Bangla New Love Story - বুকের কাছেই থাকুক সে। তাসফি আহমেদ
Bangla New Love Story - বুকের কাছেই থাকুক সে। তাসফি আহমেদ
Bangla New Love Story - বুকের কাছেই থাকুক সে। তাসফি আহমেদ
গল্পঃ বুকের কাছেই থাকুক সে।তাসফি আহমেদ।
-কেমন আছিস?
মিহিন আমার কথাটার জবাব দিলো না৷ আমার দিকে তাকালোও না। পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। খানিকটা অবাকই হলাম। কী ব্যাপার। হঠাৎ এমন করল কেন ও? আমি পেছন থেকে ডাক দিলাম,
-মিহিন?
সে শুনলো বলেও মনে হলো না৷ দ্রুত পায়ে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ মেয়েটা এতোদিন পর ভার্সিটি এলো, কোথায় ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করবে, তা না করে সে রাগ দেখিয়ে হেঁটে চলে গেল৷ একবার তাকিয়েও দেখল না৷ এমন ভাব করলো যেন আমায় চিনেও না সে। ঘটনা কী? এমনটা কেন করলো ও? আমি কি কিছু করেছি? আমার জানা মতে তো না৷ ওর সাথে এই ক'দিন আমার দেখা'ই নেই৷ তাহলে কিছু করার তো প্রশ্নই আসে না৷ অবাক ভাব নিয়েই ক্লাসের দিকে এলাম। মাথায় তখন কেবল মিহিনের ব্যাপারটাই ঘুরছে৷
ক্লাসে এসে দেখলাম সে গাল ফুলিয়ে বসে আছে৷ দেখেই বোঝা যায় খুব রেগে আছে৷ তবে রাগের কারণটা ঠিক বোঝা গেল না৷ আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। সিটটা খালিই ছিল৷ বললাম,
-কী হয়েছে তোর?
মিহিন কোনো জবাব দিলো না৷ ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কি যেন দেখছিল। আমি ওকে ডাকলাম,
-মিহিন?
সে নিরুত্তর। আশ্চর্য ব্যাপার। এই মেয়েটা এমন করছে কেন?
-তুই কি কোনো কারণে রেগে আছিস?
কোনো জবাব নেই৷ এবার আমার কাছেই কেমন জানি লেগে উঠছিল৷ একটা মানুষকে এতোবার একটা প্রশ্ন করার পর সে যদি কোনো জবাব না দেয়, যদি এমন অপরিচিত বিহ্যাভ করে তবে সেটা কেমন অস্বস্তি এবং লজ্জাবোধ সৃষ্টি করে মনের ভেতর। আমার বেলায়ও তা হচ্ছিল৷ তবুও মনের ভেতর সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরে করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-মিহিন, তুই কোনো ভাবে আমার উপর...
মিহিন চট করেই আমার দিকে ফিরলো। চোখেমুখে তার তীব্র রাগ৷ চেহারাটা কেমন লালছে হয়ে আছে৷ সে বেশ কঠিন স্বরে বলল,
-আর একটা কথা যদি বলিস তবে আমি এখান উঠে যাবো৷ হয় চুপচাপ বসে থাক৷ না হয় উঠে যা৷ তোর বসার দরকার নেই এখানে৷
এই কথা শোনার পর স্বাভাবিক ভাবেই যে কারো আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগার কথা৷ কেউই এরপর তার পাশে বসে থাকবে না৷ এমন অপমান আসলে ঠিক ভাবে নেয়া যায় না৷ তবে আমি বসে থাকলাম। অপমানটাকে গিলে নিলাম। ক্লাসের অন্য সবাই আমার দিকে বেশ লক্ষ্য করছিল৷ কারণ তার এই কথাটা বলার পরই ক্লাসটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। অল্প কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতায় কাটার পর চাপা হাসি শব্দে সেই নীরবতা ভাঙ্গল৷
পুরো ক্লাসটাই আমি চুপচাপে করে নিলাম। সব গুলো ক্লাস করার পর যখন মিহিন বের হতে যাবে তখন আমি তাকে বললাম,
-তোর নোট লাগবে? এ ক'দিন তো ক্লাস করিসিনি৷ নোট...
সে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে মারিয়ার কাছে গেল। তার কাছে গিয়ে বলল,
-নোট গুলো এনেছিস?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বই আর নোট গুলো ব্যাগে ভরে নিলাম৷ মিহিন আর মারিয়া তখন ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েছে৷ ঠিক সে সময়ে নিহান এবং ক্লাসের অন্য কয়েকটা ছেলে এসে আমার কাছে ভীড় করলো৷ নিহান আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
-সংসারে আগুন লেগেছি নাকি?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। কিছু বললাম না৷ বলেও বা লাভ কী! বোকাদের সাথে আর যাই হোক তর্ক করা মানায় না৷ এছাড়া এই ছেলে গুলোর খুব সমস্যা, আমি কেন মিহিনের সাথে এতো মিশি, সারাক্ষণ কেন তার সাথে থাকি এসব নিয়ে৷ এদের সাথে কথা না বলাই ভালো৷ আমি ওদের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এলাম। সাদিকের ডিপার্টমেন্টের সামনে আসতেই দেখলাম সে বেরিয়ে আসছে৷ আমাকে দেখতেই হাসলো। বলল,
-কী হিরো! চেহারার এই হাল কেন?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম৷ বললাম,
-কী হাল?
-এই যে এমন কালো হয়ে আছে?
-কালো হয়ে আছে নাকি?
সাদিক শব্দ করে হাসলো৷ বলল,
-ছেলের মন খারাপ অথচ সে নিজেও তা জানে না৷ মন খারাপ কেন তোর?
-কই? মন খারাপ না তো।
-আচ্ছা বাদ দে৷ তোকে একটা গুড নিউজ দেই।
-কী গুড নিউজ৷
সাদিকে চোখমুখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে এলো৷ সে হাসি মুখে বলল,
-আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আছে না? নিশি।
-তোর সাথে যে প্রায়ই দেখি৷ ওই মেয়েটা?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ওই মেয়েটা৷ ওর থেকে আজ একটা সিক্রেট উদ্ধার করেছি৷
-কী সিক্রেট?
-এই যে তার ভার্সিটির ক্রাশ বয় কে? কাকে ও পছন্দ করে।
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-এটা আমার জন্যে গুড নিউজ হয় কীভাবে?
সাদিক হাসতে হাসতে বলল,
-তুই জানিস ওই ক্রাশ বয় কে? তার ক্রাশ বয় হলি তুই৷ সে তোকে মনে মনে পছন্দ করে৷
আমি মৃদু হাসলাম৷ বললাম,
-আর গুড নিউজ পেলি না তুই৷
সাদিক এবারেও হাসলো৷ বলল,
-এবার বল তোর মন খারাপ কেন?
-আমার মন তো খারাপ না৷
-আমার কাছ থেকে লুকাবি না৷
-লুকানোর কিছু হয়নি৷
-আমি তোকে খুব ভালো করেই চিনি এবং তুই নিজেও আমাকে ভালো করে চিনিস৷
-বাসায় গিয়ে বলব৷ এখন থাক৷
-আচ্ছা৷ কিছু খাবি তুই?
-ক্ষুদা নেই৷
-আমার ভীষণ ক্ষুদা লেগেছে। চল কিছু গিলে আসি।
.
পরের দিন কেন জানি ভার্সিটি আসতে মন চাইলো না৷ তাও আসলাম৷ গেট পের হতেই দেখলাম নিশি মেয়েটা এগিয়ে আসছে৷ আমার সাথে চোখাচোখি হতেই বলল,
-হাই! কেমন আছেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-ভালোই৷ আপনি?
-খুন ভালো। সাদিক আসেনি?
-আসছে৷ একটু কাজ আছে৷ সেটা সেরেই আসবে৷ আপনি কি ওর অপেক্ষা করছেন?
মেয়েটা কেমন জানি একটা হাসি দিলো৷ বলল,
-আমি আসলে আপনার অপেক্ষা করছিলাম।
বলেই সে নিজের নিচের ঠোট চেপে ধরলো৷ হাসি কিংবা লজ্জা আঁটকাবার চেষ্টা করছে হয়তো৷ বললাম,
-আমার?
-জি৷
-কেন?
-এমনি। কথাবার্তা বলতাম।
-অহ আচ্ছা৷
-ক্লাস কখন শুরু হবে আপনার।
-বিশ মিনিটের মতো সময় আছে৷
-চলুন কোথাও বসি৷
আমি ভাবলাম সময় যেহেতু আছে একা একা থাকার চেয়ে মেয়েটার সাথে গল্প করি৷ এই ভালো। আমিও বা একাএকা কী করব৷ তাই বললাম,
-চলুন।
আমরা গোল চত্ত্বরের কাছে এসে বসলাম। বসার পর প্রথম কথা নিশিই বলল,
-তো মিস্টার তাসফি আহমেদ!
আমি মেয়েটির দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। বললাম,
-আপনি এই নাম জানেন কী করে?
-কেন? এই নাম কি জানা যায় না?
-না, ঠিক তা না৷ সবাই আমাকে শাকের আহমেদ নামে চিনে৷ তাসফি আহমেদটা অনেকেই চেনে না৷ তাই আপনি চট করেই বলে ফেলাতে অবাক হলাম৷
-আচ্ছা৷ বুঝতে পেরেছি। তা তাসফি নামটা তো আপনারই? নাকি ছদ্মনাম?
-আমার নিক নেম।
মেয়েটা হাসলো৷ বলল,
-লেখালেখি করছেন কবে থেকে?
-বাহ! আপনি এই খবরও জানেন?
-আপনাকে তো আমি ওখান থেকেই চিনি৷ বলতে গেলে আমি আপনার গল্পের একজন বড়সড় ভক্ত।
আমার মনটা চট করেই ভালো হয়ে গেল। আমি মৃদু হাসলাম৷ বললাম,
-ভালো লাগলো৷ আসলে আমার লেখালেখির ব্যাপারটা অনেকেই জানে না৷
-কেন জানে না?
-এমনিই৷ জানাতে ইচ্ছে হয় না৷
-তা বোঝাই যায়৷ আইডিতে তেমন কোনো তথ্য নেই৷ ছবি দেন৷ তবে কয়েকদিন পর সেটাও হাইড করে ফেলেন৷
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ ভাবলাম মেয়েটা আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে৷ অনেক কিছু৷ এই ব্যাপারটা ভালো লাগলো। বললাম,
-ষোলো সালের শেষ দিক থেকে লেখালেখি শুরু করি৷
মেয়েটা হাসলো৷ বলল,
-আপনার পুরো প্রোফাইলটা ঘাটা শেষ৷
আমি খানিক হেসে বললাম,
-বেশ! তাহলে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন বলতে হয়৷
-তা জানি৷ বেশ ঘেটেছি কি না৷
কথাটা বলেই মেয়েটা হাসলো৷ আমিও হাসলাম। ঠিক সে সময়ে দেখলাম মারিয়া আর মিহিন আসছে৷ আমি মিহিনের দিকে তাকালাম। তার চেহারায় সেই রাগ, সেই অভিমান এখন লেপ্টে আছে৷ মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে। রোগা রোগা৷ আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। মারিয়ার দিকে তাকালাম। তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। বললাম,
-মারিয়া শোন তো!
মারিয়া চট করেই থেমে গেল। মিহিন থামলো না। সে হেঁটে এগিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে যখন দেখলাম মারিয়া দাঁড়িয়ে পড়েছে তখন সে বেশ রূড় স্বরে বলল,
-মারিয়া?
মারিয়াকে কিছু বলার সুযোগটাও পেলাম না৷ সে দৌড়ে মিহিনের কাছে চলে গেল। আমি নিশির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। নিশি বলল,
-ক্লাসমেট?
-বেস্টফ্রেন্ড।
-রেগে আছে নাকি?
-আমারও তাই মনে হয়৷ কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছে৷
-সো স্যাড৷
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,
-উঠি৷ ক্লাসের সময় হয়েছে৷
নিশি হাসল। বলল,
-আমাকেও যেতে হবে৷
ক্লাসের দিকে আসতেই দেখলাম নিহান তার বন্ধুদের সাথে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে৷ ছেলেটার চেহারা কেমন মলিন। দুঃখি দুঃখি ভাব৷ আমার দিকে তাকালোও না৷ বেশ অবাক হলাম। হাসিঠাট্টা করা এই ছেলেটার হঠাৎ কী হয়ে গেল?
.
-মেয়েটা তোর সাথেই এমন করছে?
-হ্যাঁ৷
সাদিককে বেশ চিন্তিত দেখালো৷ বলল,
-ও তো এমন মেয়ে না৷ হঠাৎ এমন করছে কেন?
আমি বললাম,
-কে জানে৷
-তোর কি খুব খারাপ লাগছে?
-নাহ৷
-তাহলে ঘুমচ্ছিস না কেন?
-ঘুম আসছে না।
-কেন আসছে না?
-জানি না৷
সাদিক হাসলো৷ বলল,
-বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলি রে৷
-ঝামেলা?
-হ্যাঁ৷
-কিসের ঝামেলা?
-এই যে মায়ামমতার ঝামেলা!
-বুঝিনি৷
-বুঝবি না৷
-কেন?
-কারন তোর কেন ঘুম আসছে না সেটা তুই জানিস না৷ সেটা যদি জানতি তবে এই ব্যাপারটাও বুঝতে পারতি৷
-মজা করিস না৷
-মজা করলাম কই৷ সত্যই তো বললাম।
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। সাদিক টেবিল উঠে এলো৷ আমার বিছানার কাছে বসে বলল,
-এক সপ্তাহ থেকে কেমন চটপট করছিস৷ তোর স্বাভাবিক সকল নিয়ম কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে৷ যাচ্ছে৷ এটা কি তুই বুঝতে পারছিস?
আমার গলা দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ সাদিক আবার বললাম,
-মিহিনকে ভালোবাসিস?
-আমি ভালোবাসা বুঝি না৷
সাদিক শব্দ করে হাসলো৷ হাসতে হাসতে বলল,
-ফেঁসে গেলি।
-মোটেও না৷
-শোন, তোকে আমি বেশ ভালো করেই জানি৷ আমার কাছে তুই কোনো কিছুই লুকাতে পারবি না৷
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। বললাম,
-চোখের পাতা এক করতে পারি না৷ এক করলেই দেখি মিহিন তাকিয়ে আছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷
সাদিক আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। তারপর উঠে গিয়ে পড়ার টেবিল বসল। আমি বললাম,
-রাত তো অনেক হলো৷ ঘুমাবি না? নাকি পড়েই কাটাবি?
সাদিক হাসলো৷ কিছু বলল না৷ আমি উঠে গিয়ে বারান্দার কাছে গেলাম। বাইরে ভরা পূর্নিমা। চাঁদের আলো বারান্দায় আছড়ে পড়ছে৷ সাদিক পেছন থেকে বলল,
-কফি চলবে এককাপ?
-নিয়ে আয়৷
অল্প কিছুক্ষণ পরেই সাদিক কফির মগ হাতে এগিয়ে এলো। একটা মগ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-মিহিন তোর উপর রেগে আছে কেন এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিস কিছু?
-বুঝতে পারছি না৷
-তোর সাথে ওর লাস্ট ভালো ভাবে কথা হয়েছে কবে?
-ভালো ভাবে? ওর এক্সিডেন্ট হওয়ার আগে৷
-এরপর আর কথা হয়নি?
-না৷
-ফোনেও না?
-ফোন দিয়েছিলাম৷ ধরেনি৷
-এক্সিডেন্টের পর ফোন না ধরাটাই স্বাভাবিক। হাসপাতালে কতোদিন ছিল ও?
-এক সপ্তাহ হবে৷
-এই সময়ের মাঝে তুই ফোন দিয়েছিস?
-দিয়েছি৷
-ধরেনি?
-না।
-প্রতিদিন ফোন দিয়েছিস?
-প্রতিদিন দিয়েছি৷
-এখানেই ঝামেলা। এখান থেকেই সে রেগে আছে৷ এবার ভাব এখানে তার রেগে থাকার রিজনটা কী হতে পারে!
-আমি বুঝতে পারছি না দোস্ত৷ এসব নিয়ে ভাবলেই মাথাটা ভারী হয়ে আসে৷
সাদিক খানিকটা সময় চুপ করে থাকলো। বলল,
-তুই মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিস না৷
-কোন ব্যাপারটা?
-এই যে মিহিন কেন রেগে আছে সেটা নিয়ে৷
-ভাবছি।
-তোকে দেখে মনে হচ্ছে না। তুই কি আমার কাছ থেকে কিছু লোকাচ্ছিস?
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-ওইদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল।
-কী ঘটনা?
আমি আরো কিছুটা সময় নীরব থাকলাম। কফির মগে চুমুক দিয়ে চাঁদের দিকে তাকালাম। বললাম,
-মিহিনের এক্সিডেন্টের আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। ও এক্সিডেন্ট করছে শুনেই তো আমার অবস্থা খারাপ৷ কোনো মতে দৌড়ঝাপ দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম।
আমি একটু থামলাম। এক চুমুক কফি গিলে বললাম,
-ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম মিহিন মোটামুটি ধরনের একটা এক্সিডেন্ট করেছে৷ হাত পায়ে চোট লেগেছে কিছু৷ বাঁ'বাজুর কাছ দিয়ে কিছু ছিলে গিয়েছে৷ বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে শুনলাম। ও ওই সময়টায় সেন্সলেস ছিল।
আমি থামলাম। সাদিক বলল,
-এরপর?
-আমি হাসপাতালে গেলাম৷ তার খোঁজ করতে থাকলাম। এক সময় তাকে পেয়েও গেলাম। ওর অবস্থা জানার জন্যে একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে সব বললেন। মিহিন ঠিক আছে৷ সেন্স ছিল না অনেকক্ষন৷ এখন সেন্স ফিরেছে। আমি বেশ খুশি হলাম। বললাম দেখা করার ব্যবস্থা করা যাবে কি না৷ তিনি বললেন দেখছেন ব্যাপারটা। আমি করিডোরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। সেউ নার্স ফ্রি হলে তার কাছে আবার জানতে চাইলাম, দেখা করার ব্যাবস্থা করা যায় কি না৷ তিনি আমাকে সাফসাফ জানিয়ে দিলেন আমাকে ওই রুমে ঢুকতে দেওয়া হবে না৷ আমি ওখানে যেতে পারব না৷ এরপর সব কিছু বেশ দ্রুতই ঘটল৷ দুইটা ছেলে এসে আমাকে বলল আমি যেন এখান থেকে চলে যাই৷ আমি বললাম কেন যাবো? থাকলে সমস্যা কী? হ্যাংলা করে একটা ছেলে ছিল, নাম নয়ন৷ মিহিনের গাড়ির ড্রাইভার এখন সে৷ সে বলল,
-ভাই, আপনি এখানে থাকিয়েন না৷ চলে যান৷ অযথা অপমানিত হবেন?
-আশ্চর্য ব্যাপার! অপমানিত কেন হবো?
-বড় মেডাম বলেছে আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। আপনি যেতে না চান তবে জোর করতে৷
-কোন বড় মেডাম?
-মিহিন মেডামের মা।
আমি বললাম,
-থাকি একটু৷ আমি ওর বন্ধু৷ খুব ভালো বন্ধু। ওকে একবার দেখে যাবো। ব্যস৷
-আপনার সম্পর্কে আমরা সব কিছুই জানি। আপনি কে, কী করেন না করেন সব৷
-সব জেনেও তিনি আমাকে চলে যেতে বলেছেন?
-জি ভাই৷ কিছু মনে করবেন না৷ আপনাকে এভাবে যেতে বলতে হচ্ছে৷
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-সমস্যা নেই৷
-উনি বলেছেন আপনি যেন এখানে আর না আসেন এবং মিহিন ম্যামের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলতেন৷
আমি চলে এলাম সেখান থেকে। কিছুই বললাম না আর। এই ঘটনাটা মিহিন জানে না৷ তার রেগে থাকার কারণ খুব সম্ভবত এটা হতে পারে যে আমি কেন তাকে দেখতে যাইনি৷ কেন তার খোঁজ নেইনি৷ এমন কিছু৷ এজ এ বেস্টফ্রেন্ড, তার এই ক্ষেত্রে রাগ করাটা স্বাভাবিক। অথচ সে তো জানে আদত কী ঘটেছে। তোকে আমি একটা ভুল তথ্য দিয়েছি৷ ওই সময়ে আমি মিহিনকে প্রতিদিন কল দেইনি। প্রথম দিনের পর দ্বিতীয় দিন কয়েবার দিলাম৷ দেওয়ার পর মনে হলো ওকে ফোন দেওয়াটা আসলে বৃথা৷ ওর ফোনটা ওর মায়ের কাছেই থাকবে হয়তো৷ তার কাছে থাকলে মিহিনের কাছে ফোনের খবর যাওয়াটা অস্বাভাবিক ব্যাপার৷
বলে হাসলাম আমি৷ সাদিকের দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কপাল কুচকে আছে ওর৷ বলল,
-মিহিনের মা এমনটা কেন করলো?
-কে জানে! উনি আমাকে বিশেষ পছন্দ করেন না বোধহয়।
-তাই বলে এমন করবেন?
-করলেন তো!
-কথাগুলো আগে বললি না কেন আমাকে?
-এমনিই৷
-মিহিন জানে এই ব্যাপারে?
আমি হাসলাম। বললাম,
-ওকে কী করে এই কথা বলি আমি? ওর মায়ের সম্পর্কে ওর কাছে বিচার দেওয়াটা আমার কাছে অন্য রকম লাগে৷ তাছাড়া সে আমায় কোনো কিছু বলার সুযোগও দেয়নি৷ বাদ দে সেসব৷ কফিটা দারুণ হয়েছে৷
সাদিক তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ এরপর হাসলো৷ কিছু বলল না৷
.
-ভাই, ভালো আছেন?
ভার্সিটির গেটের কাছেই কেউ কথাটা বলল। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম মিহিনের ড্রাইভার নয়ন দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নয়ন ভাইয়ের বয়স তেমন নয়৷ আমার থেকে অল্প কিছু বড় হবে হয়তো। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম,
-ভালো আছি৷ আপনি কেমন?
-ভালোই৷ আমার আসলে ওই দিনের ব্যাপারটার জন্যে খুব খারাপ লেগেছে ভাই৷ বড় মেডাম কাজটা ঠিক করেননি। আমার খুব মন খারাপ হয়েছে।
-মন খারাপের কিছু নেই৷ মাঝেমধ্যে এমন কিছু অপ্রিয়কর ঘটনা ঘটে যায়৷ আমাদের সেগুলো গিলে খেতে হয়৷
-তবুও ভাই৷ এভাবে একজনকে অপমানিত করাটা ঠিক মানায় না৷
-যাক৷ আপনার মাঝে এই বোধটা আছে দেখে বেশ ভালো লাগল।
-মিহিন ম্যামও আপনার উপর রেগে আছে তাই না?
-আপনি জানেন কী করে?
-উনার গাড়িটা আমিই চালাই তো৷ তাই কিছু কথা কানে বাড়ি খায়৷ খুব বকাঝকা করে আপনাকে৷
আমি চট করেই হেসে ফেললাম। নয়ন ভাই মানুষটা অসাধারণ। আমার বেশ ভালো লাগলো৷ বললাম,
-আপনি বেশ ফ্রেন্ডলি নয়ন ভাই৷ ভালো লাগলো৷
-তা না ভাই৷ ভালো মানুষের কদর করতে হয়৷ আমাকে আপনার পেছনে লাগানো হয়েছিল বেশ কয়েকদিন৷ তখনই আসলে জানতে পারলাম আপনি কেমন!
আমি হাসলাম। কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই দেখলাম নয়ন ভাইয়ের চেহারা পালটে গেছে৷ তিনি চট করেই আমাকে বললেন,
-আমি যে আপনাকে কথা গুলো বলেছি এগুলো প্লীজ উনাকে বলবেন না৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-চিন্তা করবেন না৷ আপনার ম্যাম আমার সাথে কথাবার্তা বলেন না৷
আমি সরে দাঁড়ালাম৷ মিহিন এসে বলল,
-গাড়িতে ফোনটা রয়ে গেছে নয়ন ভাই।
নয়ন ভাই দ্রুত গাড়ি খুলে দেখলেন৷ ফোন ভেতরেই ছিল। তিনি ফোনটা মিহিনের হাতে দিতে মিহিন বলল,
-যারতার সাথে কথা বলবেন না নয়ন ভাই৷ কিছু মানুষকে এড়িয়ে যাওয়া ভালো৷
কথাটা স্পষ্ট ভাবেই কানে বাড়ি খেল। সেটা একদম বুকে গিয়ে লাগল৷ আমি গেট গলে ভার্সিটির ভেতর ঢুললাম। পেছনে মিহিনও আসছে৷ আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম৷ মিহিনের আসা না আসাতে আমার মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এমন একটা ভাব। এ ক'দিনে আসলে সব কিছু পালটে গিয়েছে৷ মিহিনের সাথে সাথে যেন আমার জীবনের গতিবিধিও পাল্টে গেছে৷ কী অদ্ভুত! আমার জীবনের গতিবিধি কখন যে অন্য একটা মানুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে গেল টেরই পেলাম না। এ জন্যেই বলে কাউকে চট করেই নির্দিষ্ট করে ফেলা ঠিক না৷ এর জন্যে পস্তাতে হয়৷ আমি এগিয়ে গেলাম। ঠিক সে সময়েই দেখলাম নিশি এগিয়ে আসছে৷ বড় অবাক লাগলো৷ এই মেয়ের সাথে আমার বেশিরভাগ সময় এই মূল গেটের রাস্তাটাতেই কেন দেখা হয়৷ মেয়েটা হাসি দিয়ে বলল,
-কেমন আছো?
আমি হাসলাম। ভালো আছি বলতে যাব ঠিক তখনই পেছন থেকে মিহিনের স্বর ভেসে এলো। বলল,
-এই নিশিই! কেমন আছো?
নিশি হেসে জবাব দিলো,
-ভালো আছি৷ তুমি?
-খুব ভালো৷ আসোতো৷ তোমার সাথে কথা আছে আমার৷
ও এমনটা কেন করলো? আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগই দিল না? এটা কোন ধরনের ফাজলামো? আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আর ভার্সিটির ভেতরে গেলাম না৷ বাসায় ফিরে এলাম। মিহিন আজ কাজটা ঠিক করেনি। মোটেও না৷
.
শুক্রবারটা আমাদের সাধারণত ঘুমে ঘুমেই কাটে৷ বারোটার আগে ঘুম ভাঙ্গে না৷ কিন্তু আজ কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটল৷ আজ বেলা নয়টাতেই উঠতে হলো৷ কে জানি এসেছে৷ দরজায় অনেকক্ষন খটখট করেছিল। কলিংবেল বাজিয়ে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো৷ চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি ভাব নিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম দরজার সামনে স্যুট-কোট পর এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন৷ বেশ অবাক হলাম। কে এই ভদ্রলোক?
-কাকে চাই?
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময়৷ বললেন,
-তুমি তাসফি?
ঘুমের ঘোরে লক্ষ্য করিনি মানুষটাকে৷ ভালো করে তাকাতেই চেহারাটা মনে পড়ে গেল৷ আরে ইনি তো মিহিনের বাবা। এখানে কী করছেন? আমি হতভম্ব হয়ে উনাকে সালাম দিলাম। বললাম,
-ভেতরে আসুন আঙ্কেল।
তিনি ভেতরে এলেন। আমি একটা চেয়ার টেনে দিলাম। বললাম,
-বসুন৷
তিনি বসলেন। বললেন,
-বাসায় আসবাবপত্র হিসেবে বইয়ের সংখ্যাই বেশি দেখছি!
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ তিনি খানিকটা চুপ থেকে বললেন,
-তুমি অসুস্থ নাকি?
-হালকা পাতলা।
-এজন্যেই ভার্সিটি যাচ্ছো না?
-জি৷
আমাকে আরো কিছুটা অবাক হতে হয়৷ আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছি না এটা উনি জানলেন কী করে? তিনি আরো কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন,
-মিহিনের মা নেই৷ এটা কি জানো?
আমার ভ্রু কুচকে এলো৷ অবাক স্বরে বললাম,
-না তো৷
-ওর যখন আট বছর তখন ওর মা মারা যায়৷ মাইশা৷ আমার ওয়াইফ৷ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ওর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল৷ বেশ কিছু দিন বেঁচে ছিল অবশ্য। খুব চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু স্রষ্টা যদি বলেন তিনি নিয়েই যাবেন তবে আমরা শত চাইলেও তাকে ধরে রাখতে পারবো না৷ তাই হয়তো পারিনি৷ নিয়ে গেলেন৷
ভদ্রলোক থামলেন৷ পায়ের উপর পা তুলে কেমন নীরব হয়ে বসে রইলেন কিছু সময়৷ তারপর বললেন,
-ওই ঘটনার পর থেকেই ও অন্য রকম হয়ে যায়৷ বেশ রাগি হয়ে যায়৷ মানসিক ভাবে চোট পায় যেন৷ আমি চেয়েছিলাম ওকে আগের মতো করতে৷ কিন্তু পারিনি৷ এছাড়া আমাকে আমার বিজনেসও দেখতে হতো৷ তাই সঠিক কেয়ারটা আমি দিতে পারিনি৷ এ জন্যে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করে৷ ফারজানা ইসলাম। তাকে আমার ভালোই মনে হয়েছিল৷ ভাবলাম মিহিন মায়ের আদরটা অন্তত পাক৷ সত্যি বলতে ফারজানা মিহিনকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসেছিল। তাকে সেভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু মিহিন ওকে ঠিক ভাবে নেয়নি৷ ওর স্নেহটা কেন জানি মিহিন গ্রহণ করতে পারেনি৷ সে নিজের মতোই থাকলো৷ পড়াশোনা, একা একা নিজের রুমে বন্ধি, স্কুল-টিউশন এসবের মধ্যেই তার সীমিত জীবন বাঁধা ছিল৷ তার কখনই বিশেষ আবদার ছিল না৷ কোনো বিশেষ চাহিদা ছিল না৷ জীবনে এই প্রথমবার ও আমার কাছে কিছু চাইলো৷ তাও মুখ ফুটে বলে নাই৷ আমাকে বুঝে নিতে হয়েছে৷
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন৷ তাকিয়ে থাকলেন কিছু সময়৷ বললেন,
-বাবা, তুমি কি ফারজানার ওই আচরণটা ভুলে যেতে পারবে? হাসপাতালে কী হয়েছে আমি ঠিক জানি না৷ তবে যেটা হয়েছে সেটা মোটেও ঠিক হয়নি৷ তোমার প্রতি বড় অন্যায় হয়েছে। তবুও ব্যাপারটা কী ভুলে যাওয়া যায় না?
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-আমাকে যে সবাই পছন্দ করবে এমন তো না৷ আমি কারো কারো অপছন্দও হতে পারি৷ সেটাই স্বাভাবি৷ আমি উনার অপছন্দ বলেই হয়তো তিনি এমন করেছেন৷ আমি বিশেষ কিছু মনে করিনি৷
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ বললেন,
-তুমি চিন্তা করো না। ফারজানাকে আমি ঠিক করে ফেলবো৷ ওটা ব্যাপার না৷ মেয়ে জাতি তো! সোজা জিনিসকেও ত্যাড়া করে দেখতে জানে৷
আমি মুখ চেপে হাসলাম। কিছু বললাম না৷ তিনি আমার দিকে মুখটা এগিয়ে এনে বললেন,
-কাল নিজের রুমে বসে বই পড়ছিলাম৷ কোত্থেকে জানি মেয়েটা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। প্রায় আধঘন্টা মতো জড়িয়ে ধরেছিল আমায়৷ আমি লক্ষ্য করলাম ও কাঁদছে৷ ওর চোখে জল। মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে। বললাম,
-কী হয়েছে৷
সে জবাব দিলো না৷ কেঁদেই গেল। আমার বুকটা কেঁপে উঠলো একদম। ওকে এমন কাঁদতে দেখেনি আমি৷ লাস্ট ও ওর মায়ের মৃত্যুতে কেঁদেছে৷ এরপর আমি ওকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি। জানতে চাইলাম,
-কী হয়েছে?
সে কান্না ভরা স্বরে বলল,
-এ কয়দিন আমি ওকে দেখিনি পাপা৷ আমার খুব খারাপ লাগছে৷ খুব খুব খারাপ লাগছে৷ চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অথচ আমি তেমন কাঁদতে জানি না৷
আমি অবাক হলাম। এই সে'টা কে? কার কথা বলছে ও? অনেকবার জানতে চাইলাম। কিন্তু সে কিছুই বলেনি আমাকে৷ হঠাৎই মেয়েটা আবার যেন অন্য রকম হয়ে গেল। আবার সেই অনিয়ম৷ খাবার ঠিক মতো খেতো না৷ ঘুমাতো না। সারারাত দেখতাম ওর রুমে বাতি জ্বলছে৷ আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটা চটপট করছে৷ ভেতরে ভেতরে সে ভালো নেই৷ খুব কষ্টে আছে৷ তার সেই কষ্ট দূর করতেই আমি আজ এখানে এলাম।
কথাটা বলে দম নিলেন ভদ্রলোক। এরপর বললেন,
-তুমি কি কষ্ট করে আজ আমার সাথে আমার বাসায় যেতে পারবে? মেয়েটার জন্মদিন আজ৷ তার জন্মদিনে আমি তাকে বেস্ট উপহারটা দিতে চাই৷ তুমি কি যাবে আমার সাথে?
.
মিহিনদের বাসাটা বেশ বড়সড়। বাইরে থেকে দেখতে যতোটা না সুন্দর ভেতরেরটা আরো বেশি অসাধারণ। পুরো বাসাটা যেন চকচক করছে৷ মিহিনের বাবা আমাকে খুব সাবধানে আসতে বললেন৷ যাতে মিহিন টের না পায়৷ আমাকে ওর রুমটা দেখিয়ে দিলেন৷ আমি ধীর পাঁয়ে ওর রুমের দিকে এগোলাম। দরজাটা খোলাই আছে৷ আমি ধীরে ধীরে ভেতরের গেলাম। মিহিন মেঝেতে বসে আছে। আমি চুপিচুপি ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার বাঁপাশে পেন্সিল, কাটার, রাবার, রং তুলি এবং রঙ৷ মেঝেতে বড় একটা আর্ট পেপার বিছানো৷ আর্ট পেপার জুড়ে একটা মানুষের ছবি৷ একটা ছেলে৷ আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ছবির ছেলেটা আমিই৷ সে আমাকে এঁকেছে৷ আমার ছবি এঁকে আমাকে দেখছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিকই লাগলো। আমি এতোদিন জলজ্যান্ত মানুষ তোর সামনাসামনি এতো ঘোরাঘুরি করলাম, তখন তাকালি না, কথা বললি না, অথচ সেই আমাকেই এঁকে এখন বসে বসে দেখছিস?
মিহিন চট করেই বলে উঠলো,
-আমি বকলেই তোকে চলে যেতে হবে? আমি তোকে অনেক কথাই বলব৷ অনেকবারই বলব চলে যেতে৷ তাই বলে তুই চলে যাবি? বললেই চলে যেতে হবে?
মিহিন এখনও লক্ষ্য করেনি আমাকে৷ সে ছবির সাথে কথা বলছে৷
-তুই এমন একটা মানুষ যাকে আমি চোখ বুঁজে বিশ্বাস করতে পারি৷ যার উপর আমি ভীষণ নির্ভরশীল। তোকে ঘিরেই আমার সব কিছু৷ আমার যতো সুখ, দুঃখ, আহ্লাদ!
একটু থেমে আবার বলল,
-তুই কেন বুঝিস না আমার সুখ-দুঃখ তুইই। কেন বুঝিস না?
কোথায় তুই আমাকে একটু বুঝবি, আমি রাগ করলে আমার রাগ ভাঙ্গাবি তা না তুই উল্টো রেগে থাকিস৷ এরপর কী করিস, অন্য মেয়েদের সাথে গিয়ে কথা বলিস৷ এটা কোন ধরনের কথা হু? কোথায় তুই আমার রাগ ভাঙ্গাবি না তুই পড়ে আছিস অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে৷ এই তুই এমন কেন রে? আমাকে বুঝিস না কেন হু?
আমি এবার পেছন থেকে বললাম,
-মানুষকে বুঝার সুযোগ দিতে হয়৷ তুই যদি সুযোগ না-ই দিস তবে আমি তোকে বুঝব কি করে বল?
মিহিন চট করেই উঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকালো৷ আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটার চোখে জল। সে কি এতোক্ষন কাঁদছিল? মিহিন চট করেই কিছু বলতে পারল না৷ একটু থেমে থেমে বলল,
-তুই এখানে কী করছিস?
-বুঝতে এলাম।
-কী বুঝতে?
-এই যে তুই বললি না তোকে আমি বুঝি না৷ তোকে বুঝতেই এলাম এখানে৷
-আমাকে তোর বঝতে হবে না৷
আবার সেই অভিমান৷ আমি হাসলাম। বললাম,
-একটু আগেই তো তুই চাচ্ছিলি আমি যাতে তোকে বুঝি৷ চাচ্ছিলি না?
-ওটা এমনিই বলেছিলাম৷
-আচ্ছা বেশ৷ আমার এতো সুন্দর ছবি এঁকেছিস কখনও তো দেখাসনি৷
-দেখতে হবে না তোর৷
-সর৷ দেখি৷ আর আছে? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আরো আছে৷ কই দেখা তো!
-এতো দেখা লাগবে না৷ তুই এখানে কেন এসেছিস?
-বললাম তো তোকে বুঝতে৷
মিহিন কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল। মাথা নিচু করে রাখলো৷ আমি তার দিকে একটু এগিয়ে গেলাম৷ পরে কী মনে করে আবার পেছন ফিরে এলাম৷ দরজার পাশে রাখা কাঠগোলাপের তোড়াটা নিয়ে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। এরপর মিহিনের কাছে ফিরে এলাম। বললাম,
-শুভ জন্মদিন৷
মিহিন জবাব দিলো না৷ আমি আবার বললাম,
-তোর জন্যে কাঠগোলাপ এনেছি। আমার গাছের কাঠগোলাপ।
-আমাকে কেন দিচ্ছিস? এগুলো তোর নিশিকে গিয়ে দে৷
-নিশি কে?
-খুব অভিনয় হচ্ছে না? এমন ভাব করে যেন নিশিকে চেনে না৷
আমি হাসলাম৷ বললাম,
-আমি আসলে এক নিশিকে চিনতাম। কিন্তু কে জানি মেয়েটাকে নিষেধ করেছে আমার সাথে যেন আর কথা না বলে। আমার থেকে যেন দূরে থাকে।
মিহিন মাথা নিচু করে রাখলো৷ বললাম,
-তারপর আমাদের ক্লাসের নিহান নামের একটা ছেলেকে কে জানি দুইটা চড় দিয়েছিল৷ কেন দিয়েছিল কে জানে! তবে আমার মনে হয় আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা...
-ওটা মোটেও তোকে নিয়ে ছিল না৷ ও ওটার দ্বারা আমাকেও মিন করেছিল৷ তাই ওকে চড় দিয়েছি।
-তাহলে নিশির ব্যাপারটা?
-ওটা আমি কিছু জানি না৷ আমি কিচ্ছু করিনি৷
আমি ওর আরেকটু কাছে গিয়ে বললাম,
-আমি সব জানি মিহিন৷ সব জানি৷ এই যে চোখের নিচে কালো দাগ গুলো, চেহারাটা ফ্যাকাসে, চোখ জোড়া কাজল শূন্য, এরা অনেক কথা বলে৷ অনেক কথা৷
মিহিন কেমন কান্না জড়িত স্বরে বলল,
-এটা তোর ভ্রম৷
-মোটেও না৷ তুই লুকোচ্ছিস৷ সবার থেকে আড়াল হচ্ছিস৷
-তাতে কার কী!
-অনেকের অনেক কিছু৷
-আমার কিছু যায় আসে না৷
-তা তোকে দেখলেই বোঝা যায়৷
-কিচ্ছু বোঝা যায় না৷
আমি চুপ করে গেলাম। কিছুটা নীরব থেকে বললাম,
-এখনও রেগে থাকবি?
-তোর উপর আমি রেগে নেই।
-তাহলে আমার সাথে এমন বিহ্যাভ কেন করছিস?
-কেমন বিহ্যাভ?
-এই যে এতো রুড আচরণ!
-আমার আচরণ এমনই।
-এমন?
-হু৷
-তাহলে তো তোর সাথে সংসার করা যাবে না৷
-কী?
-কিছু না৷ আমি গেলাম৷ এখানে থেকে লাভ নেই৷
কথাটা বলে কিছুদূর যেতেই মিহিন দৌড়ে আমার সামনে চলে এলো৷ আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। তার চোখে জল। চেহারায় তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,
-কী বলেছিস আবার বল!
-কই কী বলেছি?
-একটু আগে যে বললি?
-কী বলেছি একটু আগে?
-মজা করিস না। মাইর খাবি৷
-তুই আমাকে মারবি?
-প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই মারবো৷
-তোর সাহস তো কম না৷ হবু জামাইয়ের গায়ে হাত তুলবি? লোকে কী বলবে?না না৷ এখানে থাকা যাবে না৷ সর৷ যাই৷
মিহিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো৷ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। তার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে৷ বললাম,
-সর৷ জায়গা দে৷
-দিব না৷
-কি দিবি না! যেতে হবে তো আমাকে৷
-আমি তোকে যেতে দিব না।
-আশ্চর্য ব্যাপার। আঁটকে রাখবি নাকি৷
-রাখব৷
-এটা কেমন কথা?
-এটাই কথা৷ আমি তোকে যেতে দিব না। আমি দিনরাত কষ্ট পেয়ে মরবো আর তুই বাইরে ঘুরে বেড়াবি তা তো হয় না৷
আমি বললাম,
-তো আমাকে এখানে রেখে তুই কষ্ট দিবি?
-না৷ কষ্ট দিবো না৷ তুই আমার কষ্ট কমাবি৷ কষ্ট কমানোর জন্যে এখানে থাকবি৷
-তাহলে আমার যে এতো কষ্ট? এই যে একটা দিনও ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারি না৷ মনের ভেতর যে এতো তীব্র অশান্তি এসব শান্ত করবে কে? কে আমার কষ্ট কমাবে?
মিহিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। এরপর বলল,
-এক্সিডেন্টের পর আমার যখন সেন্স ফিরেছে আমি কেবল তোকে খুঁজেছি৷ মাকে কতোবার যে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা কেউ কি এসেছে? আমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে? প্রতিবারই মা না বলেছে৷ কী ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম তখন৷ আমি ভাবলাম তুই সঙ্গে সঙ্গেই আসবি৷ আমাকে দেখবি। কিন্তু তুই এলি না৷ তাসফি, তুই কি জানিস আমার যখন সেন্স চলে যাচ্ছিল তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাবো৷ এখনই মরে যাবো৷ আমার তখন ইচ্ছে হলো তোকে একটু দেখি৷ শেষবারের মতো তোকে ছুঁয়ে দেই৷ তোর কোলে মাথা রাখি৷ তোর হাতটা শক্ত করে ধরি৷ আমার তখন কেবল তোর কথাই মনে পড়েছিল। কেবল তোকেই মনে পড়েছিল।
মিহিন থামলো৷ খানিকটা ফুঁপিয়ে উঠলো সে৷ বলল,
-সেন্স ফেরার পর তোকে না দেখে এতো মন খারাপ হলো যে বলার মতো না৷ সাত সাতটা দিন কেটে গেল তোর কোনো খবর নেই। একটা ছোট্ট মেসেজ পর্যন্তও না! একটা মানুষের জন্যে এটা কতোটা পেইনফুল ভাব তো! কতোটা পেইন ফুল যে তার পছন্দের মানুষটা তার খোঁজ নেয়নি! সামান্য একটা মেসেজও না?
আমি খুব কষ্টে ছিলাম তাসফি৷ আমার শারিরীক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট ছিল বেশি৷ আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম৷ রাগে আমার গা জ্বলছিল যেন৷ ইচ্ছে করছিল তোকে খুন করে ফেলতে৷ সেই রাগের বসেই ভার্সিটিতে তোর সাথে এমন বিহ্যাভ করেছিলাম। এতো অচেনা অভিনয় তাইই করা। কিন্তু যখন জানতে পারলাম তুই ঠিকই এসেছিলি, আমার মায়ের চক্রান্তের স্বীকার হয়ে তোকে অপমানিত হয়ে চলে যেতে হয়েছিল তখন আমার নিজের উপর রাগ উঠছিল৷ মনে হচ্ছিল কেন তোকে একটা সুযোগ দেইনি৷ কেন তোকে কিছু বলার সুযোগ দেইনি৷ ভাবছিস এসব আমি জানি কীভাবে৷ নয়ন ভাইয়ের কাছ থেকে জানা৷ বলতে চাননি। বাট সেদিনই জেনে নিয়েছি৷ কিন্তু পরের দিন যখন ভার্সিটিতে এলাম দেখলান তুই নেই৷ টানা চারদিন তুই এলি না৷ টেনশনে আমার যাচ্ছে তাই অবস্থা৷ কেমন জানি লাগছিল ভেতরে৷ কেমন অস্থির ভাব৷ দমবন্ধ লাগছিল। কী এক শূণ্যতা কাজ করছিল ভেতরে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। সাদিক ভাইকে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি ফোন তুলেননি৷ আর তুই তো আমার ফোনই তুলছিস না৷ কতো ফোন মেসেজ দিলাম। কোনো রেসপন্স নেই তোর৷ এটা কি তুই ঠিক করলি? বল ঠিক করলি? তুই জানিস এই পেইনটা কতোটা পেইনফুল?
-তোর উপর রাগ ছিল। তাই এমন করেছি৷ রাগ কি তোর একারই আছে নাকি? আমার নেই?
-না, তোর কোনো রাগ নেই৷
-এটা কেমন কথা?
-এটাই কথা৷ তুই আমার সাথে রাগ দেখাতে পারবি না৷
-তাহলে তো হবে না৷
-কী হবে না?
-তোর সাথে আমার কিচ্ছু হবে না৷ আমার নিশিকেই দেখতে হবে মনে হয়!
মিহিন কেমন চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে তথাকলো৷ তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে৷ আশ্চর্য, ওর চেহারটা এমন লালচে হয়ে যাচ্ছে কেন? মিহিন আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো৷ আমার কলার চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
-একদম খুন করে ফেলব তোকে৷ তোর জীবনে এক মাত্র মিহিনই আছে এবং থাকবে৷ অন্য কোনো মেয়ের নাম মুখেও আনবি তো তোকে একদম মেরে ফেলবো৷
-জোরজবরদস্তি নাকি?
-যা ভাবিস৷
-এটা তো...
মিহিন কেবল তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে৷ কেমন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো৷ আমি কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারলাম না৷ চুপ করে গেলাম। কিছু সময় ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আলতো করে তার চোখের কোনাটা মুছে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে কী হাল করেছে সে৷ বললাম,
-এই চোখজোড়ায় জল মানায় না৷ এখানে কাজল মানায়৷ মায়া মানায়৷ ঘোর ধরানো প্রেম মানায়। এখানে ভীষণ গভীরতা মানায়৷ এই চোখজোড়ায় কেবল তাসফিকে মানায়৷ আর কিছু না৷ কাঁদিস না পাগলি৷ আমি তোর ছিলাম। আছি৷ থাকবো।
মিহিন হাসলো৷ হাসতে হাসতেই তার চোখে জল জমে গেল। ঠিক সেই মূহুর্তেই সে আমায় জড়িয়ে ধরলো৷ জড়িয়ে ধরতেই সে কান্না শুরু করে দিল। তার কান্না আমার বুকের ভেতরটা একদম শীতল করে দিল৷ আমার মাঝে কেমন এক ঘোর ধরালো এই মিহিন৷ মিহিনের ভেজা স্বর৷ আমি তাকে আরেকটু করে জড়িয়ে নিলাম আমার বুকের সাথে৷ সে আমার বুকের কাছেই থাকুক৷ যেভাবে তার থাকতে মন চায় সেভাবেই থাকুক৷ আমি তাকে আগলে নিলাম আমার আন্তিম পর্যন্ত৷
গল্প কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ।
আরো পড়ুনঃ মিহিন এবং শিউলি ফুল
.
গল্পঃ বুকের কাছেই থাকুক সে।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।
ভাই ভাষা হারাইলিছি কিতা খইতাম ☺️,, শুধু ইচ্ছা অইছে গল্পটা যেনো শেষ না অয় 😒💝💝
প্রথমত তাফসি+মিহিন এদের কে গল্পে রাখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
দ্বিতীয়ত প্রতিবার নতুন যে অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
superbbbbbb hoice bro... ☺☺
এত্তো ইমোশন মিশায়া গল্প কেমনে লেখেন ভাই 💘💘