গল্পঃ অর্থি। শেষ পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ অর্থি। শেষ পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ অর্থি। শেষ পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ
সে রাতে আমি রাশেদকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
-অর্থির সাথে তোর মিটমাট হয়েছে?
ও হাসলো৷ বলল,
-অনেক আগেই। এসব কাজে আমি দেরি করি না৷ তবে ওর যা রাগ! আমার অনেক সময় লেগেছে ওর রাগ ভাঙ্গাতে৷ এই বয়সে আমাকে কান ধরিয়েছে৷ চিন্তা করে দেখ কেমন মেয়ে সে!
আমি হাসার চেষ্টা করলাম৷ বললাম,
-আমারও তো সরি বলা উচিৎ। কি বলিস? উচিৎ না?
-তা উচিৎ। আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল৷
-আমি চেষ্টা করেছি৷ ও আমার সাথে কথা বলেনি৷ আমি ওকে ডাকলাম। কিন্তু ও এমন ভাব করল যেন সে আমার ডাকটা শুনতেই পায়নি৷
রাশেদ কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে৷ এরপর বলল,
-বেশ রেগে আছে মনে হয়!
-সরি বলার তো সুযোগ দিবে৷
-ফোন করে দেখ৷
-নাম্বার নেই৷
-আমার কাছে আছে তো! নে উঠা!
আমি অর্থিকে কল দিলাম। কয়েকবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো৷ ওপাশ থেকে অর্থি বলল,
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আমি৷
-আমি কে?
-আসাদ।
-কোন আসাদ?
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-চিনতে পারছেন না না নাকি চেনার চেষ্টা করছেন না?
-ভুলার চেষ্টা করছি৷
-এতো দ্রুতই অসহ্য লেগে গেল!
অর্থি হাসলো৷ কিছু বলল না৷ আমি আবার বললাম,
-একটা প্রয়োজনে ফোন দিয়েছিলাম।
-প্রয়োজন ছাড়া যে ফোন দিবেন না তা আমি জানি৷ বলুন কী প্রয়োজনে আসতে পারি আপনার?
আমি অল্প কিছু সময় চুপ থেকে বললাম,
-আপনাকে সরি বলার ছিল।
-কেন?
-এই যে আমার কারণে এতো বকা শুনতে হলো আপনাকে! তাই৷
-যিনি বকেছেন তিনি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন৷ এখানে আর আপনার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই৷ আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই৷
-আমার উপর আপনার রাগ নেই?
-জি না৷
-তাহলে কাল যে এতো ডাকলাম শোনেননি কেন?
-কানে ইয়ারফোন ছিল।
-মিথ্যা বলবেন না৷
-আপনার কাছে কেন মনে হলো আমি আপনাকে মিথ্যা বলছি?
-জানি না৷ তবে মনে হয়েছে৷ আপনি মিথ্যা বলবেন না প্লীজ৷ আপনি আমার ডাক শুনেছেন৷ ইচ্ছে করেই রেসপন্স করেননি৷ কথাটা সত্য৷ সত্য না?
-সত্য।
-কেন এমন করলেন?
-আমার প্রয়োজনে৷
-আপনার কিসের প্রয়োজন?
-আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে চাই না আমি।
-এতো বেশি রাগ ভালো না৷
-আপনার ডাকে সাড়া না দেওয়ার সাথে আমার রাগের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমি আপনার থেকে দূরে থাকতে চাইছি। ব্যস৷
-কেন দূরে থাকতে চাইছেন?
অর্থি খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
-কারণ আপনি কাছে থাকতে চাননি। বলুন চেয়েছেন?
আমি চুপ করে গেলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ অর্থি ওপাশ থেকে বলল,
-যা হবার হয়ে গেছে৷ এসব নিয়ে আর প্যানিক হবেন না৷ এসব বাদদিন৷ আপনি আপনার মতো থাকুন৷ আমি আমার মতো থাকি৷ কেমন?
-জি৷
-রাখি তবে৷ পড়া আছে৷
-আল্লাহ হাফেজ।
.
অর্থি কল কেটে দিলো৷ আমি ফোনটা বিছানার কাছে রাখলাম৷ রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার দৃষ্টিতে তীব্র উপহাস৷ বলল,
-এভাবে কেউ কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে?
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। রাশেদ বলল,
-ওকে তুই জোর করার চেষ্টা করলি না৷ এভাবে কেউ ক্ষমা চায়?
-ও তো বলেছে আমার উপর ওর রাগ নেই৷
রাশেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ বেশ কিছু সময় নীরব থেকে বলল,
-মেয়েরা যদি বলে 'আপনার উপর রাগ নেই' তখন বুঝে নিতে হবে সেই মেয়ের ওই ব্যক্তির উপর অবশ্যই রাগ আছে৷ এবং রাগটা খুব তীব্র পর্যায়ের। তাইই সে এমন সরাসরি রাগ নেই বলেছে৷ তুই ওকে জোর করতি৷ ফোন রাখতে চাইতি না৷ তখন দেখতি তার ভেতরে কতোটা রাগ পুষে আছে৷ তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারিসনি৷ ও এই কথাটা ওর অভিমান থেকে বলেছে৷
কথাটা বলে রাশেদ থামলো৷ একটু সময় নিয়ে আবার বলল,
-একটা কথা বলি শোন, কোনো মেয়ে কখনই একটা ছেলেকে চট করেই প্রপোজ করে বসে না৷ মেয়েটা তখন প্রপোজ করে যখন না বলার ব্যাথাটা তার সহ্যসীমা অতিক্রম করে ফেলে। মেয়েরা কাউকে ভালোবাসলে মুখ ফুটে বলতে জানে না৷ হাজার ব্যাথা পেলেও না। আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর ট্রাই করে কেবল৷ এরপরও না বুঝলে বাধ্য হয়ে নিজেই নিজের অনুভূতির গল্প প্রকাশ করতে আসে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা এতো ইজি না৷ তাও অর্থি সেদিন তোকে প্রায় অনেক কিছু বলল। নিজের অনুভূতি জানালো। তুই অন্তত তার অনুভূতির সম্মানটা করিস। তাকে নিয়ে একটু ভাবিস৷ মেয়েটা খারাপ না৷ সেই কোন যুগ থেকে সে কেবল তোকে ঘিরেই পড়ে আছে৷ তোর জন্যে যেন বেঁচে আছে সে৷ আমি এমন অনেক কিছুই জানি আসাদ৷ অর্থির পাগলামি তুই কখনও টের না পেলেও আমি টের পেয়েছি৷ এই যে তোকে মাঝে মাঝে ঘড়ি, পার্ফিউম বা শার্ট গিফট করি এসব আসলে আমার দেওয়া না৷ এই সব গুলো অর্থির দেওয়া৷ সে নিজে কিনে আমার হাতে দেওয়াতো৷ তার খুশি ছিল তুই কখন শার্টটা পরবি তার উপর। তোকে নিজের দেওয়া শার্ট পরা দেখে এতো খুশি হতো পাগলিটা!
আমি রাশেদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রাশেদ কথা গুলো বলে থামলো৷ আমার দিকে তাকালো৷ আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
-ওর কাজিন দেখে বলছি না। আমি তোর বন্ধু হয়ে বলছি৷ মেয়েটা তোর জন্যে যথেষ্ট। মাথা থেকে বিয়ে নিয়ে যতো উদ্ভট চিন্তা আছে ঝেড়ে ফেল৷ যারা সত্যিকারের পুরুষ তারা সমস্যা ফেস করে৷ কখনই সমস্যা হবে বলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকেই এড়িয়ে যায় না৷ জীবনের সমস্যা গুলো সলভ করার মাঝেও অন্যরকম একটা আনন্দ আছে দোস্ত৷ এই আনন্দটা তুই তখন অনুভব করবি যখন তোর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন পূর্বে করে আসা সকল ক্লান্তি পরিশ্রম গুলোকে খুব ক্ষুদ্র মনে হবে সেই আনন্দের কাছে৷ প্রশান্তির পরিসর দীর্ঘ হবে৷ বুঝলি?
আমি কিছু বললাম না। রাশেদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একটু সময় নিয়ে বললাম,
-তুই এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারিস জানতাম না তো! তাছাড়া মেয়েদের সম্পর্কে ভালোই অভিজ্ঞতা আছে দেখছি!
রাশেদ কিছু বলল না। শব্দ করে হাসল কেবল।
.
পরেরদিন ভাবলাম অর্থির জন্যে অপেক্ষা করি৷ মেয়েটাকে খুঁজে নেই৷ কিছু কথাবার্তা বলি৷ কিন্তু কী ভেবে যেন পরে আর সেটা করা হয়নি। ক্লাসটাও করলাম না৷ একা একা হাঁটতে থাকলাম৷ কিছুদূর হাঁটার পর মনে হলো আমার আর হাঁটতে ভালো লাগছে না৷ বাসায় চলে যাই। বাইরে অসহ্য লাগছে৷ আমি বাসায় ফিরে এলাম৷ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল দিলাম৷ গোসল শেষে এক মগ কফি বানালাম। অল্প কিছু কফি খাওয়ার পর মনে হলো কফিটা বিস্বাদ হয়েছে। আমি কফি সমেত মগটা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আজকাল নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই চোখের সামনে একটা মিষ্টি চেহারা ভেসে উঠে৷ কী প্রাণবন্ত সেই চেহারা। মেয়েটি একদম আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ এরপর মৃদু হাসে৷ কী অনিন্দ্য সেই হাসি৷ অর্থির চেহারাটা বারবার চোখে সামনে কেন ভেসে উঠছে এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝে উঠলাম না৷ আমার মনে হচ্ছে এই ক'দিন মেয়েটাকে নিয়ে একটু বেশিই ভেবেছি৷ তাইই তার চেহারা চোখের উপর ভাসছে৷ ক'দিন গেলেই সেটা চলে যাবে৷ আমি ক'দিন যাওয়ার অপেক্ষা করলাম৷ বেশ কিছুদিন কেটে গেল। আমি অর্থিকে দেখলাম না। এ ক'দিনে একবারের জন্যেও আমি অর্থিকে দেখলাম না৷ অর্থি নিজেই আমার সাথে দেখা দিল না। সেদিন কথার ছলে রাশেদ জিজ্ঞেস করলাম,
-কিরে? অর্থিকে দেখছি না যে? ভার্সিটি আসে না?
-আসে তো! তবে আগ থেকে কম আসে। কেন?
-এমনিই।
ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-ওকে নিয়ে কিছু ভাবছিস?
-নাহ৷ কী ভাববো! এসব আমার মাথায় ঢোকে না৷
-এজন্যেই কি রাতে ঘুমোচ্ছিস না? কেবল এপাশ-ওপাশ করিস৷
-মানে কী?
-মানেটা তুই এখন বুঝবি না৷ নিজেকে একটু সময় দে। ঠিক টের পেয়ে যাবি৷
রাশেদের কথাবার্তার আগামাথা কিছুই আমি বুঝলাম না৷ আমি কেবল ভ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
.
অর্থি তাহলে ভার্সিটিতে ঠিকই আসে৷ আমার সামনে পড়ে না৷ আমাকে এড়িয়ে চলে৷ বাহ! ভালোই৷ যাও! এড়িয়ে যাও৷ আমি তো আর তেমন কেউ না যে আমার পাশে থাকতে হবে৷ আমি দূরের মানুষ। দূরের মানুষকে এড়িয়ে চলা যায়৷ আমার কেন জানি মেয়েটার উপর অভিমান জাগল৷ আমার মনে হতে থাকলো মেয়েটা কাজটা ঠিক করছে না৷ এভাবে আমাকে এড়িয়ে যাওয়াটা খুব অন্যায়৷ কিন্তু পরক্ষনে আবার মনে হলো ও যা করছে ঠিকই করছে৷ তার এমনটা করার অধিকার আছে৷ সে চেয়েছিল আমরা একসাথে থাকি। কিন্তু আমার কারণেই সে এখন দূরে দূরে থাকছে৷ আমাকে দূর করে দিয়েছে৷ অর্থির এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটাকে আমি শাস্তি রূপে গ্রহণ করলাম। ভাবলাম এসব আমারই পাওনা। আমার কর্মের ফল। এরপর প্রায় একমাস কেটে গেল। আমি তখন ছন্নছাড়া বিষাদগ্রস্ত একজন মানুষ। এক বিকেলে বাইরে বেরিয়ে এলাম হাঁটতে৷ উদাসী হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ফুটপাতের কাছে কেউ একজন বসে আছে৷ এই কেউ একজনকে আমি জানি৷ চিনি। ইনিই সেই রহস্যময় মানব৷ যার পরিচয় এই পৃথিবীর কেউইই হয়তো জানে না৷ আমি ভালো করে দেখলাম তাকে। সে বসে বসে বাদাম চাবাচ্ছে৷ আমি পাশ দিয়ে চলে যাবার জন্যে এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম আকাশ ভাই হয়তো লক্ষ্য করবে না৷ কিন্তু আমি তার পেছনে আসতেই তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন,
-আসাদ না?
আমি সত্যিই খানিকটা চমকে উঠলাম। এই লোকের পেছনেও কি চোখ আছে নাকি? আমি বললাম,
-জি।
-এদিকে আসেন!
আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন,
-বসুন৷
আমি বসলাম৷ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ আমার দিকে কয়েকটা বাদাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-খবর কী বলেন তো!
আমি তার হাত থেকে বাদাম গুলো নিয়ে বললাম,
-কিসের খবর?
-আপনার নিজের খবর। চেহারার এই অবস্থা কেন? দাড়িগোঁফের যাচ্ছে তাই অবস্থা৷ আপনার ঘুম হয় না বোধহয়। চোখের নিচে কালি পড়ে বেশ কালো হয়ে আছে৷
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম৷ মাথা নিচু করে বাদাম ছিলায় মনোযোগী হলাম। আকাশ ভাই আবার বললেন,
-বিতৃষ্ণায় ভুগছেন?
-বিতৃষ্ণা বলতে?
-কিছু একটা পেতে চাচ্ছেন৷ অথচ পাচ্ছেন না৷ পাওয়ার তেষ্টাটা মিটছে না৷ এমন কিছু।
-নাহ৷ এমন কিছুই নয়৷
-তবে?
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না৷ অনেকটা সময় চুপ করে থাকলাম। কিছু বলার জন্যে খুঁজলাম৷ কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। আকাশ ভাই বললেন,
-কথা খুঁজে পাচ্ছেন না?
আমি উনার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হয়ে হাসার চেষ্টা করলাম৷ তিনি আবার বললেন,
-মাঝে মাঝে আমরা শব্দ হারিয়ে ফেলি। বলার মতো তেমন কোনো কথাই থাকে না৷ যে কথা গুলো থাকে সেগুলো আমরা প্রকাশ করতে পারি না৷ মুখ ফুটে বলতে পারি না৷
-বেশ কঠিন কথা বললেন। বোঝা মুশকিল।
-এতোটা জটিল তো নয়! আপনার টের পাওয়ার কথা৷
-টের পাইনি৷
-পাননি? নাকি পেয়ে লুকাতে চাচ্ছেন?
আমি বেশ অবাক হয়েই উনার দিকে তাকালাম। বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বললেন,
-আর কতো পালিয়ে বেড়াবেন? আর কতো লুকাবেন বলুন তো!
-আপনি কি মানুষের মন পড়তে পারেন?
-না তো৷ কেন?
-আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। আমার মনের ভেতরের সব কথা আপনার জানা৷
-এ আপনার ভ্রম। আপনার মনের সব কিছু আমার জানা নেই৷ আপনার চেহারা দেখে যা বোঝা যায় তাইই বলি। এর বাইরে বলাটা আমার পক্ষে অসম্ভব।
-আমার চেহারা দেখে কী বোঝা যায় বলুন তো!
-আপনি বিষাদগ্রস্ত৷ এটা বোঝা যায়। আপনি কেউ একজনকে ভীষণ মিস করছেন৷ তার সাথে আপনার সময় ব্যয় করতে মন চায়৷ অথচ আপনি তা করতে পারেন না৷ তার সাথে আপনার মনমালিন্যতা চলছে৷ এমন কিছু?
আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম,
-এমন কিছুই।
-অর্থি?
-জি।
-ভালোবেসে ফেললেন?
-জানি না৷
-এখনও বুঝে উঠতে পারেননি?
-বিতৃষ্ণায় ভুগি ভীষণ। এতো অস্বস্তি আর অস্থিরতা কাজ করে! মেয়েটাকে কতো দিন যে দেখি না! মানুষ এতোটা কঠোর হয় কী করে বলুন তো?
আকাশ ভাই হেসে বললেন,
-যেমনটা আপনি হয়েছেন৷ আপনাকে সে চেয়েছিল৷ কিন্তু আপনি সেই চাওয়াটাকে দাম দেননি৷ বুঝতেই চাননি। নিজের মনগড়া কাহিনীকে বিশ্বাস করেই পেছনে রয়ে গেলেন৷ এটাও তো এক প্রকার কঠোরতা। নাকি?
-আমি আসলেই তার জন্যে দুঃখিত৷ সে আমাকে সেই দুঃখ প্রকাশ করার সময়টা পর্যন্ত দিল না৷
-আপনি তার জায়গায় হলে দিতেন? দিতেন বলে মনে হয় না!
আমি চুপ করে থাকলাম। কিছু বলার মতো পেলাম না৷ তিনি আবার বললেন,
-মেয়েটার সেই ছোট্ট বেলার আবেগ আপনি৷ অনেক পুরনো আবেগ। তাই তার প্রেমের গভীরতা একটু বেশি৷ আর প্রেমের গভীরতা যতো গভীর হয় ব্যাথাটাও ততো তীব্র হয়৷
আমি চুপ করে থাকলাম। আকাশ ভাই আবার বললেন,
-আমি আপনাকে বেশ বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। কিন্তু আদত আপনি এতোটা বুদ্ধিমান না৷
আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। তিনি বলে গেলেন,
-আপনি জানেন মেয়েটা আপনাকে আগ থেকেই পছন্দ করে। তার পছন্দের মাত্রটা তীব্র৷ সে হিসেবে তার রাগ অভিমান তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক৷ অথচ আপনি কখনই তার রাগ অভিমান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলেন না৷ করেছেন কি?
-সে আমার উপর রেগে নেই বলেছে।
-না রেগে থাকলে আপনাকে এড়িয়ে চলে কেন? কেন আপনার চোখের সামনে পড়ে না?
আমি চুপ করে থাকলাম। তিনি বললেন,
-মেয়েদের অভিমান আকাশ ছোঁয়া। আপনি কখনই দেখে বুঝবেন না সে কতোটা অভিমানী হয়ে আছে৷ তার কাজে কর্মে কিংবা কথায় সে-সব টের পাবে। আচ্ছা আপনি কি কখনও তাকে ফোন দিয়েছেন?
-জি৷
-সে ধরেছে?
-আমার নাম্বার ব্লক করে রাখা।
আকাশ ভাই হাসলেন। বললেন,
-তারপরও আপনার মনে হয় সে আপনার উপর রেগে নেই?
আমি মনে মনে ভাবলাম কথাটা৷ আসলেই তো সত্য৷ মেয়েটা সত্যিই আমার উপর রেগে আছে৷ আমি কেবল বেকুবের মতো কিছু না বুঝেই পেছনে পড়ে থাকলাম৷ না তার খোঁজ করলাম না তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম। আকাশ ভাই বললেন,
-অর্থির মতো মেয়েরা বেশ মূল্যবান৷ এমন মেয়ে পাওয়া মুশকিল৷ যে পাবে সে বেশ লাকিই হবে৷ আসাদ ভাই, শুনুন, সময় এখনও পেরোয়নি৷ আপনি অর্থির পেছনে লেগে থাকুন৷ দেখবেন তার ভেতরের সকল রাগ ভেঙ্গে যাবে৷ এমনকি আমার মনে হয় আপনি তার রাগটা দ্রুতই ভাঙ্গাতে পারবেন৷ কারণ আপনি তার মনের ভেতরের পুরনো বাসিন্দা৷ পুরনো বাসিন্দাদের প্রতি আমাদের সকলেরই এক প্রকার দূর্বলতা কাজ করে৷ আমার মনে হয় আপনার এখনই চেষ্টা করা উচিৎ।
আমি আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি আবার বললেন,
-ভালোবাসার জন্যে অনেক কিছুই করা যায়৷ আপনিও করে ফেলুন৷ মেয়েটা যেহেতু ফোন ধরছে না, দেখা দিচ্ছে না সেহেতু আপনার উচিৎ তার বাসার সামনে চলে যাওয়া৷ তখন না দেখা করে পারবে না সে৷
-এখনই যাবো?
-আপনার যদি আরো এক রাত কষ্টে না পার করতে ইচ্ছে হয় তবে এখনই যান৷ তা না হলে যাওয়ার দরকার নেই৷
আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনার সাথে হাত মিলিয়ে বললাম,
-প্রত্যেকটা মানুষকে ইন্সপায়ার করার জন্যে আপনার মতো একজন মানুষ দরকার। এমন একজন মানুষ দরকার যে মনের কথা গুলো বুঝে ফেলবে৷ যে ভুল গুলো ধরিয়ে সঠিক পথটা দেখিয়ে দিবে৷ আকাশ ভাই আপনি তেমনই একজন মানুষ। আপনার এই উপকার আমি কখনই ভুলব না৷
তিনি হাসলেন৷ বললেন,
-বিষাদগ্রস্তদের জন্যে তাদের আকাশ ভাই আছে৷ সমস্যা নেই৷ আপনি যান৷ সামনে গেলেই দেখবেন একটা পিচ্চি মেয়ে গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর থেকে একটা গোলাপ কিনে নিবেন৷
তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে৷ এই সময়ে এই মেয়ে গোলাপ পেল কই কে জানে৷ আমি এগিয়ে গেলাম। মোড়ের কাছে আসতেই দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সত্যি সত্যি গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না৷ আমি তার কাছ থেকে একটা গোলাপ কিনে নিলাম। এরপর দ্রুত সেখান থেকে অর্থিদের বাসার পথে এগোলাম। আমাকে আজ কিছু একটা করতে হবে৷ অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে৷
.
অর্থিদের বাসার কাছে এসে অনেকক্ষন এদিকে সেদিক হাঁটলাম৷ তাকে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম না৷ না দেখে ফোন দিলাম। আমার অন্য একটা সীম থেকে ফোন দেওয়া৷ এই নাম্বারটা কেউই জানে না৷ এটা নতুন৷ অল্প কিছুদিন হলো নিয়েছি৷ আমি অর্থির নাম্বার ডায়াল করলাম। কয়েকবার রিং হলো৷ এরপর খট করে রিসিভ করার শব্দ হলো৷ আমি ফোনটা কানের পাশে চেপে ধরে রাখলাম৷ ওপাশ থেকে অর্থির সেই মুগ্ধকর স্বরটা ভেসে এলো,
-হ্যালো কে বলছেন?
আমি চুপ করে থাকলাম৷ আমার মনের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করল৷ অর্থি আবার বলল,
-হ্যালো?
আমি কাঁপাকাঁপা স্বরে বললাম,
-হ্যালো!
-কে বলছেন?
-আমি৷
-আমি কে?
-আসাদ।
অর্থি হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। চট করেই কিছু বলে ফেলতে পারলো না৷ আমি বললাম,
-একটু নিচে নেমে আসবেন?
-বাসার নিচে?
-জি৷
-আপনি আমাদের বাসার নিচে কী করছেন?
-প্রশ্ন না করে নিচে নেমে আসুন৷
-পারবো না৷
-আসতে বলছি আপনাকে৷
-আপনি বললেই হবে নাকি?
-অবশ্যই হবে৷ আপনি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছেন। এবার আপনাকে আমার জ্বালানো সহ্য করতে হবে৷
-আজব তো! কী বলছেন এসব৷
-আপনি নেমে আসুন৷ এরপর দেখবেন কি না কি বলছি৷ জলদি আসুন৷ আমি অপেক্ষা করছি৷
আমি ফোন কেটে দিলাম। ফুটপাতের কাছে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলাম। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। অর্থি এলো না৷ আমি তাও দাঁড়িয়ে থাকলাম। যতো যা-ই হয়ে যাক৷ আজ ওর সাথে দেখা না করে যাচ্ছি না আমি৷
বেশ কিছু সময় পর অর্থিদের বাসার গেট খোলার শব্দ হলো৷ আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। গেট গলে এক সুন্দরী রূপসী কন্যা বেরিয়ে এলো৷ চাতক পাখির মতো চোখ মেলে সে দুপাশ চাইলো৷ আমার দিকে চোখ পড়তেই সে থমকে গেল৷ বাইরে বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কাঁপা শুরু করলো। সে যতোই কাছে আসছে ততোই যেন ধপধপ শব্দটা বাড়ছে। অর্থি একদম আমার কাছে চলে এলো৷ আমি ভালো করে দেখলাম তাকে৷ তার কপালে ছোট্ট একটি টিপ৷ চোখে কাজল। যেন মাত্রই দিয়ে এসেছে৷ আমি কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম ওর চোখের দিকে। আমার অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছিল। কেমন জানি এক রকম প্রশান্তি আমার ভেতরের সকল তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলো৷ আমার মনে হলো আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। যতোক্ষণ সম্ভব আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ অর্থি হঠাৎ বলে উঠল,
-ডেকেছেন কেন?
আমি চট করেই কিছু বলতে পারলাম না। অর্থি আবার বলল,
-এভাবেই চুপচাপ করে থাকবেন নাকি কিছু বলবেন৷ আমার কিন্তু একদম সময় নেই৷
-নেই কেন?
-পড়া আছে।
-আসলেই পড়া আছে?
-জি৷
-আমার আপনার সাথে হাঁটতে ইচ্ছে করছে।
-মানে?
-মানে আমরা এক সাথে অনেকটা পথ হাঁটব৷
-আমার সময় নেই৷
-সময়টা করে নিন৷
-পারবো না৷
-আজ একটু পারার চেষ্টা করুন৷
-আমার কাজ আছে৷
-মিথ্যা বলা শিখে গিয়েছেন দেখছি৷
অর্থি কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো। আমি বললাম,
-আসুন৷ আমার সাথে আসুন। আপনাদের এদিকের পথঘাট চমৎকার। পিচঢালা পথে হাঁটতে লোভ হয় ভীষণ৷ আপনার হয়? কখনও হেঁটেছেন?
-না৷
-হাঁটার ইচ্ছে হয়নি?
-না৷
-সমস্যা নেই৷ আজ আমার সাথে হাঁটবেন৷ দেখবেন ভালো লাগবে৷
অর্থি কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল৷ আমি বললাম,
-আমার চেহারা কি এতোই খারাপ?
অর্থি জবাব দিল না৷ আমি বললাম,
-খুব বেশি কুৎসিত?
অর্থি ভ্রু কুচকে তাকালো আমার দিকে। আমি বললাম,
-আগে হয়তো সুন্দর ছিলাম৷ তাই কোনো এক রূপসী পছন্দ করেছে৷ এখন নিশ্চয়ই কুৎসিত হয়ে গিয়েছি৷ এ জন্যেই বোধহয় রূপসীটা এড়িয়ে চলে৷
অর্থি জবাব দিলো না৷ আমি বললাম,
-আমার নাম্বারটাও বোধহয় কুৎসিত। এ জন্যেই ব্লক করে রাখা৷ তাই না?
অর্থি চুপচাপ হাঁটতে থাকলো। আমি বললাম,
-বিরক্ত হচ্ছেন?
এবারেও অর্থির জবাব পেলাম না। বললাম,
-আমাকে একটু সহ্য করে নিন।
এরপর আরো কিছু সময় নীরব থেকে বললাম,
-নবীন বরণের অল্প কিছুদিন পর থেকেই আপনাকে আমি চিনি৷ প্রথম প্রথম আপনাকে নিয়ে আলোচনা হয় বলেই যা চিনি৷ এরপর রাশেদের কাজিন বলে আরো কাছ থেকে চেনা৷ আপনার সাথে পরিচয় হয়ে বেশ ভালো লাগল আমার৷ কিন্তু দিন যেতে যেতেই আপনি আমার সাথে যে ক্লোজ হতে চাইন এই ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি লাগল। আমি তখন দোটানায় ভুগছিলাম অর্থি। মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গ এতো দারুণ লাগতো৷ আবার মাঝে মাঝে যারপরনাই বিরক্ত জাগতো৷ এই দুটো ছাড়া আমি আপনার প্রতি তখনও কোনো গভীর দৃষ্টি দেইনি। তাইই হয়তো আপনার বাড়তি চঞ্চলতার কারণ টের পাইনি৷ চোখের ভাষাটা টের পাইনি৷ আপনি যা বোঝাতে চাইতেন তা বুঝতে পারিনি৷ আমার ইগো এবং অহংকার আমাকে এসব কিছু নিয়েই ভাবতে দেয়নি। অর্থি আমি আগ থেকেই এমন ছিলাম। বেশিরভাগ সময় একা থেকেছি৷ কারো সঙ্গ পাইনি৷ এরপর কেউ সঙ্গ দিতে এলেও বিরক্ত লাগতো৷ আমার বন্ধু বলতে কেবল রাশেদ ছিল। রাশেদ না থাকলে আমার মনে হতো এই পৃথিবীতে আমি একা৷ ভীষণ একা৷ যার বাবা মাও নেই যে মাঝে মাঝে তাদের সাথে কথা বলবে৷ সময় কাটাবে৷ অর্থি আপনি হয়তো জানেন আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়৷ জানেন?
আমি অর্থির দিকে তাকালাম। পাশ ফিরে দেখলাম অর্থি নেই৷ পেছনে তাকালাম। সে আমার থেকে দু'হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আমি বললাম,
-এই কথাটা অনেকেই জানে না৷ খুব কাছের কেউ ছাড়া আর কেউই জানে না৷
-কখন হলো এমন?
-ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে৷ আমি আসলে তখন থেকেই একা একা থাকছি৷ বাবা মায়ের সাথে আমার আলাপ আলোচনা হয় না৷ তারা তাদের মতো খুশিতেই আছে৷ দু'জনই নতুন করে বিয়ে করেছে৷ আমাকে মাঝে মাঝে ফোন দিত৷ কিন্তু আমি তুলতাম না৷ ওই সিমটা ফেলে দেই এক সময়৷ একা একা জীবন যাপন শুরু করি৷ আমার টিউশনি এবং পড়াশোনাই ছিল আমার একমাত্র কাছের। এরপর রাশেদ৷ এছাড়া আর কেউই ছিল না আমার। তিন ব্যাচ স্টুডেন্ট পড়াতাম আমি তখন৷ সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যা। যথেষ্ট টাকা হাতে আসতো৷ তাই কখনো টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়নি৷
আমি থামলাম৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-আসুন৷ আমরা হাঁটি। আচ্ছা বসলে কেমন হয়? চলুন ফুটপাতের উপর বসে কথা বলি।
আমরা ফুটপাতের উপর বসে পড়লাম৷ অর্থির চেহারার কাঠিন্যতা পূর্বে যেমন ছিল এখন তেমন নেই৷ তার দৃষ্টি কোমল হয়ে এসেছে৷ আমি বললাম,
-সেদিন আমি ভেবেছিলাম রাশেদ আমার ব্যক্তিগত সব কথা আপনাকে বলে দিয়েছে৷ আমার যা যা গোপন কথা, এমনকি আমার বাবা মায়ের বিচ্ছেদের কথাও সে বলে দিয়েছে আপনাকে। এ জন্যেই সেদিন রাশেদের উপর খুব রাগ হলো৷ না বুঝেই রেগে গেলাম৷ যেটা আসলে তখনই আমি ফিল করেছি৷ ভুলটা আমারই। কিন্তু পরে যখন জানতে পারলাম ও আসলে সেই কথাটা আপনাকে বলেনি তখন খানিকটা স্বস্তি এলো তবে বেশ অনুশোচনা হলো। সেদিন ওর পুরো কথাটা শুনলে হয়তো এতোটা রেগে যেতাম না৷ আমার আসলে রাগটা অনেক বেশি৷ এক রোখা টাইপের৷ একা একা থেকে কেমন জানি হয়ে গেছি৷
আমি অর্থির দিকে তাকালাম। দেখলাম সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আমি নির্ভয়ে ওর চোখে চোখ রাখলাম৷ মৃদু হেসে বললাম,
-জানেন অর্থি, আপনার সাথে যখনই আমার চোখাচোখি হয় তখনই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে৷ কেমন অন্য রকম একটা অনুভূতি জাগে ভেতর। এমনটা আমি আগে কখনই অনুভব করিনি৷ কেবল আপনি তাকালেই এমনটা অনুভব করি৷ কী অদ্ভুত এক আনন্দঘন অনুভূতি। আমার মনে হয় আপনার চোখে কিছু একটা আছে৷ আসলেই কিছু একটা আছে?
-তাকিয়ে দেখুন না! কিছু আছে কী না?
আমি অনেকক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কাজল কালো চোখ দুটো আমার দিকে কী ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে আছে! আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে। এরপর চোখ সরিয়ে নিলাম। অর্থি চট করেই বলে উঠল,
-আপনি কি কাঁদছেন?
আমি চোখ মুছে বললাম,
-চোখে কেন জানি পানি জমে গেল!
-আপনি কাঁদবেন না প্লীজ৷
আমি বললাম,
-পিতামাতার স্নেহটা অনেক মূলবান অর্থি। যে সন্তান পিতামাতার স্নেহ না পায় সে কেমন একঘুয়ে, রগচটা টাইপের হয়৷ আমিও ঠিক তেমনি একজন৷ বড় হওয়ার পর থেকে বাবা মায়ের ঝগড়াটা দেখে এলাম। আর কিছু দেখিনি। তাদের আমার প্রতি কোনো ভালোবাসাই দেখিনি।
আমি থামলাম৷ অর্থি কিছু বলল না৷ আমি আবার বললাম,
-বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলে আমি আপনার চোখে আমার জন্যে কেমন জানি একটা মায়া দেখতাম। কেমন অন্যরকম একটা মায়া যেটা আমি আর অন্য কোথাও দেখিনি। আই উইশ, আমি অন্তত সে সময়ে টের পেতাম এই মায়াটা কিসের? কোথায় তার উৎস!
আমি থামলাম৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-অর্থি আমি জানি না আমার কী হয়েছে৷ আমার মাথায় কী আছে কী চলছে এসব কিছুই আমি জানি না। কিন্তু রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই আমি আপনার চেহারাটা দেখি৷ আপনাকে দেখি৷ আপনার মুগ্ধনয়ন দেখি৷ আমার রাতে আর ঘুম হয় না৷ আপনাকে নিয়ে নানান কল্পনা জাগে আমার৷ আপনার চোখের ঘোরে হারিয়ে যাই আমি। রাতভর নানা কথা ভেবে কাটিয়ে দেই৷ আপনি আমার কী হোন, কেন আপনাকে নিয়ে আমি এতো ভাবছি এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতে থাকি আমি৷ বেশ কিছুদিন হলো ভোররাত ছাড়া ঘুম হয় না৷ রোজ রোজ ভার্সিটিতে এসে আপনার খোঁজ করি৷ আপনার দেখা পাই না৷ আপনার ক্লাসে যাই৷ দেখি আপনি নেই৷ যখন দেখি আপনি নেই কী একটা শূন্যতা কাছে করে ভেতরে বলার মতোন না৷ আমার মনে হয় আমার কিছুই নেই৷ আমার কেউ নেই৷ চারদিকে কেবল শূণ্যতা আর শূন্যতা৷ আপনাকে দেখি না, আপনার স্বর শুনি না, আপনার মায়াবী দু'চোখ দেখি না প্রায় অনেকদিন৷ এইসব কেমন জানি কষ্ট হয়ে দলবেধে বুকের মাঝে আঁটকে যায়৷ কী তীব্র সেই ব্যাথা! আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না৷ মাঝে মাঝে মনে হতো আমি মারা যাবো৷ কেমন জানি দমবন্ধ হয়ে আসতো। একদিন রাশেদকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম অর্থিকে কেন দেখি না৷ রাশেদ বলল অর্থি নিজ থেকেই আমাকে এড়িয়ে চলে। ভার্সিটিতে কম আসে। এলেও মাঝেমাঝে বোরখা পরে আসে। আমার মন খারাপ হয়৷ নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় আমার৷ আমি এমনিতেই অসহায়৷ তারউপর কেই যদি ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করে, আমাকে এমন করে এড়িয়ে যায় তবে আপনিই বলুন আমার কি অসহায় লাগবে না? বলুন, লাগবে না?
শেষ কথাটা আমি অর্থির দিকে তাকিয়ে বললাম। মেয়েটা জলভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে৷ আমাকে দেখছে৷ আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম,
-এই অসহায়ত্ব গিলে পড়ে থাকতাম। ব্যাথা সয়ে যেতাম। অর্থির অনুভূতি আমি বুঝতে পারিনি৷ এ আমার অন্যায়৷ আজ যা হচ্ছে, যতো ব্যাথা পাচ্ছি এসব আমার শাস্তি৷ আমি এসবই ডিজার্ব করি৷ আমার জন্যে এরচে ভালো কিছু নেই৷
অর্থি আমার গালের কাছে হাত রাখলো৷ আমার চোখের কোণা মুছে দিলো৷ আমি তার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে বলি,
-অর্থি, আপনি কেন আমাকে এভাবে এড়িয়ে গেলেন? কেন আমাকে একটাবার কথা বলার সুযোগ দিলেন না?
অর্থি কেমন ধরে আসা স্বরে বলল,
-আমি ভাবলাম আমি ভুল মানুষটাকে ভালোবেসেছি৷ আমার মানুষ আমার মতো নয়৷ আমার ভাবনার মতো নয়৷ তাইই এড়িয়ে গেলাম। আপনাকে ভুলার চেষ্টা করলাম।
-পেরেছেন ভুলতে?
-তা পারলাম কই? প্রত্যেক বিকেলে অপেক্ষা করতাম আপনি কখন আসবেন। কখন আপনাকে দেখব আমি।
-দেখা পেতেন?
-ঠিক পেতাম! মানুষটা যে প্রতিদিন টিউশনির পর একবার হলে আমাদের বাসার নিচ দিয়ে হেঁটে যেত! এটা কি মিস করা যায়?
আমি অবাক স্বরে বললাম,
-আপনি আমাকে দেখতেন?
অর্থি মাথা নিচু করে বলল,
-হু৷
-কিন্তু আপনাকে তো কখনই বারান্দায় দেখিনি।
-আমি আড়ালে থাকতাম!
-বাহ! নিজে আড়ালে আড়ালে ঠিকই দেখতেন৷ অথচ আমাকে একবার দেখা দিতেন না৷ চমৎকার বিচার আপনার!
-আপনি যে আমাকে দেখতেই আসতেন এমন তো না৷ তাছাড়া আপনার উপর রাগ ছিল আমার।
-তাহলে সেদিন কেন বললেন রাগ নেই?
-আমি বললাম আর আপনি বিশ্বাস করে ফেললেন? ওটা যে রেগে গিয়ে বলেছি তা বুঝি টের পাননি?
-আমি তখন বুঝতে পারিনি৷ আপনারা মেয়েরা এতো জটিল!
-জটিল জিনিসের মূল্য বেশি৷
আমি হাসলাম৷ বললাম,
-এখন?
-এখন কী?
-আপনার কী মন ভালো?
-জানি না।
-রেগে আছেন এখনও?
-বুঝতে পারছি না।
-একটা গোলাপ নিয়ে এসেছি৷ ওটাকে কী করব বলুন তো?
-ফেলে দিন।
আমি গোলাপটা ফেলে দিতে চাইলাম। কিন্তু ফেললাম না। গোলাপ হাতে নিয়ে অর্থির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। অর্থি চট করেই দাঁড়িয়ে গেল৷ আমি গোলাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-অর্থি, আমার আসলেই একজন কাউকে দরকার৷ এমন একজনকে যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসবে৷ আমার প্রতিটা ভুল পদক্ষেপ সে সঠিক করে দিবে৷ যে আমাকে বুঝবে৷ বোঝাবে। মানুষ একা থাকতে পারে না অর্থি৷ এই কথাটি আমি এখন বিশ্বাস করি৷ আমি বুঝতে পারি আমার ভেতরও আবেগ-অনুভূতি আছে৷ আমার ভেতরেও কেউ বাস করতে পারে৷ কেউ আমার মস্তিষ্কে বসে বসে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ আমি জানি সেই মানুষটা কে। আমি চিনি তাকে৷ সে এক মায়াবী কন্যা৷ যার মুগ্ধকর দুটো চোখ আছে৷ আমি যার চোখের প্রেমে পড়েছি। যার দৃষ্টি আমাকে ঘায়েল করেছে৷ আমাকে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে। অর্থি, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি৷ তোমার চোখের গভীরতায় ডুবেছি৷ তোমার মনজয় করা হাসির মায়ায় পড়েছি আমি। আমি তোমার মুগ্ধতায় হারিয়েছি৷ আমি তোমাকেই ভীষণ করে ভালোবেসেছি অর্থি৷ এতোটা আমি নিজেকেও ভালোবাসিনি। অর্থি, আমি চাই আমার জীবনের বাকি সব গুলো বৃষ্টির মৌসুম আমি তোমার সাথে কাটাবো৷ আমরা দু'জন এক মগে করে কফি খাবো৷ এরপর তোমাকে কোলের কাছে জড়িয়ে রেখে বৃষ্টি বিলাশ করবো৷ অর্থি তুমি কি আমার বৃষ্টি বিলাশি বন্ধু হবে? এক মগে কফি খাওয়ার সঙ্গি হবে? বলো হবে?
কথা গুলো বলে আমি অর্থির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে জলভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকল। কাঁপাকাঁপা হাতে গোলাপটা নিল। ভেজা স্বরে বলল,
-আমার পুরনো অনুভূতি গুলো কেমন পাগলাটে হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে নিয়িন্ত্রণ করতে পারছি না৷ আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷ আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷ আপনি কি আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন? আপনি আপনার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে চাই৷ আপনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই৷ উঠুন না প্লীজ৷ আমাকে জড়িয়ে ধরুন৷
আমি উঠে দাঁড়ালাম। অর্থির দিকে এগোনোর আগেই অর্থি আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ চট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কী শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বলার মতন না৷ খুব জোরে চেপে ধরে রেখে মেয়েটা উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকলো। যেন অনেক দিন পর সে কান্না করার একটা জায়গা পেল। এমন জায়গা যেখানে নিঃসংকোচে কাঁদা যায়৷ নির্ভয়ে কাঁদা যায়৷ অর্থি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-শুনুন, আপনাকে আমি ভালোবাসি৷ ভালোবাসি৷ ভালোবাসি৷ আপনাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসি। আপনি কি বাসেন?
আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে বললাম,
-তোমাকে ভালোবাসি বলতে হয়৷ বলো আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ বলো!
-আমি তোমাকে ভালোবাসি৷
কথাটা বলেই কেমন লজ্জা পেল সে৷ তার স্বর শুনেই বোঝা গেল। আমি বললাম,
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি৷ যতোটা তুমি ভালোবাসো তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি৷
-না আমি বেশি ভালোবাসি৷
-না আমি৷
-মোটেও না৷ আমি৷ আমি আমিই৷ তোমাকেও বলতে হবে 'আমি'। বলো "আমি।"
-আচ্ছা যাও৷ তুমিই৷
অর্থি কিছু বলল না৷ কান্না মিশ্রিত স্বরে হাসলো কেবল।
.
আমাদের প্রথম বৃষ্টি বিলাশঃ
বাইরে তখন দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে৷ বছরের প্রথম বৃষ্টি। আমাদের দু'জনের জন্যেও প্রথম৷ সদ্য বিয়ে হয়েছে আমাদের৷ আমি বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছি। ঠিক এমন সময় কোত্থেকে যেন অর্থি দৌড়ে এলো। আমি তার দিকে তাকাতেই অবাক হলাম৷ বললাম,
-তুমি কি এভাবে আমার সব গুলো গেঞ্জি পরে যাবে?
-হ্যাঁ৷ যাবো৷ তোমার কোনো সমস্যা আছে?
-না, তা নেই।
-তবে? পরবে না আর? আমি যেটা গায়ে দেই ওটা আর পরবে না?
-না পরে কি উপায় আছে! আমার সব গুলো গেঞ্জিই তো তুমি পরো।
-হ্যাঁ৷ পরি৷ পরব৷ আমার ভালো লাগে তাই পরব৷ তোমার তো কোনো সমস্যা হয় না তাই না?
কথাটা বলে অর্থি আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ আমি বললাম,
-না। কোনো সমস্যা নেই৷
সে এগিয়ে এসে আমার ল্যাপটপটা বন্ধ করে বলল,
-বেশ৷ ল্যাপটপটা এখন রেখে দাও৷ এখন আর কাজ করতে হবে না৷
-লেখাটা শেষ করে নেই?
-না৷ এখন কোনো লেখালেখি নেই৷ রাখো এসব৷ এদিকে আসো৷
আমি ল্যাপটপটা রেখে দিলাম৷ তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কী?
-বোঝো না কী?
আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
-বুঝি তো!
-চুপ! যতোসব উল্টা বুঝ তোমার৷ বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে দেখছো না?
আমি বাইরে তাকালাম। বৃষ্টির বেগ আসলেই বেড়ে গিয়েছে৷ আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের বিছানাটা একদম জানালার পাশে৷ এখান দিয়ে বৃষ্টি দেখা যায় ঠিক মতো৷ আমি বললাম,
-বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে৷
অর্থি কিছু বলল না৷ সে উঠে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো৷ বলল,
-বৃষ্টি যে আমার ভীষণ পছন্দ তা কি তুমি জানো?
-জানি৷
-আমাদের বৃষ্টি বিলাশ করার কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছো?
-ভুলিনি৷
-তবে?
-কফি লাগবে তো!
-বানিয়ে নাও না একটু৷
-আচ্ছা, ছাড়ো আমায়৷ আমি বানিয়ে আনছি৷
-ছাড়ব না৷
-না ছাড়লে যাবো কী করে?
-জানি না৷
-দেরি করা যাবে না কিন্তু৷ বৃষ্টি চলে যাবে৷
-তুমি আমাকে কোলে নাও৷
-এই বুড়িকে আমি কোলে নিবো?
-আমি বুড়ি না।
-আমি পারব না নিতে৷
-পারবে। তুমি আগেও আমাকে কোলে নিয়েছো৷
আমি আর কিছু বললাম না৷ অর্থিকে কোলে নিয়ে নিলাম। তাকে কোলে নিয়ে কিচেনে এলাম। আসতেই দেখলাম একটা ফ্লাক্স আর একটা বড় মগ রাখা৷ আমি ওকে নামিয়ে রেখে বললাম,
-তুমি আগ থেকে বানিয়ে রেখেছো?
সে হাসলো৷ বলল,
-হু৷
-বেশ৷ চলো তবে।
আমরা দু'জনে নিজেদের রুমে চলে এলাম। লাইটটা অফ করে দিলাম। ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। একটু একটু শীত লাগতে শুরু করল। অর্থি ফ্লাক্স থেকে এক মগ কফি নিল৷ তারপর আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ আমি তখন বিছানার উপর বসে ছিলাম। অর্থি এগিয়ে এসে আমার কোলের কাছে বসলো৷ তার হাতে কফির মগ৷ আমি বললাম,
-লিপস্টিক মাখলে কখন? কাজলও দিয়েছো দেখছি?
-টিপও তো দিলাম। তুমি না আজকাল আমার দিকে একদমই খেয়াল করো না৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-বড় অন্যায় হয়ে গেল। এই কাজের চাপে সব গুলিয়ে ফেলেছি৷
-এমনটাই করিও৷
-রাগ করলে নাকি?
-না৷
-না মানে হ্যাঁ?
-না। না নামে না৷
আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
-শোনো।
-বলো৷
-মগটা এদিকে দাও৷
-কেন?
-দাও না!
অর্থি মগটা এগিয়ে দিলো৷ আমি সেটা বিছানার পাশে রাখলাম। বললাম,
-তাকাও এদিকে।
অর্থি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আমার দিকে৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ ও বলল,
-কী দেখো?
আমি তাকিয়ে থাকলাম। বললাম,
-রেড কালারের লিপস্টিক!
অর্থি হাসলো৷ আমি বললাম,
-তোমার ঠোঁটেই যেন এটিকে অসাধারণ লাগে৷ আমার তো ইচ্ছে হয় খেয়ে ফেলি!
অর্থি এবারেও হাসলো৷ আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম৷ বললাম,
-আগে চুমু খাবো৷
অর্থি চুপ থাকলো৷ আমার দিকে ফিরলো৷ আমি মাথাটা নিচে করে নিলাম। ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের কাছে গিয়ে থামলাম। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে আছে৷ তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে৷ আমি আলতো করে তার ঠোঁটে চুমু খেলাম। প্রথমে নিচের ঠোঁট৷ এরপর উপরের৷ ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই আমার ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো৷ কেমন এক শিরশিরে শীতল শিহরণ আমার সমস্ত গা বয়ে গেল৷ আমি যেন হঠাৎ একরাশ প্রশান্তি অনুভব করলাম। অনবদ্য এক মিষ্টি স্বাদ অনুভব করলাম। আমি ধীরে ধীরে মাথা তুলে নিলাম। অর্থি বেশ কিছু সময়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। আমি তাকে দেখে গেলাম৷ সে ধীরে ধীরে চোখ মেলল। আমি তখনও তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অর্থি এবার আমার দিকে ফিরে বসল। দু'হাত আমার গালের কাছে রাখলো। এরপর আমাকে টানলো নিজের দিকে৷ নিজে কিছুটা এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো৷ বেশ গভীর ভাবে চুমু খেল সে৷ অনেকটা সময় পর্যন্ত তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের সাথে মিশে ছিল। চুমু শেষে মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছু সময়। আমার কাঁধে চুমু খেল। আমি বললাম কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ অর্থি আবার ফিরে বসলো। বৃষ্টির দিকে তাকালো৷ আমি কফির মগটা নিলাম। প্রথম চুমুক দিলাম কফির মগে৷ অর্থি নিজে সেটা আমার থেকে নিল৷ তারপর নিজে এক চুমুক খেল। এরপর গভীর দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি তার কাঁধের কাছে মাথা রাখলাম৷ চুমু খেলাম। ওকে সেভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখলাম। বললাম,
-চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির শব্দটা শোনো৷
অর্থি চোখ বন্ধ করে নিলো৷ আমিও চোখ বন্ধ করে নিলাম। বাইরে তখন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে৷ ঝরঝর শব্দটা অন্য রকম একটা সুর তুলছে৷ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে সেই সুর শুনতে থাকলাম। আমার কাছে দারুণ লাগল সুরটা। বেশ অনুভব করার মতো একটা সুর। আমি চোখ বুঁজে তা অনুভব করে গেলাম। অর্থিও ঠিক তাই করলো৷ আমরা যেন বৃষ্টির সুরেলা কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টির জগতে ভেসে যেতে থাকলাম৷ যেন চারপাশে বৃষ্টিরা দাঁড়িয়ে আছে৷ মাঝেখানে আমি আর অর্থি৷ দু'জনে একে অপরেক জড়িয়ে ধরে আছি৷ বৃষ্টিরা আমাদের এই দৃশ্য বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর সুরে কণ্ঠে গান গাইছে, "ঝর ঝর ঝর৷"
.
সমাপ্ত।
.
গল্পঃ অর্থি।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ