Love story in Bangla - গল্পের ভেতরের গল্প। তাসফি আহমেদ।
Love story in Bangla - গল্পের ভেতরের গল্প। তাসফি আহমেদ।
Love story in Bangla - গল্পের ভেতরের গল্প।
তাসফি আহমেদ।
রীতিকে এখানে দেখে বেশ অবাকই হলাম। বলা যায় ওকে দেখার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি৷ খানিকটা ধাক্কা মতো লাগল৷ আশ্চর্য ব্যাপার। এই মেয়ে এখানে কী করছে? এখানে কেন এসেছে? বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করব ঠিক ভেবে পেলাম না৷ একবার ভাবলাম চলে যাই৷ এখানে থেকে লাভ নেই৷ এই মেয়ের মুখোমুখি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না৷ কোনো মতেই সম্ভব না৷ তার মুখোমুখি হলে অস্বস্তিকর একটা মূহুর্ত তৈরী হবে। লজ্জায় পড়ে যাব৷ এরচে চলে যাওয়াই ভালো। ফিরতি পথে পাঁ বাড়াতেই মিলির কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা এতো রিকোয়েস্ট করল তার বার্থডে পার্টিতে আসতে! তারউপর সে আমার খুব ভালো বন্ধু৷ ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব।
তার জন্মদিনে আমার থাকাটা আবশ্যক। এভাবে চলে যাওয়াটা একদম অন্যায় হয়ে যাবে৷ ও রাগ করবে ভীষণ। সেই রাগ ভাঙ্গানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে৷ নাহ, এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক মানায় না৷ ভালোই চিন্তায় পড়া গেল! যাবো নাকি থাকবো? সেখানে দাঁড়িয়েই বেশ কিছু সময় ভাবলাম। তখনই আমার রীতি সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। এটা এমন এক ঘটনা যেটা মনে পড়লে আমার মনটা শক্ত হয়ে যায়৷ একটা সময় মন খারাপ হতো ভীষণ। চোখে জল জমতে চাইতো। এখন তা খুব একটা হয় না। মন খারাপ হয় না৷ চোখে জল জমে না৷ তবে নিজের ভেতরটাকে বেশ শক্ত মনে হয়৷ মনে হয় আমি সেই ব্যাথাটা সয়ে নিয়েছি৷ এখন আমি যে কোনো কিছু সয়ে নিতে পারবো৷ অবশ্যই পারবো৷
আমি ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ মিলিকে খুঁজতে থাকলাম৷ সোফার কাছে রীতি বসে আছে৷ সে এখনও আমায় লক্ষ্য করেনি৷ না করুক৷ আমি চাই সে আমাকে আজ লক্ষ্য না করুক৷ কোনো ভাবেই না করুক। আমি যেন তার দৃষ্টিতে না পড়ি৷ মনে মনে অনেক দোয়া করলাম আমি৷ সে দোয়া কাজ হলো বলে মনে হলো না৷ রীতি আমাকে ঠিকই দেখে ফেলল। আমার দিকে একবার চোখ পড়তেই সে তাকিয়ে থাকলো৷ কেবল আমাকে দেখতে থাকলো৷ আমি চারদিকে তাকালাম। এমন একটা ভাব করলাম যেন রীতিকে আমি দেখিনি৷ আমি অন্য কাউকে খুঁজছি৷ জরুরি ভাবে খুঁজছি৷ ঠিক সে সময়েই দেখলাম রীতির বাবা আসছেন৷ আমি উনাকে দেখতেই হাসলাম৷
বললাম,
-আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?
তিনি হাসি মুখে সালাম নিলেন৷ বললেন,
-খবর ভালো। তা তুমি দেরি করে এলে যে? মিলি বেশ কয়েকবার তোমার খোঁজ করেছে৷ ফোন দিল৷ তুমি নাকি ফোন তুলছ না!
-পথে ছিলাম আঙ্কেল। তাই ধরিনি৷
-ও রুমে আছে৷ দেখা করে আসো একবার৷
আঙ্কেল চলে গেলেন। আমি মিলির রুমের দিকে এগোলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে রীতি এখনও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে দেখছে৷ আমি মনে মনে ভাবলাম মেয়েটা আমাকে চিনতে পেরেছে তো? ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের সেই আমিটাকে সে কি চিনতে পেরেছে? একটা সময় যে ছেলেটা তার জন্যে উন্মাদের মতো ছিল সে কি তাকে চিনতে পেরেছে? না চিনলে অবশ্যই এভাবে তাকানোর কথা না৷ আচ্ছা রীতি কি এখনও তাকিয়ে আছে? আমাকে দেখছে? আমি কি পেছন ফিরে তাকে একবার দেখব? দেখাটা কি উচিৎ হবে?
মিলির রুমের কাছে আসতেই দেখলাম সে রুম থেকে বের হচ্ছে৷ আমি হাসলাম। বললাম,
-হ্যাপি বার্থডে প্রিন্সেস! জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভ কামনা রইলো তোর জন্যে৷ আশা করছি দ্রুতই বিয়ে করবি এবং আমাদের একটা দাওয়াত খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবি!
স্বাভাবিক ভাবে মিলির হাসার কথা৷ কিন্তু সে হাসলো না। সে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ বলল,
-তুই এতো দেরি করে এলি কেন হু? আমি তো ভাবলাম তুই এবারেও আসবি না।
-রাস্তায় জ্যাম ছিল দোস্ত!
-দুনিয়ার সকল জ্যাম কেবল তোকেই ধরে? আর কাউকে ধরে না?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
-সরি!
ও কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মৃদু হেসে বলল,
-এভাবে বেড়ালের মতো তাকিয়ে না থেকে আমার সাথে আয়৷ ছাদে সব আয়োজন করা হয়েছে৷
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-গিফট নিবি না?
-এনেছিস?
-হু।
-কই দেখি?
আমি গিফটের বক্সটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। বললাম,
-এখন থাক। পরে খুলে দেখিস। কেমন?
ও হাসলো৷ বলল,
-তুই আমার জন্মদিনে এসেছিস এটাই আমার জন্যে সবচে বড় উপহার। আমার জন্যে বেস্ট গিফট!
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না আর। আমরা ছাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছনে মিলির ছোট বোন এবং ওর বান্ধবীরা আসছে৷ এদের মাঝে রীতিও আছে৷ আমার অবাক ভাব এখনও গেল না৷ মনের ভেতর কেমন জানি করছে৷ মিলিকে জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছে এই ব্যাপারে৷ কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করা যাবে না৷ লজ্জায় ফেলে দিবে৷ আমরা এগিয়ে গেলাম। আমার সাথে মিলির ছোট ভাই অর্ক এসে দাঁড়ালো৷ বলল,
-কেমন আছেন ভাইয়া?
আমি হাসলাম। বললাম,
-ভালোই৷ তোমার খবর কী?
-ভালো৷ খুব ভালো৷
অর্কর সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে আমি উপরে উঠে এলাম।
ছাদে এসেই খানিকটা চমকাতে হলো। কী অসাধারণ ডেকরেশন। একদম চোখ জুড়িয়ে যায়৷ লাইটিংটা জোশ হয়েছে৷ চারপাশটা দারুণ করে সাজানো হয়েছে। হঠাৎ আমার কেমন জানি ভালো লেগে গেল। অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করলো৷ আমি এক পাশে এসে দাঁড়ালাম৷ সবার সব কিছু লক্ষ্য করতে থাকলাম। এমন পরিবেশে আমি কেন জানি নীরব হয়ে যাই৷ কারো সাথে তেমন কথা বলতে মন চায় না৷ দূর থেকে সবার সব হৈ-হুল্লোড় দেখতে মন চায়৷ হৈ-হুল্লোড় করতে মন চায় না৷ আমার এভাবে থাকতেই মন চায়৷ এভাবেই আমার ভালো লাগে৷
হঠাৎ আমার চোখ গেল রীতির উপরে। একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে৷ এই ছেলেটা ওর সাথে সোফায়ও বসে ছিল। কি যেন কথা বলছিল তখনও৷ কাছের কেউ হবে হয়তো। খুব কাছের? প্রিয়জন? হতেও পারে৷ হোক৷ আমি সব ভুলে গিয়েছি। মিথ্যা মিথ্যা হলেও সব ভুলে গিয়েছি৷ কিছুই মনে নেই আমার৷ আমি চিনিনা রীতিকে৷ সে যার সাথে ইচ্ছে থাকুক, যার সাথে ইচ্ছে কথা বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না৷ কিচ্ছু যায় আসে না৷ এমনটা আমি মনে মনে বলছি৷ অথচ পাশাপাশি আমার মন ভীষণ ভাবে চাচ্ছে আমি মেয়েটার কাছে যাই৷ তাকে জিজ্ঞেস করি ছেলেটা কে? কাছের কেউ? কিংবা প্রিয়জন? সে কি বিয়ে করে ফেলেছে?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কতো ভাবনাই মনে আসে৷ সেই ভাবনা গুলো একটা অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয় কেবল। আমি রীতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কালো শাড়ি পরে এসেছে সে৷ কপালের সেই টিপ, চোখের সেই কাজল আজও ঘোর ধরায়৷ সব কিছুই পুরনো হয়৷ অথচ তার প্রতি আমার ঘোর কখনই পুরনো হয় না৷ কখনই না৷ আমার মনে হয় আমি যেন এখনও তার ঘোরে ডুবে আছি৷ এতোদিন পর আজ মনে হচ্ছে আমি এখনও তাকে ভালোবাসি৷ এখনও আমার মনের কোথাও না কোথাও তার প্রতি জায়গা আছে৷ অল্প হলেও আছে৷
আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি৷ কলেজে রুদ্রের সাথে পরিচিয় হয় আমার৷ খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওর সাথে৷ ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ়৷ আমরা সব সময়ই একসাথে থাকতাম৷ এদিক সেদিক একসাথেই ঘোরাফেরা করতাম। সেবার রুদ্র তার জন্মদিনে আমাকে ইনভাইট করে৷ পহেলা জানুয়ারি, রুদ্রের জন্মদিন৷ আমি তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাই৷ সেখানেই প্রথম, রোগাপাতলা গড়নের লম্বা চুলওয়ালা মেয়েটাকে দেখি৷ কালো একটা শাড়ি পরে তার বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। হাত ভরা কালো চুড়ি। কালো শাড়ির সাথে ম্যাচ করানো৷ ফর্সা হাতে সেই চুড়ি গুলোকে আমার কাছে অনবদ্য লেগেছিল৷
আমি একটু ভালো করে দেখলাম তাকে৷ তখনই তার চোখে চোখ পড়লো। আমি যেন চট করেই কিছু একটা অনুভব করে ফেললাম। আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো। কী তীক্ষ্ণ মায়াময় সেই চোখ৷ এতো চমৎকার করে কাজল মাখানো কোনো চোখ আমি কোথাও দেখিনি৷ কখনই দেখিনি। যেন সে মেপে মেপে কাজল মেখেছে৷ কোথাও মনে হয়নি চোখের এই পাশে কাজল বেশি হয়েছে কিংবা এপাশে কম। মনে হচ্ছিল তার কাজল দেয়ার হাত বেশ পরিপক্ক৷ সেবারই প্রথম আমি কালো শাড়ির প্রেমে পড়লাম। কালো চুড়ি, কপালের কালো টিপ, চোখের সেই গাঢ় কাজলের প্রেমে পড়লাম; আমি সেই চোখের গভীরতায় নিজেকে হারালাম। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলাম।
সেই মূহুর্তে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠিনি৷ তখন কেবল মনে হয়েছে আমার এই মেয়েটাকে ভালো লেগেছে৷ এই ভালো লাগাটা অন্য রকম৷ অন্যসব সুন্দরীদের দেখলেই যেমন মন ভালো হয়ে যায় এটা তেমন নয়৷ এটা ভীন্ন৷ অন্য রকম কিছু একটা৷ সেই অনুষ্ঠানে আমি না চাইতেও মেয়েটাকে দেখেছি। আড়ালে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি তাকে। কেন দেখছি জানি না৷ কেবল মনে হচ্ছিল একটু দেখি৷ একটু দেখার পর আবার মনে হয়েছে আরেকটু দেখি না৷ সমস্যা কি! কেউ তো টের পাচ্ছে না! আমি জানি না কী হচ্ছিল আমার সাথে৷ মনের ভেতর কেবল তাকে দেখে যাওয়ার আকাঙ্খাটাই তীব্রভাবে বেড়ে চলেছে৷ সেটাই টের পেয়েছি শুধু৷
সে রাতে বাসায় এলাম বেশ রাত করে৷ রাত প্রায় দুইটা পনেরোতে শুতে যাই৷ চোখ ভরা ঘুম। মনে হচ্ছিল চোখের পাতা এক করলেই হলো! ঘুমে দেশে তলিয়ে যাবো৷ অথচ বিছানায় শুয়ে চোখের পাতা এক করতেই আমি মেয়েটাকে দেখলে। সে হাসছে৷ হাসতে হাসতে কানের কাছে চুল গুঁজে দিচ্ছে৷ আমি স্পষ্ট দেখছি৷ আমি যেন মেয়েটার সামনে বসে তা দেখছি! কী অনবদ্য সেই দৃশ্য৷
বয়সটাই হয়তো তেমন ছিল৷ রঙিন জিনিস অতি রঙিন লাগতো৷ মন ভর্তি আবেগ ছিল৷ আবেগ কি প্রেম, আমি জানি না। আমার তখন কেবল মনে হয়েছে আমার এই মেয়েটাকে চাই৷ কেবল এই মেয়েটাকেই চাই৷ আমি তার খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। তার নাম জানলাম। রীতি রহমান৷ রুদ্রদের বিল্ডিংয়ে থাকে৷ রুদ্রের ছোট বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড৷ আমার এক বছরের জুনিয়র। আমার জন্যে আরো সহজ হয়ে গেল। আমি ঘন ঘন রুদ্রদের বাসায় যেতে থাকলাম। তাদের বাসার আশপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকলাম। এভাবেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারটা কাটল।
সেবার ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের কলেজে ভর্তি হয় রীতি৷ আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে। আমার জন্যে আরো সুবিধে হয়ে যায়৷ রুদ্রের মাধ্যমে আমি তার সাথে পরিচিত হই৷ নাম জানাজানি হয়। যা আমি আগ থেকেই জানি৷ তবে এবার সেই জানাজানিটা খানিক গাঢ় হলো। প্রথম প্রথম ওর সাথে দেখা হলে হাই-হ্যালো হতো। তেমন বিশেষ কথা হতো না৷ এরপর অল্প অল্প করে আলাপ বাড়ে৷ পরিচিত বাড়ে। ভালো-মন্দের একটা বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক হয়ে যায় আমাদের মাঝে৷ সময়টা ভালোই কাটছিল।
আমি ভাবলাম মনের কথাটা এবার বলেই দেই৷ এছাড়া রীতিও যে টের পাচ্ছে না তা তো না! সে ঠিকই বুঝতে পারছে আমি কেন তার আশপাশে এতো ঘোরাঘুরি করি৷ বারবার কেন তার সঙ্গ পেতে চাই৷ সে বুঝছে৷ বুঝেও কিছু বলেনি৷ অন্যান্য মেয়েরা হলে এতো দিনে কিছু কঠিন কথা বলতো৷ কিংবা কেউ কেউ নিরবেই পাশ ত্যাগ করতো৷ রীতি তো তা করছে না৷ সে ঠিকই আমার সাথে আছে৷ বরং সে যেন আরো ক্লোজ হচ্ছে৷ যেমন একদিন কলেজ ছুটির পর গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছিলাম আমি। রীতি তখন রিক্সায় চড়ে বসলো। সে রিক্সায় করে বেশি যাতায়াত করে।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সে বলল,
-এই গাড়ির অপেক্ষা করছো?
আমি হাসলাম। বললাম,
-হু৷
-আমার সাথে আসো৷ আমাদের বাসার ওখান দিয়েও তো যাওয়া যায় তাই না?
আমি খানিকটা অবাকই হলাম। এই মেয়ে বলে কি? তার সাথে যাবো? বললাম,
-হ্যাঁ যায়। তবে...
-তবে কী? আসো তো! আমি নেমে গেলে এই রিক্সাটা নিয়ে যেও।
আমি কী করব ভেবে পেলাম না৷ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রীতি খানিকটা কঠিন স্বরে বলল,
-আসো?
আমি তার পাশে উঠে বসলাম। আমাদের মাঝে অল্প বিস্তর দূরত্ব। আমি সেই দূরত্ব আরেকটু বাড়িয়ে রোবটের মতো বসে থাকলাম। সত্যি বলতে আমার কেমন জানি লাগছে৷ বুকের ভেতরটা অসম্ভব কাঁপছে। ধপধপ শব্দটা যেন আমি নিজ কানেই শুনতে পাচ্ছি৷ হাত পাঁ যেন অল্প অল্প কেঁপে উঠছে। কপাল ঘামছে। আমি অসম্ভব নার্ভাস ফিল করলাম। আমার মনে হলো দুনিয়ার সবচে কঠিন কাজ হচ্ছে কোনো কন্যার পাশে বসা৷ বিশেষ করে সেই মেয়ে যাকে আপনি মনে মনে পছন্দ করে। ভালোবাসেন। রীতি আমার এই হাল দেখে কেমন করে যেন হাসলো৷ বলল,
-এমন রোবটের মতো বসে আছো কেন? ফ্রি হয়ে বসো তো!
আমি কিছু বলতে পারলাম না৷ আগের মতোই থাকলাম। রীতি আবারও হাসলো৷ এবারের হাসিটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী। সে যেন ভীষণ মজা পাচ্ছে৷ পাঁজি মেয়ে! আমার হাত-পা কাঁপছে৷ আর সে হাসছে৷ বলল,
-এই প্রথম কোনো মেয়ের পাশে বসছো?
আমি নাড়িয়ে সায় দিলাম। সে আবারো হাসলো৷ বলল,
-আমিও তো এই প্রথম কোনো ছেলের সাথে বসছি৷ কই আমার তো এমন হচ্ছে না!
আমি বললাম,
-একটুও হচ্ছে না?
-একটু নার্ভাস লাগছে৷ বাট তোমার মতো রোবট হয়ে যাবার মতো তেমন কিছু হচ্ছে না৷
আমি একটু স্থির হলাম৷ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। রীতি বলল,
-আমরা তো খুব ভালো বন্ধু তাই না? বন্ধুর পাশে বসতে লজ্জা কোথায় বলো তো! লজ্জা পাবার তো কিছু নেই৷ বলো আছে?
-না৷ নেই৷
-তাহলে? তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন?
-জানি না।
-জানো না? এ কেমন কথা?
-আমি সত্যিই জানি না রীতি৷
-আচ্ছা থাক এই টপিক৷ তুমি একটু ফ্রি হয়ে বসো৷ নরম্যালি কথাবার্তা বলো৷
বলে মিষ্টি একটা হাসি দিল সে। আমি কি বলব ভেবে পেলাম না৷ মুখ দিয়ে কথা আসছিল না যেন৷ নিজেকে বোবা বোবা মনে হচ্ছিল৷ রীতি আমাকে আবার দেখলো৷ আমার চোখে চোখ রাখলো৷ তারপর মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,
-তুমি কি জানো তুমি অদ্ভুত ধরনের? অন্য সবার চেয়ে আলাদা! জানো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-জানি না।
আমার মাথা নাড়ানো দেখে মেয়েটা চট করেই হেসে ফেলল৷ যেন খুব হাসির কোনো জোক্স বলেছি আমি। আশ্চর্য ব্যাপার! এতো হাসার কী আছে? রীতি হাসতে হাসতে বলল,
-তুমি এখনও ভয় পাচ্ছো? এতো ভয়ের কী আছে হু? ভয় কেন পাচ্ছো?
আমি কিছু বললাম না৷ সত্যি বলতে কিছু বলতেই পারলাম না। সে তার ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে বলল,
-কপালটা মুছে নাও৷ ঘেমে তো অবস্থা খারাপ তোমার৷
আমি ওর কাছ থেকে টিস্যুটা নিয়ে কপাল মুছলাম। সে আর কিছু বলল না৷ কেবল চুপচাপ থাকলো৷ আর মুখে চেপে হেসে গেল পুরোটা পথ৷ আমি বোবার মতো চুপ করেই থাকলাম। আসলে আমার বুকের ভেতরটা তখনও কাঁপছিল। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি রীতির পাশে বসে আছি৷ তার সাথে বসে বাসায় ফিরছি! কেমন জানি একটা অনুভূতি হচ্ছিল না৷ এই অনুভূতিটা বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করা যাবে না৷ এ এক অনন্য অনুভূতি। বুকের ভেতরটা একদম শীতল করে দেয় এটি৷ কি অদ্ভুত এক আনন্দ মেলে তখন!
এই ঘটনাটা রুদ্রকে বলতেই সে বেশ অবাক হলো। বলল, "মেয়েটা তার বান্ধবীদের সাথেও খুব একটা রিক্সা শেয়ার করে না৷ কেবল টুম্পা ছাড়া। টুম্পা সাথে না গেলে সে সব সময়ই একা একা ফিরে। আজ কি না সেই মেয়ে তোকে লিফট দিলো? অবিশ্বাস্য ব্যাপার!"
রীতির এই ব্যাপারটা আমিও জানতাম। সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া কারো সাথেই তেমন মিশে না৷ তেমন বন্ধুত্ব করেনি হয়তো৷ রুদ্রের বোন টুম্পার সাথেই সে সব সময় যাতায়াত করে৷ টুম্পা সাথে না গেলে সে একা একাই ফিরে৷ কাউকে সাথে নেয় না৷ সেখানে সে আমাকে নিল! ব্যাপারটা আসলেই অবাকর৷
এই ঘটনার পর আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটে৷ যার মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছে আসি৷ নিজেদেরকে আরো জানতে পারি৷ আমাদের বন্ডিংটা আরো স্ট্রং হয়৷ সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে আমি তাকে প্রপোজ করে ফেলি৷ সে কোনো জবাব দেয়নি প্রথমে। আমাকে কয়েকদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরালো৷ তারপর হ্যাঁ বলল! সে সময় থেকেই শুরু হয় আমাদের পথ চলা। আমাদের দু'জনের খুনসুটি। প্রেম।
সে সময়টা এতো আনন্দের ছিল বলে বোঝানো যাবে না৷ রীতি যখন আমার পাশে হাঁটতো আমার মনে হতো আমি আমার পাশে একটা জান্নাত নিয়ে হাঁটছি৷ এই জান্নাত থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসে৷ সুমধুর কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে৷ এই জান্নাতটি চোখে কাজল মাখে৷ চেহায়ার রাজ্যের মায়া-প্রশান্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!
আমি যখন প্রথমবারের মতো ওর হাত ধরলাম তখন আমার গা'টা কেমন কেপে উঠছিল। ওর নরম তুলতুলে হাতটা ধরতেই একটা শীতল শিরশিরে অনুভূতি আমার রক্তস্রোতের সাথে মিশে গেল। সমস্ত দেহে কেমন শিরশিরে একটা অনুভূতি চালান হয়ে গেল৷ আমি সেবার তার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলাম। অনেকক্ষন ধরে রেখে বললাম, "এই হাতটা আমি ছাড়ব না৷ কখনই না৷" রীতি কিছু বলেনি তখন৷ আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জাময় হাসি দিল কেবল।
ইন্টার ফাইনল এক্সামের দু'মাসে আগে রীতি ফোন দিয়ে জানায় সে আর আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছে না৷ আমাদের পথচলা এই পর্যন্তই ছিল। আর না। ফোনালাপটি এমন ছিল,
-একটা কথা বলি?
-বলো জান!
-সিরিয়াস কথা৷
-বলো না৷ শুনছি৷
-আমি আর রিলেশনটা রাখতে চাচ্ছি না৷ আমার স্টাডিতে অনেক ডিস্টার্ব হচ্ছে৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-এটা সিরিয়াস কথা?
-কেন? তোমার কাছে কি ফানি মনে হচ্ছে?
-অবশ্যই।
-আমি কিন্তু সিরিয়াস।
-মানে?
-আমি সত্যিই বলছি৷ আমি চাইনা আমরা আর এগিয়ে যাই৷
-রীতি তুমি ফান করছ!
-মোটেও না৷ আমি সত্যি বলছি তোমাকে।
-কী হয়েছে হঠাৎ?
-যা হয়েছে সেটার জন্যে তুমি দায়ী।
-আমি?
-হ্যা৷
-আমি আবার কী করলাম?
-এই যে আমার সময় নষ্ট করলে।
-সময় নষ্ট করেছি?
-হ্যাঁ। তোমার চক্করে না পড়লে আমার এক্সামের রেজাল্ট এতোটা খারাপ হতো না।
-তোমার এক্সাম খারাপের পেছনে আমি দায়ী?-তুমিই। তুমিই ফোন দিয়ে আমায় ডিস্টার্ব করতে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতে৷ যেসব আমি আগে কখনই করিনি। আমি একটা নিয়ম মেনে চলতাম। তুমি আমার নিয়মে ব্যাঘাত ঘটিয়েছো৷ আমাকে আমার লক্ষ্যচ্যুত করেছো। তোমাকে সঙ্গ দিতে গিয়েই আজ আমার এই অবস্থা। শোনো আমার লক্ষ্য স্থির করা৷ এসব প্রেম ট্রেম করে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না আর৷ তুমিও তোমার লক্ষ্যে আগাও৷ ভালো রেজাল্ট করে ভালো কিছু করে দেখাও।
-রীতি? তুমি এতোদিন আমায় সঙ্গ দিতে?
-তা-ই তো!
-সঙ্গ আর প্রেম দুইটা ভীন্ন কথা৷
-আমি প্রেম ট্রেম সম্পর্কে এতো বেশি কিছু জানি না৷ এবং সত্যি বলতে আমি তোমাকে নিয়ে তেমন কিছুই ফিল করি না৷ করিনি৷ আমি জাস্ট তোমার পাগলামোটাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এতোদিন তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি৷ যাতে তোমাকে সীমাবদ্ধতায় রাখতে পারি৷ কিন্তু কে জানতো তোমার এই চক্করে আমার নিজের অবস্থাই খারাপ হয়ে যাবে!
-পাগলামো মানে?
-পাগলামো মানে বোঝো না? এই যে যেখানেই দেখো তাকিয়ে থাকো, চারপাশে এতো ঘোরাঘুরি করো, এতো যে কথা বলতে চাও এসব কি কেউ লক্ষ্য করে না? সকলেই করে। এবং যখন লক্ষ্য করে আমার কাছে এসে তোমার সম্পর্কে জানতে চায় তখন আমার খুব রাগ লাগে৷ তুমি কেন আমার পেছনে ঘুরছো এসব প্রশ্ন আমাকে কেন করে সবাই? সবাই কেন আমার কাছেই জানতে চায়? তুমি জানো না এই ব্যাপারটা আমার জন্যে কতোটা ইরিটেটিং। আমার অসহ্য লাগতো৷ তোমার এসব চাঞ্চল্যতা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। তাইই তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করি৷ তখন ব্যাপারটা মোটামুটি চাপা পড়ে যায়৷ সহজে ব্যাপার গুলো ইগ্নোর করা যায়৷ তোমার প্রপোজের রিপ্লাইটাও আমি মন থেকে দেইনি৷ ফ্রেন্ডরা খুব পিড়া দিচ্ছিল এটা নিয়ে৷ পাশাপাশি ভাবলাম তোমাকে রিফিউজ করে দিলে তুমি আবার কোন নাটক শুরু করো। সে জন্যেই মূলত হ্যাঁ'টা বলি৷
রীতি থামলো। কিছু সময় সে চুপ করে থাকলো৷ আমি কিছু বলতে পারলাম না৷ কেবল মোবাইলটা কানের কাছে ধরে রাখলাম। আমার হাতটা কাঁপছিল তখন৷
-ভাইয়া?
আমি খানিকটা চমকে উঠি৷ পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি মিলির ছোটবোন দাঁড়িয়ে। সে বলল,
-এতো গভীর ভাবে কি ভাবছেন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সে আবার বলল,
-আপনাকে আপু ডাকছে।
-কেন?
-কেক কাটবে এখন৷ তাই৷
-এখনও কেক কাটেনি?
-না। আমাদের কিছু রিলেটভস আসার কথা ছিল৷ তাদের আসতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। তাই এই বিলম্ব।
কথাটা বলে সে চলে গেল। আমি ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। মিলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে কেক কাটলো। কেক কাটতেই সমস্ত মজলিস করোতালিত শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো।
-তোকে আমি প্রায়ই একটা গল্প বলতাম৷ মনে আছে তোর?
আমরা তখন ছাদে বসে আছি। সবার থেকে একটু দূরে। মিলির পার্টি প্রায় শেষ৷ মেহমানরা তখন চলে যেতে শুরু করেছে। সে সময়ে মিলি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। আমি খানিকটা অবাক হলাম। ওর চেহারায় বেশ সিরিয়াসনেস৷ বললাম,
-কোন গল্প?
-একটা মেয়ের গল্প৷ যে মেয়ে তার করা ভুলে জন্যে নিজের প্রেম হারায়৷ প্রেমিক হারায়৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-মনে পড়েছে! গল্পটা কিছুটা আমার গল্পের মতোন। এই গল্পটা নিয়ে আমাদের মাঝে বেশ তর্কবিতর্ক হতো তাই না?
-হু৷ তা হতো।
আমি আবারও হাসলাম। কিছু বললাম না আর। সে বলল,
-তোর কি কখনই মেয়েটার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হয়নি৷
-নাহ৷
-কেন?
-এমনি। ইচ্ছে হয়নি৷
-মেয়েটাকে জানবি?
-আগ্রহ নেই।
-তোর সব আগ্রহ তো তোর সেই কন্যাকে নিয়ে৷ সেই কন্যা যে তোকে একটা সময় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। -তাকে নিয়েই আগ্রহ থাকাটা স্বাভাবিক না?
-তা স্বাভাবিক। তবে...
-তবে?
-এই মেয়েটাকে তোর জানা উচিৎ।
-কেন?
-কারণ তোর আর তার গল্প মিলে একটি পরিপূর্ণ গল্প হয়৷
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওর দিকে। সেও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ তারপর বলল,
-এখানে আসার পর তুই যে মেয়েটাকে সবচে বেশি দেখেছিস সেই মেয়েটাই হচ্ছে আমার গল্পের মেয়েটা৷
-মানে?
মিলি খানিকটা থেমে বলল,
-সাদিক, রীতি আমার কাজিন হয়। তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। সে আমার আপন বোনের মতো৷
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। মিলিও চুপ করে থাকল কিছু সময়। সে কেবল আমার দিকে চেয়ে থাকলো৷ আমি তার চোখ দেখলাম। সে সত্যি বলছে৷ একদম সত্যি বলছে৷ মিলির চোখে জল জমে গেল। সে জল ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোদের ব্রেকাপটা ঠিক আমার কারণেই হয়েছে। এর জন্যে আমিই দায়ী।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকলাম। এতোটাই অবাক হলাম যে কিছু বলতেও পারলাম না। কেবল চুপচাপ শুনে যেতে থাকলাম৷ মনে হচ্ছে কথা বলার ক্ষমতাটাই হারিয়ে গিয়েছে আমার৷ মিলি আবার বলল,
-এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না৷ তোর সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হবার পর ফেসবুকের মাধ্যমে রীতি তোকে পেয়ে যায়৷ আমার কোনো পোষ্টের কমেন্ট থেকে হয়তো৷ এরপর সে তোর সম্পর্কে জানতে চায়৷ কেবল জানতে চায়। সাড়ে তিন বছর পর মেয়েটা সেদিন আমার সাথে কথা বলে৷ আমাকে মেসেজ দেয়৷ আমি তোর পরিচয় দেই৷ তোর সম্পর্কে বলি৷ সে তখনও আমায় কিছু বলেনি৷ চুপচাপ ছিল। আমি ভাবলাম এমনিই জানতে চেয়েছে৷ সিরিয়াস কিছু নয়৷ তাই আর বিস্তারিত জানতে চাইনি। কারণ ওই সময়ে ওর আমার সাথে কথা বলাটাই আমার কাছে বেশি কিছু মনে হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক ব্যাপার গুলো যেন আমি ভুলেই গেলাম। গতবছর আমার বার্থডেতে সে আমাদের বাসায় আসে। এসেই সোজা আমার রুমে ঢুকে। দরজা লাগিয়ে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে আমায়। আমার বুকের কাছে মুখ গুঁজে সেকি কান্না তার! আমি অবাক হই৷ বলি,
-কী ব্যাপার? কাঁদছিস কেন?
রীতি কিছু বলে না৷ কেবল আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। সেদিন ওর কান্নাটা যদি দেখতি! চোখের জল আঁটকে রাখতে পারতি না৷ মনে হচ্ছিল মেয়েটা এতোদিন কাঁদতে পারেনি। আজ হঠাৎই আমাকে কাছে পেয়ে কেঁদে দিল। আমার কোলটা তার একমাত্র কান্নার জায়গা হলো।
সে যখন শান্ত হয় আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে৷ ঠিক তখনই সে আমাকে তোর কথা বলে৷ তুই যে তার সেই প্রেম ছিলি সে কথা বলে। তোদের প্রেমের কথা বলে৷ আমার মাথায় বাজ পড়ে তখন। মাথাটা ভার হয়ে আসে কেবল। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমি মিলির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছু বলতেই পারলাম না। সত্যিই পারলাম না৷ মিলি আবার বলল,
-ইন্টারের সময়টাতে সে আমায় ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে৷ বলে তার নাকি এক্সাম রেজাল্ট খারাপ হয়েছে৷ সে জন্যে তার মন খারাপ৷ এতো বাজে রেজাল্ট তার কখনই হয়নি। আমি তাকে খুব বকাঝকা করি৷ তাকে যাচ্ছে তাই বলি৷ তাকে বোঝাই এই বয়সটা প্রেমের না৷ এখন পড়ালেখা করার সময়৷ সামনে এগিয়ে যাবার সময়। সাদিক, আমি তোর আর ওর ব্যাপারে আগ থেকেই জানতাম৷ রীতি আমাকে সব বলতো৷ সব৷ তাই আমি তাকে নানা ভাবে বোঝাতে থাকলাম। এসব প্রেমের কারণে মানুষ লক্ষ্যচ্যুত হয়৷ সবার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়৷ নিজের ইচ্ছের উপর মানুষের বিশেষ জোর থাকে না তখন৷ আমি তাকে খুব কঠিন ভাবে বললাম তোকে ছেড়ে দিতে। তোর সাথে আর কোনো যোগাযোগ না রাখতে বললাম। বললাম মাঝে মাঝে একটু কঠোর হতে হয়৷ কিছু পেতে হলে কিছু দিতেই হয়৷ সে আমার কথা শুনলো না৷ বরং সে আমাকে বেশ কঠিন স্বরে বলল,
-আমি এটা করতে পারব না৷ এটা করা অসম্ভব। আমি কখনই ওকে ছাড়তে পারব না৷ ওকে ছেড়ে তো আমি নিজেও থাকতে পারব না৷ আমার বেঁচে থাকাটাই তো কষ্টকর হয়ে যাবে৷ আর তুমি বলছো ওকে ছেড়ে দিতে? এটা তো কখনই সম্ভব হবে না৷
আমি ওকে বোঝাতে পারিনি৷ না বোঝাতে পেরে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকে তার স্টাডিও খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ আমি ভাবলাম ওকে এখান থেকে মুক্ত করে আনি। এই প্রেমের জাল থেকে আমার বোনটাকে বাঁচাই। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমি কী করে জেনে শুনে অন্ধকারে ঠেলে দেই? আমার ছোট বোনের মতো সে৷ জেনে শুনে তো তাকে এভাবে তলিয়ে যেতে দিতে পারি না। জেদ চাপল। আন্টি আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে সব বলে ফেললাম।
"আপনার মেয়ে মেট্রিকে গোল্ডেন পেয়েছে৷ তার একটা ব্রাইট ফিউচার আছে৷ আমরা সকলেই চাই ও ইন্টারেও ভালো করুক৷ কিন্তু আঙ্কেল, আমার মনে হচ্ছে রীতি সেটা আর করতে পারবে না। ও ওর লক্ষ্য থেকে সরে গিয়েছে৷ উল্টাপাল্টা মানুষের সাথে মিশছে৷ আপনারা কিছু করুন৷ এভাবে ওকে ছেড়ে দিয়েন না৷ লাইফটা হেল হয়ে যাবে ওর।"
আমি নিজে গেলাম ওর বাসায়৷ ওকে বোঝালাম৷ তাও কাজ হলো না৷ এরপর জোর করতে হলো৷ সেদিন যে ও তোকে ফোন দিয়েছে সে ফোন কলের সকল কথা আমার বানানো। আমি নিজেকে ওকে বলতে বলেছি৷ আঙ্কেল, আন্টি এবং আমি ওর সামনে বসে থেকে ওকে দিয়েই কথা গুলো বলিয়েছি। আমি তোর কথা ভাবিনি৷ আমি ওর মনের অবস্থাটাও জানতে চাইনি৷ আমি কেবল ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছি৷ কেবল ওর ভবিষ্যৎ। ঠিক সে জন্যে আমার বোনটা সাড়ে তিন বছর আমার সাথে কথা বলেনি৷ আমার মুখটাও দেখেনি।
সত্যি বলতে ওই ঘটনার পর ও কেমন জানি হয়ে যায়৷ বিশেষ করে ওই মূহুর্তেই যে ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি৷ ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটল যে মেয়েটা তোর সাথে শেষবারের জন্যেও দেখা করতে পারেনি৷ সেখান থেকে সব কিছু নিয়েই দ্রুত ঢাকায় চলে আসে৷ এই ব্যাপারটা রীতিকে একদম বদলে দেয়৷ ওকে কেমন নিশ্চুপ করে ফেলে৷ সে একদম শান্ত হয়ে যায়৷ কেমন অন্যরকম৷ আমার সাথে তো কথাই বলত না৷ বাসার কারো সাথেই তেমন কথা বলতো না৷ সেই মূহুর্তে ওর আম্মু যদি ওকে বলতো, "রীতি একটু বিষ দেই৷ খেয়ে নে৷" সে নির্দ্বিধায় সেটা খেয়ে নিতো। এমন হয়ে গিয়েছিল সে৷
আমরা সবাইই চিন্তায় পড়ে গেলাম। এমন হাস্যজ্বল-প্রানবন্ত মেয়েটি এমন কেন কেন হয়ে গেল৷ প্রেম গেলে গেছে না হয়৷ এ বয়সে তো এমনই হয়ই। তাই বলে কেউ এতোটা ভেঙ্গে পড়বে? এভাবে মূহুর্তের মাঝে অচেনা হয়ে যাবে? রীতির এমন অবস্থা দেখে আমার আন্টি প্রায়ই আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতেন৷ তার একটাই কথা,
"মিলি, মেয়েটা এমন কেন হয়ে গেল? আমাদের কারো সাথেই তেমন কথাবার্তা বলে না৷ এমন আচরণ করে যেন আমরা তার পর। আপন কেউ না৷" আন্টির প্রতিটি ফোন কল তখন আমায় একটা কথা বুঝিয়ে দিতো। খুব করে বোঝাতো,
"মিলি তুই অন্যায় করেছিস৷ তোরা সবাই মিলে মেয়েটার সাথে অন্যায় করেছিস৷ এমনটা না করলেও পারতি তোরা৷"
আমি নিজেই বুঝতে পারলাম আমি কতোবড় ভুল করেছি৷ কতো বড় ভুল৷ সাড়ে তিন বছর পর মেয়েটি আমার সাথে কথা বলে। মেসেঞ্জারে ছোট্ট একটা মেসেজ,
"ছেলেটা কে?"
আমি যখন জানতে পারলাম তুইই সেই ছেলে তখন আমার অপরাধবোধ আরো বেড়ে গেল৷ আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তোর চোখে চোখ রাখতে পারতাম না৷ তুই যখন তোর প্রেমের কথাটা বলতি আমার ভেতরটা কেঁপে উঠতো৷ বারবার মনে হতো আমি অপরাধী। আমি মহা অপরাধী। আর সহ্য করতে পারছিলাম না৷ এরপরই প্রতিজ্ঞা নেই৷ যা হবার হোক৷ তোদের এবার এক করিয়েই ছাড়ব। তোরা আমাকে ক্ষমা কর কিংবা না কর৷ আমি তোদের মিলিয়ে ছাড়বোই৷
মিলি থামলো৷ চুপ করে মাথা নিচু করে রাখলো৷ আমার চোখে জল৷ গলাটা কেমন ভার হয়ে আছে৷ কেমন ধরে আসা স্বরে বললাম,
-তোর বোনটার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়েছে তো?
মিলি ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ আমার হাত চেপে ধরলো সে৷ বলল,
-প্লীজ৷ ফরগিভ মি সাদিক৷ ফরগিভ মি। আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছে মানুষের জীবনে সুখটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কতোটা প্রয়োজনীয়।
আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-তুই যেদিন প্রথম গল্পটা আমায় বললি আমার কেমন জানি লাগলো৷ মনে হলো এই গল্পটা বেশ পরিচিত৷ একদম আমার গল্পটার মতো৷ অথবা এটা আমার গল্পটার বাকি অংশ৷ আমার বেশ খটকা লাগলো৷ প্রথমবার কিছু করলাম না। দ্বিতীয়বার মনমরা হয়ে সেই একই গল্প যখন আবার বললি তখন আমার কেন জানি মনে হলো এটা নিয়ে একটু ভাবা উচিৎ। কিছুটা রিসার্চ প্রয়োজন৷ তোকে তো সরাসরি জিজ্ঞেস করা যাবে না৷ কী মনে করিস আবার৷ এদিকে খোঁজ নেওয়ারও কোনো উপায় পেলাম না৷ বেশ ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে৷ কীভাবে কী করা যায়! এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকদিন পর রীতির কথা মনে পড়ে গেল৷ সেই রঙিন স্মৃতি গুলো আবার মাথানাড়া দিয়ে উঠলো৷ ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে একবার দেখি৷ কতোদিন দেখিনা তারে৷ এখন কেমন জানি আছে সে! সে রাতেই রুদ্রকে ফোন দিলাম। বললাম রীতির ফেসবুক আইডি ম্যানেজ করে দিতে৷ রুদ্র সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে তার আইডির লিংক দিলো৷
আমি ওর আইডিতে গেলাম। ওর প্রোফাইল ঘাটলাম। প্রায় অনেক রাত পর্যন্ত আমি সেই প্রোফাইলে পড়ে থাকলাম৷ এক একটা ছবি আমি প্রায় পনেরো বিশ মিনিট নিয়ে দেখেছি৷ কেবল তাকিয়ে থেকেছি৷ ব্যাস৷ ঘাটতে ঘাটতে আমি যখন অনেক নিচে নেমে এলাম তখনই একটা পোষ্টে তোর কমেন্ট দেখলাম৷ তুই যে লাইক দিয়েছিক সেটাও শো করছিল। আমি আরো ঘাটলাম৷ শেষের ছবি গুলোতেও তোর কমেন্টস আছে৷ আমি ওর এবাউট চেক করলাম৷ সেখানেই গিয়ে দেখলাম ফ্যামিলি মেম্বারে তোকে কাজিন করে রাখা৷
আমি থ হয়ে গেলাম৷ মাথায় যেন বাজ পড়লো৷ তাহলে তুই এতোদিন আমার রীতির গল্পই বলছিলি? আমার গল্পই আমাকে বলছিলি? আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না৷ খানিকটা মন খারাপই হলো৷ তুই আমাকে কেবল তোর কাজিনের গল্পটাই বলতে৷ কখনই বলিসনি তোর কাজিনের বিপরীতের মানুষটি কেমন আছে৷ সেটা নিয়ে হয়তো তুই ভাবিসওনি৷ তুই তোর কাজিনের চিন্তায়ই মগ্ন ছিলি৷ আমি ভাবলাম তোকে কথা গুলো বলি৷ তোর গল্পের বাকি কিছু অংশ তোর জানা উচিৎ। তোকে জানাই৷ আমি ছলেবলে অনেক চেষ্টা করলাম। অনেক ভাবে তোকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। অথচ তোকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না আমি। কিংবা তুই বুঝতে চাইতি না৷ বা এড়িয়েই যেতি আমার গল্পটা৷ একবার ভাবলাম সরাসরি বলে দেই৷
পরে ভাবলাম থাক৷ এসব নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো হবে৷ তোর কাজিন আমার সাথে চিট করেছে এটা জানার পর তোর মন খারাপ হবে। আমাদের মধ্যে না চাইতেই দূরত্ব তৈরী হবে৷ আমি সেটা চাইনি। তাইই তোকে কিছু বলিনি৷ এমনকি এরপর থেকে তোর সাথে আমার পূর্বের প্রেম নিয়ে কোনো আলোচনাও করিনি৷ থাক সেসব৷ পুরনো পুরনোই৷ তবে কিছু ব্যাপার মাথায় ঢুকতো না৷ তুই বলতি কোনো ছেলে তোর কাজিনকে কষ্ট দিয়েছে৷ কোনো ছেলের জন্যে সে কষ্ট পাচ্ছে৷ সে কষ্ট পায় কীভাবে? যেখানে সে নিজেই আমাকে ছেড়ে গেছে৷ সেখানে তার কষ্ট পাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক লাগলো৷ প্রশ্নটা বেশ ক'বারই মনের ভেতর এসেছে৷ কিন্তু বলিনি৷ বলতে পারিনি। চুপচাপ থেকেই গেলাম।
এছাড়া হয়তো আর কোনো উপায়ও ছিল না৷ কিন্তু এখন জানতে পারলাম আমি যে গল্পটা জানি তার ভেতরেও আরো একটা গল্প আছে৷ জোরজবরদস্তির গল্প। যেটা আমি জানি না৷ অথচ আমার জানা উচিৎ ছিল।
কথাটা বলে থামলাম। এরপর মৃদু হেসে বললাম,
-কাকতালীয় ভাবে তুই আমার গল্পেরই ভিলেন হয়ে গেলি৷ অজান্তেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার বিধ্বস্তের কারণ হয়ে গেল।
মিলি জলভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-তুই আমাকে কথাটা একবার বলতি সাদিক৷ জাস্ট একবার কথাটা বলতি৷ আমি তোদের আরো আগেই মিলিয়ে দিতাম৷ এতোদিনে আমার মাথা থেকে এই অপরাধের বোঝটা নেমে যেতো৷ আমিও একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম৷ শান্তির ঘুম না রে অনেকদিন।
আমি চুপ করে থাকলাম। কিছু বললাম না৷ সব কিছুই কেমন জানি লাগছে৷ কেমন অন্য রকম। হাসফাস লাগছে৷ ভেতরটা কেমন অস্থির৷ মিলি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো৷ বলল,
-বসে থাক এখানে৷ ও আসবে৷
আমি বসে থাকলাম৷ কিংবা বলা যায় আমি কী করব ভেবে পেলাম না৷ আমার কী করা উচিৎ তাও বুঝতে উঠলাম না৷ আমার কেন জানি এখান থেকে উঠতেই মন চাচ্ছে না৷ আমাত মন চাচ্ছে আমি এখানে বসে থাকি৷ আজ সারাটা রাত এখানে বসে কাটিয়ে দেই৷ আমি চুপচাপ সেখানে বসে থাকলাম৷ অল্প কিছু পরেই দেখলাম কালো শাড়ি পরা মেয়েটি এগিয়ে আসছে৷ যার হাত ভর্তি চুড়ি৷ কপালে টিপ৷ চোখে কাজল। সেই কাজল লেপ্টানো। চোখের চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে৷ মেয়েটা আগের থেকে আরো রোগা হয়ে গিয়েছে৷ চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা৷ মুখটা ফ্যাকাসে। রীতি আমার কাছে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে থেকেই তার দিকে চেয়ে থাকলাম। কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললাম,
-কে-কে-কে-ম-ন আছো?
রীতির চোখে জল৷ কণ্ঠে কান্না মেখে বলল,
-প্রথম যেদিন তুমি আমার হাত ধরেছিলে সেদিনের কথা কি তোমার মনে আছে? তুমি বলেছিলে আমার হাত কখনই ছাড়বে না৷ মনে আছে সে কথা?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-আছে৷
-তখন আমি কিছুই বলতে পারিনি৷ কেন পারিনি জানি না৷ তবে সেই সময়ে আমার একটি ইচ্ছে জেগেছিল মনে৷ আমার খুব করে ইচ্ছে হয়েছিল তোমাকে জড়িয়ে ধরি৷ খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরি৷ কিন্ত কেন জানি তখন কথাটা বলতে পারিনি৷ আজ সেই কথাটা বলার সুযোগ হয়েছে৷ খুবই উপযুক্ত সুযোগ।
কথাটা বলে রীতি আমার দিকে চেয়ে থাকলো। আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো আমার দিকে৷ আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম৷ কী মায়া সেখানে৷ কী অনবদ্য এই দু'চোখ৷ তাকিয়ে থাকার কী অসাধারণ স্বাধ৷ কী ঘোর৷ আমি চেয়ে থাকলাম। রীতির চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়ে গেল৷
সে কান্নামিশ্রিত স্বরে বলল,
-যাবার আগে অন্তত তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরার সুযোগটি আমার হয়নি৷ তোমাকে কয়েক সেকেন্ড দেখার সুযোগও আমার হয়নি৷ কেমন অতৃপ্ত ছিলাম৷ আমার সব আছে৷ অথচ মনে হতো কী জানি নেই৷ কেউ একজন নেই৷ কোথাও যেন ভীষণ শূন্যতা। খালিখালি ভাব। ভেতরে খুব তৃষ্ণা। খুব কাতর৷ না পাওয়ার ব্যাথায় ভুক্তভোগী আমি৷ নিজের নামে মিথ্যা বলে তোমার সাথে যে অন্যায় করলাম, তোমাকে কষ্ট দিয়ে যে বিচ্ছেদ করলাম তার কষ্ট আমি এখনও পাচ্ছি৷ প্রতিটা সেকেন্ডে পাচ্ছি। কী তীব্র সেই ব্যাথা তাকি তুমি জানো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-খুব জানি৷
রীতি আরেকটু এগিয়ে আসে৷ বলে,
-'জান' শব্দটাও একটা শূন্যতা তৈরী করে ফেলেছিল সাদিক৷ কতোদিন শব্দটা শুনি না৷ কেউ বলে না৷
রীতি খানিকটা সময় চুপ থাকলো৷ বলল,
-আমার সেই অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলো আজ পূরণ হোক৷ আমার হৃদয়জগতে ভীষণ খরা৷ আজ সেখানে বৃষ্টি নামুক৷ মুশলধারায় বৃষ্টি নামুক৷ আমার সকল অতৃপ্তি আজ তৃপ্ত হোক৷ সাদিক তুমি কি আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে৷ তোমার বুকে মাথা রেখে ভীষণ কাঁদতে মন চাচ্ছে আমার৷ আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে সাদিক৷ আমি অনেকক্ষন কাঁদব আজ৷ তুমি কি আমায় তোমার বুকে একটুখানি ঠাই দিবে? একটুখানি কাঁদতে দিবে?
আমি কিছু বললাম না। আর অপেক্ষা করলাম না৷ মেয়েটাকে চট করেই জড়িয়ে ধরলাম৷ একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম। কেমন জড়িয়ে আসা স্বরে বলল,
-প্রশান্তি মিলেছে আজ৷ দলবেঁধে সুখেরা এসেছে৷ রীতি তুমি কি জানো তুমি আমার একমাত্র সুখ? এক মাত্র প্রশান্তি?
রীতি কিছু বলল না৷ বলতে পারলো না৷ সে কেবল আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো৷ কী তীব্র সেই কান্না। কী ভীষণ ব্যাথাময় সেই কান্নার স্বরে৷ আমি রীতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। বললাম,
-আর কখনই আমাকে ছেড়ে যাবা না৷ আমি তোমাকে যেতে দিবো না৷ তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে রাখবো৷ কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না৷ কেউ না৷
রীতি কিছু বলল না৷ সে কেবল আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়৷
গল্পঃ গল্পের ভেতরের গল্প
ভুলত্রুটি মার্জনীয়