ভালোবাসার গল্পঃ প্রিয় ইতি সুখে থাকো তুমি। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
ভালোবাসার গল্পঃ প্রিয় ইতি সুখে থাকো তুমি। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম।আমি জানি এই গন্ধটা কেন পাচ্ছি! এটা চেরী ফলের গন্ধ।আমার রুমমেট ইফতিকে জিজ্ঞেস করলাম, “সাত সকালে চেরী দিয়ে কি হবে?” ইফতি কিছু বলে না।আমার হাতে একটা চেরী ফল ধরিয়ে দেয়।আমি হাসি এবং একটা ছোট্ট কামড় দেই। কেমন যেন গন্ধ গন্ধ লাগে, তবুও খেয়ে ফেলি।আজ সকালে আমার নাস্তা করা হবেনা।হা্তে একটা পয়সাও নেই।আম্মা চিটাগাং থেকে কাল ফোন করেছিল।বলেছে আব্বুর এক্সিডেন্ট হয়েছে একটা ছোটখাটো। এখন আম্মুর হাত খালি, তাই একটু কষ্ট করে যেন ম্যানেজ করে নেই।আমি আম্মুকে অনেক উৎসাহ নিয়ে বলি, “কোন সমস্যা নাই মা।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো”।
ইফতি আমাকে আরো দুটা চেরী খেতে দেয়।আমি একটা খেয়ে আরেকটা রেখে দেই।পরে ক্লাস করে এসে ক্ষুদা লাগলে খাবো।ও আমাকে বলে, “দোস্ত আজকে ক্লাস করবোনা”। আমি অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি, “আজকে কি ইমার সাথে ডেটিং আছে?” ইফতি খেক খেক করে হাসে। আমাকে বলে, “ইমা আমার সাথে আজকাল ভালোভাবে কথাও বলেনা বুঝলি।কত রিকোয়েস্ট করছি আজকে দেখা করার জন্য!”
আমি ইফতিকে বলি, “সমস্যা নাই দোস্ত।আরেকটা গার্লফ্রেন্ড বানায় ফেল”। ইফতি আমার কাধে একটা বাড়ি দেয়।ওর কোন শব্দ পাইনা আর ঘরে। আমি বুঝতে পারি ও আর রুমে নেই। আমি আস্তে আস্তে জানালার ধারে হেটে যাই।আমার রুমের জানালার পাশে একটা আম গাছ আছে।আমি প্রতিদিন যখন ইফতি থাকেনা আম গাছের পাতায় হাত বুলাই।আমার মনে হয় গাছটা আমাকে ভালোবাসে।আমি যখনই গাছটা ছুয়ে দেই তখনই একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে যায় আমার চারপাশে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাতে আশেপাশের সব কিছুর গন্ধ নেই।আমার মনে হয় চারদিকে অনেক অনেক আলো।এই আলো আমার অনেক ক্লান্তিকর জীবনটাকে অনেক সহজ করে দেয়।
আমার বন্ধু ইফতির কথা আপনাদেরকে বলি।ইফতি ছোটকালে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিকভাবে হাটার ক্ষমতা হারিয়েছে।আমি প্রায় সময় শুনি ও রাত্রেবেলা কাদে গুটুর গুটুর করে। একদিন তো বিশাল কান্নাকাটি। আমি খুব মন খারাপ করে পাশে বসে ছিলাম।ওর কাধে হাত দিয়ে বলেছিলাম, “দোস্ত কাদিস কেন? কি হইছে?” আমাকে ও বললো, “আজকে ইমা আমাকে বলে ওর ফ্যামিলি নাকি আমাকে কোনদিন পছন্দ করবেনা। আমাকে নাকি ওর বাসায় ল্যাংড়া বলে ডাকে।ও এইরকম কাউকে বিয়ে করতে পারবেনা”।
আমি ইফতিকে কিছু বলতে পারিনি সেদিন।কি বললে ওর কষ্ট কিছুটা কমতো আমি জানিনা।ইমার সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য হলো চেরী ফল।আমাকে একদিন ও ইমার সাথে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটার কন্ঠটা কি মিষ্টি লাগলো।আমি সেদিন ইফতির উপর বেশ ঈর্ষা বোধ করেছিলাম।ইমা অবশ্য আমাকে পছন্দ করেনি একদম। আমাকে বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ করেনা।আমি জানিনা কেন পছন্দ করেনা।তবে আমার খুব ইচ্ছা করে প্রতিটা মানুষকে দেখতে।মানুষ দেখতে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর।সবচেয়ে বেশি লোভ জাগে নিজেকে দেখতে।আমি কি দেখতে ভালো? আমাকে কি কোন এক মানবী একটাবারের জন্যও অপলক চোখে দেখে?এই প্রশ্নগুলো নিজের মনে যখন আসে তখন মনে হয় আমি খুব একা।
আমার চারপাশের অন্ধকার জগতের মাঝে আমি আরো বিলীন হয়ে যাই। রুম থেকে যখন বের হয়ে ক্লাস যাবো ভাবছিলাম ঠিক তখন মনে পড়লো আজকে আমার একটা পরীক্ষা আছে।জুনিয়র ব্যাচের একটা ছেলেকে প্রতিমাসে আমি কিছু টাকা দেই আমার হয়ে পরীক্ষায় লিখে দেয়ার জন্য।পরীক্ষার আগের রাতে তাকে ফোন করে ম্যানেজ করে নিতে হয়।ছেলেটার নাম সজীব।ছেলেটা আমাকে পছন্দ করেনা কারন আমি ওকে খুব বেশি টাকা দিতে পারিনা।মাসে ১ হাজার টাকার থেকে বেশি কিছু দেয়ার সামর্থ আমার নেই।প্রতিবার যখন টাকাটা মাসের ৫ তারিখে ছেলেটার হাতে বুঝিয়ে দেই তখন সে প্রায়ই বলে, “ভাই পরের মাসে কিছু বাড়ায়া দিয়েন।আপনে তো প্রতি সপ্তাহে দুই তিনটা কইর্যা পরীক্ষা দেন”। আমি কাচুমাচু হয়ে বলি, “চেষ্টা করি ভাইয়া।দেখি পরের মাসে কি করতে পারি”। আজকে ক্লাসে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করতে হয় শুভকে।শুভ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।কারণ ও আমাকে কখনো করুণা করেনা, আমাকে আড়ালে কানাবাবা বলে ডাকেনা।ও আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি।তাই ক্লাসের আগে ওকে আমি ফোন দেই।
ও আমাকে রাস্তা পার করে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়।আমি শুভর প্রতি কৃতজ্ঞ।আমার সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটে ক্লাস শেষ করে যখন আমি আর ও একসাথে বসে চা খাই।ও আমার সাথে রাজ্যের নারীঘটিত আলাপ করে, কার সাথে কখন প্রেম করলো সব জানায়।আমি চুপ করে শুনি, মাঝে মাঝে হুম হুম বলি।আমারো তখন অনেক প্রেম করতে ইচ্ছা করে।আমি একটা উদ্ভট কথা প্রায়ই ভাবি।এমন যদি হতো, আমাদের সাথে একটা আমার মতই দৃষ্টিশক্তিহীন মেয়ে পড়ে।তাহলে হয়তো, আমাদের মধ্যে অনেক প্রেম প্রেম হতো।কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছেনা।পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমার মত অন্ধ লোকের এত প্রেম করার শখ কেন? তাদের জন্য বলি, প্রেম সবার জন্য। আপনাদের কাছে আমি হয়তো একজন কানাবাবা ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু আমার মনটা অন্ধ না।আমার মন ভালোবাসা দেখতে জানে। আমার বাবা মা আমাকে মনে হয় তেমন একটা ভালোবাসেনা, আমার কাছের মানুষরা আমাকে একটু কেমন যেন এড়িয়ে চলে।
আমি যখন ভালোবাসা জিনিসটা বুঝতে শিখেছি তখন থেকে মনে হতো, আমাকে কেউ ভালোবাসেনা কেন?অথচ আমার কত ইচ্ছা করতো আমার মা বাবা আমাকে অনেক আদর করুক, মাথায় হাত দিয়ে বলুক, “এটা আমাদের ছেলে”। অবশ্য আমি আমার বাবা মায়ের আসল ছেলে না।তাই আমাকে একটু অবজ্ঞা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমার তখন বয়স ছয় বছর।আমার বাবা আর মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া তখন। আমি ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে আমার ঘরের দরজার কাছে যাই।আমি শুনতে পাই বাবা বলছে, “এতিমখানা থেকে আর কাউকে পাইলানা, একটা ল্যাংড়া কানা বাচ্চা ধরে নিয়ে আসছো”। আমার মা কাদে।বাবাকে বলে, “আমাদের তো কোন ছেলে মেয়ে হচ্ছিলোনা।আমি কি জানতাম এই নিষ্পাপ শিশুর চোখ আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাবে?” বাবা গজগজ করে কি যেন বলে।এর কিছুদিন পর আমার মায়ের কোলজুড়ে একটা নতুন জীবন পৃথিবীতে আসে।তাই বাবা চাইতেননা আমি তাদের সাথে থাকি।আমার মা আমাকে একটু একটু ভালোবাসতো তাই ফেলে দেয় নাই।অবশ্য আমার বোন হওয়ার পর মা আমাকে মাঝে মাঝে অনেক মারতেন।
একদিন আমি আমার ছোট্ট বোনের নাকে হাত দিয়ে দুষ্টুমি করছিলাম।মা দেখে অনেক মারে। আমাকে বলে, “খবরদার আমার বাচ্চার কাছে আসবিনা”। আমি আর কখনো তিতিনের কাছে যাইনি।তিতিন অবশ্য আমাকে অনেক ভালোবাসে।ও আমাকে দেখলে আমার চুল ধরে টানে। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, তবুও এখনো এমনই করে।ওর সব বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আমার পরিচয় করায় দেয়। অনেক আদর করে বলে, “এই দেখ, এই সুইট ছেলেটা আমার ভাইয়া।ভাইয়া একটা হাসি দিয়ে দেখাতো”। আমি লজ্জা পাই, তবুও হাসি। তিতিন ওর বান্ধবীদের বলে, “যারা আমার এই সুইট ভাইয়ার সাথে প্রেম করবি হাত তোল”। আমি জানিনা কেউ হাত তোলে কিনা।প্রায় মনে হতো, একবার জিজ্ঞেস করি তিতিনকে কেউ হাত তুলেছিলো কিনা।জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনো। আমি আমার মা বাবার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।তারা আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন।এটা ঠিক আমাকে কেন যেন আমার স্কুল কলেজের শিক্ষকরা অনেক ভালোবাসতেন।আমি অন্য সাধারণ ছাত্রদের মত পরীক্ষা দিতাম। আমাকে শুধু একটু খাতাটা গুছিয়ে দিতে হতো।আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল আপার কাছে যেদিন আমার বাবা নিয়ে গিয়েছিলো সেদিন তিনি বলেছিলেন, “ছেলে পারবে তো?” বাবা বলেন, “সব পারে আপা।S.S.C তে অপশনাল সহ ৪.৭৫ পেয়েছে।
ক্লাসে স্যারদের কথা শুনে শুনে লিখতে পারবে খাতায়।একটু যদি সহযোগিতা করতেন তাহলেই হয়। ছেলে কালকে থেকে কান্নাকাটি করছে কলেজে ভর্তি করানোর জন্য।“ প্রিন্সিপাল আপা আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন।আমার যেদিন H.S.C এর রেজাল্ট দিলো তখন সারা দেশে মাত্র কয়েকজন 5.00 পেয়েছিলো।আমি তাদের মধ্যে একজন ছিলাম।আমাদের কলেজে একমাত্র ফাইভ।আপা আমার বাসায় এসে পড়েছিলেন।আমাকে ডেকে জড়িয়ে ধরে কেদে বললেন, “বাবারে তুই অনেক বড় হ।আমার যদি সামর্থ্য থাকতো আমি আমার চোখ দুইটা তোকে দিয়ে দিতাম।আমি তোর জন্য অনেক দোয়া করবো”। আমার অনেক কান্না পেয়েছিলো সেদিন।আম্মু আব্বু আমাকে ওইদিন জীবনে প্রথমবার অনেক আদর করেছিলো।আমাকে একটা জামা কিনে দিয়েছিলো।রাতে আমি সেই জামা পড়ে এক রুম থেকে আরেক রুমে হেটে হেটে গান গাইছিলাম।আমার বোন আমাকে দেখে শুধু হাসছিলো।আমি ওর কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তিতিনমণি আমার জামার রঙ কি?”
তিতিন বলে, “লাল রঙ ভাইয়া”। আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়ি, অনেক কাদি। আমার নষ্ট চোখ দিয়ে পানি পড়ে।তিতিনকে বলি, “আমার খুব এই রংটা দেখতে ইচ্ছা করে।আমাকে কেউ দেখতে দেয় না কেন?লাল রঙ কেমন?” তিতিনমণি সারা রাত আমার হাত ধরে কাদছিলো।সেদিন আমি অনেক অনেক মন খারাপ করেছিলাম।আমি আল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি আমাকে জীবন দিলে, কিন্তু জীবনের রংটা দেখতে দিলেনা কেন?” শুভ যখন আমাকে ক্লাসে নিয়ে গেল তখনও স্যার ক্লাসে আসেননি। আজকে হ্যামলেট পড়ানো হবে। কিছুদিন আগে ওথেলো পড়ানো হয়েছিলো।আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস “আ ফেয়ারওয়েল টু দ্যা আর্মস”।আমাকে এই বইটার অডিও উপহার দিয়েছিলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু অনিক।অনিক কিছুদিন আগে কক্সবাজারে ঘুরতে যেয়ে হারিয়ে যায়।ওকে আর কেউ খুজে পায়নাই।ও সমুদ্র দেখতে যাবার আগে বলেছিলো, “দোস্ত তোরে একদিন সাগরে নিয়ে যায়া স্রোতের ধাক্কা খাওয়াবো। জীবনে আর কিছুই চাইবিনা তাহলে”। আমি বলি, “আচ্ছা”। ক্লাসে আমাকে করুণা করে মনে হয় সবাই সামনে বসতে দেয়।আজকে শুভ আমাকে ক্লাসে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো।আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই চলে যাস কেন?” শুভ বললো, “ক্ষুদা লাগছে দোস্ত। আজকে নীরবে যামু কয়েকজন মিল্যা।তুই মন দিয়া ক্লাস কর। আমারে রাত্রে বুঝাবি যা ক্লাসে পরাইছে”। আমি হাত নেড়ে ওকে বিদায় দেই।
আমার চোখে আজকে সকাল থেকে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।পানি এসে জমা হয়ে যাচ্ছে।যত পানি মুছি তত বেশি যন্ত্রণা বাড়ে।এই যন্ত্রণার মধ্যে একটা খুব সন্দর কন্ঠ শুনতে পেলাম।আমার অনেক কাছ থেকে কন্ঠটা আসছে।বুঝতে পারলাম, মেয়েটা ইতি। ইতি খুব সুন্দর একটা পারফিউম ব্যবহার করে।আজকে মনে হয় ও আমার পাশে বসেছে।ইতি মেয়েটাকে আশেপাশে দেখলে আমার মধ্যে কেমন কেমন যেন একটা লাগে।আমার মনে হয় এটা মেয়েটা বুঝতে পারে।ও আমাকে অবশ্য পাত্তা দেয়না।একদিন সাহস করে একটা কলম চেয়েছিলাম।ও অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি লিখতে পারো?” আমি খুব বিব্রত বোধ করেছিলাম। প্রায়ই মানুষজন আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি তাদের মত নই। আমি ইতিকে বলেছিলাম, “ভুলে চেয়েছি।আমি আসলে লিখতে পারিনা”। ইতি আমাকে অবশ্য কলম দিয়েছিলো।আমি ক্লাস শেষে যখন ওকে কলম ফেরত দিতে গেলাম তখন ও আমাকে স্যরি বললো।আমার এতে আরো খারাপ লেগেছিলো। এরপর থেকে ওর সাথে আর কখনো একটিবারের জন্যও কথা হয়নি।একদিন শুভকে বলে ফেলেছিলাম, ইতিকে আমার অনেক ভালো লাগে।শুভ খুব সুন্দর করে সেটা ইতিকে জানিয়ে দিয়েছিলো।ইতি এরপর আমাকে দেখলেও এড়িয়ে যেত মনে হয়।
আমিও ওর আশেপাশে যেতাম না। আজকে ক্লাস শেষে যখন চলে যাচ্ছিলাম ইতি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “তুমি কি এখন লাঞ্চ করবা?” আমি মাথা নাড়ি।ও নিজে থেকেই আমাকে বললো, “আজকে আমার জন্মদিন।আমি যদি আজকে তোমাকে লাঞ্চ করাতে চাই তুমি রাগ করবে?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।মুখ দিয়ে হুম জাতীয় আওয়াজ করে বুঝাতে চাইলাম, “কোন সমস্যা নাই”। ইতিকে নিয়ে যখন লাঞ্চ করতে গেলাম তখন ক্যান্টিনে কোন খাবার ছিলোনা তেমন।ইতি আমাকে বললো, “তোমার জন্য একটা পিৎজা নিয়ে আসি?” আমি মাথা নাড়ি।যদিও ভার্সিটির পিৎজা আমার একদম ঘিন্না লাগে খেতে, কিন্তু ওকে তো এই অবস্থায় এটা বলা যাবেনা। আমি চুপ করে বসে থাকি।ও আমাকে বললো, “তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?” আমি একটা ধাক্কা খেলাম।কিছু না বলে ভাব করলাম এমন যেন কিছু শুনতে পাইনি।ইতি আমাকে বললো, “আচ্ছা তোমাকে কিছু বলতে হবেনা।লজ্জা পাচ্ছো কেন এত?” ইতি কেন যেন অনেক হাসতে লাগলো।আমাকে ফিসফিস করে বললো, “আমাকে কেউ কখনো ভালবাসেনি জানো?” আমার মনে হলো মেয়েটার মন খারাপ।আমি তাকে কি বলবো জানিনা।আমার মাথায় এত বুদ্ধিও নেই কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে তার মন ভাল করে দেয়ার মত।আমি আমতা আমতা করে বললাম, “মন খারাপ হওয়া ভালো না।হার্টে সমস্যা হয়”। ইতি আবারো হাসে।আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে তোমার কি অনেক সুন্দরী মনে হয়?” আমি অসহায় বোধ করি।
ওকে বলি, “আমি জানিনা ইতি।তুমি কেন এমন করছো?” ইতি কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, “আমাকে যেদিন শুভ বললো তোমার আমাকে অনেক ভালো লাগে তখন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।আমার কখনো মনে হয়নি আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারে”। আমি বললাম,” তুমি ভাল মেয়ে তো! কেন কেউ ভালোবাসবেনা?” ইতি কেমন করে যেন বললো, “আমি দেখতে অনেক কালো তো, তাই আমাকে কেউ ভালবাসেনা।একটা ছেলেকে অনেক ভালবাসতাম। কালকে রাতে সে আমাকে একবারও উইশ করেনাই।আমি তাকে নির্লজ্জের মত ফোন দিয়েছিলাম। তাকে কিছু বলার আগেই সে জানালো অনেক ব্যস্ত আছে।আসলে জানো, ও এখন একটা মেয়ের সাথে প্রেম করে।মেয়েটা অনেক কিউট”। আমার অনেক মন খারাপ হলো।কেন যেন মনে হলো তাকে বলি, তুমি আরো অনেক কিউট।কিন্তু আমি বলতে পারলাম না।পিৎজায় একটা কামড় দিয়ে বললাম, “তুমি অনেক ভালোবাসো ছেলেটাকে?” ইতি কি সুন্দর করে হাসলো।আমি দেখতে পাইনা তবুও ওর হাসির আওয়াজ শুনে অনেক অনেক ভালো লাগলো।আমি কি তাকে বলবো যে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমি পারফিউম ব্যবহার করি একটা। পারফিউমটার গন্ধ ঠিক ওর গায়ে দেয়া পারফিউমের মত।
আমি কতরাত মনে মনে ওর হাত ধরে বলেছি, ভালোবাসি।আমি কতদিন বৃষ্টির ঝাপটায় নিজেকে সিক্ত করেছি শুধু তাকে অনুভব করতে।ও তো অনেকটা বর্ষার মন খারাপ করা বৃষ্টির মত।ওটা আমাকে ছুয়ে দিয়ে যায় সব উষ্ণতা মুছে দিয়ে।আমি সেই বৃষ্টিকে অনেক ভালোবাসি, নিজেকে উজাড় করে দেই সেই শীতল জলস্পর্শে যার প্রতিটি ফোটায় আমি পুলকিত হই।আমি অনুভব করতে পারি পৃথিবীর প্রতি আমার গভীর ভালোবাসাকে।প্রিয় ইতি, তোমাকে কথা দিচ্ছি সেই বৃষ্টির থেকেও আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসবো।আফসোস এটা তাকে বলার মত অধিকার আমি রাখিনা। ইতি যখন আমাকে আমার হলে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো তখন আবার সে একটা বিব্রতকর প্রশ্ন করলো।আমাকে বললো, “আচ্ছা অর্ক তোমার কি আমার জন্য অনেক ভালোবাসা?” আমি মাথা নিচু করে হাসি।তাকে দুষ্টুমি করে বলি, “হা অনেক তো”। ইতি আমার গালে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলে, “তুমি অনেক মিষ্টি একটা ছেলে।তোমার সাথে প্রেম করবো।করবা?” আমি সেদিন নিস্তব্ধ থেকেছিলাম।শুধু মাথা নাড়িয়ে সাহস করে তার হাতটা ধরেছিলাম। আমি অনুভব করেছি আমার ভালবাসার স্পর্শে তার কেপে কেপে ওঠা।
আল্লাহ যদি আমাকে একটু দেখতে দিতো, আমি সবার আগে আমার ভালোবাসার এই মানবীকে দু চোখ ভরে দেখতাম। তার চোখ দুটো একটাবার ছুয়ে দিতাম।তাকে বলতাম, “আজকের এই পৃথিবী শুধু তোমার আমার”। পরের একটি বছর আমার জীবনে শুধু ইতি আর আমি, আমি আর ইতি।ও প্রতিদিন আমাকে নিয়ে ক্লাসে যেত।আমার বন্ধু ইফতি আমাকে এজন্য প্রতিদিন অনেক টিজ করতো।শুধু ইফতি না আমার আরো কিছু বন্ধু আমাকে নিয়ে দুষ্টুমি করতো।আমি কিছু বলতাম না।আমরা একটা মহাকালের কাহিনী লিখতাম। আমি যা লিখতাম তাতে ইতি থাকতো সবগুলো পাতা জুড়ে।ও সবসময় আমার হাত ধরে থাকতো। ক্লাসে আমার পাশে কাউকে বসতে দিতোনা।আমি ওকে মাঝে মাঝে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা শোনাতাম।জীবনানন্দের কবিতা আমার খুব প্রিয়।প্রাণের কবির একটি একটি করে কবিতা ও আমাকে যখন শোনাত তখন মনে হত, এত ভালোবাসার আলো কেন চারদিকে। আমি দরিদ্র ছিলাম তাই ওকে কিছু কিনে দিতে পারিনি তেমন।তবে একদিন টাকা জমিয়ে একটা নুপূর কিনে দিয়েছিলাম।ও নুপূর পড়ে আমার সামনে এসে রিনঝিন আওয়াজ করতো।আমার তখন যে অনুভূতি হতো তা হয়তো কাউকে বোঝানো যাবেনা।কষ্ট একটাই ছিলো, ইতি কখনো আমাকে বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে। আমি জানিনা সে বাসতো কিনা। জানতে ইচ্ছাও করেনাই।যদি এমন কিছু শুনি যে আমার মনটা ভেঙ্গে যায়, তবে তো সব হারালাম। একদিন ইতির অনেক মন খারাপ।
আমি চুপ করে তখন টি.এস.সিতে বসে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম।ইতি আমাকে বললো, “তোমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়না কেন আমার মন খারাপ?” আমি ওকে বললাম, “তুমি হয়তো বলবানা, তাই কিছু জিজ্ঞেস করছিনা”। ইতি বলে, “আমার মন খারাপ কারণ কাল ও আমাকে ফোন করেছিলো। আমাকে বললো, সে আমাকে ভালোবাসতে চায়”। আমি একটা ধাক্কা খেলাম।ওকে কি বলা উচিত ভাবছিলাম।তার আগেই ও বললো, “আমি ওকে কি বলবো অর্ক?” আমার গলা তখন শুকিয়ে গেছে। অনেক কান্না পাচ্ছে। তবুও আমি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম, “ওর কাছে যাও।ওকে আগে জিজ্ঞেস করে নিয়ো, ও তোমাকে ভালোবাসবে তো সবসময়?” ইতি কাদে। আমাকে বলে, “আমাকে ও কত কষ্ট দিছে তুমি জানো।প্রতিটা রাতে আমি ছেলেটার জন্য কাদি।ও আমাকে এতদিন পরে ভালোবাসার কথা বলে কেন?আমি যে এত্তগুলা কষ্ট পাইলাম সেটা কে দেখবে?” আমি হেসে বলি, “তুমি বিয়ে করে ওকে কাদিয়ো।ঠিক আছে?” একদিন ইতির বিয়ের দিন।সেই বিশেষ দিনে আমি আর মনমরা ইফতি হলের ছাদে উঠে বসে আছি। ইফতি আমাকে বলে, “দোস্ত ইমাকে ফোন দিছিলাম আজকে।ও আমাকে গালাগালি করলো।আমি ওকে কি করে বুঝাবো যে তাকে ভুলা সম্ভব না?” আমি ইফতির উপর রাগ করি।ইমার বিয়ে হয়ে গেছে তিনমাস হলো। ইফতির তো মেয়েটাকে ফোন করা উচিত না।আমি ওকে রাগত স্বরে বলি, “তুই ছ্যাচড়ার মত করিসনা।ওর বিয়ে হইছে।আর ফোন দিবিনা”। ইফতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তুই বুঝবিনারে গাধা।মাঝে মাঝে মনে হয় শ্বাস আটকায় আসতেছে।ওর গলা না শুনলে মরেই যাবো।শালার ভালোবাসা! জীবনটা হেল কইর্যা দিলো”।
আমি ইফতির কথা শুনিনা।আমি ইতির কথা ভাবি।আমি কেন এত গাধা ছিলাম! আমার মত দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষকে ইতির মত চমৎকার একটা মেয়ে কেন ভালবাসবে?আমার চারপাশে এত অন্ধকার যে আমি সেখানেই বারবার হারিয়ে যাই।এমন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ভালোবাসতে নেই। হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হলো।আমি বৃষ্টির ঝাপটায় নিজেকে যখন মেলে ধরলাম তখন একটা আশ্চর্য অনুভূতি হলো।আমার মনে হলো আমি যেন দেখতে পাচ্ছি আশেপাশের জগতটাকে।আমাদের মাথার ওপর নাকি একটা বিশাল চাঁদ আছে, সেই চাদের রঙ রুপালী।সেই চাঁদ মাঝে মাঝে স্বর্গকে আমাদের মাঝে এনে দেয়।আমরা স্বর্গকে নিজ হৃদয়ে ধারণ করি, তাতে বসবাস করা জোৎস্নার আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করি।আজকে হয়তো সেই জোৎস্নাকে আমি দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে মনে ইতির জন্য কবিতা সাজাই, আজকের চাঁদ তোমার আমার তাতে জমে থাকা সবটুকু আলো আমাদের ভালোবাসার গল্প বলে তাদের স্নিগ্ধ রুপালী আলোয় আমি ইতিকে সেই রুপালী আলোর গল্প বলতে চেয়েছিলাম।আমি সেই রুপালী আলো দেখতে পাইনা, কিন্তু তাকে অনুভব করি আমার অন্তরে।আজকের এই বৃষ্টিঝরা গভীর রাতে কেউ ভালোবাসার গল্প লিখুক আর না লিখুক, আমি ইতির জন্য লিখবো।শুধু লিখবো, “প্রিয় ইতি সুখে থাকো, ভালো থাকো”।
.
সাদ আহম্মেদ
Read More