ভালোবাসার গল্পঃ আমি খুঁজে ফিরি কাউকে। লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ

 



ভালোবাসার গল্পঃ আমি খুঁজে ফিরি কাউকে

লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ


সাবেরার সাথে আমার পরিচিত হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলোনা। কিন্তু টিউশনী ছেড়ে দেয়ার পর ছাত্রের মা নতুন একটা টিচার এনে দেয়ার জন্য এমন অনুরোধ করলো যে আমার কিছু করার ছিলোনা। এমআইএসটি এর একটি ফেসবুক পেজে আমি তাই পড়াইতে আগ্রহী টাইপ পোস্ট দেয়ার এক ঘন্টা পর সাবেরা আমার মোবাইলে কল করে বলে, তুমি কি আবীর না আমাদের ক্লাসের। আমার টিউশনীটা খুব দরকার। এটা কি এখনো আছে? এই মেয়ের সাথে আমার মনে হয়না কেউ কোনদিন প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলেছে। ওকে দেখলেই মনে হয় এই মনে হয় একটা আজেবাজে ঝাড়ি দিলো।

 

আমি ওকে ছাত্রের বাসা চিনিয়ে দেয়ার জন্য আজকে ইউনির ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে আছি এটা জানলে পরের দিন থেকে ক্লাসে সবাই আমাকে ক্লাস থেকে ব্যান করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।এই মেয়ে গত এক সেমিস্টারে তিনটা ছেলেকে ক্লাসে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে। আমি একবার ক্লাসে যেয়ে ওর সাথে চোখাচোখি হওয়ায় ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভালো আছো? ও আমার দিকে না তাকিয়ে খাতা বের করতে করতে স্যারের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করলো যার অর্থ দাঁড়ায়, তোর ভদ্রতার খ্যাতা পুড়ি। যাই হোক, সাবেরার সাথে দেখা হলে আমি ওকে বললাম ধানমন্ডী ২৭ নং বিকল্প বাসে চড়ে যেতে হবে। তারপর পাঁচ মিনিট হাটা পথ। যেতে পারবে?

 

সাবেরা আমার দিকে না তাকিয়ে একটু হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো, ধন্যবাদ। সমস্যা নেই। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আফসার আমার দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং এর একটু সামনে দাঁড়িয়ে। খেয়াল করলাম ও সাথে সাথে মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন করলো। আমি ইয়াল্লাহ ইয়াল্লাহ বলতে বলতে সেখান থেকে দ্রুত পলায়ন করার চেষ্টা করলাম। সামনে একটা রিকশা দেখে ঝুপ করে উঠে সাবেরাকে মিউমিউ করে ডাক দিলাম, ইয়ে এক রিকশায় যাবা? সাবেরা রিকশায় উঠে আমার পাশে বসে বললো, অন্য রিকশা নিবো কেন? আমি মাথা নেড়ে নিজের কলঙ্কিত মুখ যতদূর সম্ভব নিচু করে ভার্সিটি থেকে মিরপুর ১২ নম্বর ক্রস করলাম।

 

আমার মেজাজ বেসম্ভব খারাপ। সেইদিন সাবেরাকে যদি আউলায় ভুলায় বলতে পারতাম যে ছাত্রের টিচার ঠিক হয়ে গেছে তাহলে আজকে আর এই অবস্থা হতোনা। সাবেরাকে আমি সারাটা পথ আর একটা কিছু বললাম না। বাস থেকে নেমে যখন রাপা প্লাজা ক্রস করবো তখন ও আমাকে বললো, আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? আমি মাথা নেড়ে বললাম, ইয়ে এই গলি দিয়ে দুই মিনিট হাটলেই হবে। ও মাথা নেড়ে বললো, নাহ এই কথা না। আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম তুমি এমন মন খারাপ করে আছো কেন? আমি তোমার সাথে আসলাম ব্যাপারটা কি খুব আপত্তিকর ছিলো তোমার জন্য? আমি ভয় পাইলাম। কি বলবো না বুঝে ডানে বামে আকাশে বাতাসে তাকিয়ে গাধার মত বললাম, আজকে খুব গরম পড়ছে তাই না?

 

এই কথাটা স্কুল জীবনে ইংরেজীর মহাশিক্ষক জাহাঙ্গীর স্যার বলতেন। আমরা সবাই উত্তরে স্যারকে সুর করে বলতাম, জ্বী স্যার। স্যার খুশি হয়ে বলতেন, এই গরমে তোদের আমার গ্রামের বাড়ির আম কাঠালের গল্প বলি। আমরাও খুশি হয়ে যেতাম যে আজকে বাড়ির কাজ করিনাই বলে বেতের বাড়ি খেতে হবেনা। স্যারের মাইরের স্টাইল খুব ইউনিক ছিলো। স্যার প্রথমে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, বাবারে মারতে ভালো লাগেনা। কিন্তু কি করবো, তোমরা হলো শাখামৃগ। তোমাদের একটু ডলা দিলে মনে হয় জগতে একটা ভালো কাজ করলাম। দেখি তোমার পিছনটা উচু কর। এইখানে বাড়ি দিলে ব্যাথা লাগে কিন্তু শরীরে ক্ষতি হয়না। মাইর দেয়ার পর স্যার মন খারাপ করে আবার বলতেন, শিক্ষক যেখানে মারেন সেই জায়গায় জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করেনা।

 

আমি আহলাদে গদগদ হয়ে ভাবতাম, যাক বাবা আমার পিছনটা স্যারের হাতেই এতো নির্যাতিত হয়েছে যে জাহান্নাম কেন জান্নাতে প্রবেশ একবারে শিউর। বাকি শরীরের কি হবে জানিনা। আমার ঘরজামাই মামা মাঝে মাঝে মামীকে খুশি করতে বলতো, বউ যেখানে যেখানে রাগ করে আঘাত করে সেখানে জান্নাতের আতরের সুবাস আসবে মৃত্যুর পর। আমি তাই এখন বউয়ের হাতে বাকিটা ছেড়ে দিছি আর কি। মূলকথায় ফিরে আসি। আপাতত আমি সাবেরা নামক এই দজ্জাল মহিলার সামনে মূলার মত দাঁড়িয়ে আছি। সাবেরা আমাকে বললো, আবীর চলো যাই। ঐটাই তার সাথে আমার শেষ কথা। আমি এরপর নীরবে ওকে ছাত্রের বাসায় বুঝিয়ে দিয়ে পরেরদিন ক্লাসে কি কি অপমান হতে হবে সেগুলো ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে গেলাম।

 

এরপর দেড় মাস তার সাথে ক্লাসে, হাটে ঘাটে মাঠে, ল্যাবে, সাগরে সমুদ্রে নদীতে যেখানেই আমার দেখা হয়েছে আমি তাকে মুখ নিচু করে মনে মনে সালাম দিয়ে চলে আসছি। সাবেরাকে কি আমি খানিকটা ভয় পাই? পাঠক স্বীকার করতে লজ্জা নাই, ছোট্ট খাট্ট এই কাঠখোট্টা মেয়েটাকে আমি সিরিয়াস ডর খাই। মাস খানেক আগে এক ছেলে ওর মোবাইল ধরেছিলো বলে সে ওই ছেলেকে পুরা ক্লাসের সামনে চিৎকার করে যেভাবে বেইজ্জত করছে আমরা সবাই তারে ভয় খাই। ওর মাঝে এমন কিছু একটা আছে যার জন্য ওর সাথে কথা বলতেও অস্বস্তি বোধ হয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওর হয়তো কিছু একটা সমস্যা আছে। আমার সিক্রেট ক্রাস প্রিয়াংকা যাকে আমি ঢং করে প্রিয়া ডাকি ওকে একদিন জিজ্ঞাসা করছিলাম সাবেরাকে নিয়ে।

 

প্রিয়া আমাকে বললো, ওরা মেয়ে পার্টিও ওর সাথে খুব একটা মেশেনা। তবে মেয়েটার অর্থনৈতিক সমস্যা আছে এবং হয়তো পারিবারিক সমস্যা আছে। এইজন্য হয়তো এরকম করে। প্রিয়ার ব্যাপারে কিছু বলার নাই। ও খুব চিকন স্বরে এমন মিষ্টি করে কথা বলে যে আমি ও যতবার আমার দিকে তাকায় কথা বলে আমি গলিত বিগলিত হয়ে বাষ্প হয়ে উঠি।তাকে পছন্দ করি এই কথাটা আমি কখনোও বলিনি।বলাটা এই জীবনে সম্ভবও না।ওকে আমি কোনভাবে আমার দুর্বলতাটাও বুঝাতে পারিনা। খুব বেশি হলে আমি গদগদ হয়ে জিজ্ঞাসা করি, কোণ আইস্ক্রিম খাবা? আল্লার দুনিয়ায় এত্ত কিছু থাকতে আমি কেন ওরে এই কথাটাই শুধু বলি আমি জানিনা।

 

ও আমাকে একদিন হেসে জিজ্ঞাসা করে, আবীর তোমার আব্বুর কি কোণ আইসক্রিমের ফ্যাক্টরী আছে? আমি প্রিয়াকে নিয়ে মহা বিপদে আছি। সিনিয়র, ক্লাস মেট এমনকি কতিপয় অতি সাহসী জুনিয়রও ওকে দেখলে এমন একটা ভাব নিয়ে কথা বলে যে চাহিবা মাত্র এই হৃদয় তোমারে দিতে বাধ্য থাকিবে। সব লুচ্চাগুলা ওর আশেপাশে ঘুরে।মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয়ে আমি বাসায় যেয়ে ফুল সাউন্ডে প্রাচীন কালের রক বাংলা শুনতাম , এই জ্বালা জ্বালা জ্বালা এই অন্তরে।নাহ মনের জ্বালা মিটতোনা। আমি ওর আশেপাশে প্রেম প্রেম ভাবওয়ালা কাউকেই সহ্য করতে পারতাম না। আমার ভালো লাগতো ওর সাথে একা একা বসে একটু কথা বলতে, সময় কাটাতে।

 

সে বিশেষ একজন ছিলো।এই কথাটা তাকে বলা দরকার ছিলো, খুব দরকার। যাই হোক অনেকদিন পর সাবেরার সাথে আমার আবার কথা হলো। সে ক্লাস গ্যাপে আমি যখন ক্যান্টিনে বসে প্রিয়ার জন্য এক চেয়ার ছেড়ে অপেক্ষা করছিলাম তখন হঠাৎ কোথা থেকে যেন এসে সেই চেয়ারে বসে পড়লো। আমি ওকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়ায় সালাম দেবার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। এরপর আরেহ এইটা তো সাবেরাএকথা ভেবে নিজেকে সামলিয়ে ওকে মলিন মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, আজকে ক্লাসে খুব গরম লাগছে তাই না? সাবেরা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

 

এই মেয়ে হাসতে জানে, ও খোদা মোরে ধর।সে আমাকে বললো, তুমি টিউশনীটা ম্যানেজ করে দিলে, আমি তোমাকে ঠিকমত ধন্যবাদটাও দিতে পারিনি। যদি কিছু মনে না করো, আজকে কি আমি তোমাকে খাওয়াতে পারি ক্যান্টিনে। কালকে আমি বেতন পেলাম তো, তাই ভাবলাম তোমাকে একটা ছোট্ট ট্রিট দেই। আমি ঢোক গিলে বললাম, কোন সমস্যা নাই। ট্রিট না দিলেও চলতো। সে আবার হাসলো। বললো, না চলতো না। আবীর আমি বাঘ ভাল্লুক টাইপ কিছু না। তুমি এমন করে আমার সাথে কথা বলছো কেন? আমি বললাম, না আসলে তোমাকে একটু ডর লাগে।

 

ও আমার দিকে সিরিয়াস দৃষ্টিতে তাকিয়ে এরপর হো হো করে হেসে বললো, তোমরা পোলাপাইন সব একেবারে ফার্মের মুরগী টাইপ হয়েছো। আমি যে গ্রাম থেকে আসছি ওখানে তোমাকে নিয়ে গেলে ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে করায় দিতো। আমি এবার সত্যিই হাসলাম এবং বুঝলাম সাবেরা আমার বন্ধু হতেই পারে। অদ্ভূত হলেও সত্য এর কিছুদিন পর আমি আর ও দুইজন দুইজনকে তুই সম্বোধনে কথা বলা শুরু করলাম। অনেকটা গলায় গলায় বন্ধুত্ব টাইপ। আমার সৌজন্যে আমার অন্য বন্ধুদের সাথেও সাবেরার খানিকটা বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সাবেরার একটাই সমস্যা ছিলো।

 

সে মাঝে মাঝে খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে মানুষকে পচায় দিতো। যেমন কয়েকদিন আগে বন্ধু শান্ত ইএমই বিল্ডিং এর চিপায় যেয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। সাবেরা সেখানে যেয়ে বন্ধুকে বললো, শান্ত আমাকে তোমার বিড়িটা একটা টান দিতে দিবে। সাবেরাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে সত্যিই তাই চাচ্ছে। শান্ত খুব কুল ভাব নিয়ে ওকে সিগারেট বুঝায় দিলো। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সাবেরা বিড়ি নিয়ে সত্যি সত্যিই একটা টান দিলো এবং এরপর শান্তকে বললো, খুব বিচ্ছিরি। আমাদের গ্রামে একটা পেট খারাপ কুত্তা ছিলো। ওটা মাঝে মাঝে বিভিন্ন খারাপ লোকের বাসায় যেয়ে হাগু দিয়ে আসতো রাতের আধারে। একদম ওইরকম গন্ধ। বিশ্বাস করো।

 

শান্ত এরপর চাইলেও সাবেরা আশেপাশে থাকলে সিগারেট ধরাতে পারতোনা। এমনকি আমাদের পাশেও ও যখন সিগারেট ধরাতে চাইলে আমরা ওকে মশকরা করে বলতাম, দোস্ত একটা হাগুটাইপ গন্ধ পাইতাছোস তোর মুখে? আমি সাবেরাকে কখনো ওর পরিবার নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। একদিন ও ইউনির একটা প্রোগ্রাম শেষে যখন বেশ রাত করে বাসায় যাচ্ছিলো আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর বাসায় কেউ কিছু বলবেনা? ও একটু গম্ভীর হয়ে বললো, আমার বাসায় কেউ নাইরে চিন্তা করার মত? আমি ইতস্ততবোধ বোধ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ও আচ্ছা। সবাই কি গ্রামে?

 

ও মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমার কেউ নেই আসলে। আমি একপ্রকার এতিম। আমি শহরে থাকি একটা মহিলা হোস্টেলে। আমার সাথে থাকে বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজ করা সহজ সরল মেয়েরা। যেখানে থাকি ওখানে আমি একমাত্র ছাত্রী। খুব ইচ্ছা করে ভালো একটা বাসায় থাকতে, অথবা হোস্টেল। কিন্তু উপায় নেই। টাকা শর্ট। সাবেরার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, ওর চেহারার মধ্যে খুব দুঃখী দুঃখী একটা ভাব। আমি সেদিন ওর সাথে আর কোনকিছু নিয়েই কথা বলিনি। কিছুদিন আগে আমি সাহস করে আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রিয়াকে দাওয়াত দিলাম ধানমন্ডির আমেরিকান বার্গারে।

 

এই কাজটা করার জন্য আমি দীর্ঘ সময় প্রস্তুতি নিয়েছি। বহু নির্ঘুম রাত আমার কেটেছে তাকে প্রস্তাব দেয়ার জন্য। তো আমি যেদিন মিনমিন করে ক্লাসের ফাকে তাকে বললাম, পরদিন বিকেলে সে ফ্রি আছে কিনা ও হেসে বললো, কেন কোণ আইসক্রিম খাওয়াবা?আমার তো ঠান্ডা লেগেছে। আমি বললাম, ইয়ে না। নতুন একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ খুলেছে আমেরিকান বার্গারের, ধানমন্ডিতে। তাই ভাবলাম বন্ধুদেরকে বলি একসাথে একদিন ওখানে বসা যায় কিনা? ও আমাকে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে।

 

কাল তাহলে দেখা হবে। আমি মনে মনে খুশিতে গদ্গদ হয়ে ওকে বললাম, ওইখানে কোণ আইস্ক্রিম নাই। আমি বাহিরে থেকে নিয়ে আসবোনে। ও কিছু না বলে হেসে চলে গেলো।আর আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম ওকে কিভাবে আমার ভেতর টগবগ করে ফুটতে থাকে ফুটন্ত ভালোবাসার কথা বলা যায়।পরদিন বিকেলে আমি যখন আমেরিকান বার্গারে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন ও আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে বললো, ওর গলায় কফ হইছে। ও আসতে পারবেনা। আমার মন অনেক খারাপ হইলো। অনেক বেশি। নিজেকে কেমন যেন ছাগল মনে হচ্ছিলো।

 

এইসেই ভাবতে ভাবতে ধানমন্ডি লেকে চলে গেলাম। রবীন্দ্র সরোবরে চুপ করে বসে আমার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিলো। আমি কেন ওকে আসতে বললাম আজকে। কেন ভাবলাম যে সে আমার কথায় টুকটুক করে হেটে চলে আসবে। ও আমাকে পছন্দ করেনা। এই ব্যাপারটা আমি এত্তদিনেও ধরতে পারিনি। সে হয়তো আমাকে এখন ব্যাক্কল ভেবে ফাজলামী করতেছে। এসব যখন চিন্তা করে আমার সাদা কালো জার্সিটার কোণায় সেলাই ছিড়ছিলাম তখন সাবেরা পিছন থেকে এসে খানিকটা চিৎকার করে বললো, কিরে তুই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতেছিস কেন?

 

আমার চোখে তখন আসলেও পানি ছিলো। কিন্তু আমি ফিচফিচায় কাঁদতেছিলাম না। কিন্তু তখন মনটা এতোটাই খারাপ ছিলো যে রাগ করার মত পরিস্থিতি ছিলোনা। আমি ওকে গম্ভীর হয়ে বললাম, সাবেরা এইখানে কি করতাছিস এখন? ও হাতে বাদামের প্যাকেট নিয়ে আমার পাশে বসলো। তারপর হাতে একটা বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো, আরেকটু সামনেই তো ছাত্র পড়াই। পড়ানো শেষ হলে প্রতিদিন এখানে চলে আসি। আমার এই জায়গাটা খুব প্রিয়। আগেও আসতাম।একদম ছোট্টকালে বাবা নিয়ে আসতো। আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, তুই না গ্রামে থাকতি। ও মাথা নেড়ে বললো, হ্যা থাকতাম।

 

৬ বছর বয়সে গ্রামে থাকতে গিয়েছিলাম। এর আগে ঢাকাতে থাকতাম এই ধানমন্ডিতেই। আমি ও করে একটা শব্দ করলাম। ওর সাথে আর এইসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা। ভাবছিলাম উঠে চলে যাই। প্রিয়াকে একটা তুখোড় মেসেজ পাঠাতে হবে। এমন একটা মেসেজ যাতে সে বুঝতে পারে আমি অনেক কষ্ট পাইছি। তার এমন করাটা উচিত হয়নাই। আবার কেন যেন কিছুই করতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা। মনে হচ্ছিলো কারো সাথে এই ব্যাপারে একটু আজেবাজে প্যাচাল পাড়ি। সাবেরা ভালো অপশন না। ওর সাথে পড়াশোনা ছাড়া খুব কম বিষয়ে খোলাখুলি কথা হয়। সাবেরা অবশ্য একটুপর নিজ থেকেই জিজ্ঞাসা করলো, তোকে দেখে মনে হচ্ছে মন খারাপ। আমাকে বলে বিরক্ত করার দরকার নাই অবশ্য।

 

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, সবার থেকে সব কিছু প্রত্যাশা করা উচিত না তাই না? সাবেরা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এত্ত বড় দীর্ঘশ্বাস এই সত্যি উপলব্ধির জন্য। আমি জানিনা তোর এমন কি প্রত্যাশা ভেঙ্গেছে। কিন্তু সত্যি কথা বলি, তোর এইসব প্রেমপিরিতী টাইপ দুঃখ দেখলে হাসি পায়। আমি মেজাজ খারাপ করে বললাম, তোকে কে বলছে এইটা প্রেমজনিত কোন কিছু। সাবেরা বললো, কুল সাজার চেষ্টা করোনা। এইভাবে এমন একটা রোমান্টিক জায়গায় এসে তুমি ঘাসের ডগা ছিড়তে ছিড়তে বুক চাপড়ায় হাহাকার করবা কি ডায়রিয়া হওয়ার শোকে। জীবন কি এইটাই এখনো তোরা জানিস না, বুঝিস না। আমি ওকে থামিয়ে বললাম, সাবের ভাই তোমার এইসব সিরিয়াস কাবজাব শুনতে ভালো লাগতেছে না।

 

তুমি তার থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি খাও। আমি যাই। সাবেরা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো, একটা গল্প শুনবি। পাঁচ মিনিট নিবো। এরপর তুই তোর রাস্তায় চলে যাস। হবে? আমি উঠে যাচ্ছিলাম। আবার বসলাম। গল্প শুনি। নিশ্চয়ই কোন ইন্সপায়ারিং গল্প বলবে।আমার এইমুহূর্তে এইসব শোনার মুড না থাকলেও কেন যেন চুপ করে বসে বললাম, বলে ফেল। সাবেরা বাদাম ফেলে হাত ঝেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, একটু ভাব নিয়ে বলি হা। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে বললো, একটা ছোট্ট মেয়ের গল্প বলবো। ওর বাবা ওকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে চারদিক অন্ধকার থাকলেও জেগে জেগে দেখতো। একদিন মেয়েটা ঘুম ভেঙ্গে বাবাকে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, বাবা কি দেখো?

 

বাবাটা বললো, মা আমি একটা পরী দেখি। আল্লাহ আমার গরীব খানায় একটা চাঁদের আলো দিয়ে বানানো পরী দিছে। ওইটাকে প্রাণ ভরে দেখি। সেই বাবাটা মাঝে মাঝে তার মেয়েটার অসুখ করলে রাত জেগে ওর পাশে শুয়ে ওকে দোয়া কালাম পড়ে ফু দিতো। মেয়ের মা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতো, এরকম অতিরিক্ত করো কেন? বাবাটা বোকাবোকা হাসি দিয়ে বললো, আমার ছোট্ট মা তো তাই। বাবাটা প্রায় দিন ঘুমিয়ে থাকলে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতো কখন মেয়েটা জেগে উঠে তাকে দেখে একটা সুন্দর হাসি উপহার দেবে। মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে যখন ঘুম পাড়াতো এঘর ওঘর ঘুরে তখন মেয়েটা একদম ঘুমাতে চাইতোনা। কারণ মেয়েটা চাইতো

 

বাবা যেন তাকে আরো গান শোনায়, আরো চুমু খায়। সাবেরা এটুকু বলে থেমে গেলো। আমি খেয়াল করলাম ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টুপটুপ করে। ও হাত দিয়ে জল মুছে বললো, বুঝছিস আমি ছিলাম আমার বাবার সবকিছু।তারপর কি হলো হঠাৎ করে বাবাটা অসুস্থ হয়ে কেমন যেন হয়ে গেলো। কিছু তার মনে থাকেনা। কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে থাকে। মাসখানেকের মধ্যে এমন অবস্থা দাড়ালো বাবাকে বেধে রাখতে হতো। ব্যবসায় কিছু একটা সমস্যা হয়েছিলো। আমি ছোট্ট ছিলাম একদম, কিচ্ছু বুঝতাম না। বাবা খুব চিৎকার করতো মাঝে মাঝে। মাথা ধরে বলতো, যন্ত্রণা, ব্যাথা। আমি সামনে গিয়ে দাড়ালে শুধু একটু চুপ হয়ে থাকতো। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।

 

আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার কাছে চলে যেতাম। বাবা কাউকে না চিনলেও আমাকে চিনতো, আমাকে আঙ্গুল দিয়ে ছুয়ে দিতো। এর মাস ছয়েক পরে একদিন মামারা এসে মাকে বাসা থেকে নিয়ে গেলো। আমিও মায়ের সাথে চলে গেলাম ওই বাসায় আমার পাগল বাবাটাকে ফেলে রেখে। মাকে মামারা আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিলো। কিন্তু মায়ের নতুন সংসারে আমার কোন স্থান ছিলোনা। আমার এক মামা গ্রামে জমি দেখা শোনা করতো। সবাই আমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিলো।আমি অনেক কাদতাম বাবাকে দেখার জন্য। মা মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে কথা বলতো।

 

আমি মা কে জিজ্ঞাসা করতাম, আমার বাবা কই? বাবার কাছে আমাকে একবার নিয়ে যাও। জানিস আবীর, আমার বাবার কান্নার শব্দ প্রতিদিন আমি শুনতে পেতাম। দেখা যেত, গভীর রাতে আমি ঘুমের মধ্যে হাসফাস করে কাঁদছি বাবার জন্য।আমি স্বপ্নে দেখতাম বাবাকে কেউ ধরে নিয়ে খুব মারছে আর আমি সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি। বাবাকে বারবার ধরতে চাচ্ছি কিন্তু কে যেন আটকে রেখেছে। এর থেকে খারাপ স্বপ্ন আর হয়না। তারপর সেই মামার বাসায় খুব মারধোর খেয়ে বড় হলাম। আমার মামী ছিলো ইয়া মোটা একটা মহিলা। উনার কোনকিছুতে রাগ হলেই আমাকে ধমাধম মারতো। আমার কষ্ট লাগতোনা খুব একটা। আমি ছাত্রী খুব ভালো ছিলাম।

 

মার অনুরোধে তাই আমার পড়াশোনাটা ঠিকই চলতো। এসএসসির পর মামা আমার একটা বিয়ে ঠিক করলেন। আমার রেজাল্ট অনেক ভালো ছিলো, ইচ্ছা ছিলো ঢাকায় এসে একটা ভালো কলেজে ভর্তি হবো। কিন্তু মামা একদিন থাপ্পড় দিয়ে বললো, পাগল ছাগলের মাইয়ার আবার ঘোড়ারোগ হইছে। আমি বাসা থেকে দুই তিনবার পালিয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিবার আমাকে ধরে আনা হতো আর প্রচুর মারা হতো। আমি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে ঘরের দরজা আটকে বসে থাকতাম। একদিন রাতে যেই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো সে দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে শেষ করে দিলো। জানিস আমার বেশি কষ্ট কেন হয়েছিলো সেদিন?

 

আমার বেশি কষ্ট হয়েছিলো আমার বাবাটার জন্য, নিজের জন্য না। আমার মনে হচ্ছিলো বাবা সব দেখছে, সব জানছে। আমাকে কেমন দুধে ভাতে মানুষ করেছিলো। বাবা কিভাবে সহ্য করবে তার আদরের মেয়ে যার গায়ে কখনও একটা আচড় লাগতে দেয়নি সে আজকে এভাবে... সাবেরা ফুপিয়ে কাঁদছিল, আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর কান্না দেখে আমারও খুব কান্না পাচ্ছিলো। সাবেরা হাত দিয়ে ওর মুখ ঢেকে বললো, এরপর প্রতিরাতে আসতো মদ খেয়ে, মাতাল হয়ে। আমাকে নির্যাতন করার আগে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ওই শূয়োরের বাচ্চা বলতো, বিয়া করবিনা ঠিক আছে।মজাটা লইয়া ল... আমি সাবেরাকে মাটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর মামা মামীকে বলিসনাই?

 

সাবেরা পাগলের মত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলতো, ওরা সব জানতো রে। আমি প্রতিদিন মারা যেতাম ওরা জানতো। কিন্তু কিছু বলতোনা, বাধা দিতোনা। ওদেরকে টাকা দিতো।জানিস আমার সারা শরীরে এখনও ওদের মারের দাগ আছে। কিন্তু আমার ভেতরটা এতবার রক্তাক্ত হয়েছে, কখনও মনে হয় আর ঠিক হবেনা। সেইসময় নিজেকে আমার খুব ক্ষুদ্র মনে হতো। এত্ত তুচ্ছ একটা অস্তিত্ব মনে হতো, আমি আত্নহত্যা করতে চাইতাম। অনেকবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারিনি। সাহস হয়নি। তবে ঠিক ঠিক একদিন পালিয়ে গেলাম। বেশ কিছু টাকা চুরি করেছিলাম।

 

আমার এক স্কুল বান্ধবী ঢাকায় ওর চাচার বাসায় আমাকে থাকতে দিয়ে সাহায্য করেছিলো। ওরা আমাকে একটা মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করিয়েছিলো। জানিনা কিভাবে সুস্থ হয়েছিলাম। পড়াশোনা আবার শুরু করলাম। একা একা এই ধূলোর শহরে বাচার জন্য লড়াই করছি। আমি সাবেরার হাত ধরে বললাম, আমি খুব স্যরি। তোকে কি বলবো বুঝতে পারছিনা আসলে। তুই এত যুদ্ধ করে এই জায়গায় আসছিস, আমি হলে পারতামনা। তুই কতটা গ্রেট তুই জানিস না। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। সাবেরা আকাশের দিকে সেই তারা খুজতে খুজতে বললো, এত্ত কিছু হয়ে গেলো আমার। সব কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু একটা কষ্ট ভুলতে পারিনা জানিস। সাবেরা কথা বলতে পারছিলোনা।

 

ও ধরা গলায় বললো, বাবার স্পর্শটা মনে করতে পারিনা। মাত্র পাঁচ বছর বয়স ছিলো তো। একটা ছবি আছে আমার কাছে, মার থেকে নিয়েছি। জানিস আমার কিন্তু ঠিকই মনে আছে বাবা পিঠে আদর করে যে গানগুলো শোনাতো সেই গানের সুর। বাবা অসহায় দৃষ্টিতে যখন ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো সেই অসহায় চোখগুলো। আমি এই কষ্ট নিয়ে বাঁচতে পারিনা। আমার বাবাটা এই দুনিয়ার সব থেকে ভালো বাবা ছিলো। ঢাকায় এসে আমি মার থেকে ঠিকানা নিয়ে বাবাকে খুজতে গিয়েছিলাম। জানতে পারলাম বাবা পাগল হওয়ার পর তার ভাই বোনরা তাকে ঠিকমত দেখে রাখতে পারতোনা।

 

একদিন নাকি বাবা ওই বাসা থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলো। এরপর আর কেউ জানেনা বাবা কোথায়। সাবেরাকে আমি কৌতুহলো হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর সাথে এত কিছু হলো। তোর মা তো বেঁচে ছিলো। উনি কিছু করলেন না কেন? সাবেরা চোখ মুছে বললো, মা নতুন সংসার সেখানে তার দুই বাচ্চা নিয়ে খুব ব্যস্ত।আমার তার সাথে আমার ব্যাপারে কিছু বলতেও ইচ্ছা করতোনা। আমি বোধহয় মাকে খুব অপরাধী ভাবতাম। এইতো কয়েকদিন আগে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। কিভাবে যেন জানতে পেরেছিলেন গ্রামে আমার সাথে কি নির্যাতন হয়েছিলো। আমার থাকার জায়গায় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলো খুব। আমি কিছু বলিনি। আমি কারো কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করিনা। মার কাছেও না।আমি বুঝি মায়ের এখন নতুন একটা জীবন আছে। সে ভালো থাকুক তার নতুন সংসার নিয়ে।

 

আমাকে টাকা পয়সা দিতে চেয়েছিলো। আমি না করে দিয়েছি। জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা শিখিয়েছে তা হলো, নিজেরটা নিজে করে নাও। আমি সাবেরাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর বাবাকে এখনো খুজিস? সাবেরা উঠে দাড়ালো। আমাকে চোখ মুছে বললো, এইজন্যইতো এখানে প্রায় দিন আসি।বাবা আমাকে প্রায়ই এখানে নিয়ে আসতো। কোলে নিয়ে ঘুরতো। জাহাজ বাড়িটার কাছে একটা লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করে। বাবা তিনটাকার ঝালমুড়ি কিনে আনতো। তারপর আমরা দুইজন মজা করে খেতাম। আমি ওকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ তাহলে জানেনা তোর বাবা কোথায়? তুই হাসপাতাল, থানায় খোজ করে দেখতে পারিস। আমি সাহায্য করবো? সাবেরা হেসে বললো, নাহ তোর কিছু করতে হবেনা। শুধু যা বললাম এগুলো নিয়ে কারো সাথে কোন কথা বলিসনা।

 

অবশ্য বললেও আমার আর যায় আসেনা। এক শহর অবজ্ঞা নিয়ে বাস করতে করতে আমার এখন বেশ সয়ে গেছে। এখন যাইরে। আমি মাটি থেকে উঠে দাড়িয়ে ওকে বললাম, শোন কিছু মনে করিসনা। আমি কি তোর বাবার ছবিটা একবার দেখতে পারি? সাবেরা ব্যাগ থেকে লেমিনেটিং করা একটা ছবি বের করে দিলো। আমি মোবাইলে ওটার একটা ছবি তুলে বললাম, আমিও এখন থেকে খুজবো। সাবেরা আমার অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে বললো, তুই অনেক ভালো রে দোস্ত। আমি যাই। হোস্টেলে যেয়ে আজকে রান্না করে খাওয়াতে হবে অনেককে। সেইদিনের পরের এক সন্ধ্যায় আমি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। পথে এক পরিচিত বৃদ্ধ ফকিরকে দেখে তার পাশে বসে পড়লাম। ফকির আঙ্কেলকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি।

 

আমাদের বাসায় যেকোন মিলাদ মাহফিলে উনাকে জানালেই হয়। উনি উনার দল নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। আমাকে দেখলেই একটা ফোকলা হাসি দিয়ে বলতেন, কি বাজান ভালা আছো? আজকে যখন উনার পাশে রাস্তায় বসলাম তখনোও উনি আমার দিকে তাকিয়ে সেই পরিচিত হাসিটা দিয়ে বললো, বাজান শরীর ভালা? আমি হাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা পলিথিনে মোড়ানো পিঠা বের করে বললাম, চাচা আম্মা আপনার জন্য দিছে। দুপুরে খাইছেন নাকি হোটেলে খাওয়াইতে নিয়ে যাবো?

 

চাচা হাসিমুখে বললো, আজকে একটা আজিব কিছ্যা হইছে। রাস্তার ওইপারের একটা হোটেল আছেনা, অইহানের পাশ দিয়া যাইতাছিলাম। ক্যাশে যেই বেডা বসে অয় আমারে দেখলেই হুরহুর করে। আইজকা আমারে নিজে থেকে ডাইক্যা কইলো, চাচা শরীর ভালা? আমি হাইসা কই, খারাপ নাই। তুমি ভালা আছো? বেডায় আমারে কয়, চক্ষে তো কিছু দেখেন না। এইহান লইয়া প্রতিদিন হাইট্যা যান দুপুরে, কষ্ট হয়না? আমি কই, আমার খুব খুদা লাগে তাই তোমার হোটেলের পাশ দিয়া হাইট্যা যাই। তোমার পাক করা খিচুড়ির গন্ধ পাইলে মনে হয় আমার মায়ে রানছে ৭০ বছর আগে যেমনে রানতো।

 

খুব ভালা লাগে, তাই দাওয়াত না থাকলে তোমার হোটেলের পাশ দিয়া একটু হাইট্যা যাই। এই কথা শুইন্যা বেটায় আমারে ধইর্যা ভিতরে বসায় খাওয়াইছে। কইছে প্রত্যেকদিন দুপুর হইলে যেন ওর লগে বইসা খাই। দুইটাকা কইর্যা দিতে হইবো। আইজকা বাজান বুঝলা অনেকদিন পর পেট পুইর্যা খাইছি। আইজকা রাতে উপাস দিমু। বেশি খাইয়্যা ফেলাইসি। আমি আবীর প্রায়দিন কত খাবার নষ্ট করি, মায়ের যত্ন করে বানানো রান্না ভালো না লাগলে ওয়াক ওয়াক করে ফেলে দেই।আর এই লোকটা একবেলা রাস্তার পাশের ময়লা ছনের হোটেলে খেয়ে কি শান্তিতে পেটে হাত দিয়ে আছে। অবাক হয়ে ভাবি, আমিই তো আসল ফকির। এতো প্রাচুর্য্য, আভিজাত্যে থাকি।

 

প্রায় দিন পাঁচ পদের খাবার দিয়ে ভাত খাই, কিন্তু কখনো এত আরাম করে এই চাচার মত হাসতে তো পারিনা। চাচার হাতে একটা চকোলেট দিয়ে বললাম, খাবার পর ডেজার্ট লাগে। এই হাতে দিলাম একটা ডেজার্ট। আমার মাথায় চাচা হাত বুলিয়ে বললেন, বাজান আমি এইটা আমার নাতির জন্য লয়া যাই? ও তিনদিন ধইরা খুব একটা ভালো চকোলেট খাইতে চাইতেছিলো। আমি হাসিমুখে আরেকটা চকোলেট ধরায় দিলাম। জানি এটাও উনি উনার নাতির জন্যই নিয়ে যাবেন। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া দুই বছরের মেয়েটাকে উনি কিভাবে এতো ভালোবাসেন জানিনা। যার কিছু নেই, টাকা পয়সার মোহ যাকে ধরতে পারেনি সেই হয়তো জানে একটা ছোট্ট বাচ্চাও তার জীবনে কতটা প্রয়োজন হয়ে উঠতে পারে। তাইতো সে ভালোবাসতে পারে। মন থেকে পারে। আমরা পারিনা হয়তো।

 

চাচাকে একটু পর বললাম, চাচা আমি আসলে একটা উপকার চাইতে আসছিলাম। আপনি বলেছিলেন আপনাদের একটা সংঘটন আছে যেখানে ঢাকা শহরের লাখো ফকির সদস্য হয়ে আছে। আমি একজনকে খুজছি। সে আজ থেকে প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে পাগল অবস্থায় বাসা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো। আমার মনে হয় উনি এখন ভিক্ষা করেন। চাচা চিন্তিত চোখে বললো, কাইলকা তোমারে নিয়া যামু আমাগোর অফিসে। একটা ছবি নিয়া আইসো। হয়তো খুইজ্যা পাওন যাইবো।

 

সন্ধ্যার দিক কইরা আইসো। আমি পরের দিন ঠিকসময়ে চাচার কাছে চলে যাই। উনি আমাকে উনার অফিসে নিয়ে যান। আমি মোবাইলে তোলা ছবিটা উনাদের সংগঠনের আরেক চাচাকে দিলাম। উনি চাইলে ছবিটা কয়েকটা প্রিন্ট করেও উনার হাতে বুঝিয়ে দিলাম। সাথে আমার ফোন নম্বরটাও দিলাম। উনি আশ্বাস দিলেন যদি খোজ মিলে আমাকে জানাবেন। আপাতত উনি ঢাকা ও আশেপাশের শহরগুলোতে ছবিটা ছড়িয়ে দেবেন এবং এরপর খুজে দেখবেন। এরপর অনেকদিন কেটে যায়। টার্ম ফাইনালের কিছুদিন আগে প্রিয়াংকা আমাকে একদিন ফোন করে বলে, আবীর কেমন আছো? তুমি কি ইলেক্ট্রোম্যাগন েটিকসের কোন নোট করেছো?

 

অনেকদিন পর আজকে ওর সাথে কথা বলছিলাম। আমার জন্মদিনের পর ওর সাথে কখনো দেখা হলেও কথা বলিনি। যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেছি। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা।ওকে দেখলে খারাপ লাগতো। খুব খারাপ লাগতো। আমি জানিনা কারো কারো জন্য কেমন করে এতো মায়া হয়। ওর জন্য হতো। আমি জানি এটা ও কখনো বুঝবেনা। এটা ভেবে আরো অনেক খারাপ লাগতো।যাই হোক, ও যখন আমাকে নোটসের কথা জিজ্ঞাসা করলো আমি একটু চিন্তা করে বললাম না করিনি। করার ইচ্ছা নেই আপাতত। ও কিছুক্ষণ চুপ থেকে তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিলো ঠিকমত বাই না বলেই। ওর অপেক্ষাটা ছিলো হয়তো আমি যদি ওকে কিছু বলি তার জন্য। কিন্তু আমার বলার ইচ্ছা ছিলোনা।

 

আমার শুধু মনে হচ্ছিলো ও কখন ফোনটা রাখবে। একটা দূরত্ব হয়ে গেছে হয়তো। এর দুদিন পর আচমকা ওর সাথে দেখা হয়ে গেলো ক্যান্টিনের সামনে। আজকাল ওর সাথে দেখা হলে আমি চোখ সরিয়ে অন্য দিকে চলে যাই। আজকে ওর সাথে প্রিতি ছিলো যে আমাকে দেখেই বললো, আবীর দৌড়ায় কই যাও ভাই। একটু দাঁড়াওআমি দাঁড়িয়ে দুইজনকেই হাই দিলাম। তারপর কিছু হয়নি এমন ভাব করে প্রিতিকে বললাম, না সানি আমার জন্য ভিতরে অপেক্ষা করছিলো তো তাই আরকি একটু দ্রুত যাচ্ছিলাম। আজকে তোমাদের গ্রুপের ল্যাব আছে? প্রিতি হেসে বললো, কি জন্য দৌড় দিছো তা তো জানি। যাই হোক ল্যাবের জন্যই বলতাছিলাম।

 

স্যার একটু আগে মেসেজ দিছে আজকে ল্যাবটা হবেনা। তোমাকে জানায় দিলাম, তুমি অন্য যাদেরকে পাও একটু বলে দিও। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন প্রিয়া আমাকে বললো, কালকে আমার বাসায় সবার দাওয়াত। যদি পারো তাহলে চলে এসো। আমি কৌতুহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের দাওয়াত? প্রিয়া বললো, কালকে ছোট বোনের জন্মদিন আর তোমাদেরকে কখনো বাসায় দাওয়াত দেইনি। তাই ভাবলাম। দুপুরের দিকে চলে এসো। আমি মাথা নেড়ে বললাম, স্যরি কালকে একটু ব্যস্ত থাকবো। আশা করি কালকে তোমার একটা সুন্দর দিন যাবে। তোমার ছোট্ট বোনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিও আমার তরফ থেকে। আমি আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলাম। রাগ লাগছিলো। ও কি ভাববে না ভাববে তাতে আমার কিছু যায় আসেনা কেন জানি। সাবেরার সাথে একটু পর দেখা হলো মেজাজ খারাপ অবস্থায়।

 

ও প্লাজার উপরে উঠে কোণ আইস্ক্রিম খাচ্ছিলো। আমাকে দেখে বললো, তোদের ফ্যাক্টরীর আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। আমি তো প্রিয়াংকার মত এতো সুন্দরী না তাই নিজেরটা নিজেই কিনে খাই, কেউ কিনে দেয়না। আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, চুপ কর শালা। ও হাসতে হাসতে বলে, দেখ এই জীবনে আমি তোর শালা হইতে পারবোনা। শালী হইতে পারি খুব বেশি হলে।রাগ না কইরা আয় আমার থেকে এক কামড় আইসক্রীম খা। আমি ওর থেকে আইসক্রিম ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই বাকিটা খেয়ে ফেললাম।তারপর ওকে বললাম, কালকে কি প্রিয়ার বাসায় যাচ্ছিস তোরা? ও মাথা নেড়ে বললো, আমি যাবো। অন্যদের কথা জানিনা। তুই যাচ্ছিস না তাই না? আমি মাথাটা একটা ঝাকি দিলাম। ও হেসে দিলো আমার ভাব দেখে। বললো, আচ্ছা এইজন্য তোর মন খারাপ। আহারে বাবুটা। একটা কথা বলতো।

 

এই মেয়ে তোরে পাত্তা দেয়না, তাও ওর প্রতি তোর এতো রাগ কেন? আপনজন ছাড়া অন্য কারো সাথে রাগ করার টাইম পাস কোথা থেকে? আর এখন ওর লেভেল ফোরের একটা ভাইয়ার সাথে প্রেম চলতেছে জানিস? আমি এটা জানতাম না। একদম না। ওর মুখে এই কথা শোনার সাথে সাথে আমার পিঠ দিয়ে কেমন যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার জীবনের প্রথম কাউকে চাওয়া। না ঠিক চাওয়া না, ভালোবাসা ছিলো তো। সাবেরা আবার বললো, কালকে ওই ছেলেকে ওর বাসায় দাওয়াত দিছে সবার সাথে অফিসিয়ালী পরিচয় করায় দিতে।

 

তোকে এই জন্যই যাইতে বলছে। তুই একটা ছাগল। ও যে তোর সাথে খেলে এটা আমরা সবাই বুঝি, শুধু তুই বুঝিসনা। তোর জন্মদিনের যেদিন দাওয়াত ওকে দিছিলি সেদিন ও হলে যেয়ে এইটা নিয়ে অনেক জোকস করছিলো আমার সাথে। আমি সাবেরার দিকে তাকিয়ে বলি, এইজন্যই তুই সেদিন আমার সাথে দেখা করতে আসছিলি? আমার চোখে পানি দেখে সাবেরা একটু চুপ হয়ে গেলো। একটু আমতা আমতা করে বললো, দেখ দোস্ত। এতো অল্পতে কষ্ট বুকে নেয়া ঠিক না। আমি বুঝতেছি তোর অনেক খারাপ লাগতেছে। কিন্তু সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। দেখিস একদিন তোর মনের মত কাউকে পেয়ে যাবি। এখন ঢং করা বাদ দিয়ে চল ল্যাবে যাই। আমি ল্যাবে গেলাম এবং এরপর দিন প্রিয়ার বাসাতেও গেলাম। প্রিয়া আমাকে দেখে বেশ খুশী হলো।

 

আমি প্রিয়ার নতুন প্রেমিককে দেখেও না দেখার ভান করে ওর কাছে সোজাসুজি যেয়ে বললাম, আচ্ছা একটা জরুরী কথা ছিলো। খুব জরুরী। ও একটু অবাক হয়ে বললো, আচ্ছা। আগে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমি ওর কথা পুরোটা শেষ না করে বলি, তোমার পছন্দের মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার আগে কথাটা বলা জরুরী ছিলো। ওকে নিয়ে আমি একটু সবার থেকে আড়ালে যেয়ে বলি, একটা ভুল হয়েছে। প্রায়দিন ক্লাসে তোমার কলম খাতা পেন্সিল নানান কিছু হারিয়ে যেতো। তুমি অনেক খুজে পেতেনা, আমিও ভাব ধরতাম তোমার জন্য সেগুলো খোজার। ওগুলো সব আসলে আমি নিয়ে রাখতাম। তোমার দিকে সরাসরি তাকায় থাকার সাহস আমার কখনো ছিলোনা। আমি তাই তোমার খাতা কলম নিয়ে সেগুলোর দিকে তাকায় থাকতাম। মাঝে মাঝে সেগুলোর গন্ধ নিতাম

 

তুমি শ্যানেল ফাইভ অথবা ফ্লোরিস যাই ব্যবহার করো আমি সেগুলোর গন্ধ না পেয়ে অন্যরকম একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পেতাম। তোমার ২ বছর আগে যখন টাইফয়েড হয়েছিলো আমি প্রতিদিন লুকায় লুকায় তোমাদের ছাদে বসে থাকতাম। তুমি এক সপ্তাহ ক্লাসে আসোনা, তাই একবার তোমাকে দেখার জন্য আসতাম। তোমার দারোয়ানকে সেইজন্য একশো টাকা দিন প্রতি ঘুষ দিয়েছি। তুমি যেদিন প্রথম ক্লাসে এসেছিলে, তুমি তোমার এক বান্ধবীকে তোমার সবচেয়ে প্রিয় আইস্ক্রীম যে করনেলি সেটা বলছিলে। আমি দূর থেকে শুনেছিলাম এবং এরপর থেকে ঠিক করি তোমাকে প্রতিদিন একটা করে আইসক্রীম খাওয়াবো। প্রিয়াংকা এই সকল পাগলামীগুলো আমার করা ঠিক হয়নাই। তোমাকে বিব্রত করেছি, নিজে তার থেকেও বেশি হয়েছি।

 

তুমি যে আমাকে একটা কৌতুক মনে করো এটা বোঝার মত বুদ্ধিটা আগে হয়নি। তোমার কাছে দুঃখিত। তোমার থেকে নেয়া সব কলম, পেন্সিল তোমার সোফার টিটেবিলের নিচে রেখে এসেছি। আমি যাই? প্রিয়াংকা আমার দিকে না তাকিয়ে নিচে তাকিয়ে ছিলো। আমি চলে যাওয়ার আগে আরেকবার, শেষবার দাঁড়িয়ে বললাম দেখো, আজকে যার সাথে তোমার সম্পর্ক বা যদি ভবিষ্যতেও কেউ তোমার জীবনে আসে আমি কথা দিতে পারি আমার থেকে বেশি তোমাকে কেউ কখনো চাওয়ার দুঃসাহসটাও করতে পারবেনা। শুভ অপরাহ্ণ। আমি পালিয়ে গেলাম।

 

কিভাবে যে আমার বাসায় পৌছেছিলাম আমি টের পাইনি। সাবেরা ঠিক বলেছিলো, এতো অল্পতে কষ্ট পাওয়ার কি আছে।জীবন আরো অনেক বড়, মহান। একটা ভালোবাসা নষ্ট হওয়াতে তার কিছু যায় আসেনা। আফসোস, এটা আমাকে আগে কেউ বুঝাতে পারেনি। রাত ৯টার দিকে আচমকা একটা ফোন পাই মোবাইলে। ফোন করেছেন জালাল উদ্দিন নামে একও ভদ্রলোক। পান খেতে খেতে খুবই অস্পষ্ট ভাষায় সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আবীর সাহেব বলছেন? আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম, জ্বী। কে বলছেন? জালাল সাহেব তার নাম বলে জানালেন কালকে যে সকাল সকাল আমি চলে আসি ফকির সমিতির অফিসে। সাবেরার বাবাকে পাওয়া গেছে।

 

আমি ফোন রেখে একবার ভাবলাম সাবেরাকে ফোন দেই। তারপর মনে হলো, একবারে ওর বাবাকে নিয়ে ওর কাছে যাবো। ওর বাবা যত দূরই থাকুক আমি উনাকে সেখান থেকে নিয়ে সাবেরার কাছে যাবো। আচ্ছা সাবেরা কি করবে ওর বাবাকে পেয়ে?নিজের এমন একটা বিষণ্ণ সময়েও সাবেরার খুশির কথা মনে করে আমার খুব ভালো লাগতে থাকে। পরদিন সকালে আমি, বাসার পাশের ফকির চাচা আমাকে নিয়ে লালবাগ বস্তিতে গেলেন। একটা কুটিরে যেয়ে দেখি একটা বৃদ্ধ করে মহিলা ভাত রাধছেন। আমি সালাম দিয়ে আশেপাশে তাকালাম সাবেরার বাবার জন্য।

 

ফকির আঙ্কেল প্রথম কথা বললেন। আমার দিকে তাকায় বললেন, বাবা মন খারাপ কইরোনা। তোমার বন্ধুর আব্বা দুইবছর আগে অসুখ কইর্যা মইরা গেছে। এই ঘরটায় উনি থাকতো। সবসময় পাগলামী করতো। মাঝে মাঝে এইহানকার লোকজন বাইন্ধ্যা রাখতো। কেউ কেউ কইছিলো হাসপাতাল লইতে। কিন্তু উনারে নেওন যাইতোনা। এই বুড়া মহিলা উনারে নিজের ছেলের মত দেইখ্যা রাখতো। ভিক্ষা করতে লয়া যাইতো। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, উনার কবরটা কই। এইবার বয়স্ক করে মহিলাটা নিজে থেকেই বললো, আমার গ্রামে লয়া কবর দিছি।

 

আমার পোলার লাহান আছিলো। ওর মাইয়্যাটারে নিয়া আসবা? ওর একটু দেখমু। আমি জানতামনা ওর মাইয়্যা আছে। মাঝে মাঝে একটা ছোট্ট পুতুল ধইর্যা খুব আদর করতো। ওরে এউগ্যা লইয়া আসো। আমি একটু দেহি। চক্ষু নষ্ট হইয়া গেছে। তাও খুব দেখবার মন চায়। পরের তিনদিন খুব ব্যস্ততায় কাটে। আমি প্রথমদিন সাবেরাকে কিছু বলতে পারিনাই। দ্বিতীয়দিন ক্লাসে ও আমাকে দেখে বলে, তুই এমন চোরের মত পালায় পালায় আছিস কেন? আমার প্রেমে পড়ছিস প্রিয়াংকার ছ্যাকা খাইয়া? কাধ লাগবে? আমি সাবেরাকে কিছু বলিনা।

 

ও চলে যাচ্ছিলো তখন ওকে ডাক দিয়ে বলি, তোর সাথে একটু কথা বলবো। একটু ওই দিকে চল। সাবেরা হেসে বললো, তোর মতিগতি তো সুবিধার না। দাড়া চুলটা একটু ঠিক করে নেই। একটু ভাব নিয়ে কথা শুনতে হবে। সাবেরাকে নিয়ে আমি প্লাজার সামনের রাস্তায় হাটতে হাটতে বলি, সাবেরা আর ছয়মাস পর পাশ করে বের হয়ে যাবো। তোকে একটা কথা বলি? সাবেরা মাথা নেড়ে বললো, বল। আমি ওকে বললাম, আমার বলতে খুব অবাক লাগছে, কিন্তু তাও বলি। তুই আমার সমচেয়ে ভালো বন্ধু। সত্যি কথা। সাবেরা হেসে বললো, ছাগল।

 

এইভাবে বলতে হয় নাকি কে ভালো বন্ধু। ওটা তো বুইঝে নেয়া যায়। আমি হেসে সাবেরার দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু এখান থেকে পাশ করার পর হয়তো তুই আমাকে আর চিনবিনা। আমিও অনেক ব্যস্ত হয়ে আর যোগাযোগ করবোনা। এইযে সুন্দর মাঠের পাশের রাস্তাটা, যেখান দিয়ে তুই আর আমি প্রায়ই হেটে হেটে যাই সব হয়তো হারায় যাবে। আমরা মাঝে মাঝে শুধু এগুলোর কথা মনে করবো। তারপর আবার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবো তাই না? সাবেরা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, আমি ঠিক এই সবুজ মাঠটা যখন দেখি তখন মনে হয় আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়নি। এই সবুজ ঘাসগুলো, পাশের গাছগুলো কেমন জরাজীর্ণ হুয়ে যায়।

 

তারপর রোদ বৃষ্টি পেলে আবার জেগে ওঠে না, ঠিক তেমন।তোর সাথে প্রেম থাকলে বলতে পারতাম, তুই আমার রোদ বৃষ্টি। হাহা।আচ্ছা তুই কি সত্যি পাশ করার পর আমাকে ভুলে যাবি? আমি সাবেরার দিকে তাকিয়ে থাকি আনমনে। এরপর ওকে কাপতে কাপতে বলি, তোর বাবাকে খুজে পেয়েছি। আমার সাথে কাল মানিকগঞ্জ যেতে পারবি? সাবেরার হাসিমুখটা বদলে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিভাবে? আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলি, তোর ছবিটা মোবাইলে নিয়েছিলাম না।

 

এরপর খুজেছি কয়েকদিন, পেয়ে গেছি। আমি সাবেরার দিকে তাকাই ও কি বলে শোনার জন্য। ও প্রথমে কেমন একটা অদ্ভূত হাসি দেয়। মনে হলো যেন ওর ভেতরের মানুষটা বের হয়ে এলো কিছুক্ষণের জন্য। বাবার মেয়েটা, আদরের মেয়েটা বাবাকে পাওয়ার খুশিতে বের হয়ে এলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওকে খেয়াল করি, খুব আগ্রহ করে। ওর মুখের আদলটা আস্তে আস্তে বদলিয়ে যেতে থাকে। হাসিটা কেমন যেন কান্নার মত হয়ে যায়। আমাকে অনেক কষ্ট করে কান্না আটকে বলতে চায়, বাবা বেঁচে নাই তাই না? আবীর ঠিক করে বল।

 

একঝাক শীতল পানির টুপটাপ বৃষ্টির অস্থির ঝনঝনানিতে আমার ভেতরে আচমকা একটা অস্তিত্ব নাড়া দেয়। তোমরা যাকে বৃষ্টি বলো আমি বলি তাকে কান্না। ওর কান্নাটা আমাকে এমন করে আঘাত করলো কেন জানিনা। আমি সাবেরাকে বলি, চল আজকে বৃষ্টি দেখি। কাল ভোরে মানিকগঞ্জ যাবো। বয়স্ক যে মহিলা সাবেরার বাবাকে দেখে রাখতো তার নাম রহিমা খাতুন।তার তিনটা ছেলে ছিলো, দুইটা মেয়ে। ৭১ এর যুদ্ধে তিন ছেলে ২০ বছরের কম ছিলো বয়সে।

 

একদিন রাজাকাররা পাকিস্তানী সেনা নিয়ে রহিমা খাতুনের বাড়িতে আতিথেয়তা নেয়। তার দুই মেয়ে জয়নব ও আসমা যাদের বয়স ছিলো ১০ এবং ১৪ বছর তাদেরকে মেজর আসলাম বেগ মাথায় হাত বুলিয়ে পাকিস্তান থেকে আনা আমের চাটনী উপহার দিয়ে বলে, পাকিস্তানী আম এই বিশ্বের সেরা আম। আমার মা নিজের হাতে এই চাটনী বানিয়েছে। আমি খাদ্য গ্রহণের পর এই চাটনী একটু করে খাই। তোমরাও খাও। রহিমা খাতুনের তিন ছেলে অত্যন্ত ভীতু ছিলো। তাদের বাবা নেই তিন বছর ধরে। এই ভয়ানক যুদ্ধে তারা দিশেহারা হয়ে মায়ের আচলে লুকিয়ে থাকতো।

 

সবচেয়ে ছোট্ট যেটার বয়স ১৫ বছর তার নাম ছিলো মাসুম মিয়া। মাসুম মিয়া মেজরের পায়ের কাছে বসে ভাঙ্গা উর্দুতে বলে, হাম আচ্ছা হ্যায়। মুক্তি কুত্তা হ্যায়। রহিমা খাতুন ভয়ে ভয়ে মেজর আসলাম বেগ আর তার সাথের তিন সেনাকে খাওয়ায়। এরপর যাওয়ার সময় আসলাম বেগ রহিমা খাতুনকে বলে, তোমাদের সাথে একটু বাতচিত করি। তোমাদের এই গরীব গ্রামে এসে আমি অসহায় হয়ে গেছি। বউ নেই, সন্তান সব করাচীতে। আমার বন্ধু দরকার। রহিমা খাতুন উর্দু বোঝেন না।

 

ভয়ে ভয়ে মেজরের দিকে তাকান। মেজর আসলাম রহিমা খাতুন কে ঘরের ভেতরে নিয়ে যান। মায়ের কান্নার শব্দ শুনে তার পাঁচ বাচ্চা তিন হানাদারের পা চেপে ধরে অনেক আকুতি জানায়। একটু পর রহিমা খাতুনকে বাহিরে পাঠিয়ে মেজর চিৎকার করে বলে, দুনো বাচ্চোকো ভেজো। মেজর আসলাম বেগ যখন রহিমা খাতুনের বাড়ি থেকে বের হয় তখন চারদিক সুনসান নীরব। শুধু তার দুই মেয়ে চিৎকার করছে। পরের দিন রহিমা খাতুন আর তার দুই ছেলের খুব কষ্ট হয় মেয়েগুলোকে কবর দিতে। ওদের হাত পা প্রায় শরীর থেকে খুলে গেছে।

 

কবর দেয়া শেষ করে মাসুম মিয়া তার মায়ের কাছে বলে, আম্মা এই দেখেন আমার দুইটা চোখ, দুইটা হাত আর দুইটা পা আছে। কসম আল্লাহর যদি এর একটাও ঠিক থাকে আমি যুদ্ধ কইরা সব শূয়োররে মারমু। আম্মা আপনি খালি কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন। রহিমা খাতুনের সাথে তার তিন ছেলের এর দুইমাস পর দেখা হয়। শুকনো, জরাজীর্ণ মুখে হাসি দেখে রহিমা খাতুন তার ছেলেদের জড়ায় ধরেন। ওদেরকে রাতের খাবার খাওয়ায় বলেন, আইজকাই যাবিগা? বড় ছেলে ফারুক বলে, খাইয়াই যামুগা মা। তুমি নিজের খেয়াল রাইখো। মাসুম মিয়া মায়ের হাত ধরে বলে, মা একটা কথা কই। ওইযে মেজ ভাই হাতে একটা বস্তা লইয়া আইছে না

 

ওইখানে চাইরটা মাথা আছে। দাউ দিয়ে কাইট্যা নিয়া আসছি। আমারে আমার কমান্ডার কয়, আমি জানোয়ার হইয়া গেছি। মা ঠিক কইর্যা কউ তো, হারাম শূয়োর মারা কি পাপ হইয়া গ্যাছে? রহিমা খাতুনের ছেলেরা সেই রাতে চলে যায়, এরপর আর ফিরে আসেনি। রহিমা খাতুন জানতেন তারা ফিরে আসবেনা। উনি সেরাতেই বুঝেছিলেন। তার ছেলেদের চোখে যে আগুন দেখেছেন সেই আগুনটা মানুষটাকে পুড়িয়ে দগ্ধ করে দেয়। রহিমা খাতুন মাঝে মাঝে রাতে বিলাপ করেন।তিনি স্বপ্নে দেখেন তার ছেলেরা তার জন্য গোলাপী রঙের শাড়ি নিয়ে এসেছেন।

 

তার হাত ধরে বলছেন, মা তোমার জন্য স্বাধীনতার পুরষ্কারমূল গল্পে ফিরে আসি। সাবেরাকে যখন রহিমা খাতুন কাছ থেকে দেখলেন তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মা তোমার বাবায় আমারে মাঝে মাঝে কইতো তার একটা ছোট্ট পরী আছে। নাম জিগাইলে ফ্যালফ্যাল কইরা চায়া থাকতো।মারা যাওয়ার দুইদিন আগে খুব অসুস্থ আছিলো। রাতে ঘুম থিকা যাইগ্যা কয়, আম্মা আমার একটা পরী আছে। ও খালি স্বপ্নে কাছে আইস্যা কান্দে, ওর কষ্ট দেইখা ঘুম ভাঙ্গি যায়।

 

আমার মাইয়্যাটার জন্য দোয়া কইরো। ওর অনেক কষ্ট। মানিকগঞ্জের এক নাম না জানা প্রায় গ্রামের মত এক এলাকায় রহিমা খাতুন আমাদেরকে নিয়ে যায়। একটা প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া বাড়ির সামনে এসে বলে, এইটা আমার বাড়ি ছিলো। ৩০ বচ্ছর আগে ছাইড়া দিছি। ওইযে ওইহানে যে জংলা দেখতেছো তার পাশে তোমার বাপরে গেরামের লোকরা মিল্যা কবর দিছে। আসো আমার লগে আসো নাতি। সাবেরা অনেকক্ষণ কবরের দিকে তাকায় থাকে। আমি চাচ্ছিলাম ও কান্না করুক। কিন্তু ও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর বসে পড়ে কবরের পাশে। আস্তে আস্তে মাটিতে হাত বুলায়। মিনমিন করে বলে, বাবা এই দেখো আমার কোন কষ্ট নেই।

 

একটুও কান্না করছিনা। তুমি বাবা আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবানা। তোমার ছোট্ট মেয়েটা এখনো ঠিক তেমনি রয়েছে যেমন তুমি দেখেছিলে। বাবা আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, অনেক। পড়ন্ত সন্ধ্যায় আমি যখন সাবেরাকে ওর হোস্টেলে নামিয়ে দিলাম তখন হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওদের মহিলা হোস্টেলের রাস্তাটা খুব বাজে, কাদায় ভরে যায়। রাস্তায় ওর সাথে আমার আর একটা কথাও হয়নি। একটাও না। আমি ওর থেকে দ্রুত বিদায় নিতে চাচ্ছি। ওর একটু একা সময় দরকার আমি জানি। এই বৃষ্টিতে তাই আমি কিভাবে বাসায় ফিরে যাবো সেটা নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।

 

ও আমাকে হোস্টেলের অতিথিরুমে নিয়ে একটু বসতে বললো। আমি একটু অপেক্ষা করার পর ও হাতে করে একটা তোয়ালে নিয়ে বললো, মাথার পানি মোছ। বৃষ্টি একটু কমলে চলে যাস। আমি মাথা নাড়লাম। ও একটু চুপ থেকে আবার বললো, আবীর তোকে একটা কথা বলি। তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুই জানিস? আমি মাথা নেড়ে ওকে একটা ছোট্ট হাসি উপহার দিয়ে বললাম, জানি। সাবেরা তোয়ালেটা আমার হাত থেকে নিয়ে তারপর মাথায় মুছে দিতে দিতে বললো, দেখ তুই সেদিন বলছিলি না আমি পাশ করার পর তোকে ভুলে যেতে পারি। এমনটা কখনও হবেনা।

 

আমি তোকে কখনই ভুলবোনা। বিশ্বাস কর।তুই হয়তো খুব ব্যস্ত হয়ে যাবি, আমার সাথে ঠিকমত যোগাযোগ রাখবিনা।কিন্তু আমি তোকে কখনই ভুলবোনা। এরপর একটা অদ্ভূত ব্যাপার হয়ে গেলো। আমাকে ও জড়িয়ে ধরলো, শক্ত করে। সেই আদিকাল থেকে মানুষ মানুষকে ভালোবাসার জন্য, তার উষ্ণতা বোঝাতে স্পর্শ করতে চায়। খুব কাছের মানুষকে যখন ভালোবেসে স্পর্শ করা যায় তখন তার মনের খানিকটা অংশ যাকে ছুয়ে দেয়া হয় তার কাছে এসে পড়ে। আমি সাবেরার এই অংশটা চাইনি। সাবেরা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো, আমিও ওকে কেন যেন তেমন করেই জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আমার ভেতরটা বদলে গেলো। সাবেরার হাহাকার, নির্লিপ্ততা তার একাকীত্ব, খুব বিষণ্ণতায় ভোগা আত্নাটা আমার ভেতর আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো।

 

কিন্তু আমি, আবীর হাসান সৌম্য খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমার ক্ষমতা ছিলোনা তার থেকে বের হওয়ার। জানিনা কতখানি সময় পার হয়েছে। সাবেরা আমাকে কখন ছেড়ে দিয়েছিলো। কখন কিভাবে কেমন করে আমি আবার আমার পরিচিত বাসায় ফিরে এসেছিলাম খেয়াল হয়নি। সাবেরা, তুই সত্যি আমার খুব কাছের বন্ধুরে। খুব কাছের। আমি সেদিন মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক বলেছিলাম। ইউনি থেকে বের হওয়ার পর সবাই যে যার মত ব্যস্ত হয়ে গেলো।

 

সাবেরার সাথে আমার আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। আমি জানতাম ও ভালো আছে। বছর সাতেক আগে শেষ আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফোন করেছিলো। জিজ্ঞাসা করেছিলো, আমি কেমন আছি। উত্তরটা জানতাম না। বলেছিলাম, আরেকদিন বলবো। ফেসবুক, টুইটার সবখান থেকেই আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কিছু ভালো লাগতোনা। প্রিয়াংকা যাকে আদর করে প্রিয়া ডাকতাম ও মাঝে মাঝে ফোন করতো। সেই ঘটনার পর একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলো, ওকে এখনো চাই কিনা। ও নাকি আমাকে খুব চায়। আমি ওকে কিছু বলিনি। আগ্রহ দেখাইনি। চাইতাম ওকে, ওর সাথে একটা নিশ্চুপ সন্ধ্যা ভোগ করার খুব ইচ্ছা ছিলো।

 

কিন্তু হয়ে উঠেনি। প্রিয়ার বিয়েতে আমি হাসিমুখে উপস্থিত হয়ে অতিথি খাইয়েছি। এরপর যখন প্রিয়া আর ওর বরের সাথে ছবি তুলতে গেলাম খুব বাজে ব্যাপার হলো। প্রিয়া আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বললো, এখনো সময় আছে। যাবে আমার সাথে? আমি স্টেজ থেকে নেমে গেলাম। শুনেছিলাম বিয়েটা তিনদিন পর ভেঙ্গে গিয়েছিলো। এরপর একদিন হঠাৎ করে রাস্তায় প্রিয়ার সাথে দেখা। ও লেকের পাড়ে একটা বেঞ্চে বসে ছিলো। আমি পাশে বসে বললাম, সব ভালো?

 

ও হেসে বললো, অনেক ভালো। নিজের মত থাকি। যাকে ভালোবাসতাম তার সাথেই থাকি। কথা বলি। সে শুধু নীরবে হাসে। কথা বলেনা। প্রিয়ার চোখে জল দেখেছিলাম। খুব সেদিন খুজেছিলাম ওর জন্য সেই টিনেজকালের ভালোবাসাটা। নাহ ,পাইনি। ও বিদায় নেওয়ার আগে আমার হাত ধরে বলেছিলো, জানো আমি এখন বেশ একটা শিক্ষা পেয়েছি। যে তোমাকে ভালোবাসে তাকে আঘাত করোনা। আঘাতে ভালোবাসাটা রক্তাক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর এসিডের মত চারপাশটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই দেখোনা, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো। খুব জ্বলছি। কাউকে বলার নেই। তুমি ভালো আছো আবীর, মিষ্টি লাজুক ছেলে? একদিন সাবেরার সাথেও কেমন করে যেন দেখা হয়ে গেলো। প্রায় সাত বছর পর। আমাকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললো, আবীর সাহেব।

 

আমার কাছের বন্ধু যে আমার সাথে যোগাযোগই রাখতে চায়নি সে আছে কেমন? আমি তখন অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় যাচ্ছি। সন্ধ্যায় একটা পাত্রী দেখতে নিয়ে যাবে মা। পাত্রীর চোখটা খুব নরম, দেখলেই মায়া হয় এমন। আমার ভালোই লেগেছিলো। ভাবছিলাম এবার বিয়েই করে ফেলবো। হয়তো সুখী হবোনা, হয়তো হবো। কিন্তু জীবনটা খুব ব্যস্ত তো, সবাইকে দৌড়াতে হয়। আমাকেও দৌড়াতে হবে।এই ব্যস্ত পথে সাবেরাকে আবার পাশে পেয়ে গেলাম। ওকে বললাম, আর বলিসনা এতো ঝামেলায় থাকি। তোর পুরনো নম্বরটাও তো বদলায় ফেলছিস, আমি ফোন করে পাইনা। সাবেরা হেসে বললো, তোর মিথ্যা কথা শুনতে খুব মজাই লাগে।

 

তোর অফিস কি এইখানেই নাকি? বউ কই? আমি পাশের একটা কফিশপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ওকে সেখানে নিয়ে গেলাম। ওকে হেসে বললাম, তোর জামাই কই? সাবেরা আমাকে বললো, আমাকে কে বিয়ে করবে বল? আমি তো তোর প্রিয়াংকার মত এতো সুন্দর না। কেউ ভালোওবাসেনি। তুই বিয়ে করিসনি কেন? কথা বলতে বলতে কফি এসে হাজির। সাবেরাকে খেয়াল করলাম। ও চোখে কাজল দিয়েছে। ওর গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা তো তাই কাজলটা খুব জাকিয়ে বসেছে। ডান হাতে একটা সেফায়ারের লেডিস কালেকশন ওয়াচ। আমি ঘড়ির কাটায় আকা ছোট্ট পাথরটা দেখছিলাম। ও আমাকে আবার জিজ্ঞেস করে, কিরে কিছু বলিসনা কেন? আমি মাথা নেড়ে বললাম, বিয়ে করিনি।

 

করবো হয়তো সামনে।জানিনা।তোর জামাই এর কথা বল। কবে বিয়ে করলি? সাবেরা ব্যাগ থেকে ওর মোবাইল বের করে কি যেন দেখছিলো। তারপর আমাকে বললো, আমি সত্যিই বিয়ে করিনি। কাউকে মনে লাগেনা।তুই করিসনি কেন? প্রিয়া শুনেছিলাম তোকে অনেক ভালোবাসতো। তুই তো অনেক ভালোবাসতি ওকে একসময়। কি হয়েছিলোরে? আমি হেসে দিলাম। একটু পর বললাম, খারাপ লাগে ওর জন্য। ওকে শুধু শুধু বিয়ে করে কষ্ট দিতে চাইনি, ভালোবাসা ছিলো কিনা জানিনা। তবে যাই ছিও সেটা মরে গিয়েছিলো অনেক আগেই।

 

একটা বিশাল হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছি এখন। যেদিন কাউকে হাহাকারটা বিক্রি করে দিতে পারবো সেদিন চিন্তা করবো। সাবেরা আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে বললো, এতো হাহাকার কেন? আমি বললাম, একজন ধরায় দিছিলো। বুকের মধ্যে। জনম জনম এটা নিয়েই আমার বয়ে বেড়াতে হবে। ভালো লাগে মাঝে মাঝে। আমি জানিনা এটা কি! জানার আগ্রহও নেই তেমন।যখন খুব বুকে জ্বালাপোড়া করে তখন তার কথা ভাবি, তার সাথে ভালোবাসা হলে একসাথে থাকা হলে কি হতো সেসবই ভাবি। খুব ভালো লাগে তখন। এই ভাবনাগুলো শুধু আমার। আমি যেমন করে ইচ্ছা সাজাতে পারি, ভাবতে পারি। কেউ তাতে ভাগ বসাতে পারবেনা।

 

এমনকি যে মানুষটা আমাকে এই একরাশ হাহাকারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলো সেও না। চমৎকার না? সাবেরা কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো, তাকে একবার বলতে পারলিনা? আমি আজন্ম পুষিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসের খানিকটা ঝেড়ে দিয়ে বললাম, বলা যায়না। তাকে বলা যায়না। কেন জানিনা।আমি যাইরে।বাসায় যেয়ে আজকে অনেক কাজ আছে। তুই ভালো থাক। কফির বিল দিয়ে দিস। আমার কাছে খুচরা নেই। আমি কফিশপ থেকে বের হয়ে আড়ালে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। আচ্ছা সাবেরার হাতটা ধরে আজকে যদি একবার ওকে বলি, ও ঠিক করে বলুক তো কেন সেদিন ওকে ছোয়ার পর থেকে আমার সবটা জীবন উলটপালোট হয়ে গিয়েছিলো? আমি যে সেই বাধন থেকে আজো মুক্ত হতে পারিনি। আমি কি খুব তুচ্ছ? খুব ক্ষুদ্র? কে আমাকে অধিকার দিয়েছে ওকে নিয়ে ভাবার।

 

ও যখন কফিশপ থেকে বের হচ্ছিলো, আমি পিছন থেকে ওর হাতটা ধরলাম। ও অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো আমাকে। তারপর তাকিয়ে থাকলো। আমি খেয়াল করলাম ওর চোখটা ভেজা। কাজলটা ফর্সা মুখে কেমন যেন লেপটে গেছে। আমাকে আমতা আমতা করে বললো, আমি খুব স্যরি। আমি বুঝেছিলাম, কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম তুই আমাকে এসে বলিস। একটাবার বলিস। আমার...তোর অনেক দেরী হয়ে গেলো।আসলে দোষটা আমারই। সাহস পাইনি।

 

আমি তোর যোগ্য ছিলাম না। আমি তো অনেক আগেই পচে গেছি, মরে গেছি। আমার তোকে বলার মত, ভালোবাসার মত সাহস ছিলোনা। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সামনের মাসে আমার বিয়ে। যেই ব্যাঙ্কে চাকরী করি, সেখানে গত তিনবছর ধরে এক ছেলের সাথে পরিচয়। কিভাবে যেন পছন্দ করে ফেললাম। আমি সাবেরার হাত ছেড়ে দিলাম। ওকে বললাম, না রে। আমার কোন দাবী নেই। এতো তুচ্ছ ভাবিসনা আমাকে। খুব খুশি হলাম তোর কাউকে ভালো লাগে জেনে। ভালো থাকবি, আর চোখে কাজল কম দিবি।

 

তোকে এইসব আজাইড়া সাজগোজ একদম মানায়না। রিকশা করে বাসায় ফিরছিলাম যখন মা ফোন দিলো। মা জিজ্ঞেস করলো, এতো দেরী কেন করছিস? যাবিনা? আমি শান্ত স্বরে বললাম, মা যেতে পারছিনা। ওদেরকে না করে দাও। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, এই নিয়ে আটবার হলো। কবে রাজি হবি বাবা? আমি মাকে বললাম, মা ক্ষমা চাই শেষবারের মত। আচ্ছা একটা কাজ করোনা। ওদেরকে কালকে আসবো বলে দাও। আজকে না। আজ একদম ভালো লাগছেনা। মা খুব স্যরি।

 

দুইমাস পর আমার বিয়ে হয়ে গেলো খুব মায়া মায়া চোখের মেয়েটার সাথে। এর আরো অনেকদিন পর ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি মাঝে মাঝে একা বারান্দায় বসে কি ভাবেন? আমি মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলি, আকাশের কাছে হাহাকার বেচি। ও এত্ত বড় যে আমার ক্ষুদ্রতা ওর কাছে নির্লজ্জের মত বের হয়ে আসে। তখন লাজ ভুলে ওর কাছে আমার অধম হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে বিক্রিবাট্টা করি। মৃন্ময়ী আমার কাধে হাত রেখে বলে, আমাকে দেবেন? আমি ওর হাত ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলি, তোমাকে ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু দেয়ার নাই। আর কিচ্ছু না। মৃন্ময়ী আমার কাধে মাথা রেখে বলে, আপনার এতো কবি কবি টাইপ কথা বুঝিনা। আমি খুব সহজে বুঝি, হাহাকার বলে কিছু নাই। ভালোবাসাটাও ক্ষুদ্র যখন আপনি কারো দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারবেন তাহার সাথে এক জীবন বেশ কাটিয়ে দেয়া যায়।আর কিছু ভাবার নেই। আমিও হাসলাম।

 

আসলেও এতো ভাবাভাবির সময়টা যে সত্যিই নেই।

.

আবীর হাসান সৌম্য আমার বন্ধু ছিলো। খুব কাছের বন্ধু। ও সত্যি সত্যি হাহাকার ফেরী করে বেড়াতো। মনের কথা একদম বলতে পারতোনা। মৃন্ময়ীর সাথে ওর বিয়ে হয়নি, ব্যাপারটা লেখকের সুপ্ত ইচ্ছার প্রশ ছাড়া আর কিছুই না। একদিন গভীর রাতে ও আমাকে ফোন করে বললো, সব ঘোলা ঘোলা লাগে।একফালি ঘোলা চাঁদের আলো আইন্যা দে। জুস বানায় খাই। দেখি শান্তি লাগে কিনা। প্রতিবছর মে মাসের ২৫ তারিখে আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে বন্ধুকে খুজি, পাওয়া যায়না। হারিয়ে যাওয়া মানুষকে হয়তো চাঁদও গ্রহণ করেনা।

.

 

সাদ আহম্মেদ


Bangla Golpo: ইস্পা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url