Bangla Golpo: ফাঁসি। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
Bangla Golpo: ফাঁসি। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
সাদ আহম্মেদ
কবীর ভাই হেসে বললেন, সব বুঝে পাকনা বুড়ি। আর তাছাড়া আমার মনের কথা তো ভাই এই বাচ্চাটাকে
ছাড়া আর কাউকে বলার মত নাই।
কবীর ভাই বড় বড় চোখে তাঁর মেয়ের
দিকে তাকিয়ে বলে, মা তুমি সব বোঝো না।
কবীর ভাইয়ের মেয়ে কিছু না বুঝে মাথা
দুপাশে দুলিয়ে বলে, না না।
সেই কবীর ভাই তাঁর মেয়েকে গলা টিপে
হত্যা করে এখন ফাঁসির আসামী বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সেইদিনের ঘটনার পর আমরা
ফ্ল্যাটের সবাই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। কবীর ভাইয়ের মত ভালো মানুষ এমন কিছু করতে
পারে এটা বিশ্বাসযোগ্য ছিলোনা। আমার বাবা সেদিন রাতে বাসায় এসে আমাকে ডেকে বললেন, কবীরের সাথে তুই তো মাঝে মাঝে ছাদে যেয়ে সিগারেট খেতি। তোর সাথে এই
ঘনিষ্টতার কথা ভুল করেও পুলিশকে বলবিনা। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবি, তুই তারে খুব বেশি চিনিসনা। মনে থাকবে?
আমি মাথা নেড়ে চলে আসলাম এবং
পরবর্তীতে বহুদিন শকের উপর ছিলাম। এটা আমার দুর্ভাগ্য যখন উপরের ফ্লাটে শীলাভাবি
চিৎকার করছিলো আমি প্রথম দৌড়িয়ে গিয়েছিলাম এবং তাজরিনের লাশ সোফাতে পড়ে থাকতে
দেখেছিলাম। বাচ্চাটার সারা মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিলো। কবীর ভাই মাটিতে বসে
কাঁদছিলেন। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোনরকমে তাজরিনকে কোলে নিয়ে দৌড়ে
রাস্তায় যেয়ে চিৎকার করছিলাম, ভাই কেউ
বাচ্চাটাকে বাঁচান। রাস্তার লোক জড়ো হয়ে মোবাইলে ছবি তুলা শুরু করলো, কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এক রিক্সাওয়ালা দৌড়িয়ে এসে আমাকে আর
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পাশের ডেল্টা হসপিটালে নিয়ে যায়। ভাগ্যিস ব্যাটার মোবাইল
কেনার পয়সা নেই।
তারপর হঠাত করে কবীর ভাই আমাকে মাস
খানেক আগে জেলখানা থেকে ফোন দেন। আমি দুইবছর পর উনার ফোন পেয়ে খুবই অবাক হয়েছিলাম।
আমার খোজখবর নিয়ে বললেন, আবীর তোমার একটা হেল্প লাগতো ভাই। তুমি
কি একদিন কষ্ট করে পুরান ঢাকায় জেলে আসতে পারবা। সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে আসতে হবে।
আমার ফাঁসি পরের মাসের ২০ তারিখ। তাঁর আগে তোমার সাথে একটু কাজ ছিলো।
আমি কবীর ভাইয়ের উপর রেগে ছিলাম, আবার করুণাও হচ্ছিলো। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করে
বললাম, ভাই আমার সাথে কি কাজ আগে বলেন।
কবীর ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ভাই আমার খুব জরুরী কাজ আছে। আর কেউ নাই ভাই সাহায্য করার। আমারে
শেষবার একটু সাহায্য করো। কবীর ভাই কেঁদে দিলেন বলতে বলতে। আমি উনাকে আর না করতে
পারিনাই। কথা দিলাম দেখা করবো। ফাঁসির আসামী আমার সাথে তাঁর মৃত্যুর সপ্তাহ দুই
আগে কি বলতে পারে এটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
দেখা করার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে
আয়েশাকে ফোন দিলাম। আয়েশা সাধারণত আমার ফোন একবারে কখনো ধরেনা, আজকে ধরলো এবং আমাকে অবাক করলো। ফোন ধরে আমি কিছু বলার আগে ও বললো, আজকে সকাল থেকে কি অদ্ভূত বৃষ্টি হচ্ছে দেখছো? আজকে দেখা করতে পারবা?
আমি বোকার মত বললাম, আমার তো ছাতা নাই। আসতে আসতে ভিজে যাবো।
আয়েশা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ভাগ্যিস তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড না। ভাগ্যিস তুমি আমার সাথে এতোদিন
ধরে ইটিশপিটিশ করার চেষ্টা চালাইলেও আমি গলে যাইনাই। আমি কি ভাগ্যবতী এইরকম একটা
ফাস্ট ক্লাস গেজেটেড গাধার সাথে আমার কোন প্রেম নাই।
আমি হেসে বললাম, তোমাকে ফোন দিছিলাম একটা কাজে। এইসব বৃষ্টি খাওয়ার মুড নাই ভাই।
তুমি কি কষ্ট করে আমার জন্য একটু খিচূড়ি ইলিশ রান্না করে রাখতে পারবা? আমি সন্ধ্যার দিকে তোমার বাসায় যেয়ে খেয়ে আসবো।
আয়েশার মুখের অবস্থা চিন্তা করে তখন
আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, ও ফোনটা কাঁধ দিয়ে কানে চেপে ধরে চুল বাধতে বাধতে বলছে, ইলিশের পিছার কাটা আজকে তোমাকে পানি দিয়ে গিলিয়ে খাওয়াবো। তুমি
একবার আসো বাসায়।
আমি রাত্রি আটটা দশে পৌছে যাবো।
প্লিজ একটু শুটকী ভর্তা রেখো - এটুকু বলে ফোন কেটে দিলাম।
শরীর আজকে খুব ম্যাজ ম্যাজ করছে।
কবীর ভাইয়ের এই ফালতু ঝামেলা না থাকলে আমি বাসা থেকে বের হতাম না। তাছাড়া আমার
আসলেও ছাতা নেই। বৃষ্টি নিয়ে আমার কোন রোমান্টিজম কাজ করেনা। বৃষ্টি আমার কাছে
একটা আপদ। রাস্তায় কাঁদায় মাখামাখি করে হাটা, জামা ভিজে শরীরের সাথে জাপটে থাকা এ সবকিছু আমার বিরক্ত লাগে।
তারচেয়ে বরং আজ কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে। কবিতার নাম দেবো, আজ আমি তোমার হাতে গাল পাতবো। আয়েশা কখনো আমার গালে হাত রাখেনি, একবার ওর হাত ধরেছিলাম রাস্তা পার করতে যাওয়ার সময়। ও ছ্যাত করে
হাত সরিয়ে বললো, এইসব কি রকম লুচ্চামী? আমি তোমার বউ লাগি?
আমার হাত ছাড়িয়ে ও নিজে আমার হাত
ধরে রাস্তা পার হলে আমি রেগে বললাম, আমার হাত ধরছো কেন লুইচ্চা বেটী?
ও হেসে বললো, এই লুচ্চা বলবানা। মেয়েরা কোন ছেলের হাত ধরে থাকলে সেটাকে বলে
ভালোবাসার স্পর্শ। অবশ্য তোমার জন্য এটা করুণাস্পর্শ। যাও এখন এক প্লেট ফুচকা
খাওয়াও।
গত ছয়বছর ধরে আমার একটা বিশ্রিরোগ
হয়েছে। যাই করি সবসময় মনে হয়, আচ্ছা ও যদি পাশে
থাকতো তাহলে কি করতো। কেমন করে ভাবতো। আমার যদি মনটা একটু খারাপ থাকতো ও কি আমার
খসখসে হাতটা আলতো করে ছুয়ে মাহমুদা খাতুনের „সেই মেয়েটি “ কবিতার চারটা
লাইন আবৃত্তি করে শোনাতো,
Bangla Golpo: আজ অতোশির খুশির দিন।
কবীর ভাইকে দেখে আমি প্রথমেই একটা
ধাক্কা খেলাম। উনি আমাকে দেখে হেসে বললো, খুব শুকিয়ে গেছি তাই না?
আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম, তা তো যাবেনই। এখানে মনে হয়না খুব ভাল খাবার দেয়া হয়।
কবীর ভাই মাথা নেড়ে বললো, যা দেয় আলহামদুলিল্লাহ।
আমি খেয়াল করলাম, কবীর ভাইয়ের দৃষ্টি কেমন যেন অস্বাভাবিক। কথা বলার সময় ভয়ংকরভাবে
শরীর কাঁপে। সারা শরীরে কালশিটে দাগ। এই লোক আগে গুচ্চির পারফিউম, লিভাইস এর টি শার্ট ছাড়া জামাকাপড় কিনতোনা। আজকে সেই লোককে দেখে
একটু মায়া হচ্ছিলো। কিন্তু যখনই তাজরিনের মলিন মুখটার কথা মনে পড়লো, প্রচন্ড রাগে ঘৃণায় কবীর ভাইয়ের অসহায় মুখাবয়বে একটা জানোয়ারকে
দেখতে পাচ্ছিলাম।
এইরকম একটা খারাপ মানুষের সাথে
পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকতে খুব ঘৃণা হচ্ছিলো। আমি তাকে বললাম, আমার একটু কাজ আছে। কি কথা আছে বলেন?
কবীর ভাই তাঁর শার্টের পকেট থেকে
একটা এটিএম কার্ড বের করে বললো, আবীর তুমি একটু
কষ্ট করে এই কার্ডটা থেকে টাকা বের করে গ্রামে আমার মা কে পাঠাতে পারবে? কার্ডের পিন নম্বর ৭৬৭৮। দুই লাখের কিছু বেশি টাকা আছে। আমাকে সবাই
এতো ঘৃণা করে, কেউ দেখা করতে আসেনা। আমি আর কাউকে
বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না ভাই। এইটুকু করতে পারবে?
ভদ্রলোকের কথা বলতে যেয়ে হাপানীর মত
টান উঠছে। উনার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আগে ছিলোনা। আমি কবীর ভাইয়ের থেকে কার্ডটা নিয়ে
বললাম, এই সাহায্যটা আপনাকে করবো। কিন্তু
একটা শর্ত আছে। আপনাকে আমি খুব রিস্পেক্ট করতাম। তাজরিনকে নিজের মেয়ের মত
ভালোবাসতাম। শবে বরাতের আগের রাতে যখন ওর জ্বর হলো, আমি সারারাত মসজিদে বসে ওর জন্য দোয়া করছিলাম, নামাজ পড়ছিলাম। আপনি নিজের মেয়েকে কিভাবে মেরে ফেললেন আগে এটার
জবাব দেন। তারপর আমি চিন্তা করবো আপনাকে সাহায্য করা যায় কিনা।
কবীর ভাই হাত জোড় করে একদম মুখস্থ
ছড়ার মত বললো, আমি আমার মেয়েকে চাপে পড়ে হত্যা
করেছি। আমি একজন জুয়াড়ু। জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে সেদিন বাসায় যেয়ে রাগে নিয়ন্ত্রণ
হারিয়ে আমার স্ত্রী এবং আমার মেয়েকে হত্যা চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী আনিসা আক্তার
শীলা আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তাকেও আঘাত করি। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আমি
আমার কন্যাকে গলা টিপে চাপ প্রয়োগ করি। তাতে সে শ্বাস আটকে মরে যায়। এহেন
ঘৃণ্যকর্মের জন্য প্রাপ্য যেকোন শাস্তির জন্য আমি সদা প্রস্তুত।
কবীর ভাই কথাগুলো আমাকে বলছিলেন না।
কাকে বলছেন উনি নিজেও জানেন না। আমি খেয়াল করলাম, এই লোকটা একদমই অস্বাভাবিক হয়ে গেছেন। আমি চলে আসার আগে উনি আবার
ডেকে বললেন, আবীর আর একটা জিনিস। এইখানে একটা
ছবি আছে। এই ছবিটা আমার মেয়েকে দিও। ও ওর বাবার চেহারা যেন কখনো ভুলে না যায়। ওকে
বলো ওর বাবা আল্লাহর কাছে যেয়ে ওর জন্য অনেক দোয়া করে। ভাই, পারলে টাকা তুলে আমার মেয়ের জন্য একটা গলার লকেট কিনে দিও। আমার
মেয়ের খুব ওর মায়ের লকেট পছন্দ ছিলো। প্রায়ই ধরে ধরে খেলতো।
আমি হতভম্ব হয়ে উনার হাত থেকে ছবিটা
নিলাম। কবীর ভাই আর সেই মানুষটা নেই, লোকটা এখন বদ্ধ পাগল। উনার মেয়েটাকে যে উনি নিজের হাতে হত্যা করছেন
সেটাও ভুলে গেছেন। এইরকম একটা পাপ করার পর বোধহয় সেই চাপটা নেয়ার মত মানসিক অবস্থা
উনার নেই। আমি আবার বিশ্বাস অবিশ্বাসের সংকটে পড়ে গেলাম। এমন একটা ভালো মানুষ
কিভাবে পারে তাঁর আড়াই বছরের বাচ্চাকে হত্যা করতে। আমি আগেও বিশ্বাস করতে পারিনি, এখনও পারছিনা। যেদিন বিশ্বাস করতে শুরু করবো, সেদিন থেকে আমিও অসুস্থ হয়ে যাবো এটা নিশ্চিত।
কবীর ভাইয়ের কার্ডে মাত্র ৭৭ টাকা
ছিলো। ব্যাঙ্কে গিয়ে জানলাম, উনার স্ত্রী সব
টাকা তুলে ফেলেছেন আগেই। জানিনা কেন যেন তবুও আমি কবীর ভায়ের গ্রামে যেয়ে উনার
মায়ের সাথে দেখা করতে আসলাম। সাথে ছিলো ৩৮০০০ টাকা। এই সামান্য টাকাটাই আমার দেড়
বছর চাকরীর সঞ্চয়। আমি জানি উনার মা গ্রামে থাকেন একা। আগে কবীর ভাই গ্রামে টাকা
পাঠাতেন, সেটা দিয়েই উনার মায়ের চলতো। বাবা
নেই, তাই একমাত্র ছেলেই গরীব মায়ের একমাত্র সম্বল ছিলো।
কবীর ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি চিনতে
আমার কষ্ট হয়নি। গ্রামে সবাই উনার বাড়িকে খুনীর বাড়ি হিসেবে চিনে। চাচী খুব অসুস্থ
ছিলেন। আমি যখন হাতে টাকাটা দিলাম, উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। আমাকে বললেন, বাবা তোমার নাম কি?
আমি নাম বললে উনি চোখে মোটা চশমাটা
দিয়ে বললো, আমি টাকাটা নিবোনা। এটা একটা মসজিদে
দান কইর্যা দিও। আমার হায়াত নাই বেশি দিন।
এক পোলা আগেই মইর্যা গে্ছে, আরেক পোলা খুন কইর্যা ফাসিতে ঝুলবো দুইদিন পর। আমি টাকা দিয়ে কি করমু বাবা? আমার কিছু লাগবোনা।
আমি উনাকে অনেক বুঝিয়েও লাভ হলোনা।
চলে আসতে যাচ্ছিলাম, উনি আমার হাত ধরে দরজা পর্যন্ত
এগিয়ে দিলেন। বের হওয়ার আগে হাত ধরে বললেন, বাবা আমার এই বাড়িরে সবাই এখন খুনী বাড়ি কয়। অথচ এই গ্রামের কত
মাইনষেরে আমার পোলা বাইচ্যা থাকতে দান খ্যরাত কইর্যা বাচাইছে। কত সম্মান ছিলো আমাগো। আমার ছোট পোলার মত ভালো মানুষ
আর হয়না। ওয় ওর বড়ভাই আর ভাবী শহরে গাড়ি চাপা খাইয়া মইর্যা যাওয়ার পর ওগো তিনমাসের বাচ্চারে নিজের কাছে রাইখ্যা আপন
বাচ্চার মত পালছে, খাওয়াইছে। নিজের বাপের থেকেও বেশি
সোহাগ করছে। ওয় এই বাচ্চারে মারবো, আমি বিশ্বাস করিনা। আমার পোলাটারে সবাই ফাসায় দিয়া মাইর্যা ফালাইতাছে। আমার স্বামী নাই, কেউ নাই। আমার এতো ভালো পোলারে আমি বাঁচাইতে পারলাম না। আমার পোলার
কোন খারাপ নেশা ছিলোনা। ওর বউরে যায়া তোমরা জিগাও, আমার পোলা ওর কি করছিলো। ওয়ই কিছু একটা করছে। আমার পোলারে তোমরা
বাচাও। ওয় আমার সোনার টূকরা পোলা। বিশ্বাস করো বাবা, ওয় কাউরে খুন করবার পারেনা। আমার বাপটারে কেউ বাঁচাও।
ঢাকায় ফিরে আসার পথে সারাটা রাস্তা
আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। তাজরীন যে উনার ভাইয়ের বাচ্চা, নিজের ছিলো না এটা আমি কল্পনাও করিনি আগে। এইরকম একটা মানুষ খুন
করতে পারে আমি কিভাবে কিছু না বুঝে বিশ্বাস করলাম জানিনা। আমরা কত সহজে একজন
মানুষকে বিচার করে ফেলি! নিজের ওপর নিজের ঘৃণা লাগছে।
Bangla Golpo: মেঘের কোনো ঠিকানা নেই।
রাতে ঘুম আসছিলোনা। বারবার কবীর
ভাইয়ের মায়ের আকুতির কথা মনে পড়ছিলো। একটু চোখ লেগে আসলে আমি আবার তিনবছর আগের সেই
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে ফিরে যাই। চিৎকার শুনে আমি দৌড়িয়ে কবীর ভাইয়ের বাসায় ঢুকি।
দরজাটা হালকা খোলা ছিলো। ভেতরে ঢুকে দেখি তাজরিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখটা
সেদিনের মত লাল কিন্তু চোখটা খোলা। বাচ্চাটা ঠোট উল্টিয়ে কাঁদছে। আমি ওর কাছে
এগিয়ে আসলে ও আমার হাত ধরে চোখটা ঘরের এক কোণায় নিয়ে স্থির করে রাখলো। তারপর আমি
ওর দৃষ্টি বরাবর যখন তাকালাম তখন কে যেন মনে হলো মাথায় একটা বাড়ি দিলো। আমার মাথা
দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু রক্তের
রংটা পুরোপুরি লাল নয়। সাদা লাল মিশ্রিত একটা রঙ। কি ভয়ংকর ভয় লাগছে। আতংকে আমার
ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এবং তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো, কবীর ভাইকে আমি ভুল বুঝেছি। সবাই ভুল বুঝেছে।
সকালবেলা আয়েশাকে ফোন করলাম। ও তখন
নাস্তা খাচ্ছে। আমার ফোন আজকে তিনবার রিং হওয়ার পর ও খুব অবহেলা নিয়ে ধরলো। আমাকে
শীতল গলায় বললো, তোমার জন্য আমি কত কষ্ট করে কালকে
ইলিশ মাছ জোগাড় করেছিলাম জানো? এই ধাপ্পাবাজিটা…
আয়েশার কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি
বললাম, আয়েশা একটা ভুল হয়ে গেছে। কবীর
ভাইয়ের কথা তোমার মনে আছে না? উনি আসলে উনার
মেয়েটাকে মারেননি। যে মেরেছে আমি তাকে সেদিন দেখেছি কিন্তু তখন বুঝিনি। একটা
নির্দোষ মানুষের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। আমি জানিনা কি করা উচিত।
আয়েশা বললো, শান্ত হও। তুমি কিভাবে জানো? আচ্ছা ফোনে কিছু বলার দরকার নাই। আমি বাসায় আসছি।
৪৫ মিনিট পর আয়েশা আমার বাসায় এসে
জিজ্ঞেস করলো, বলো কি হয়েছে?
আমার মাথা তখন প্রচন্ড ব্যাথা করছে।
আমি বললাম, চা খাবে? আমার খুব মাথা ধরেছে। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারি নাই। এখন একটা
শব্দ বলতেও কষ্ট হচ্ছে। তুমি ছাদে যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
একটু পর ছাদে যেয়ে আমি আয়েশার পাশে
বসলাম। তারপর বললাম, ভাবীর একটা লোকের সাথে সম্পর্ক
ছিলো। সেদিন ওই লোকটা বাসায় ছিলো। দরজার পাশে লোকটা লুকিয়ে ছিলো। ওর গায়ের লাল
সাদা স্ট্রাইপ দেয়া জামাটা আমি দেখেছিলাম খুব অল্প সময়ের জন্য। তাজরিনকে নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে পড়াতে আমি ব্যাপারটা পরে ভুলে যাই। আয়েশা আমি জানি ওই লোকটার সাথে
ভাবীর সম্পর্ক ছিলো। আমি জানি।
আয়েশা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কিভাবে?
আমি ঢোক গিলে বললাম, উপরে একটা পানির ট্যাঙ্কির রুম আছে। আমি একদিন সন্ধ্যায় সেখানে
লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তখন হালকা আলোতে আমি দেখলাম ভাবি একটা মানুষকে নিয়ে
উপরে আসলো। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কবীর ভাই। পরে দেখি না। আমি পাত্তা দেইনি। একটু পর
ভাবীর অদ্ভূত আওয়াজ শুনে আমি লুকিয়ে নিচে তাকাই। আমি দেখলাম লোকটা ভাবীর হাত ধরে
আছে কেমন করে যেন। এসব দেখে আমি এতো শকড হয়েছিলাম, কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কবীর ভাই আর তাঁর স্ত্রীর ব্যক্তিগত
ব্যাপার চিন্তা করে আমি কখনোও কাউকে এটা নিয়ে কিছু বলিনি। আয়েশা সমস্যাটা হলো
ভাবীর সাথে ছাদে আসা লোকটা যে জামাটা পড়ে ছিলো ওই একই জামাটা আমি সেদিন তাজরিনদের
বাসায় দেখেছিলাম। অল্প একটু ক্ষণের জন্য, কিন্তু আমার অবচেতন মনে সেটা ছিলো। সবার মত আমি ভেবেছিলাম কবীর ভাই
জুয়া খেলায় হেরে মানসিক চাপে এই জঘণ্য কাজটা করেছে। আমি এখন জানি, এই কাজটা উনার না। ওনাকে ফাসানো হয়েছে।
আয়েশা ভয় ভয় চোখে বললো, দেখো তোমার ধারণা হয়তো ঠিক। কিন্তু কবীর ভাইয়ের আর ৪ দিন পর ফাঁসি
হয়ে যাবে। এখন তো আর কিছু করা সম্ভব না। এটা তো জানো তাই না?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে। একটা সাদাসিধে ভালো মানুষের
এভাবে ফাঁসি হতে পারেনা। আয়েশা আমি জীবনেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবোনা যদি কিছু
না করি। আমার কিছু একটা করতে হবে।
আমি পরেরদিন যেই থানায় কবীর ভাইয়ের
নামে মামলা হয়েছিলো সেখানে গেলাম। এ ব্যাপারে আমি কাউকে কিছু জানালাম না। বাবা মা
কে বললে উনারা হয়তো টেনশন করবে। আর বাধাও দিতে পারে এই ভয়ে আর কিছু বলিনি। থানার এ
এস পি আমার ব্যাচমেটের বড় ভাই তুষার সিদ্দিকী। আমি তাকে যেয়ে পুরো ব্যাপারটা খুলে
বললাম। উনি আমার সব শুনে বললো, আবীর তুমি খুব
ভালো করেছো আমাদেরকে জানিয়ে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, উনার ফাঁসি কার্যকর হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি। কারো কাছে কোন
প্রমাণ নেই। তুমি অবচেতন মনে কি খেয়াল করেছো সেটার উপর ভিত্তি করে এমন একটা ফাঁসির
আসামীকে তো মুক্তি দেয়া যাবেনা।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, অবশ্যই জানি ভাই। কিন্তু কিছুদিন পেছানো তো যাবে। উনার পরিবার খুব
অসহায় ভাই। উনার মা ছাড়া কেউ নেই। কেউ কিছু করার নেই। কিন্তু আপনারা চাইলে হয়তো
কিছু একটা পারেন করতে। একটা সাদাসিদে মানুষের বিনা কারণে ফাঁসি হয়ে যাবে ভাই।
তুষার ভাই আমাকে বললেন, তোমরা অনেকে ভাবো আমাদের অনেক ক্ষমতা। আসলে ব্যাপারটা এমন না। আমি
রাষ্ট্রের একজন সৎ কর্মচারী, আমার ক্ষমতা খুব কম।
আমি যদি অসৎ হতাম তাহলে আমার অনেক ক্ষমতা থাকতো। আমি চাইলেও খুব একটা কিছু করতে
পারিনা। কেসটা থানায় অনেক আগেই ক্লোজড হয়ে গেছে। সেসময় কবীর সাহেবের উপর মানুষজন
যে পরিমাণ ক্ষেপে গিয়েছিলো, সরকার বাধ্য হয়ে নারী ও শিশু আইনে
দ্রুত বিচার করে ফেলেছে। আরো অনেক রাজনৈতিক ব্যাপার আছে যা আসলে আমি বলার ক্ষমতা
রাখিনা। যদি খুব বড় কোন প্রমাণ থাকতো আমি চেষ্টা করে দেখতাম। আমার সর্বোচ্চ দিয়ে
চেষ্টা করতাম। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আমি তুষার ভাইয়ের রুম থেকে বের হয়ে
আবার ফিরে এসে বললাম, ভাইয়া একটা প্রমাণ আছে। আমাদের
বাসায় প্রতি ফ্লোরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। ওই লোকটা যাকে আমার খুনী মনে হচ্ছে সে
সেদিন যে রুমেই ছিলো তা কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজ দেখে প্রমাণ করা যাবে। শুধু এটা
দেখলেই হবে আমি যখন কবীর ভায়ের বাসায় ঢুকি তাঁর আগে লোকটা বাসায় এসেছিলো কিনা। ভাই
আপনি চাইলে সম্ভব।
তুষার ভাই হেসে বললো, আবীর তোমার কি মনে হয় আমাদের পুলিশ এসব দেখেনি। আমরা হলিউডের
সিনেমায় দেখানো পুলিশের মত হয়তো স্মার্ট না, কিন্তু তাই বলে বাংলা সিনেমায় দেখানো পুলিশের মত খুনাখুনি শেষ হলে
হ্যান্ডস আপ বলে টুকটুক করে দৌড়িয়েও যাইনা। তারপরও আমি আরেকবার দেখবো এই কেসটা।
তুমি সপ্তাহখানেক পরে এসে যোগাযোগ করো। আমি তোমাকে আপডেট জানাবো। ওকে ভাইয়া?
আমি থানা থেকে বের হয়ে সোজা বাসায়
চলে আসলাম। গত দুদিন ধরে অফিসে যাইনা। অফিসের কলিগ একজন তিনবার ফোন দিয়েছে, ফোন ধরিনি। একটা অসুস্থ বাতাস চারদিকে, এ অবস্থায় স্বাভাবিক মানুষের মত জীবনযাপন করাটা আমার জন্য প্রায়
অসম্ভব। কেউ সেটা বুঝবেনা।
অনেক রাতে আমি শীলা ভাবীর পুরনো
নম্বরে ফোন করলাম। আমার ভাগ্য ভালো, নম্বরটা এখনো উনি ব্যবহার করেন। আমি ফোন করে আমার পরিচয় দিলে উনি
কেমন মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো আবীর?
আমি ঠান্ডা মাথায় বললাম, ভাবী আপনি মাঝে মাঝে ছাদে যেই লোকটার সাথে পরকীয়া প্রেম করতেন, হাত ধরাধরি করে নোংরা কাজ করতেন সেই মানুষটাই কি তাজরিনকে মেরে
ফেলেছে? আমার কাছে কিন্তু ছাদে আপনাদের
একসাথে বেশ কিছু ছবি আছে।
অনেকক্ষণ ফোনের ওপাশ থেকে আমি কোন
শব্দ পাচ্ছিলাম না। এরপর আমতা আমতা করে উনি বললেন, আবীর এইসব কি বলো। আমাকে এমন নোংরা কথা বলার সাহস পেলে কোথায়?
আমি উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে
বললাম, আমি একটা কাজ করি। কবীর ভাইয়ের মত
নির্দোষ মানুষটার আপনার আর আপনার অবৈধ প্রেমিকের করা অপরাধে ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে, আমি নাহয় আপনার অন্তরঙ্গ ছবিগুলো ফেসবুকে আপনার হোমপেজে পোস্ট করে
আসি। এরপর পুলিশকেও দিলাম। আপনারও একটা শিক্ষা হোক, কি বলেন?
শীলাভাবী ফোনের ওপাশে খুব জোরে জোরে
নিঃশ্বাস ফেলছিলো। আমি হেসে বললাম, ভয় পাবেন না ভাবি। আরেকটা কথা। আপনার প্রাক্তন প্রেমিকের লাল সাদা
শার্টটা কি এখনও আছে।? একটু ব্র্যান্ডের নামটা জিজ্ঞেস
করবেন উনাকে? আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো শার্টটা, নিজেও একটা কিনতাম। আমি কিন্তু সব জানি ভাবী, আপনার পরকীয়া প্রেমিক যে তাজরিনের খুনী সেটাও আমি জানি।
এটা শুনে ফোনটা শীলা কেটে দিলো। আমি
জানি, যে অপরাধ করে সে ভীতু হয়। আমি ভীতু
মানুষটার একটা ছোট্ট ভুলের অপেক্ষায় আছি।
Bangla Golpo: অন্ধকার একটি কোমল ছায়া
প্রায় ৪৫মিনিট পর আমার কাছে আবার
ভাবীর নম্বর থেকে ফোন আসলো। ফোন ধরলে কাঁদতে কাঁদতে উনি বললো, আবীর তোমার ভাইয়ের সাথে আমার বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
আমি আমার মামাতো ভাইকে খুব পছন্দ করতাম কিন্তু বাবা মা রাজি হয়নি তাই নিরুপায় হয়ে
আমার কবীরকে বিয়ে করতে হয়েছিলো। কবীর ভালো মানুষ ছিলো, কিন্তু আমার ভালোবাসা ছিলোনা।
তাজরিন কি দোষ করেছিলো? এই অবুঝ বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে পারলেন?- আমি রেগে জিজ্ঞাসা করলাম।
শীলা ভাবী বললেন, ওটা দুর্ঘটনা ছিলো। কিন্তু এর জন্য আমরা কেউ দায়ী নই। তুমি এখন
হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু সব শুনলে তুমি বুঝতে পারবে। তুমি আমার সাথে
একবার দেখা করো আবীর, আমি সব গুছিয়ে বলবো। তুমি যা ভাবছো
তা না।
আমি উনার সাথে দেখা করতে রাজি হলাম।
পরের দিন ভোর সাতটায় খিলগাও মডেল স্কুলের পাশের মাঠে উনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
ঠিক ১০ মিনিট পর কালো বোরখা পড়ে উনি আমার সাথে দেখা করতে আসলেন। আমাকে দেখে বোরখা
থেকে মুখ বের করে বললেন, আবীর ভালো আছো? আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছো তাই অনেক ধন্যবাদ। আমি অনেক কষ্টে
বাসা থেকে বের হয়েছি। বেশিক্ষণ বসতে পারবোনা। তোমাকে আমি সব বলবো কি হয়েছিলো
সেদিন। এরপর তুমি যা ইচ্ছা ভাবো। কিন্তু প্লিজ আমার এসব ছবি তুমি পুলিশকে দিওনা।
আল্লাহর কসম লাগে। তোমাকে আমি ভাইয়ের মত জানি। প্লিজ এমন করোনা।
আমি যথেষ্ট কৌতুহল বোধ করছিলাম।
উনাকে বিশ্বাস করাটা কতটা সমীচিন হবে সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। তারপরও বললাম, আপনি বলুন। আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে এখন আর কিছুই যায় আসেনা। একটা
নিরাপরাধ মানুষের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে আপনার অপকর্মের জন্য।
শীলাভাবি কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললেন, আমরা সবাই নিরাপরাধ। আমি, কবীর, আমার মামাতো ভাই ইশরাক আমরা কেউ
তাজরিনের হত্যার জন্য দায়ী না।
একটু থেমে উনি আমাকে সেদিনের সব
কিছু বলা শুরু করলেন, আবীর তুমি যখন বাসায় আসো তার আরো
দুই ঘন্টা আগে তাজরিনকে হত্যা করা হয়েছিলো। কবীর আর আমার বিয়ের কিছুদিন পর আমি ওকে
জানাই ওর সাথে বিয়ের আগে আমার ইশরাকের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কবীর ব্যাপারটা মেনে
নিতে পারেনি। কিন্তু ও ভালো মানুষ ছিলো, তাই আমার সাথে মানিয়ে নেয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করে। কিন্তু আমার পক্ষে
ওকে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি, এটা কবীর বুঝতো। তবুও আমাকে অনেক
ভালোবাসতো। খুব চাইতো একটাবার যেন আমি ওকে বুঝতে পারি, কাছে আসতে পারি। আমি পারতাম না, কারণ তখন ইশরাক নিয়মিত আমার সাথে দেখা করতো, ফোন করতো। আমি তখনো ভাবতাম ইশরাকের সাথে সংসার কররার। কবীর কিছুটা
জানতো, কিন্তু অপেক্ষা করতো আমার জন্য। এর
কিছুদিন পর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই। কিন্তু বাচ্চাটা রাখার আমার কোন ইচ্ছা
ছিলোনা। ওকে যখন আমি এ ব্যাপারে জানাই, ও খুব রেগে গিয়েছিলো। সেসময় প্রতিদিন আমাদের প্রচুর ঝগড়া হতো, দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। একসময় কবীর বিবাহবিচ্ছেদের
সিদ্ধান্ত নেয়, আমিও রাজি হয়ে যাই। শুধু একটা শর্ত
ছিলো, বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনতে হবে এবং
ওকে দিয়ে দিতে হবে। সেসময় কবীরের সাথে ওর অফিসের ঈশিতা নামে এক কলিগের সাথে সম্পর্ক
হয়। মহিলা বিবাহিত হলেও স্বামীর সাথে দুবছর ধরে কোন সম্পর্ক ছিলোনা। কবীর ঠিক
করেছিলো আমার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলে ঈশিতাকে বিয়ে করবে। ঈশিতার তাজরিনকে নিয়ে বা
আমার পেটে থাকা ভবিষ্যৎ সন্তানকে নিয়ে কোন আপত্তি ছিলোনা। সমস্যা হলো যখন ঈশিতার
মানসিকভাবে অসুস্থ স্বামী সব কিছু জেনে যায়। উনি প্রায়ই কবীরকে ফোন করে হুমকি
দিতেন। ওই বদমাশ লোকটা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী ছিলো, তাই কবীর একটু ভয়ে থাকতো। একদিন লোকটা আমাদের বাসায় আসে আর তখন
ইশরাকও আমার সাথে দেখা করতে বাসায় এসেছিলো। সে প্রথমে বাসায় ঢুকে আমাদেরকে মারধর
করে। তাজরিন তখন ভয়ে পালিয়ে যেতে চায়। লোকটা ওকে আটকিয়ে গলা টিপে হত্যা করে। আমি
বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে মাথায় আঘাত করে বেশ জোরে। আমার মামাতো ভাই তখন রাগের মাথায়
ওই লোককে রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে আঘাত করে। ওই জানোয়ারটার সাথে আমাদের
অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। তারপর আমি আর ইশরাক ওকে মাথায় বাড়ি মেরে ফেলে দেই। সেই
আঘাতে ও মরে গিয়েছিলো তৎক্ষণাৎ। তাজরিনের মৃতদেহ দেখে আসলে আমার মাথা ঠিক ছিলোনা।
সেদিন ঘরে একটা না দুটো লাশ ছিলো আবীর। বিশ্বাস করো আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম
তাজরিনকে বাঁচাতে, পারিনি।
আমি কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে
গেলাম। উনাকে বললাম, আপনি একটা সিনেমার গাজাখুরি কাহিনী
আমাকে শুনালেন আর আমি বিশ্বাস করলাম, এটা তো সম্ভব না। ওই লোক, আপনার প্রেমিক বাসায় ঢুকলো সব তো সিসিটিভিতে দেখা যাওয়ার কথা।
পুলিশ আপনাদের কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি কেন?
শীলা বললো, এই দুর্ঘটনার পরে আমি ভয়ে ভয়ে কবীরকে ফোন দেই জরুরী বাসায় আসার
জন্য। ও বাসায় আসার আগে কিছু জানতোনা। এসে যখন তাজরিনকে মরে পড়তে থাকতে দেখে ওর
মাথা ঠিক ছিলোনা। আমি আর ইশরাক অনেক কষ্টে ওকে কি হয়েছে সব বোঝাই। একসময় ও
সিদ্ধান্ত নেয় আমার পেটের বাচ্চাটার যেন কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য সব দোষ ও ওর কাঁধে
নিয়ে নেবে। আমাদের তখন আর কিছুই বলার ছিলোনা। এর থেকে ভালো উপায় আর কিছুই ছিলোনা।
কবীর নিরাপরাধ ছিলো, কিন্তু ইশরাকেরও তো কোন দোষ ছিলোনা।
কবীর যদি নিজের ঘাড়ে সব নিয়ে নেয়, তাহলে ইশরাক
বেঁচে যাবে, আমি বেঁচে যাবো। পুলিশ কবীরের
স্টেটমেন্ট পেয়ে এ ব্যাপারে খুব বেশি আর ঘাটাঘাটি করেনাই। মাঝখানে অবশ্য আমাকে
পুলিশের তদন্তের দায়িত্বে যে লোক ছিলো সে অনেকদিন ব্ল্যাকমেইল করেছিলো। উনার কাছে
নাকি ক্যামেরার ফুটেজ আছে যেখানে ঈশিতার স্বামীকে বাসায় জোর করে ঢুকতে দেখা গেছে
কিন্তু বের হতে দেখা যায়নি। আমি আমার যা গহনা ছিলো, সাথে কবীরের ব্যাঙ্কের টাকা সব কিছু দিয়ে উনার মুখ বন্ধ রেখেছি।
কিন্তু উনি এখনও টাকা দাবী করেন, আমি দিতে পারছিনা
আর। জানিনা সামনে কি হবে। আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত তার মধ্যে তুমি এসে
হাজির হলে। আমার আত্নহত্যা করা ছাড়া এখন আর উপায় নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোকের লাশটা কি করেছেন?
শীলা বললো, সেদিন লাশটা আমরা কোণার ছোট্ট ঘরটায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। দুদিন পর
এসে আমরা লাশটা একটা স্যুটকেসে ভরে রামপুরা ওভার ব্রিজের উপর থেকে ফেলে দেই। আবীর, বিশ্বাস করো, আমি প্রতিদিন
অপরাধবোধে ভুগি। যে মানুষটাকে একবারও ঠিকমত ভালোবাসিনাই, ক্রমাগত অবহেলা করেছি সে আমাকে আর আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে জীবন
দিয়ে দিলো। সেসময় সবকিছু দুঃস্বপ্নের মত ঘটে গেছে। আমি কিছু করতে পারিনাই।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আপনি অপরাধ করছেন। আপনি কবীর ভাইয়ের মত একটা ভালো মানুষকে
ভালোবাসতে পারেন নাই, এটা অপরাধ না। কাউকে ভালো লাগতে নাই
পারে। আপনি অপরাধ করেছেন বিয়ের পর উনাকে না জানিয়ে আপনার প্রেমিক ইশরাতের সাথে
দিনের পর দিন দেখা করেছেন সম্পর্ক রেখেছেন। এসব করার আগেই আপনার আলাদা হয়ে যাওয়া
উচিত ছিলো। তবে আপনার মত অবিবেচক মানুষের মাথায় এটা ঢুকবে নাকি জানিনা। আপনাকে আমি
একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমার কাছে আপনার কোন ছবি নেই, আপনার প্রেমিক যে একজন খুনী তারও কোন প্রমাণ ছিলোনা। কিন্তু এখন
আমি যেহেতু সব জানি, আমি পুলিশকে সব জানিয়ে দেবো। আমি
আপনাদের নামে মামলা করবো। কবীর ভাইকে যেভাবে হোক আমি বাঁচাবো।
আমার কথা শেষ করার আগেই শীলা আমার
হাতে তার মোবাইলটা তুলে দিলো। আমাকে বললো, ছবিটা দেখো। এই মেয়েটার নামও তাজরিন রেখেছি। দেখতেও কত মিল দেখো।
আমার কিছু হলে এই বাচ্চাটার কি হবে এটা একবার চিন্তা করে যা ইচ্ছা করো। আমি অপরাধ
করেছি বিয়ের পরেও পুরনো সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে। কিন্তু এই বাচ্চাটার অপরাধ কি! এই বাচ্চাটার
জন্যই আমি আর কবীর সেদিন এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কবীর আমাকে কতটা চাইতো আমি
এখন বুঝতে পারি। এই ছোট্ট মেয়েটা এখন আমার সব। তোমাকে আল্লাহর কসম লাগে, এই বাচ্চাটার জীবন নষ্ট করো না। এই বাচ্চাটাকে আমি ছাড়া কেউ দেখার
নাই। যে ভালোবাসাটা আমি কবীরকে দিতে পারিনাই, এই বাচ্চাটাকে তার সবটুকু দিবো। আর আমার সাথে ইশরাকের এখন আর কোন
সম্পর্ক নেই। আমি ছোট্ট একটা চাকরী করে বাচ্চাটাকে নিয়ে বেঁচে আছি। কেউ আমাদের
দেখেনা ভাই আল্লাহ ছাড়া। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। আমি কিছু মনে করবোনা যদি তুমি আমার
কথা পুলিশকে বলে দিলেও। আমি অপরাধী, আমার তো শাস্তি হওয়াই উচিত তাই না?
.
কবীর ভাইয়ের লাশ নেয়ার জন্য আমি আর
কবীর ভাইয়ের মা সকাল থেকে কারাগারের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আঞ্জুমান মুফিদুল
ইসলামের একটা লাশবাহী গাড়ি আমাদের পাশেই ছিলো। দুপুর বারোটায় যখন উনার লাশটা নিয়ে
আসা হয় উনার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুজন পুলিশের সহযোগিতায় আমরা লাশটা গাড়িতে
নেই। কবীর ভাইয়ের মা সাদা চাদর সরিয়ে উনার ছেলের মুখ দেখে একবার আমার দিকে একবার
নিস্পৃহ মুখটার দিকে তাকায়। কবীর ভাইয়ের মুখটা কেমন সাদাটে হয়ে গিয়েছে। আমি উনার
মৃতমুখ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মানুষটা তার একটা বাচ্চাকে হারালো, আরেকটা বাচ্চার মুখটাও দেখতে পারলোনা। সমাজের কাছে সে নিজের
বাচ্চাকে হত্যা করা জঘণ্য খুনি। শুধু আমরা গুটিকয়েক মানুষ জানি, এই ভালোমানুষটাকে বিচার করার অধিকার সমাজ রাখেনা।
সপ্তাহখানেক পর রাতে আয়েশাকে ফোন
করলাম। আয়েশা ফোন ধরে বললো, এতোদিন কোথায় ছিলে? ফোন দিলে ধরোনা, কলব্যাকও করো না।
আমি শুষ্ক গলায় বললাম, আয়েশা আসলে একটা মানসিক ধকলের উপর ছিলাম।
ও জিজ্ঞাসা করলো আমার কি হয়েছে। আমি
আয়েশাকে সব বললাম। সব শুনে বললো, আবীর তুমি যাই
সিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটা সঠিক ছিলো। তোমার এসবে জড়ানোর কথা না। এখন তুমি আর তোমার
নেয়া সিদ্ধান্তকে জাজ করতে যেওনা। হ্যা একটা নিরাপরাধ মানুষের ফাঁসি হয়েছে, কিন্তু সবকিছুই আসলে একটা বাজে ঘটনাপ্রবাহ। উনার স্ত্রীর নামে তুমি
মামলা করলে কবীর ভাইয়ের সাথে এক প্রকার অন্যায় করা হতো। উনার বাচ্চাটা তখন এতীম
হয়ে পড়তো। উনি কি এটা চাইতেন?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, না।
ও তখন আবার বললো, দেখো ওই মহিলা নিজে কি ভালো আছে। তার অপরাধের শাস্তি সে বেঁচে থেকে
পাচ্ছে। এসব ভুলে যাও আবীর। কালকে আমার সাথে দেখা করতে পারবা?
আমি ওর সাথে দেখা করবো জানিয়ে ফোনটা
রেখে দেই।