গল্পঃ অর্থি। প্রথম পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ।
গল্পঃ অর্থি। প্রথম পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ
গল্পঃ অর্থি। প্রথম পর্ব। লিখেছেন - তাসফি আহমেদ।
মেয়েটা আমাকে দেখতেই থেমে গেল। কিছু সময় আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। এরপর মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলো। কাছে এসে বলল,
-আপনি এখানে?
আমার চেহারায় তখনও অবাক ভাব৷ এই মেয়েটাকে এখানে দেখব বলে আশা করিনি। কেমন জানি লাগছে৷ কেন জানি বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না৷ যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই মেয়েটাকে দেখছি৷ এটা কেমন কথা! আমি কোনো মতে বললাম,
-এদিকে টিউশনি আছে একটা৷
-টিউশনি? আপনি টিউশনি করান?
-জি৷
-এদিকে কোথায়?
-এই তো সামনেই৷ চল্লিশ নাম্বার বাসা।
-চল্লিশ নাম্বার? ওই বিল্ডিংটার দুই বিল্ডিং পরেই তো আমাদের বাসা!
আমি মৃদু হেসে বললাম,
-আচ্ছা!
-আপনাকে আগে কখনও দেখিনি এদিকে৷ টিউশনিটা কি নতুন?
-জি৷
-কবে থেকে শুরু করেছেন?
-দিন দশেক হবে।
-কী বলেন! এতো দিন হয়ে গেল? আমি টেরও পেলাম না?
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। হাসলাম কেবল। অর্থি আবার বলল,
-চলুন। একসাথে যাই৷ আমিও বাসায় যাবো৷
-চলুন।
আমরা দু'জন হাঁটতে থাকলাম। কিছুদূর যেতেই অর্থি বলল,
-ইদানিং ভার্সিটিতে কম দেখছি আপনাকে। দেখা হলেও বেশ ব্যস্ত থাকেন৷ ক্যাম্পাসেও বেশিক্ষণ থাকেন না৷ কেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-ওই যে ব্যস্ত থাকি৷ তাই৷
-কী নিয়ে এতো ব্যস্ত শুনি?
-আছে কিছু কাজ৷
-খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
-গুরুত্বপূর্ণ বলাই যায়৷ আসলে বাসাটা চেঞ্জ করেছিলাম৷ সেখানেই যা ব্যস্ত ছিলাম।
-কোথায় উঠেছেন?
-ভার্সিটির কাছেই।
-বাহ! বেশ তো! ভার্সিটি থেকে আমাদের এখানটা খুব একটা দূরে নয়৷ কাছেই বলা যায়৷
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ অর্থি আবার বলল,
-মাঝে মাঝে আপনার সাথে গিয়ে দেখা করা যাবে।
-তা যাবে।
কথাটা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। অর্থি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো৷ চট করেই যেন তার মনে পড়ে গেল আমাকে এখানে থামতে হবে৷ সে বলল,
-অহ আপনাকে তো যেতে হবে৷
-জি৷
-আচ্ছা৷ যান তবে৷ আবার দেখা হবে। কেমন?
-হুম।
আমি ভাবলাম কথাটা বলে অর্থি চলে যাবে৷ কিন্তু সে গেল না৷ সে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। দারোয়ান আমাকে দেখতেই এক গাল হেসে বলল,
-কেমুন আছেন সার?
আমি হাসিমুখে বললাম,
-ভালোই৷ আপনার খবর কী?
-ভালা৷
আমি ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম। কলিং বেল বাজালাম। ভাবলাম একবার পেছন ফিরে তাকাই। মেয়েটা হয়তো এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখছে৷ এমনটা কেবল আমার মনে হলো৷ এটা সত্যি সত্যি হবার মতোন কিছু না৷ কিন্তু আমি যখন সত্যিই পেছন ফিরে তাকালাম তখন দেখলাম অর্থি ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কেমন জানি এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে৷ আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে নিলাম। আমার মনে হলো আমি তার চোখে কিছু একটা দেখেছি৷ অন্য রকম কিছু একটা৷ যেটা আগে কখনই দেখিনি। কিংবা হয়তো খেয়াল করিনি৷ আমি সত্যিই এবার অবাক হলাম৷ আশ্চর্য ব্যাপার! এই মেয়ে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
.
অর্থি আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে৷ একই ডিপার্টমেন্টের। তবে সে আমার জুনিয়র। আমি তাকে চিনতাম না৷ চিনলাম রাশেদের মাধ্যমে। সে আবার রাশেদের কাজিন৷ সেই সুবাদে একদিন পরিচয় হয়৷ ব্যস৷ এরচে বেশি কিছু জানতাম না আমি৷ তবে যখন থেকে তাকে চিনলাম তখন থেকে তার ব্যাপারে নানান গুঞ্জন শুনলাম৷ সুন্দরী বলে তার অন্য রকম একটা দাপট আছে ভার্সিটিতে। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই এক সিনিয়র ভাইয়া ওকে প্রপোজ করে বসলেন। উনি যথেষ্ট স্মার্ট এবং মেধাবী ছাত্র৷ ওই ভাইয়াটার জন্যেও অনেক মেয়ে পাগল ছিল! স্মার্ট এবং মেধাবী ছেলেদের পেছনে যেমন মেয়েদের লাইন লেগে থাকে তেমন। ভাইয়া তাদের পাত্তা দিতেন না৷ অথচ অর্থিকে তিনি প্রপোজ করে বসলেন। আমরা সকলেই তো যারপরনাই অবাক। তবে এরচে বেশি অবাক হলাম যখন জানতে পারলাম অর্থি সেই প্রপোজালটা রিজেক্ট করে দিয়েছে। মেয়েটার বান্ধবীরা নিশ্চিত একে বেশ গালিগালাজ করেছে৷ যেখানে অন্যরা সকলে ছেলেটার জন্যে পাগল সেখানে এই মেয়ে কি না রিজেক্ট করেছে? কোনো পাগল মেয়েই এমনটা করবে! এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ছেলেদের মুখে অর্থির নাম প্রায়ই শুনি৷ এছাড়া সে একজন গল্পকারও নাকি! তার কয়েকটা গল্প নাকি পত্রিকায়ও গিয়েছে। ব্যস৷ তার ব্যাপারে এতটুকুই আমার জানা৷ এরচে বেশি কিছু না৷
অর্থির সাথে আমার কখনই তেমন কথাবার্তা হয়নি। তার সাথে হাই হ্যালো হতো৷ এই যা! কখনো বসে দু'দন্ড আলাপ হয়নি৷ একসাথে চা-কফি গেলা হয়নি৷ মেয়েটা একদিন বলেছিল অবশ্য। আমার কাজ ছিল বলে তার সাথে যাওয়া হয়নি৷ প্রথম প্রথম এভাবেই চলছিল। কিন্তু ইদানীং মেয়েটার মাঝে দারুণ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ভার্সিটিতে সময় সুযোগ পেলেই সে আমাদের সাথে আড্ডা দিতে চলে আসে৷ আমরা ডিপার্টমেন্টের সকলে বসে আড্ডা দিলেও সে এসে সেখানে বসবে৷ একদম আমার পাশ ঘেঁষে বসবে৷ রাশেদের পরিচিত বলে ডিপার্টমেন্টের অনেকের সাথে তার ভালো পরিচয় আছে৷ তাই কেউই কখনও আপত্তি করেনি৷ তবে আমি বেশ অস্বস্তিবোধ করতাম। এভাবে চট করেই এসে পাশে বসাটা আমার কাছে কেমন জানি লাগতো৷ অন্যরকম একটা অনুভূতি হতো৷ তাও চুপচাপ বসে থাকতাম৷ কিছু বলতে পারতাম না।
আবার মাঝে মাঝে দেখা গেল আমি আর রাশেদ বসে আছি৷ কোত্থেকে জানি মেয়েটা এসে আমাদের সাথে বসে পড়তো৷ বসেই গল্প করতে শুরু করতো৷ এতো কথা বলে মেয়েটা! মাথা ধরে যায়৷ মাঝে মাঝে রাশেদ ফোন এসেছে বলে ফোন কানের কাছে ধরে উঠে চলে যায়৷ আমি পড়ে যাই বিপাকে৷ একা একা আমাকে বসে বসেই তার বকবক শুনতে হয়৷
-শুনুন একটা কথা বলি৷
-বলুন৷
-চট করেই প্রেমে পড়ে যাবেন না৷ কাউকে ভালো লাগলেই প্রপোজ করে দিতে হবে এমন তো না!
-তা ঠিই৷
-আপনাদের ছেলেরাই এসব বেশি করে৷ একটা মেয়েকে ভালো লাগলেই তাকে প্রপোজ করে বসেন৷ আরে ভাই দেখা মাত্রই প্রপোজের কি আছে? কিছু দিন সময় নে৷ একটু ভাব! এটা আকর্ষণ নাকি প্রেম তাও তো বুঝতে হবে তাই না? অথচ এরা সেসব দেখে না৷ ভালো লেগেছে বলেই প্রপোজ করে বসেছে ব্যস৷
-এ জন্যেই ডিভোর্সের সংখ্যাটা বেশি৷
-ঠিক বলেছেন৷ পরে গিয়ে দোষ দেয় প্রেমের৷ এদেরকে কে বোঝাবে যে প্রেম আর আকর্ষনের মাঝে বিস্তর তফাত৷
এতটুকু বলে মেয়েটা থামে৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,
-তা আপনি প্রেম করছেন নাকি?
-জি না৷
-সত্যিই?
-সত্যি।
-বিশ্বাস হচ্ছে না৷
-কেন হচ্ছে না?
-আপনার মতো একটা ছেলে প্রেম করছে না এটা অবিশ্বাস্য।
-অবিশ্বাস্য কেন হতে যাবে?
-এই যে আপনি এতো সুন্দর, সুদর্শন। এতো দারুণ দুটো চোখ! আপনার পেছনে নিশ্চয়ই মেয়েদের লাইন লেগে থাকে। এমন ছেলেরা সিঙ্গেল থাকে না৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-আপনি আমার কথাই বলছেন তো?
-তা নয় তো কার?
-কেন জানি নিতে পারছি না কথা গুলো৷ আমার নিজেকে কখনই এতো সুদর্শন মনে হয়নি।
-তা কারোই হয় না৷ নিজেকে কেউই বিশেষ পছন্দ করে না৷
-তাও৷ আমাকে নিয়ে কেউ এতো গভীর আলাপ করেনি৷ তাছাড়া এসব আমার সাথে যায়ও না৷ এসব যায় মিনহাজ ভাইয়ের সাথে।
-মিনহাজ ভাইটা আবার কে?
-ওই যে, যে আপনাকে প্রপোজ করলো? আমাদের সিনিয়র ভাইটা।
-ওহ!
অর্থি 'ওহ' বলে বেশ কিছু সময় নীরব থাকলো৷ কিছু বলল না৷ আমি বললাম,
-সত্যিকার সুদর্শন তারা৷ মিনহাজ ভাইয়ের মতোন ছেলেরা। তাদের পেছনে কন্যাদের লাইন থাকে৷ আমাদের মতো এভারেজ ছেলেদের পেছনে না৷ আপনি তো মিনহাজ ভাইকে চিনতে পেরেছেন তাই না?
-জি।
-তিনি আমার চেয়ে বেশি স্মার্ট৷ সুদর্শন। এই কথাটি নির্মম সত্য৷ সত্য না?
-তা সত্য।
-আপনার কি মন খারাপ?
অর্থি মাথা তুলে তাকালো৷ কাজল কালো চোখ মেলে আমার দিকে চাইলো৷ ঠোঁটের কোণে মায়াবী এক হাসি টেনে বলল,
-মন খারাপ না।
-হঠাৎ যে নীরব হয়ে গেলেন?
-কই? নীরব হলাম কই?
-এই যে আপনার কথা বলার তেজটা কেমন কমে এলো!
-আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। আমার মনে হয় যে মানুষ গুলো বেশি বেশি কথা বলে তাদের সবার সাথেই এমন হয়৷ হঠাৎ হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে যায়৷ আচ্ছা আপনি কি গল্প পড়েন?
-মাঝে মাঝে উপন্যাস পড়া হয়।
-কী ধরনের উপন্যাস পরেন? রোমান্টিক, থ্রিলার নাকি ভৌতিক।
আমি মৃদু হেসে বললাম,
-ডিপেন্ডস অন মাই মুড!
অর্থি হাসলো। কিছু বলল না আর।
আমাদের এভাবে আলাপ হতো৷ মাঝে মাঝে কিছু সময় বিরক্তি লাগত আবার কখনো ভালোও লাগতো৷ তর্কে বিতর্কে আমাদের একটা অগোছালো সময় পার হয়ে যেত। কেউই বিশেষ টের পেতাম না৷ মাঝে মাঝে মনে হতো সময় খুব দ্রুত যায়৷ আবার মাঝে মাঝে মনে হয় ঘড়ির কাঁটা আর চলছে না৷ এভাবেই যাচ্ছিল দিনকাল।
তবে এই দুইদিন আমি বোধহয় অর্থিকে একটু বেশিই দেখছি। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই তাকে দেখছি। দেখছি বলতে মেয়েটা আমার চোখের সামনে পড়ে যাচ্ছে৷ কাল সকালের দিকে গেলাম মার্কেটে৷ গিয়ে দেখলাম সে সেখানে৷ বান্ধবীদের সাথে এসেছে৷ বিকেলের দিকে তার সাথে ফের পার্করোডে দেখা৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা গিলছে। আমাকে দেখতেই টেনে নিয়ে গেল। জোর করে অখাদ্য ফুচকা গেলালো। তবে সত্যি বলতে সেদিনের ফুচকাটা অখাদ্য ছিল না৷ আমার মনে হলো আমি সেদিন আমার জীবনের সেরা ফুচকাটা খেয়েছি।
সবই ভালো৷ তবে সমস্যা হলো এই মেয়েটা একবার দেখা হলে আর ছাড়তে চায় না। আমি অযুহায় দেখিয়ে চলে আসতে চাইলেও সে আসতে দেয় না৷ কথার জালে যেন আমাকে আঁটকিয়ে রাখে৷ কিংবা কোনো জরুরি কাজ আছে বলে আমাকে উদ্ভট সব জায়গায় নিয়ে যায়৷ আমার কিছুটা বিরক্তি লাগে। তবে সেটা প্রকাশ করি না৷ কিংবা আমি যেন প্রকাশ করতেই জানি না৷ মুখ ফুটে বলতে জানি না "আমি এখন কোথাও যেতে পারব না। আপনি খুব জোরাজোরি করলেও আমার পক্ষে আপনার সাথে কোথাও যাওয়া সম্ভব না৷ কোনো মতেই সম্ভব না৷" মেয়েদের উপেক্ষা করা আসলেই কি কঠিন?
অয়নকে আজ ঠিক ভাবে পড়াতে পারলাম না৷ বারবার অর্থির চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছিল। গেটের কাছে তার কেমন এক মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার চিত্রটা চোখের উপর ভেসে উঠছিল৷ আমি খুব করে চাইলাম তার চেহারা যেন এমন ভেসে না উঠে৷ আমি অয়নকে পড়ানোয় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম৷ অথচ আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠলো না৷ আমি কোনো মতেই নিজের ভাবনা থেকে অর্থিকে দূর করতে পারলাম না।
অয়নদের বাসা থেকে বের হতেই দেখলাম অর্থি দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে আকাশি রঙের একটা শাড়ি৷ গোল গোল চোখ দুটোয় গাঢ় করে কাজল দেওয়া৷ দু'ভ্রুয়ের মাঝ বরাবর একটা টিপ৷ আমি বেশ কিছু সময় বোকার মতো অর্থির দিকে চেয়ে থাকলাম। আমার চোখ সরছিল না৷ আমার কেন জানি ইচ্ছে হয়েছিল আমি আজ সারাদিন অর্থিকে দেখি। কেবল তার দিকে চেয়ে থাকি। আশ্চর্য ব্যাপার! এমনটা আমার কখনই মনে হয়নি৷ আজ কেন মনে হলো? অর্থি মৃদু হেসে এগিয়ে এলো৷ আমি তখন নুপুরের শব্দ শুনলাম। দু'হাতের রিনঝিন চুড়ির শব্দ। আমার ঘোর ভাঙ্গল৷ অর্থি এগিয়ে এসে বলল,
-চলুন।
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-কোথায়?
-চলুন না। আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
-এখনই যাবো?
-হ্যাঁ৷
-কিন্তু...?
-কোনো কিন্তু টিন্তু চলবে না।
-আমার কাজ আছে অর্থি৷
-তা জানি তো৷ বেকারদের কাজ একটু বেশিই থাকে।
-আমার আসলেই কাজ আছে।
-তা থাকুক৷ আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে৷ যেতেই হবে৷
আমি কিছু সময় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলাম অর্থির দিকে৷ সত্যি বলতে এবার আমার মেজাজ খারাপই হলো৷ এই মেয়ের সাথে দেখা হওয়াটাই মারাত্মক ভুল। দেখা হলেই সে নানান বাহানায় নানান জায়গায় নিয়ে যায়৷ আমার কথা সে শুনতেই চায় না। আমার উপর কেমন জানি একটা অধিকার খাটায়৷ যেন সে যা বলবে আমাকে তা করতে হবে৷ করতে হবে মানে করতেই হবে৷
অর্থি বোধহয় আমার বিরক্তিভাব কিছুটা টের পেল। সে খানিকটা ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলল,
-চলুন না৷ শুধু আজকের জন্যে৷ আর কখনই আপনাকে বিরক্ত করব না৷ প্রমিজ৷
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু বললাম না আর।
আমরা একটা রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় উঠে কেউ কোনো কথা বললাম না। বেশ কিছু সময় নীরবতায় কাটলো। কিছুদূর যেতেই রিক্সাটা থেমে গেল। একটা ছেলে এসে একটা ব্যাগ রেখে গেল৷ ব্যাগ ভর্তি কিসব জিনিস৷ ফলমূল বোধহয়। ছেলেটা অর্থির দিকে তাকিয়ে বলল,
-অর্থির কি মন খারাপ?
অর্থি কেমন করে যেন তাকালো। বলল,
-জি না৷
-ইনি আসাদ না?
-জি।
-হ্যালো আসাদ, আমি আকাশ।
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। বললাম,
-হ্যালো, আমি আসাদ।
তিনি হাসলেন। অর্থির দিকে চেয়ে বললেন,
-আমার সাথে যাওয়ার সময় কখনই তো এতো সাজগোছ করোনি। আজ হঠাৎ এতো আয়োজন?
বলে হাসতে থাকলেন তিনি৷ অর্থি কিছু বলল না। আমি দেখলাম সে ঠোঁট চেপে অন্য দিকে চেয়ে আছে৷ তার গালটা কেমন লালচে হয়ে আছে৷ লজ্জায় তার যাচ্ছে তাই অবস্থা৷ আমি অবাক হলাম। মেয়েটা এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন?
আকাশ ভাই বললেন,
-আমার কাজটা খুবই জরুরি অর্থি। তা না হলে আজ ঠিকই তোমার সাথে যেতাম৷ যাই হোক, যাও তোমরা। সাবধানে থেকো।
আমাদের রিক্সা চলতে শুরু করলো৷ আমরা অনেক দূর নীরবতাকে সঙ্গি করে চলে এলাম। অর্থির বোধহয় মন খারাপ৷ মেয়েটা আমার বিরক্তি ভাবটা যেন বুঝে ফেলেছে৷ সে বুঝতে পেরেছি আমি তার উপর বিরক্ত৷ আমার খানিকটা খারাপই লাগলো৷ বিরক্তিটা এভাবে প্রকাশ পেয়ে যাবে ভাবিনি৷ নীরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,
-আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
-বেশ!
-আপনার প্রোফাইলটা ঘাটলাম।
-তাই?
-হুম৷ ভালো লাগলো৷ কয়েকটা গল্পও পড়ে ফেললাম। কী চমৎকার ছোট গল্প গুলো৷ আমার বেশ ভালো লাগল। সেদিনের পর থেকে তোমার প্রোফাইলটা নিয়মিত ভিজিট করতে শুরু করলাম।
-শুনে ভালো লাগলো৷
আমি খানিকটা সময় নীরব থেকে বললাম,
-কারো অপেক্ষায় আছেন আপনি। তাই না?
অর্থি হাসল। বললাম,
-আমরা সবাইই কারো না কারো অপেক্ষায় থাকি৷
-সবাইই থাকে না বোধহয়৷
-তাও স্বাভাবিক। নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়।
-তার মানে অপেক্ষায় থাকাটাকে আপনি নিয়ম বলছেন?
-জি। আশপাশ দেখেই বলছি৷ সবাইই কেউ একজনের অপেক্ষা করে৷ এমনকি একজন নষ্ট ছেলে কিংবা নষ্ট মেয়েও এক সময়ে কেউ একজনের অপেক্ষা করে৷ যে তাদের সকল নষ্টামির গল্প জেনেও তাদের তীব্রভাবে ভালোবাসবে৷ এক সময় তারাও চায় ভালোবাসা পেতে৷ সত্যিকারের ভালোবাসা৷ আসলে আমরা সকলেই ভালোবাসা পেতে চাই৷
-তারমানে আপনার অপেক্ষা কেবল কেউ একজনের যে আপনাকে তীব্রভাবে ভালোবাসবে৷ যে কেবল আপনাকেই চাইবে৷ মূল কথা হলো আপনি একজন সুপুরুষের অপেক্ষা করছেন। তাই তো?
-অপেক্ষা করাটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়৷
-তা নয়৷ তবে অনর্থক। এসব অপেক্ষা থেকে নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমি মনে করি৷
অর্থি হাসলো৷ বলল,
-প্রেম কিংবা অপেক্ষা কখনই ক্যারিয়ারের দিকে তাকায় না৷ যখন তাকাবে তখন মনে করবেন সেখানে প্রেম নেই৷ প্রেম ছিল না।
আমি কিছু সময় অর্থির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা আমার দিকে তাকাচ্ছে না৷ সে সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে৷ তার চেহারায় ভীষণ সিরিয়াসনেস। আমি বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম। অর্থিকে দেখলাম। তার অবাধ্য চুল গুলোকে আকাশের মেঘের মতো উড়তে দেখলাম। চোখ ভরা কাজল নিয়ে সামনের দিকে বেশ কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এক অভিমানী কন্যাকে দেখলাম আমি। আমার কেন জানি মনে হলো আমি এই অর্থিকে চিনি না। সে আমার অজানা৷ তাকে কখনই দেখিনি আমি৷ আজ দেখলাম কেবল। অর্থি মিন মিন করে বলল,
-আপনি অবশ্য এসব বুঝবেন না।
আমি প্রথমে ঠিক বুঝলাম না। বললাম,
-কী বললেন?
-কিছু না৷
-কিছু তো বলেছেন।
-কিছুই বলিনি।
-এই তো বুঝতে পারলাম। কী বুঝব না বলেন তো?
-কিছু না৷
-প্রেম? না এই অপেক্ষা?
অর্থি জবাব দিল না৷ সে চুপচাপ থাকলো৷ আমি বললাম,
-আসলেই আমি এসব বুঝি না৷ এসব বড় জটিল ব্যাপার৷
অর্থি এই কথাটির কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলল,
-শুনলাম আপনার বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ টাগ্রহ নেই৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-ঠিক শুনেছেন।
-কেন জানতে পারি?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
-আবদ্ধ জীবন আমার কাছে ভালো লাগে না অর্থি। বিয়ে মানেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা। নিজেকে এক অজানা সুতোয় বেধে ফেলা। দায়িত্ব কর্তব্যের শেষ নেই। সত্যি বলতে পুরুষের সকল প্রকার স্বাধীনতা বিয়ের পর চলে যায়। তাছাড়া কেউ আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছে এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ না৷ অসহ্য লাগে৷ আমি আমার মতোই। কেউ কেন আমার উপর অধিকার খাটাতে আসবে?
অর্থি হাসলো। কিছু বলল না৷ আমাদের রিক্সাটা থেমে গেল। আমরা নেমে পড়লাম৷ অর্থি ভাড়া মিটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমি ব্যাগটা নিতে পারবো না৷ আপনি কি একটু সাহায্য করবেন?
আমি কিছু না বলে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। তবে অর্থির এভাবে কথাটা বলায় আমার কিছুটা মনক্ষুন্ন হল৷ সে যেন চট করেই কেমন পর পর বিহ্যাভ করছে৷ কেমন অচেনা এক আচরণ। অথচ এই মেয়ে এর আগে কখনই এমন করেনি। কখনই না৷ আমার খারাপ লাগল। কিন্তু খারাপটা কেন লাগল? কেন লাগছে?
আমরা একটা বস্তির দিকে ঢুকে পড়লাম। ঢোকার সময় অর্থিকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ওই লোকটা কে ছিল?
-কে?
-ওই যে, যে ব্যাগটা রেখে গেল। আকাশ নাকি কি একটা নাম!
-অহ আকাশ ভাইয়া! উনি আমার কিছু হন না৷ তেমন চিনিও না। নামটা আকাশ৷ ব্যস৷ এতটুকুই জানি।
-কী বলেন। আর কিছুই জানেন না। তাও তার সাথে এই বস্তিতে আসতেন?
অর্থি হাসলো৷ বলল,
-গল্প আছে একটা৷ আকাশ ভাইয়ের সাথে আমার এই বস্তিতেই দেখা হয়৷ উনি একজন চমৎকার মানুষ। আমার দেখা অসাধারণ মানুষদের মধ্যে একজন!
-আপনি অসাধারণ বলছেন তার মানে নিশ্চয়ই তার মাঝে তেমন কোনো গুণ আছে!
-তা আছে৷ ইনি মানুষকে বেশ ভালো ভাবে কনভিন্স করতে পারেন৷ কথা বলায় পটু৷
-আপনার কি কথা বলায় পটু এমন ছেলে পছন্দ?
অর্থি চট করেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। তারপর বলল,
-নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিবেন।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অবাক স্বরে বললাম,
-মানে?
অর্থি কিছু বলল না। সে হেঁটে চলে যেতে থাকল। আমি বোকার মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই মেয়েটা আমাকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে বলল কেন? আমি দ্রুত হেঁটে গেলাম। তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
-ওই কথাটা কেন বললেন আপনি?
অর্থি হাসলো। বললাম,
-এই যে আপনি হঠাৎ এতো জেরা করছেন৷ তাইই বললাম। বলে আপনাকে থামিয়ে দিলাম।
-জেরা করছি কই? জানতে চাইলাম কেবল।
-জানতে চাওয়া আর জেরা করার মধ্যে তফাত আছে৷
-কী তফাত?
-মানুষ যখন জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে তখন তার চোখে জানার আগ্রহ দেখা যায়৷ আর যখন জেরা করে তখন তার চেহারায় আগ্রহ না অন্য কিছু দেখা যায়৷
-অন্য কিছু কী?
-বললে বিশ্বাস হবে না৷
-না হোক৷ তাও বলুন। কী দেখলেন আমার চোখে৷
-বাদ দিন৷
-মোটেও না৷ বলুন বলছি!
-বলা বলির কিছু নেই৷ আপনি জাস্ট এটা ভাবুন যে আপনি তখন কী বলেছিলেন। আপনার প্রথম প্রশ্নটা জানতে চাওয়া টাইপের ছিল৷ কিন্তু পরের গুলো তা ছিল না৷
আমি আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না৷ দেখলাম অর্থিকে দেখতেই দুইজন মহিলা এগিয়ে এলেন। অর্থির কাছে এসেই একজন বললেন,
-কেমুন আছ গো মা?
আমি বেশ অবাক হলাম। ওই মহিলা দু'জন অর্থিকে দেখে এতো খুশি হলো কেন? এরা কি অর্থির পরিচিত কেউ? খুব কাছের কেউ? কারা এরা? আমরাও বা এসব নিয়ে এখানে কেন এসেছি?
.
(প্রথম পর্ব)
.
গল্পঃ অর্থি।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।