুলের দরজা ধাক্কাইছি, কেউ খুলেনাই। পরেরদিন যায়া আমরা কাইন্দা ওই বেটারে বহুবার জিগাইছি।
আমাগোরে পঞ্চাশ টাকা দিয়া কইছে, মুমু মইর্যা গেছে। কেমনে মরছে কইতে পারেনা। ওরে পুইত্যা দিয়া আসছে। কাউকে
কিছু কইলে আমাগোরেও পুইত্যা ফেলবে। আমরা ঐ বেডার বাড়িত লুকায় লুকায় গেছিলাম। শুভ
যায়া বহুত বার হাতে পায়ে ধইর্যা জিগাইছে, ওর বোন কই? ওই বেডা পরে আমাগোরে আশুলিয়া লয়া
যায়া পানিত দেখায় কইছে ওইহানে ফালায় দিছে। শুভ বিশ্বাস করেনাই। পত্যেকদিন যায়া ওই
বেডার ঘরের কাছে বয়া ওর বোনরে ডাকতো। আমিও যাইতাম লগে। হেরপর একদিন আমাগোরে ওই
বেডা আরো কয়েকটা পোলা লইয়া অনেক মাইর দিছে। আমার হাত ভাইঙ্গা গেছিলো। আমরা এর
লাইগ্যা একদিন বুদ্ধি কইর্যা মুমুর একটা পেন্সিল আছিলো। ওইটা
দিয়া বুদ্ধি কইর্যা ওইর বেটার চোখ গাইল্যা দিছি। ওর
বেডা আমাগোরে কুত্তা দিয়া খাওয়াইবো কইছিলো, আমরা হের চোখ খাওয়ায় দিছি। লোকজন দেইখ্যা ফেললে আমি পলায় আইছিলাম।
শুভরে কইছিলাম দৌড়াইতে। ও কইলো পরে আইবো। এরপর ওরে সবাই মাইর্যা ধইরা লয়া গেছে। ওয় কি সত্য মইর্যা গেছে? ওয় হারাদিন ওর বোনরে খুজতো। আমারে
কইতো ওর বোন নাকি বাসায় আছে। হের ক্ষুধা লাগছে। হোসনা খালার বাসাত শুইয়া আছে জ্বরে।
চকলেট খাইবার চায়।
শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে
আসলো। আমি সাজাহানকে বললাম, আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া। তোমাদের কথা
কাউকে বলবোনা। শুভ এখন আল্লার কাছে আছে। ইনশাল্লাহ অনেক ভালো আছে। তুমি চিন্তা
করোনা। মুমুকে তোমরা আর পাওনাই না?
সাজাহান মাথা দুইদিকে নাড়ায়। আমি হতাশ
হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই লোকটার বাসায় যখন যেতে কখনো
মুমুর কোন আওয়াজ পেয়েছো? কথা বলছে, কাঁদছে – কিছু একটা? আমি তাহলে হয়তো একবার নিজে পুলিশ নিয়ে যেয়ে দেখে আসতাম।
সাজাহান চোখ বন্ধ করে কান্না করে
বলে, না কেমনে পামু? ওয় তো কথা কইতে
পারেনা, বোবা। এক্কেবারে বোবা।
==================================
*আমার লেখার সাজাহানের বক্তব্যের এ অংশটা সত্যিকারের এক পথশিশুর
কথা। ফটোগ্রাফার আকাশ ভাই এমন এক পথশিশুকে পেয়েছিলেন যে ঠিক এমন করেই আমাদের বাসায়
বড় হওয়া শিশুটির মত ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলো।
সাদ আহম্মেদের সকল গল্প পড়তে নিচের লিংকে যান-