গল্পঃ আমার সুখ পাখি - মিহিন | লেখক - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ আমার সুখ পাখি - মিহিন | লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ আমার সুখ পাখি - মিহিন | লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ আমার সুখ পাখি - মিহিন | লেখক - তাসফি আহমেদ


দরজায় শব্দ হলো। বেশ কয়েকবার শব্দ হতেই আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল৷ আশ্চর্য ব্যাপার! এই সাতসকালে কে এলো আবার? আমার মেজাজটা খানিকটা খারাপই হলো৷ এমনিতেই রাতে ঠিক ভাবে ঘুম হয় না৷ শেষরাতে চোখে ঘুম ধরে। সেই ঘুম বেশ বেলা করে ভাঙ্গে৷ বেলা করে না ভাঙ্গলে সারাটা দিন আমার বড় অস্বস্তিতে কাটে৷ মাথা ভার হয়ে থাকে৷ মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে৷

খিটখিটে মেজাজের কারণে মাঝে মাঝে মিহিনের সাথে আমার বেশ ঝামেলা হয়ে যেতো৷ কারণ ছাড়াই আমি রেগে যেতাম। আমি রাগতে না চাইলেও রেগে যেতাম৷ মিহিন বেচারি কিছু বলতে পারতো না৷ কেবল চুপচাপ সহ্য করে যেতো৷ অবশ্য সে জানে, আমার রাগ থামলে আমি কানে ধরে ক্ষমা চাইতেও লজ্জাবোধ করি না৷
ইদানীং আমার মনে হয় লজ্জাবোধটা একদমই কমে গেছে৷ বাড়িওয়ালার দু'মাসের ভাড়া আমি দেইনি৷ আমার দিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল৷ অথচ আমি ইচ্ছে করেই দেইনি৷ সে টাকা আমি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আম্মা জানি টাকা গুলো দিয়ে কী করেছেন! এই মানুষটা বাড়তি টাকা রাখতে জানে না৷ খরচ করে ফেলে৷ অবশ্য আমি খরচ করার জন্যেই দিয়েছি৷ তিনি যা ইচ্ছে করুক৷ এতে উনি আনন্দ পেলেই হয়! উনার আনন্দটাই মূখ্য৷
দরজায় আবার শব্দ হলো৷ তবে কেউ কিছু বলল না৷ "কেউ আছেন?" এমন কিছু তো বলার কথা৷ অথচ আমি তেমন কিছুই শুনলাম না৷ আমার মনে হলো বাড়িওয়ালা এসেছে৷ একমাত্র তারই আসার কথা৷ সে ছাড়া আমাকে খোঁজ করার মতো তেমন কেউ আর অবশিষ্ট নেই এই শহরে। বাড়িওয়ালা লোকটাও কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। আগে আমাকে দেখলে হাসতো৷ মিষ্টি কথা বলতো৷ ইদানীং তিনি আমাকে দেখলেই বেশ গম্ভীর হয়ে যান৷ চেহারাটা কালো করে ফেলেন। খুব একটা কথাও বলেন না৷ টুকটাক ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে যা বলেন। তখন তার চেহারা বড়ই শক্ত দেখায়৷ আসলে আমি কখনই ভাড়া নিয়ে এমন বিলম্ব করিনি৷ তাই তিনি কঠিন ভাবে কিছুই বলতেও পারছেন না৷ তা না হলে এতোদিনে যে তিনি অনেক গুলো কঠিন কথা শুনিয়ে দিতেন এটা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।
আমি শুয়ে থেকে বললাম,
-কে ওখানে?
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না৷ কেবল দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ ছাড়া৷ আমি আবার বললাম,
-কে?
এবার ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর শব্দ ভেসে এলো,
-দরজা খুলুন।
আমার ভ্রু কুচকে এলো৷ কণ্ঠটা বাড়িওয়ালার না৷ অন্য কারো৷ এই অন্য কারো কণ্ঠটা আমার বেশ পরিচিত। অথচ আমি চিনতে পারছি না এই কণ্ঠের মালিক কে? আমি উঠে গেলাম৷ দরজা খুলতেই দেখলাম স্যুট-কোট পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে৷ তার চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি। আমি অবাক হলাম। এই চেহারাটা আমার পরিচিত লাগছে৷ অথচ কোথায় দেখছি মনে করতে পারছি না৷ কে সে তাও বুঝতে পারছি না। আমি বললাম,
-কাকে চাই?
ছেলেটা বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,
-স্যার আপনাকে ডেকেছেন৷
আমি আরেকটু অবাক হলাম। বললাম,
-কোন স্যার?
ছেলেটা কিছু বলল না৷ কেবল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমিও তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। এই তাকিয়ে থাকার মধ্যেই আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল৷ আমি এই মানুষটাকে চিনে ফেললাম। কোন স্যার ডেকেছে তাও চট করে বুঝে গেলাম। লজ্জাময় হাসি দিয়ে বললাম,
-অহ! শফিক ভাই! খবর কী?
শফিক ভাই হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন,
-চিনতে পারলেন তবে!
আমি হাসলাম। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
-আমার চেনা আর না চেনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ না৷ ভেতরে আসুন৷ কেমন আছেন?
শফিক ভাই ভেতরে এলেন৷ আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন,
-স্যার আপনাকে ডেকেছেন৷ যতো দ্রুত সম্ভব আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-কেন?
-জানি না৷ সকাল সকাল আমাকে ফোন দিয়ে বললেন আমি যেন অফিস যাবার আগে আপনার এখানে আসি৷ এরপর আপনাকে নিয়ে তাদের বাসায় চলে যাই৷
আমি ভিতুস্বরে বললাম,
-আমার খবর আছে মনে হয়। নাকি?
-হতে পারে৷ আপনি যে কাজটা করলেন!
-কিন্তু খবর এতোদিন পরে কেন করতে হবে? এটা তো সঙ্গে সঙ্গে করার কথা৷ নাকি তখন উনার ইগো হার্ট হয়নি৷ এ ক'দিন ভেবে ভেবে হার্ট হয়েছে!
-কে জানে! বড়লোকদের বোঝা মুশকিল! আমি শুনেছি ড্রাইভারকে কয়েকবার পাঠানো হয়েছে আপনার খোঁজে৷ আপনাকে পাওয়া যায়নি৷
আমি অবাক হলাম। বললাম,
-কী বলেন? আমাকে পাওয়া যাবে না কেন?
-আপনি নাকি বাসায় ছিলেন না।
-তাও হতে পারে। আমি ভাই গরীব মানুষ। এদিক সেদিক যেতে হয়৷ তা না হলে পেটে ভাত জোটে না৷
শফিক ভাই হাসলেন। বললেন,
-জলদি করে রেডি হোন৷
-দেরি হবে খানিক। আপনি চলে যান৷ আমি আস্তেধীরে উনাদের বাসায় চলে যাবো৷
শফিক ভাই চোখ বড় করে খানিকটা জোরালো স্বরে বললেন,
-আপনি কি আমার চাকরি খেতে চান নাকি?
-না তো৷ চাকরি খাওয়া যায় নাকি?
-মজা করবেন না ভাই৷ আপনাকে সঙ্গে করে না নিয়ে গেলে স্যার রেগে যাবেন৷
-রাগলে রাগবে৷ তাতে আমার কী?
-আপনার তো কিছু হবে না ভাই৷ আমার চাকরিটাই চলে যাবে কেবল৷
-তার মানে আমার যাওয়া না যাওয়ার সাথে আপনার চাকরি থাকা না থাকা সম্পর্কিত?
-অনেকটা তেমনই৷ আপনি তো জানেনই উনার রাগ সম্পর্কে।
-তাহলে আমি আজ সেখানে যাবোই না৷
শফিক ম্যানেজারের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন৷ তিনি মুখ কালো করে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার চেহারায় কষ্টভাব৷ সে যেন কান্না করে দিবে৷ আমি বেশ মজা পেলাম৷ নিজেকে বেশ ক্ষমতাবান মনে হলো৷ যাক, আমারও খানিকটা দাম আছে এই পৃথিবীতে। শফিক ভাই ভিতু ভিতু গলায় বললেন,
-কেন ভাই? আপনি কি চান না আমার চাকরিটা থাকুক?
-মোটেও না।
-কেন?
-এই কেন'র উত্তরটা আপনি ভেবে বের করুন৷ বের করতে পারলে আপনার সাথে যাবো৷ না হলে না।
কথাটা বলে আমি ওয়াশ রুমে চলে এলাম। শফিক ভাই কিছু বলতে পারলেন না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন কেবল।
ওয়াশরুমে এসে আমার চিন্তাজগত গভীর হয়ে এলো। আমি আসলেই খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ আমার ধারণা অনুযায়ী মিনহাজ আবেদিন আমাকে ডাকার মতো লোক না৷ আমি যা বলে এসেছি তারপরও তিনি আমাকে ডাকবেন এটা অনেকটা স্বপ্নের মতো৷ তবে ডাকতে পারেন৷ একান্ত কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে পারেন তিনি৷ এই কাজটাই এই ভদ্রলোক খুব পারেন৷ তার জন্যে তিনি কখনই আমাকে তার বাসায় ডাকবেন না৷ অফিসে ডেকেই কেস ক্লোজ করে দিতেন৷
কিন্তু তিনি তা করলেন না৷ আমাকে বাসায় ডাকলেন৷ তাও আবার অফিসের ম্যানেজারকে বাসায় পাঠিয়ে নিয়ে যেতে বললেন৷ ড্রাইভারকে দিয়েও বেশ ক'বার খোঁজ নিলেন৷ ঘটনা কী? এতো জরুরি তলব কেন? আমাকে বেশ ভালোই চিন্তায় পড়তে হলো। আমার খানিকটা অস্থিরও লাগলো। আমার মনে হলো আমার পক্ষে ওই বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না৷ আমি সব কিছুই সহ্য করতে পারি৷ পারবো৷ তবে মিহিনকে ওখানে তার স্বামীর পাশে দেখব এমনটা আমি সহ্য করতে পারবো না৷ এটা আমার সহ্যসীমার বাহিরে। মিহিন ওই বাড়িতে থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তার স্বামী থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। যদি থেকে গেল? মিহিনের স্বামী না থাক। মিহিন থাকল? তখন? আমি কীভাবে এই মেয়ের মুখোমুখি হবো? কীভাবে? এই মূহুর্তে মিহিনকে ফেস করার ক্ষমতা আমার নেই৷ আমি এমনিতেই অনেক দূর্বল হয়ে পড়ছি৷ আমি পারব না তাকে সহ্য করতে৷
মিনহাজ সাহেব আমাকে মানসিক শাস্তি দেওয়ার জন্যে ডাকছেন না তো? হতে পারে আমি গেলে আমার সামনে মিহিন এবং তার স্বামীকে এনে দাঁড় করিয়ে বলবে, 'লুক, দে আর মেড ফর ইচ আদার কাপল।' 'মিহিনকে দেখতে পাচ্ছো তো? দেখো সে কতোটা হ্যাপি?' কিংবা মিহিনের স্বামীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলবেন, 'এই হলো সেই ছেলে যে কেবল বড় বড় কথাই বলতে পারে৷ কাজের কাজ কিছুই না৷' 'এই ছেলেই ক'দিন আমার মেয়েকে একদম পাগল করে দিয়েছিল।' এও হতে পারে যে তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলবেন, 'ছেলেটাকে দেখো৷ তোমার চেয়ে হ্যান্ডসাম। গুড লুকিং। তার অর্থ সম্পদের কমতি নেই। তার সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করো৷ দেখবে তুমি কিছুই না তার কাছে৷' 'লেবেল বোঝো? লেবেল? প্রেম করলে নিজের লেবেলের কারো সাথে করিও। যার সাথে তোমার সাথে সব কিছু ম্যাচ হবে।'
-ভাই? জলদি বের হোন৷ অনেক সময় হলো তো?
আমি ভেতর থেকে বললাম,
-উত্তরটা পেয়েছেন?
ওপাশ থেকে জবাব এলো না৷ আমি বললাম,
-আপনি বরং বাসায় চলে যান৷ নিউ সিভি রেডি করুন৷ আবার চাকরি যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হোন৷
এবারও ওপাশ থেকে জবাব এলো না৷ আমি মনে মনে হাসলাম। আবার চিন্তায় মগ্ন হলাম৷ এবারের চিন্তাটা একটু গভীর৷ ব্যাথাময়৷
মিহিন মেয়েটাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি৷ আসলে মেয়েটাই এমন৷ ভালোবেসে পারা যায় না৷ আমিও পারিনি৷ কীভাবে জানি মায়া করে ফেললো। এই অগোছালো আমিকে গুছিয়ে নিলো। সে নিজের এমন একটা পজিশান ক্রিয়েট করল যে মনে হতো তাকে ছাড়া আমার যেন আর কিছুই চাই না৷ আমার কেবল এই মেয়েটাকেই চাই৷ কেবল এই মেয়েই৷ এমন হলো যে তাকে একদিন না দেখলে আমার ভেতরে হাসফাস শুরু হয়ে যায়৷ দমবন্ধ লাগে। সে একবার টানা পনেরো দিন তার গ্রামের বাড়িতে ছিল৷ এই পনেরো দিনে আমার অবস্থা প্রায়ই শেষ৷ কী যে অস্থির লাগছিল! একবার তো ইচ্ছে হয়েছিল ওর গ্রামেই চলে যাই৷ এভাবে আর কতোক্ষন! যাইনি৷ তাকে কিছু বলিওনি৷ নিজের অস্থিরতা কে নিজের মাঝে রাখলাম। কেন জানি তখন মনে হতো এই অস্থিরতা প্রকাশ করার দরকার নেই৷ গোপন থাকুক৷ আমার সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ুক। সে এলে না হয় একসাথে তাকে অনেকক্ষণ দেখবো৷ পুরোটা দিন দেখে নিবো! আমি যতো কিছুই গোপন রাখতাম এই মেয়েটা কীভাবে জানি সেসব বুঝে যেতো৷ সে ঠিকই বুঝতো আমি তাকে দেখার জন্যে অস্থির৷ কিন্তু আমি সেই অস্থিরতা প্রকাশ করতে চাইছি না। গোপন রাখছি৷ মেয়েটা কীভাবে যেন বুঝত৷ বুঝে গিয়ে আমাকে ভিডিও কল দিতো৷ কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার, সেই কলে তাকে স্পষ্ট দেখতাম না৷ তার দুটো কথাও ঠিক মতো শোনা যেত না৷ সেই গ্রামে নেটওয়ার্কের বড় ঝামেলা!
আমি তাকে না দেখে থাকলাম৷ আমার অল্প অল্প সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ল৷ সেই ক্ষমতা বলেই আমি পাগলিটাকে এতোদিন না দেখে আছি৷ মাঝে মাঝে আর পারি না৷ বড় অসহ্য লাগে৷ মনে হয় যে অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো৷ সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেলে আমি মেয়েটার ছবি দেখতাম। আমার ফোনের পুরো গ্যালারি জুড়ে এই মেয়েটার ছবি৷ আমি সেগুলো দেখতাম৷ আমার হাসফাস লাগা কমে আসতো৷ মনে হতো শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক ভাবে চলছে৷ প্রশান্তি লাগছে এখন৷ ফিলিং গুড!
মিহিনের বাবা শহরের একজন নামকরা ব্যাবসায়ী। প্রথম সারির একজন। স্বভাবতই তিনি আমার ব্যাপারে জানার পর বেশ রাগ করলেন৷ শুধু রাগ করেই যে চুপ থাকলেন তা কিন্তু না৷ আমাকে নানান উপায়ে থ্রেট দিলেন৷ ভার্সিটির ভিসির দ্বারা, আমার অফিসের বসের মাধ্যমে, পুলিশ দিয়ে কিংবা লোক পাঠিয়ে ভদ্রলোক আমার দূর করতে চাইলেন৷ এবং সত্যি বলতে আমি দূর হয়েও গিয়েছিলাম৷ আমার মনে হলো এখানে থেকে আমি সেল্ফ রেসপেক্ট হারাচ্ছি৷ এখানে আমার কোনো সম্মান নেই৷ দাম নেই৷ এসব আমার অসহ্য লাগতো৷ মিহিনকে এসব ব্যাপারে বললে তার কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেতো৷ আমি প্রথম প্রথম তার কান্নার কারণেই চুপ করে থাকতাম। কিছু বলতাম না৷ কিন্তু পরবর্তীতে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মিহিনের সাথে ব্রেকআপ করে ফেললাম। এখানে কিছুই সম্ভব না৷ কিছুই না৷ অযথাই আমি আমার মানসম্মান হারাচ্ছি৷ যেখানে নিজের মান সম্মান হারাতে হয়, যেখানে নিজের কোনো অযুতই থাকে না সেখানে এমন হাজারও প্রেম বিসর্জন দেওয়া যায়৷ আমিও দিয়ে দিলাম। তাও অন্তত এই পৃথিবীতে যতোদিন বাঁচবো মাথা তুলেই বাঁচবো।
মিহিনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেল। তার বড়লোক বাবা যারপরনাই খুশি৷ এখন তিনি টাকাওয়ালা পাত্র খুঁজবেন৷ পেলেই মিহিনের বিয়ে হয়ে যাবে৷ আমি তখন মনে মনে মিহিনের উপর খুব রেগে ছিলাম। সে কেন এলো আমার জীবনে? কেন আমাকে এমন মায়ায় ফেললো যে মায়াটা কাটানো সম্ভব না? কেন আমাকে এতো ঘোরে ফেললো আমি তাকে ছাড়া কিছুই বুঝি না৷ তাকেই আমার প্রয়োজন৷ কেন এমন করলো ও?
সে আসতো, তবে এই অহংকারী পিতার মেয়ে হয়ে নয়৷ একজন নিরহংকারী পিতার মেয়ে হয়েও আসতে পারতো৷ যে পিতা তার মেয়ের পছন্দকে মূল্যায়ন করবে৷ অন্তত এভাবে ফেলনার মতো ফেলে দিবে না৷ লোক পাঠিয়ে অপমান করবে না৷
একা একা বড় বিতৃষ্ণায় দিন কাটছিল আমার৷ রুম বন্ধ করে দিনরাত একা একা পড়ে থেকেছি৷ পুরুষের কাঁদতে হয় না জেনেও ভুল করে কেঁদে ফেলেছি৷ ঠোঁট চেপে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছে৷ আমাকে সেই কাঁদতেই হয়েছে৷ কিছু ব্যাথা মানুষকে কাঁদিয়ে ছাড়ে৷ কাঁদতে বাধ্য করে৷ মিহিনের বিচ্ছেদ আমার তেমনই একটা ব্যাথা ছিল। একটি অপ্রকাশিত ব্যাথা যার বিশাল ক্ষতের কোনো চিহ্ন নেই। তবু বুকের অল্প কিছু জায়গা জুড়ে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব হয়। অসহ্যকর একটা ব্যাথা যা চোখে জল এনে দেয়। কাঁদিয়ে ছাড়ে।
প্রথম ক'বার কেঁদে খানিকটা মজা পেয়ে গেলাম আমি। বেশ ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমার কষ্ট কিছুটা কমে আসছে৷ বুকের ভেতরটা হালকা হচ্ছে৷ তখনই মিহিন এসে উপস্থিত হতো। উপস্থিত বলতে ফোন দিতো৷ অন্য নাম্বার থেকে৷ আমি চিনতাম না৷ ভুল করে রিসিভ করে ফেলতাম,
-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ আসতো। কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
-এই? এমন করছো কেন?
আমি চুপ থাকতাম। সে আবার বলতো,
-এভাবে আমাকে পর করে দিয়ে তুমি কি সুখে আছো বলো? তোমারও তো কষ্ট হয়৷ হয় না?
আমি খুব কষ্টে বলতাম,
-না৷ আমার এতো কষ্ট টষ্ট হয় না৷
ওপাশের কান্নার আওয়াজ বেড়ে যেতো৷ বলতো,
-আমার তো কষ্ট হয়৷ আমার ভীষণ কষ্ট হয় তাসফি৷ তুমি আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে৷ তোমার কাছে নিয়ে যাও৷ প্লীজ৷ আই বেগ ইউ!
আমি ফোন কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দিতাম। মেয়েটা আর কল করতে পারতো না৷ ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দেওয়ার পর মনে হতো কাজটা আমি ঠিক করিনি৷ একদমই ঠিক করিনি৷ ব্ল্যাকলিস্টে না ফেললেও চলতো৷ এভাবেই থাকতো৷ ফোন দিলে আমি কষ্ট করে কেটে দিতাম৷ মেয়েটা না হয় একটু বেশিই ফোন দিয়ে ফেলতো৷ আমি না হয় কিছুক্ষণ ফোনটা বন্ধ করে রাখতাম৷ কিংবা সে ফোন দিলে ফোন তুলতাম না৷ রিং হওয়ার শব্দটা শুনতাম। এই শব্দটা শুনতেও তো দারুণ লাগতো৷ মনে মনে ভাবতাম মেয়েটা অন্তত ফোন দিচ্ছে তো! সে তো এখনও আমার আছে! আমাকে মনে রেখেছে!
-ভাই, বের হোন। আমি উত্তরটা পেয়েছি।
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। বললাম,
-আসলেই পেয়েছেন?
-জি।
-সত্যি?
-হু।
-মিথ্যা হলে কিন্তু খবর আছে৷ পরে হাতে পায়ে ধরলেও আমি যাবো না৷
শফিক সাহেব চুপ হয়ে গেলেন৷ কিছু বললেন না৷ আমি হাসলাম খানিক৷ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম অল্প কিছুক্ষণ পরেই৷ দেখলাম শফিক সাহেব বিছানার কাছে বসে আছেন৷ খুব মনযোগ দিয়ে কী যেন ভাবছেন। যাক, এই লোককে খানিকটা টেনশনে রাখা গেল। তা না হলে এতোক্ষণে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে মাথা খেয়ে নিতো৷ আমি বললাম,
-কী ভাই? কিছু পেলেন?
শফিক ভাই বেশ চিন্তিত চেহারা নিয়ে তাকালেন আমার দিকে৷ কিছু বললেন না। আমিও কিছু বললাম না আর। প্যান্ট শার্ট পরে তৈরী হয়ে নিলাম। বললাম,
-নাস্তাটা বাহিরেই করি৷ কী বলেন?
আমাকে প্রস্তুত দেখেই শফিক সাহেব হেসে ফেললেন। তার চেহারার একদল চিন্তাভাব মূহুর্তে যেন বিদায় হয়ে গেল৷ তিনি কাছে এসে বললেন,
-আপনি আমাকে ওই প্রশ্নটা অযথাই দিয়েছেন তাই না? আপনি এমনিতেই যেতেন৷ যেতেন না?
আমি হাসলাম। বললাম,
-এই অবান্তর প্রশ্নটা করে আপনাকে খানিকটা সময় অন্য চিন্তায় ডুবিয়ে রাখলাম আরকি। এছাড়া আর কিছু না৷
-এমনটা কেন করলেন?
-কারণ এমনটা না করলে আপনি আমাকে যাওয়ার জন্যে তাড়া দিয়ে দিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলতেন৷ তাই৷
শফিক সাহেব এক গাল হাসলেন৷ বললেন,
-আপনি ভাই অনেক চালাক আছেন!
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷
.
মিহিনদের বাসার গেটের কাছে যখন আমাদের গাড়ি চলে এলো তখনই আমি ভেতরে ভেতরে খানিকটা নার্ভাস ফিল করলাম। আমার ধিরে ধিরে বুকের ভেতরটা কাঁপা শুরু করছিল৷ আমার সত্যিই খানিকটা ভয় ভয় লাগছিল৷ ওইদিন যে আচরণটা করলাম, তারপর যে আবার মিহিনের বাবার মুখোমুখি হবো ভাবিনি৷ ভাবলে সেদিন মোটেও এতো লাগাম ছাড়া কথা বলতাম না৷ আমি তো ভেবেছি এটাই আমাদের শেষ আলাপ৷ আর হবে না৷ তাইই মুখের উপর সব বলে চলে এলাম। কিন্তু কে জানত উনি যে আবার আমাকে ডেকে পাঠাবেন!
মিহিনদের বাসাটা এক কথায় অসাধারণ। ওর বাবা যাই করুক, বাড়িটা বানাতে কোনো কিছুতে কমতি করেননি৷ সামনের বাগানটাও চমৎকার। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে৷ ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় না যে তিনি এতোটা সৌখিন৷ আমি গাড়ি থেকে নামলাম। নামতেই দেখলাম বাগানের ওদিক থেকে মিনহাজ সাহেব আসছেন৷ আমার বুকের ভেতর ধপ করে উঠল যেন৷ আমি কোনো মতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উনি কাছে আসতেই সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন না৷ শফিক ভাইকে বললেন,
-বাগানে নিয়ে যাও ওকে৷
আমি ঢোক গিললাম। আশ্চর্য ব্যাপার। বাগানে কেন নিয়ে যাবে? এটা আবার কেমন কথা? বাগানে নিয়ে উদাম কেলাবে না তো? আমি কোনো মতে শফিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ বললেন,
-চলুন ভাই৷
ততোক্ষণে মিহিনের বাবা চলে গিয়েছেন৷ আমি বললাম,
-কোথায় ভাই?
-এই তো সামনে।
শফিক ভাই হাঁটা শুরু করলেন৷ আমি উনাকে অনুসরণ করে চলতে শুরু করলাম। আল্লাহ জানে আজ কপালে কী আছে! কিছু পথ হাঁটার পরই দেখলাম উঠোনের মতো কিছু অংশ৷ ঘাঁষের চাদরের উপর একটা টেবিল এবং চারপাশে বেশ কিছু চেয়ার রাখা৷ শফিক ভাই আমাকে সেখানে বসতে বললেন৷ বললেন,
-বসুন৷ স্যার চলে আসবেন একটু পরই।
আমি চেয়ারে বসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক! আমাকে এখানে বসার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে তাহলে। আমি আরাম করে বসলাম। তবে ভেতরের ভয়টা রয়েই গেল। চাপা একটা ভয়! মিহিনের বাবা জানি আজ কী বলে!
মিহিনের বাবার সাথে আসলে মোটামুটি আমার বেশ ভালোই একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল তখন৷ মিহিনের সাথে ব্রেকাপের পরও তিনি মনে করতেন আমি কোনো ভাবে ওর সাথে যোগাযোগ রাখছি৷ ওকে পাগলের মতো করে তুলছি৷ একদিন লোক পাঠিয়ে আমাকে তুলেও নিয়ে গেলেন তার অফিসে৷ গোপন রুমে বসিয়ে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসা করলেন৷ সেবার আমার মনে হয়নি আমি তাকে খুশি করতে পেরেছি৷ তার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরই আমি সঠিক দিয়েছি। কিন্তু সেগুলো ভদ্রলোকের পছন্দ হয়নি৷ তিনি নিজের বিশ্বাসের উপরই অটল থাকলেন; আমি কোনো না কোনো ভাবে তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখছিই৷ উনার জিজ্ঞাসা শেষে আমি কেবল একটা কথাই বলেছিলাম,
"আপনাকে আমি জ্ঞানী ভেবেছি৷ এতো বড় বিজনেস দাঁড় করানো আসলে চাট্টিখানি কথা না৷ আপনি যেহেতু সেটা করতে পেরেছেন সেহেতু আপনার মাঝে আসলেই কিছু একটা আছে৷ কিন্তু আজ কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি ওই পর্যায়েরই লোক না৷ আপনার মাথায় নূন্যতম জ্ঞানটুকু নেই৷ থাকলে এভাবে আমাকে তুলে নিয়ে আসতেন না৷ আপনার মেয়ের সাথে আমি নিজ থেকেই ব্রেকাপ করেছি৷ ব্রেকাপের পর সে মোট পাঁঁচবার আমাকে কল দিয়েছিল। তার পাঁচটা নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে রাখা৷ দেখুন।" এটা বলে আমি তাকে ফোনের নাম্বার গুলো দেখালাম। বললাম,
"আপনি নিজের মেয়েকে বাসায় আঁটকে রেখেছেন৷ তার কাছে পৌঁছাবার কোনো পথ নেই৷ তারপরও আপনার কীভাবে মনে হয় আমি আপনার মেয়েকে উন্মাদ করে তুলছি?"
সেদিনের কথা গুলো ভদ্রলোকের মাঝে প্রভাব ফেলছিল কি না জানি না, তবে কথা গুলো বলে কেমন জানি প্রশান্তি লাগছিল৷ বেশ আনন্দ অনুভব করছিলাম। আরো কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বলিনি৷ বলার প্রয়োজনবোধ করিনি৷
এর ঠিক অল্প ক'দিন পরেই আমাকে আবার ডাকা হয়৷ এবার তুলে নিয়ে যায়নি অবশ্য৷ অফিসের গাড়ি পাঠিয়েছে৷ আমি খানিকটা অবাকই হলাম। এমন ডাকের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না আসলে। সেই সকালে মিহিনেরও ফোন আসে৷ ফোন দিয়ে বলল দ্রুত তার বাবার সাথে দেখা করতে৷ দেখা করেই যেন তাদের বাসার কাছে চলে যাই৷ সে আমার অপেক্ষায় থাকবে। আমার মনটা খানিকটা ভালোই হয়ে গেল৷ আমার মনে হলো যাক, এবার ভালো কিছু ঘটছে। সব কিছু আশা করি সমাধান হয়ে যাবে৷ কিন্তু আমাকে যে আবারো সেই অন্ধকারে পড়ে থাকতে হবে তা আমার জানা ছিল না৷
আমি বুক ভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে উনার অফিসে গেলাম। শফিক ভাই উনার কেবিন পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। উনি আমার দিকে না তাকিয়েই চেয়ারে বসতে বললেন,
-বসো৷
আমি বসলাম। উনি উনার সামনের ফাইলটা ক্লোজ করে এক পাশে রাখলেন৷ এরপর চেয়ারে হেলান দিলেন৷ বিশাল একটা হাই তুললেন৷ চোখের গ্লাসটা ডেক্সের উপর রেখে চোখ কচলে নিলেন। বললেন,
-ব্ল্যাক ম্যাজিক জানো?
আমি কিছুটা অবাকই হলাম। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবো ভাবিনি৷ বললাম,
-জি না৷
-সত্যি করে বলো৷ সত্যি কিংবা মিথ্যা যা-ই বলো মিহিনের সাথে তোমার বিয়ে হবেই৷ কারণ আমি বাধ্য৷ উপায়হীন।
আমার ভ্রু কুচকে এলো৷ বললাম,
-বুঝিনি৷
-প্লীজ ডোন্ট এক্ট। ইউ নো এভ্রিথিং।
-আ'ম নট এক্টিং!
-ইয়েস! ইউ আর!
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,
-আমাকে কেন ডেকেছেন?
-ডাকার কারণ অনেক গুলোই৷ তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব চাই৷ তুমি আমার মেয়েকে কী করেছো? কেমন জাদু করেছো যে সে তোমার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে৷ তোমার জন্যে সে কিছু খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না, এমনকি আমাদের কারো সাথেই কথা বলছে না! মেয়েটা এতোটাই দূর্বল হয়ে পড়লো যে কাল মাথা ঘুরেই পড়ে গেল! কী করেছো বলো তো?
আমি হাসলাম। বললাম,
-জাদু করেছি।
ভদ্রলোক চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন৷ আমি আবারও হাসলাম৷ বললাম,
-এই জাদুটা আপনার মেয়ের থেকেই শিখেছি৷ ভালোবেসে মোহে ফেলে দেয়া৷ সে যেমন আমাকে ফেলল আমিও তাকে ফেলে দিলাম৷
-প্লীজ! এমন ষ্টুপিড কথাবার্তা অন্তত আমার সামনে বলো না৷ আমি এসব বিশ্বাস করছি না৷
আমি হাসি মুখে বললাম,
-মিহিন বলল তার বাবা মা প্রেম করে বিয়ে করেছেন। কথাটা কী সত্য? বিশ্বাস হচ্ছে না৷
উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন৷ আমি আবারও বললাম,
-আপনারা কি আসলেই প্রেম করে বিয়ে করেছেন?
উনি বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
-আমি এখানে তোমাকে ডেকেছি তোমার আর মিহিনের ব্যাপারে কথা বলতে৷ আমাদের ব্যাপারে নয়৷
-এড়িয়ে যাচ্ছেন।
-মোটেও না। আমি তোমার মতো ছেলের সাথে আমার পারসোনাল ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই না৷
আমি চট করেই চুপ হয়ে গেলাম। আমার মেজাজটা একটু খারাপই হলো৷ আমার মতো ছেলে মানে? আমি কেমন ছেলে? কী বলতে চান তিনি? আমি মাথা নিচু করে বললাম,
-আমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে? আশপাশের কথা বাদ দিয়ে মূল কথায় আসুন।
মিনহাজ সাহেব অনেকক্ষণ কিছু বললেন না৷ চুপ করে থাকলেন৷ আমার মেজাজ তখন অল্প অল্প করে গরম হচ্ছিল। এই লোক আমাকে ভাবেটা কী? আমাকে "তোমার মতো ছেলের..." কথাটা বলার সাহস পায় কী করে? উনি বেশ কিছু সময় পর চোখমুখ কালো করে বললেন,
-তোমার বাসায় কে কে আছে?
-মা আর ছোট বোন আছেন।
-আর?
-আর কেউ নেই।
-বাবা?
-নেই।
-তোমার মা এখন কোথায়?
-গ্রামে।
-গ্রামে?
'গ্রামে' বলেই উনি আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি মারাত্মক কোনো কথা বলে ফেললাম। যেন আমার কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি৷ কঠিন অন্যায় হয়েছে৷ তিনি এবার খানিকটা জোরালো স্বরে বললেন,
-তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে গ্রামে থাকবে নাকি?
-জি৷
-অসম্ভব৷ মিহিনকে কী ভাবো তুমি? যেই মেয়ে কিচেন...
-থামেন থামেন থামেন। এগুলো অনেক আগের ডায়লগ৷ পুরাতন বাংলা মুভিতে দেখতাম৷ শুনে শুনে কান পেঁকে গিয়েছে৷ বাদ দিন সেসব৷ আমাকে এখানে ডাকার কারণ কী? মিহিনের সাথে বিয়ের কথাবার্তা বলা এই তো?
উনি কিছু বললেন না৷ চুপ করে থাকলেন। চেহারা অসম্ভব গম্ভীর। যেন তার এই কথাটা স্বীকার করতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বললাম,
-একটা প্রশ্নের জবাব দিন।
তিনি এবারেও কিছু বললেন না৷ আমি আবারও বললাম,
-আমাকে আপনার কেমন ছেলে মনে হয়৷ আমার ব্যাপারে আপনার অভিমতটুকু জানতে চাই৷ আচ্ছা অভিমতের ব্যাপারটা বাদ দিন৷ আমি জানি আপনার অভিমত কী হবে৷ অযথা আমার মেজাজটা খারাপ হবে৷ আপনি জাস্ট এটা বলুন যে আপনি আমাকে পছন্দ করেন কি করেন না? হ্যাঁ বা না বলবেন।
তিনি বেশ দ্রুতই বললেন,
-না৷ অবশ্যই তোমাকে আমার পছন্দ না।
-তাহলে আমার সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন কেন?
-আমি চাচ্ছি কই? আমার মেয়ের উন্মাদনা দেখেই তো আমাকে এই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে।
-সে কী বেশি পাগলামো করছে?
-তুমি জানো না বোধহয়?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,
-আমার জানার উপায় কী বলুন তো? আমি তো জ্যোতিষ না যে গায়েবি জানব৷
এবার যেন খানিকটা চিন্তায় পড়লেন ভদ্রলোক। তিনি চুপ করে থাকলেন৷ আমি আবারও বললাম,
-আচ্ছা বাদ দিন সেসব৷ মূল কথায় আসুন৷ আপনি বলেছেন আপনার মেয়ের জন্যেই আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ আপনি মোটেও আমাদের বিয়েতে রাজি নন। তাই না?
-হু।
-আপনার ধারণা কী? আমি কি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো?
-করবে না কেন? অবশ্যই করবে৷ তুমি তো এটাই চাও।
আমি হাসলাম। বেশ কিছু সময় হাসলাম। বললাম,
-স্যার, আপনার মেয়েকে যদি এভাবেই আমার বিয়ে করতে হতো তবে সেই কবেই বিয়ে করে ফেলতাম!
মিনহাজ সাহেবের ভ্রু কুচকে এলো৷ তিনি বললেন,
-মানে?
-মানে আমি চাইলেই আপনার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতে পারতাম৷ কেবল আমি চাইনি বলেই সে আপনার বাসায় পড়ে আছে। আচ্ছা, আপনি মনে মনে এটা ধারণা করেন না যে আমি আপনার ধনসম্পত্তি দেখেই আপনার মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছি! এমনটাই তো ভাবেন নাকি?
-অবশ্যই।
-আপনার আমাকে রাস্তার ছেলে মনে হয় না?
-হয়৷
-নিচু প্রকৃতির মনে হয় না?
-হয়৷
-দরিদ্র, নিচু স্বভাব, ছোট চিন্তাভাবনা কিংবা আপনি আমাকে সব সময়ই ছোট করে দেখেন৷ দেখেন না?
-দেখি৷
-বিয়ের পরও আমাকে নিয়ে এই চিন্তাভাবনা গুলোই আপনার মাথায় থাকবে৷ থাকবে না?
-থাকবে।
-তখন আমাকে নিয়ে আপনার মনে আরো কুৎসিত ধারণা জাগতে পারে। এখন যেমন খারাপ ভাবছেন তখন দেখা গেল আরো কয়েকগুণ বেশি ভাবছেন৷ এমনটা তো হতেই পারে। কী বলেন?
-পসিবল।
-তবে আপনার মন থেকে আমার এই ধারণা গুলো দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কম না?
-কম না। কখনো কমবে না৷ নিশ্চিত থাকো।
-আপনি অত্যন্ত রাগী এবং অহংকারী। প্রচুর ইগো আপনার৷ এই কথা কী আপনি বিশ্বাস করেন?
তিনি এবার ভ্রু কুচকে তাকালেন। খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন৷ আমি আবার বললাম,
-মিহিনের সাথে বিয়ের পর যে আপনি এই ইস্যু গুলো নিয়ে ঝামেলা করবেন না এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না৷ আপনি ঝামেলা করবেনই। নানান ভাবে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করবেন। অপমান করবেন। কোথাও গেলে নিজের মেয়ের জামাই বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবেন না। আমাকে এড়িয়ে চলবেন। ছোট করে দেখবেন৷ আপনার কী মনে হয়? এই হেয়ভাব কিংবা আমাকে ছোট করার ব্যাপারটা আমি তখন সয়ে নিতে পারবো?
উনি চুপ থাকলেন। আমি বলে গেলাম,
-আপনি জানেন না৷ আপনার যা ইগো তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি ইগো আমার আছে৷ এই যে আপনার সাথে কথা বলছি না, দায়ে পড়ে বলছি৷ মন থেকে একটা কথাও বলছি না৷ আরে আপনার এই জঘন্য চেহারা দেখার ইচ্ছেও তো আমার নেই।
উনার চেহারা শক্ত হয়ে এলো৷ মুখ লাল হয়ে গেল চট করেই৷ আমি থামলাম না৷ এই সময়ে থেমে যাওয়া মানেই বিপরীত পক্ষকে কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়া। বললাম,
-আমি এখন আপনার এসব ব্যাপার মেনে নিতে পারছি না, বিয়ের পর কীভাবে মেনে নিবো বলেন তো? এটা আপনি ভাবেন কী করে? আত্মসম্মানবোধ কি কেবল আপনারই আছে? আমার নেই৷ আমাকে আপনার ছোট লোক মনে হয়? কেন মনে হয়? আমার টাকা পয়সা কম দেখে? নাকি আপনার সমকক্ষ নই বলে? শোনেন, আমার অবস্থান অনুযায়ী আমার ধনসম্পদ যথেষ্ট আছে। এটাই আমার জন্যে যথেষ্ট। আপনি যদি মনে করেন ধনসম্পদ বেশি বলে আপনি আমার থেকে বড় হয়ে গিয়েছেন তবে সেটা আপনার ভুল ধারণা তো বটেই, এটা আপনার ছোট চিন্তাভাবনারও প্রকাশ। আপনি একটু পেছন ফিরে দেখুন৷ কোথায় ছিলেন আপনি? শুনলাম, তিন বেলার খাবারটুকুই কেবল নিয়মিত ছিল আপনাদের সংসারে। সংসারের কারো বাড়তি কোনো আবদার কখনই দাম পেত না৷ আপনি সেখান থেকে উঠে এসেছেন৷ তার মানে কী? আপনি ওই সময়ে ছোটলোক ছিলেন? এখন বড় লোক হয়েছেন? আমার তো তা মনে হয় না। আমার মনে হয় আপনি সে সময়ে ওই অবস্থানে বড় লোক ছিলেন। এখন এই অবস্থানে আপনি ছোট লোকই হয়ে আছেন যার চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণই থার্ডক্লাস৷ মনের ভেতর অন্ধকার রয়ে গেছে আপনার৷ ছোটলোক বড় লোক অবস্থান ভেদে হয় না৷ চিন্তাভাবনা ভেদে হয়। আপনি আমাকে লোক পাঠিয়েন নানান ভাবে টর্চার করেছেন৷ আমার আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছেন। আপনি যতোদিন লোক পাঠিয়েছেন ততোদিন আমার মনে হয়েছে আমি ছোট লোক৷ আমি আপনার সমকক্ষ নই৷ আপনি আকাশে তো আমি মাটিতে৷ বিস্তর তফাত! অথচ আমরা দু'জনেই মানুষ। মৃত্যুর পর আমাদের দু'জনকেই একই নিয়মে কবরে যেতে হবে৷ কবরে আপনাকে যা প্রশ্ন করা হবে আমাকেও তাই করা হবে৷ ভিন্ন কিছু না। একসময়ে আমরা একই কাতারের মানুষ হয়ে যাব। যেখানে কোনো ছোট বড়ের পার্থক্য থাকবে না৷ শোনেন, একটা উপদেশ দেই, আমরা সবাইই মানুষ। আমাদের সবার পরিচয় একই৷ এখানে কেউ ছোটলোক নয় কিংবা কেউ বড় লোক৷ আপনি আপনার যোগ্যতা এবং পরিশ্রমের বলে এই পর্যন্ত এসেছেন৷ আমি আমার যোগ্যতা এবং পরিশ্রমের বলে এই পর্যন্ত এসেছি৷ যোগ্যতা ভেদে আমাদের অবস্থান ভিন্ন৷ ব্যস৷ এই হলো পার্থক্য। এছাড়া আর কোনো তফাত নেই আমার আর আপনার মাঝে। আপনি ভাবছেন আমি আপনার সম্পদের লোভে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই৷ আমি মূহুর্তে আপনার সামনে স্পষ্টই বলছি আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব না৷ আপনি যতোদিন মন থেকে আমার ব্যাপারে ওইসব বাজে চিন্তা দূর করবেন কিংবা যতোদিন না আপনি মনে থেকে চাইবেন আমিই আপনার মেয়ের উপযুক্ত ততোদিন আমাকে হাজার বলেও বিয়ের পীড়িতে বসাতে পারবেন না৷ আগে আপনাকে রাজি হতে হবে৷ এরপর বিয়ে হবে৷ আমি মূলত এই কারণেই আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাইনি৷ আমি চাইলেই পারতাম৷ তবে আমি সেটা করিনি। কারণ মিহিনের জীবনে তার ফ্যামিলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমি আমার প্রেমের জন্যে তাকে তার ফ্যামিলি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না৷ আর তাছাড়া প্রেম করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো না৷ কাউকে মন থেকে ভালোবাসলাম এটাই তো বড় পাওয়া৷ যাই হোক, এসব আপনার মাথায় ঢুকবে না৷ কারণ আপনার সেই জ্ঞানটুকু নেই৷ আমি জানি আপনি কখনই চাইবেন না আপনার মেয়ে আমার হোক৷ না চাওয়াটাও অস্বাভাবিক না৷ আপনি আপনার মেয়ের সাথে যা ইচ্ছে করুন, তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে ফেলুন, আমার কোনো আপত্তি নেই৷ তবে আমার মনে হয় না আপনি আপনার মেয়ের কাছ থেকে আমাকে দূর করতে পারবেন৷ যদি সত্যিই দূর করতে চান তবে আপনাকে ভিন্ন কিছু ভাবতে হবে৷ অন্যরকম কিছু। আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাইছি?
নিশ্চুপ মিনহাজ আবেদিন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না৷ আমি মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-আমার ধারণা মতে আপনি এই কাজটা বেশ ভালো করেই পারবেন৷ মিহিনের মনে এমন ঘৃণা জাগাবেন যে সে আমার মুখটাও দেখতে চাইবে না৷ আমি জানি আপনি সেটা পারবেন৷ আপনার জন্যে শুভ কামনা রইলো। আশা করব আর কখনই এভাবে অফিসে ডেকে অপমান করবেন না৷ ভালো থাকবেন।
ওখান থেকে বাসায় ফিরে আসার পর আমার মনে হলো হায় হায় কী বলে এলাম এগুলো! এতো গুলো কঠিন কঠিন কথা কীভাবে বলতে পারলাম আমি? আমি উনাকে ছোট লোক বলেছি! জ্ঞানহীন বলেছি! কীভাবে বলেছি? আমার মুখে কি একবারও বাঁধল না? আঁটকালো না? চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লাম। উনি জানি কেমন রেগে আছেন! আল্লাহ জানে এই লোক আমার কী করে ফেলে! পুলিশে টুলিশে দিবে নাকি? সে রাতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি চলে আসি৷ চাচা আগে আপন প্রাণ বাঁচা!
তবে অবাক করা ব্যাপার হলো তিনি তেমন কিছুই করেননি৷ এবং ওই ঘটনার পর আজ তার সাথে আমার প্রথম দেখা৷ মিহিন? মিহিনকে কতোদিন দেখি না আমি? কতোদিন হবে? কে জানে! মনে নেই! মনে থাকার প্রয়োজনও নেই।
আমি অনেকটা সময় একা একা বসে থাকলাম। এর অল্প কিছু পরেই কারো নুপুরের আওয়াজ কানে এলো৷ রিনঝিন শব্দ। সাথে দুটি স্বর। একটি ছেলের এবং অন্যটি মেয়ের৷ মেয়ের ভয়েসটা আমার কাছে পরিচিত লাগলো৷ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম৷ তাকাতেই দেখলাম মিহিন এগিয়ে আসছে৷ সাথে সেই ছেলেটা৷ যার সাথে ওর এঙ্গেজম্যান্ট হয়েছিল৷ আমি এদের ছবি দেখেছিলাম ফেসবুকে। দু'জনকেই বেশ হাস্যজ্বল লাগছিল৷ চমৎকার এক ছবি৷ মিহিনের বাবা কাজটা বেশ ভালোই করেছিলেন। আমাকে নিয়ে মিহিনের মনে এমন ভাবে ঘৃণা জাগিয়েছিলেন যে মেয়েটা একদম বিয়েতেই রাজি হয়ে গেল! আমি কিছুটা অবাকই হলাম৷ আমি মনে মনে বিশ্বাস করতাম যতো যা-ই হোক, এই পৃথিবীর কেউই কখনও মিহিনের মনে আমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ঘৃণা জাগাতে পারবে না৷ তার প্রতি আমার বিশ্বাস এমন ছিল। কিন্তু সেদিন ওর বাবার ভয়ে যখন বাড়িতে ফিরছিলাম তখন সে ফোন দিয়ে যে কথা গুলো বলল আমায় সে সময় থেকেই আমি মোটামুটি তারউপর থেকে সেই বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলি। সেদিন যাচ্ছেতাই ব্যাবহার করে মিহিন৷ আমাকে নানান কথা বলে ছোট করে৷ আমি তার বাবাকে কী বলেছি, সে আমাকে এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলেছে৷ আমি কেবল চুপচাপ শুনে নিয়েছি৷ এছাড়া আমার আর কিছু করারও ছিল না৷ আমি কেবল মনে মনে বিশ্বাস করে নিয়েছি মিহিন নামে কেউ নেই৷ কেউ আমাকে ভালোবাসেনি৷ কখনই ভালোবাসেনি। মনে মনে হাসলাম। 'বিশ্বাস করে নিয়েছি' কথাটা বলা সহজ৷ অথচ নিজের মনকে বোঝানো কত কঠিন৷ মন মানতেই চায় না যে মিহিন এখন আর আমার নেই৷ সে এখন আর আমার কেউ না৷ আমি তার কেউ না৷ আমরা দু'জন এখন ভিন্ন ধরনের মানুষ। মনকে এসব বোঝানো বড় মুশকিল।
মিহিন চট করেই থেমে গেল। আমাকে দেখতেই তার চেহারায় রাজ্যের অবাক দেখা দিল। সে এক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। নিজের মতো করে চুপচাপ বসে থাকলাম। এখানে আসার পূর্বে আমার এই একটা ভয় ছিল। মিহিন এবং তার বর। আমি জানি, এদের দু'জনকে এক সাথে দেখলে আমার গা জ্বলে যাবে৷ রাগ হবে৷ অস্বস্থি হবে৷ এবং এখন তাই হচ্ছে৷ আমার কেমন জানি লাগছে৷ আশ্চর্য ব্যাপার! এই মেয়ের বাবার বাড়িতে কী? স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারে না? আমি বসে থাকলাম। পেছন ফিরে দেখলাম না৷ মিহিনকে দেখতে মন চাইলো খানিক। তাও করলাম না। সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ হতে নেই৷ আমি চুপচাপ বসে থাকলাম।
পেছনের স্বর দুটো কাছে আসে ধীরে ধীরে৷ তারা আমার সামনে চলে আসে। ছেলেটি মিহিনের হাত ধরে রাখে শক্ত করে। মিহিনকে বসতে সাহায্য করে৷ মিহিন চুপটি করে আমার বিপরীত চেয়ারে বসে। আমি মনে মনে অস্থির হই! কী হয়েছে মিহিনের? মেয়েটি কি হাঁটতে পারে না? তাকে কারো ধরে বসাতে হবে কেন? তাছাড়া এই মেয়ে এখানে কী করছে? এখানে তার বাবা আসার কথা! সে কেন এলো?
মনের ভেতর অনেক গুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়৷ উত্তর মেলে না। আমি একগাদা অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকি৷ আমার সামনে আমার প্রাক্তন বসে আছে৷ আমার চিরচেনা প্রাক্তন। তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীটা চলে গিয়েছে৷ যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হেসেছে! তার হাসির অর্থ আমি বুঝতে পারি না৷ মিহিনের এভাবে আমার সামনে এসে বসার অর্থটাও না! হঠাৎই নিজেকে কেমন নির্বোধ লাগল! অসহায় বোধ হলো৷ আমরা মানুষ, আমরা আমাদের অনুভূতির কাছে কতো অসহায়!
বেশ কিছু সময় কেটে যায়! কেউ কোনো কথা বলে না৷ দু'জনেই নিশ্চুপ। আমার অস্বস্তি ভাবটা বেড়ে গেল! আমার কেন জানি মনে হয়, মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি উঠে যেতে চাইলাম! উঠে দাঁড়াতেই সেই সুপ্রিয় স্বরটি ভেসে আসে,
-তাসফি?
আমি তার দিকে ফিরি৷ হাসার চেষ্টা করি। কি বলব ভেবে পাই না৷ সে মৃদু স্বরে বলে,
-বসো৷
আমি বসে পড়ি চুপচাপ। মিহিন বলে,
-কেমন আছো?
-ভালোই৷ তুমি ঠিকঠাক?
-হ্যাঁ। বেশ!
-অসুস্থ মনে হচ্ছে!
-তেমন কিছু না৷ ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে কেবল।
-ও।
এতটুকু বলে আমি চুপ করে থাকলাম! আর কথা খুঁজে পেলাম না৷ আমি অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরটা অসম্ভব কাঁপছে। আমার কথা গুলো কেমন কেঁপে কেঁপে আসছে৷ কথার শব্দে যেন মৃত মৃত ভাব! এই মেয়ের সামনে এভাবে বসে থাকা যে এতো কষ্টকর হবে জানা ছিল না! মিহিন বলে,
-আমার কিছু হলেই একটা সময় কেউ একজন খুব উত্তেজিত হয়ে যেত৷ আমাকে এটা করতে বলত৷ ওটা করতে বলত৷ কতো কেয়ার! মানুষটার যে কী হয়েছে!
আমি হাসার চেষ্টা করি৷ বলি,
-প্রত্যেকের অতীত একটা শিক্ষা কেবল৷ এরচে বেশি কিছু না৷
-হ্যাঁ৷ শিক্ষা তো বটেই!
-তোমার বাবা কোথায়?
-আছেন৷ কথা বলবেন তোমার সাথে৷
-কখন? আমার তাড়া আছে খানিক।
-আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছো না?
আমি কিছু বললাম না৷ মিহিন আবার বলে,
-তোমাকে আমি ডেকেছি। বাবা ডাকেননি৷
-তুমি?
-হ্যাঁ। অবাক হচ্ছো?
-অবাক হওয়ার মতোই তো! আমার প্রাক্তন আমাকে কেন ডাকবে?
-ডাকা যায় না?
-অবশ্যই না।
-কি জানি! আমার তোমাকে ডাকতে ইচ্ছে হলো৷ তাই ডাকলাম।
-তোমার ইচ্ছেতেই তো সব কিছু হবে না৷
-আজ তো হয়েছে৷ আজ, এই একদিনই যথেষ্ট।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ এরপর চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মিহিন বলল,
-তোমাকে এতো অচেনা লাগছে কেন তাসফি?
আমি মৃদু হাসি৷ বলি,
-তুমি আমাকে চিনেছো কবে?
-তোমাকে আমি যতোটুকু চিনি, জানি, এই পৃথিবীর আর কেউই ততোটুকু চিনে না। জানে না৷
-মিথ্যা বলবে না৷ আমি জানি তুমি আমাকে চেন না৷ চিনোনি৷ আমাকে কেবল আমার মা'ই ভালো চিনেন৷ সে আমাকে যতোটুকু চেনে তারচে বেশি অন্য কেউ চেনে না৷ তুমি কি আমায় বিশেষ কিছু বলার জন্যে ডেকেছিলে?
মিহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-হ্যাঁ। বিশেষ কিছু বলার জন্যেই৷
-একটু জলদি বলবে প্লীজ! আমাকে যেতে হবে।
-কোথায় যাবে? এতো তাড়া কিসের তোমার।
-পার্সোনাল।
মিহিন চট করেই কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কেবল। আমি ওর দিক থেকে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এই মেয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না৷ মিহিন কেমন ধরে আসা কণ্ঠে বলে,
-তুমি বিয়ে করেছো?
-কথাবার্তা চলছে৷
-মেয়ে দেখা হয়েছে?
-হ্যাঁ৷ দেখা শেষ৷ মা এখানে আসবেন কয়েকদিন পর৷ ধানমন্ডিতে নতুন বাসা নিয়েছি। একসাথে সেখানে উঠব৷ এরপর বাকি কথাবার্তা আগাবে৷
মিহিন কেমন জানি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷ আমি তার চোখে জল দেখি৷ মেয়েটার চেহারা যেন চট করেই কালো হয়ে গেল। সে কোনো মতে বলল,
-মেয়ে দেখতে কেমন?
-ছবি দেখবে?
-না৷ ছবি দেখব না৷ তুমি বলো।
-মেয়ে সুন্দরী। ভালো। মোটামুটি আমার জন্যে যথেষ্ট।
-আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী?
-আমি সুন্দরের পূজা করি না৷ আমার পছন্দকে মূল্যায়ন করি৷
-তুমি পছন্দ করছো, তার মানে সে সুন্দরীই হবে৷ আমার চেয়ে বেশি অবশ্যই হবে৷ হবে না?
-কে জানে! হবে হয়তো৷
মিহিন কিছু বলল না৷ চুপ করে গেল৷ ওর গাল দুটো কেমন ফুলে এলো যেন! কেমন লালচে হয়ে গেল৷ নাকের ডগাটাও লালচে হয়ে আসছে৷ আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। আকাশে রঙের কূর্তি পরা এই মেয়েটিকে যে এখন কেমন রূপসী লাগছে সেটা এই মেয়ে নিজেও জানে না। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই দেখলাম মিহিন কাঁদছে৷ সে ঠোঁট চেপে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে৷ অথচ করতে পারছে না৷ তার ভেতরের অনিচ্ছুক কান্নাটা যেন চলেই আসছে৷ সে সেটাকে মোটেও রোখাতে পারছে না৷ মিহিন মুখে হাত দিয়ে কান্না করে ফেলল! গা কাঁপিয়ে কান্না করা! অল্প অল্প শব্দ আসছে৷ তার প্রতিটা ফোঁপানোর শব্দ যেন আমার ভেতরে তোলপাড় সৃষ্টি করছে৷ আমার খুব ইচ্ছে করছে, আমি উঠে যাই৷ ওকে জড়িয়ে ধরি৷ বলি, কেঁদো না৷ আমি আছি তো।
মিহিন কোনো মতে কান্না থামিয়ে বলে,
-তুমি খুশি তো?
আমি বিপরীতে হাসলাম। বললাম,
-তোমার বিশেষ কথাটা শোনার অপেক্ষা করছি।
-হ্যাঁ৷ তাই বলি৷ বোঝ কমাই! এই কষ্টের ভার নেওয়া মুশকিল।
-কষ্ট?
-হ্যাঁ৷ কষ্টই৷ নিজের পাগলামি এবং বোকামির ফলাফল।
আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে৷ কিছু বললাম না। বুঝার চেষ্টা করলাম৷ মিহিন বলে যায়,
-সেদিন আমি পুরোটা ক্ষন বাসার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ বুক ভরা আশা ছিল৷ তুমি আসবে৷ তোমাকে ছুঁব৷ জড়িয়ে ধরবো৷ তোমাকে কতো দিন যে দেখি না! পুরোটা দিন তোমায় দেখার প্ল্যান করেছিলাম৷ আরো কতো কি! সময় গড়ালো৷ তুমি এলে না৷ ফোন দিলাম। ফোন তুললে না৷ মনের ভেতর একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল৷ কেন জানি মনে হতে থাকলো কিছু একটা ঠিক নেই৷ বাজে কিছু হতে যাচ্ছে৷ তাও তোমাকে ফোন দিয়ে গেলাম৷ তুমি ফোন তুললেই না৷ বাবাকে কল দিলাম৷ বাবা কল ধরে বেশ নরম স্বরে বললেন,
-তুমি বাসায় আছো মিহিন?
-হ্যাঁ। বাসাতেই৷
-থাকো৷ বাবা আসছি৷ কোথাও বের হয়ো না৷
তখন নিশ্চিত ভাবেই মনে হলো কিছু একটা আসলেই ঠিক নেই৷ খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে৷ এবং তাই হলো৷ বাবা অফিস রেখে বাসায় এসে হাজির হলেন৷ সোজা আমার রুমে আসলেন৷ তার চেহারা কালো হয়ে আছে৷ কেমন মর্মাহত ভাব৷ আমি অবাক হই৷ বাবাকে এমন রূপে আগে কখনই দেখিনি৷ তার প্রথম কথা ছিল, "সে আমাকে ছোট লোক বলেছে৷ আমি কি ছোট লোক? আমার চিন্তাভাবনা নিচুস্তরের বলেছে৷ মিহিন, আমার চিন্তাভাবনা কি আসলেই নিচু স্তরের? আমি আমার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে অসংখ্যবার ভাবতে পারি৷ নানান কিছু ভাবতে পারি। আমার এই ভাবনাটা কি অন্যায়?" কথা গুলো বলে বাবা বেশ নিরীহ ভঙ্গিত তাকিয়ে থাকলেন৷ এতো কঠিন একজন মানুষ, আজ হঠাৎ এতো নিরীহ, অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন দেখেই আমার মন কেমন কেঁদে উঠলো৷ আমি বাবাকে বলি, "ও তোমাকে এসব বলেছে?" তিনি আমার পাশে এসে বসেন৷ বলেন, "এসব তো শুরুতে বলেছে৷ এরপর? সেগুলো আমি আর বলতে পারবো না৷ আমার মুখ দিয়ে আসবে না। অফিসে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছে একদম৷ শফিককে জিজ্ঞেস কর৷ ওর থেকে শুনে নে৷ শফিক? এই শফিক? এদিকে এসো! আল্লাহ, আমার মান সম্মান রইলো না আর৷"
শফিক ভাই দৌড়ে আসেন৷ রুমের ভেতরে এসে দাঁড়ান৷ আমি তার দিকে তাকাই৷ সেও একই ভাবে মুখ কালো করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলি,
-শফিক ভাই? ও বাবার সাথে সত্যিই বাজে ব্যাবহার করেছে?
শফিক ভাই চুপ থাকেন খানিক৷ এরপর বলেন,
-আপনি যদি সেখানে উপস্থিত থাকতেন তবে বিশ্বাস করতে পারতেন৷ এছাড়া আপনাকে বিশ্বাস করানো মুশকিল হয়ে যাবে৷ আমি নিজেও বেশ অবাক হয়েছি৷ এই মানুষটার আচারব্যবহার যে এতো বাজে হবে জানা ছিল না!
আমি জল ভরা দৃষ্টিতে শফিক ভাইয়ের দিকে তাকাই৷ তার প্রতিটা কথা আমার সত্য মনে হয়৷ আমার বুক ফেটে কান্না আসতে চায়৷ শফিক ভাই আবার বলেন,
-স্যার তো বিয়ের কথা বলতে বসেছিলেন৷ অথচ সে স্যারের চোদ্দগুষ্টির দূর্নাম করে গেল! ছি ছি ছি! কি সব কথা! বলে কি না, "আমি চাইলে আপনার মেয়েকে উঠায় নিয়ে যেতে পারতাম৷ কেবল আমি চাইনি বলেই সে আপনার বাসাতে আছে এখনও৷" আমি মনে মনে বলি আমার ম্যাডাম কি এতোই সস্তা নাকি যে তোর মতো রাস্তার ছেলে বললেই চলে যাবে?
আমি ভেঙ্গে পড়ি৷ এদের কথা গুলো বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় পাই না৷ রাতের দিকে তুমি ফোন ধরো৷ তোমাকে জিজ্ঞেস করতেই তুমি স্বীকার করো যে তুমি সত্যিই বাজে ব্যাবহার করেছিলে। আমার মেজাজটা চড়ে যায়৷ আমি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারিনি৷ তোমাকে যাচ্ছেতাই বলি৷ যেগুলো বলা অনুচিত সেগুলোও বলে ফেলি। নিজেও বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে আমি কী বলছি! কেবল বলেই গিয়েছিলাম!
মিহিন থামে। একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে। চোখ ভরা জল৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ বলি,
-সব কথার মাঝে এমন একটা কথাও বলেছিলে, "তোর ভাগ্য ভালো যে আমার মতো মেয়ে তোর সাথে প্রেম করেছে৷ এটা ভেবে সারাজীবন কাটিয়ে দিস৷ কারণ এমন সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার আর পাবি না।" কথা গুলো যেন এখনও আমার কানের কাছে বাজে৷
মিহিন কিছু বলতে পারে না৷ তার গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ে যায় কেবল।
কিছু সময় কেটে যায় নীরবে। কেউই কোনো কথা বলি না৷ নীরাবতা কাটিয়ে মিহিন বলে,
-আমার বিয়ে ঠিক হয় আমার এক কাজিনের সাথে৷ শুদ্ধ নাম ওর। এই যে একটু আগে এলো; সে৷ আমি রাজি হয়ে যাই৷ আমার আর করার কিছুই ছিল না৷ আমি উপায়হীন ছিলাম৷ অথচ আমি যদি একটু ভালো করে খোঁজ নিতাম তবে অবশ্যই কোনো উপায় পেয়ে যেতাম৷ টের পেয়ে যেতাম শফিক ভাইয়ের হঠাৎ প্রমোশন হয়ে গেল কেন? আড়ালে আড়ালে আমার বাবা কেন এতো খুশি ছিল৷
আমাদের এঙ্গেজম্যান্টের পর হঠাৎ কি একটা কাজে যেন বাবার রুমে যেতে হয় আমাকে৷ তার দরজার কাছে যেতেই আমাকে থেমে যেতে হয়৷ দরজায় কান পাততেই সব স্পষ্ট হয়ে যায়৷ বাবা ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন৷ আমার আর তোমার ব্যাপার নিয়ে। সেই সব গল্পের কথা, যা যা নিয়ে ঘটিয়েছেন। আমি বাবার রুমে যাই না আর৷ শফিক ভাইয়ের খোঁজ করি৷ তাকে বের করে সত্যটা জেনে নেই৷ এমন সত্য যা জানার পর আমার নিজের উপরই ঘৃণা চলে আসে৷ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমিই এমন কিছু করেছি। জলদি করে বাবার কাছে যাই৷ জানতে চাই আসলে সে এমনটা কেন করেছে? কেন আমার সাথে এই গেমটা খেললো৷ বাবা জবাব দিতে পারেন না৷ তিনি কেমন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান৷ বলেন,
-মিহিন, কাল রাতে আমি টের পেয়েছি, আমি আসলে কতোটা সেলফিশ এবং ইম্যাচিউর একটা কাজ করেছি৷ আমার কী হয়ে গিয়েছিল জানি না৷ আমি যেন ছেলেটার প্রতি অযোথাই রেগে যেতাম৷ ছেলেটার প্রসঙ্গ আমাকে কেমন রাগিয়ে দিত৷ আমার ইগো মানতে চাইতো না যে এই ছেলেটা আমার মেয়ের জামাই হোক! অথচ ছেলেটার কাছে তার সবটাই আছে যতোটা থাকা প্রয়োজন৷ সে তোমার জন্যে পার্ফেক্ট ছিল৷ অথচ সেটা আমি টেরই পাইনি৷ কাল আমার বন্ধু আমার সব গুলো ভুল ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি আসলে কতো বড় ভুল করেছি৷ ত্রিশ বছর আগে এমনটা আমার সাথেও হতে পারতো৷ অথচ হয়নি৷ আমি আমার প্রিয়জনকে পেয়েছি৷ সে জন্যেই হয়তো আমি আজ এই অবস্থানে৷ তোমার আম্মুর সাথে আমার বিয়েটা না হলে আজ হয়তো আমি এখানে থাকতামই না৷ সেই আমি এই কাজটা কীভাবে করলাম৷ কীভাবে এমন ভুল করলাম?
বাবা ভুল করলেন৷ সেই ভুল তিনি টের পেলেন৷ আমি ভুল করলাম। সেই ভুল টের পেলাম৷ অথচ আমরা দু'জনের কেউই সেই ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইবার সাহস পেলাম না। মনে হতো, কোন মুখে মানুষটার মুখোমুখি হবো? কী বলব তাকে গিয়ে?
আমি বিশ্বাস হারালাম৷ আমার আবার সেই বন্দী, একাকী জীবন শুরু হলো৷ সেই একা একা অন্ধকারে জানালা মেলে বসে থাকা। আকাশ পানে চেয়ে থেকে নিজের ভুলের সাজা ভোগা। এই যে এতো দিন হলো, রাতে যে ঘুম যাচ্ছি, তৃপ্তি পাই না তাসফি। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই কেন বারবার তোমার চেহারা চোখে ভাসে? কেন বুকের মাঝে প্রচণ্ড শূন্যতা কাজ করে? কেন মনে হয়, আমার খুব কাছের কেউ একজন নেই? খুব প্রয়োজনীয় কেউ একজন নেই আমার। তাসফি, আমি আজ পর্যন্ত প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি৷ যে নিঃশ্বাসটা বের হয়ে আসে, সেটা কেবল কষ্টে মাখা থাকে৷ এই শ্বাসে বেঁচে থাকা যায়, তবে সুখ পাওয়া যায় না। কারণ সেখানে কোনো প্রশান্তি থাকে না৷ আজ হঠাৎ তোমাকে দেখার পর আমার কেন সেই প্রশান্তিটুকু অল্প হলেও ফিরে এলো বলো তো? কেন আমার তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে? কেন ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার দিয়ে বলি, "আমায় ক্ষমা করো তাসফি।" বলো আমায়? কী করব আমি? আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি সুস্থ নেই৷ আমার ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষত৷ তীব্র ব্যাথা। এই ব্যাথা নিয়ে সুস্থ থাকা যায়?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খুব কষ্ট করের ভেতরের চাপা ব্যাথাটুকু লুকাবার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-তোমার ভ্রম হচ্ছে মিহিন।
-ভ্রম না৷ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি৷
-তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই।
-আমি যে দেখতে পাচ্ছি৷
-কী?
-এই যে, রাগ, ক্ষোভ, ব্যাথা?
-তুমি ভুল দেখছো৷
-আমি ভুল দেখি না৷ আমি তোমাকে বুঝতে পারি৷
-তুমি আমাকে বুঝতে পারো না৷
-কেন মিথ্যা বলছো?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম! বললাম,
-আসলেই। মিথ্যাই বা কেন বলছি৷
-সত্যি করে বলো তো, তুমি কি সুখে আছো? ভালো আছো?
-বাদ দাও৷ আমার সুখ দুঃখ নিয়ে নিশ্চয়ই তোমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই৷
-আছে৷ অবশ্যই আছে৷
-কেন? থাকবে কেন?
-আমি তোমাকে ভালোবাসি তাসফি৷
কথাটা বলেই থেমে গেল মিহিন৷ আমি তার দিকে চেয়ে থাকলাম। অনেকক্ষন চেয়ে থাকলাম৷ আমার চোখে অল্প অল্প জল জমতে থাকলো৷ কতোদিন পর এই লাইনটা শুনলাম! আমি বললাম,
-কেন মিথ্যা বলছো?
-মিথ্যা? মিথ্যা লাগছে তোমার কাছে? এদিকে আসো তো! চোখে চোখ রাখো। দেখো আমায়! এই যে এতোক্ষন হলো, তুমি কি আমাকে ভালো করে দেখেছো? একবারের জন্যেও দেখেছো?
-আমি দেখতে চাই না।
-কেন? কেন চাও না৷
-মিহিন, আমার বিয়ে কথা...
-চুপ! একদম চুপ৷ এই প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলবে না৷ তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে৷ বিয়ে হয়ে যায়নি এখনও৷
-কিন্তু তোমার তো হয়ে গিয়েছে৷
মিহিন তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমি কিছু বললাম না৷ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলল,
-এতো কিছুর পর আমি কীভাবে বিয়ে করি বলো তো?
-করোনি?
মিহিন কিছু বলে না আর৷ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। আমি বলি,
-কেন করোনি? এঙ্গেজম্যান্ট তো হয়েছিল।
-জাস্ট রিং পরানো হয়েছে৷ বেশি কিছু না৷
আমাকে খানিকটা অবাকই হতে হলো৷ কেন জানি বিশ্বাস হতে চাইলো না যে মিহিন বিয়ে করেনি৷ আমি তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে৷ অনেক ক্ষন তাকিয়ে থাকলাম৷ আমার চোখে জল জমতে শুরু করলো৷ মিহিন বলে উঠে,
-আমার বাবা লজ্জায় তোমার সামনে আসতে পারছেন না৷ তিনি আমাকে পাঠালেন৷ আমি লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তোমার কাছে এলাম৷ তোমার চোখে চোখ রাখার যোগ্যতা নেই জেনেও চোখ রাখলাম। কেন জানি না। আমার মনে হচ্ছিল এই সাক্ষাতটুকুর ভীষণ প্রয়োজন ছিল৷ অন্তত আমার বেঁচে থাকার জন্যে৷
আমি চুপ করে রইলাম। মিহিনের কথা শুনে গেলাম৷ মিহিন আবার বলে,
-তাসফি, আমি ভুল করলাম। আমার বাবা ভুল করলেন৷ তুমি কি আমাদের ক্ষমা করে দিবে? আমাদের কি এই পাপ থেকে মুক্ত করবে?
-প্লীজ, আঙ্কেলকে এখানে এনো না৷ উনার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই৷ বরং আমি নিজে লজ্জিত উনার সাথে এমন বাজে বিহ্যাভ করার জন্যে৷ আমার এমনটা করা উচিত হয়নি৷ কেন যে এই পাগলামিটা করলাম! এতো বড় অন্যায় যে আমার দ্বারা হয়ে যাবে আমি ভাবিওনি৷ তুমি উনাকে প্লীজ, আমাদের মাঝে আনিও না৷ উনার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই৷
-তাহলে রাগ কার উপর? আমার?
-আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম মিহিন! আমার মনে হতো এই পৃথিবীর কেউই তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না৷ তুমি কখনই আমাকে ভুল বুঝবে না৷
-আমি কী করতাম বলো? তখন আমার মাথায় কিছুই ছিল না৷ আমি উন্মাদের মতো ছিলাম!
-তুমি আমাকে নানান কথা বলেছো৷
-আমি সরি বলছি তো!
-আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি মিহিন৷ তোমার বাবার এতো অপমান আমাকে আঘাত দেয়নি৷ অথচ তোমার একটা কথা আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে৷
-সরি! আমি স্বাভাবিক জ্ঞানে এসব বলিনি৷
-যেভাবেই হোক, তুমি বলেছো৷ আমাকে কষ্ট দিয়েছো! তুমি জানো না৷ এটার ব্যাথা কতো তীব্র হয়৷ আমি এই পৃথিবীর সব ব্যাথা সয়ে নিতে পারি৷ পারব৷ কিন্তু তোমার দেওয়া একটা ব্যাথাও আমার দ্বারা সওয়া সম্ভব না৷ কেন জানি পারি না৷ এতো এতো কাঁদি, তাও কেন জানি মনে হয় এমনটা না হলেও পারতো৷ মিহিন অন্তত এমন না করলেও পারতো! কী যে অসহ্য কষ্ট হতো মিহিন! কীভাবে বোঝাই তোমাকে?
মিহিন কান্না করে দিলো চট করেই৷ আমি নিজের চোখ মুছে নিলাম। মিহিন ভেজা স্বরে বলে,
-প্লীজ তাসফি৷ আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো!
আমি কিছু বলতে পারি না৷ আমার স্বর আঁটকে যায়৷ গলার কাছে যেন একদল কান্না এসে জমে থাকে৷ আমি কাঁদতে চাই৷ অথচ এই মেয়ের সামনে কেন জানি কাঁদতে পারি না। মিহিন উঠে দাঁড়ায়৷ বলে,
-প্লীজ, তুমি কেঁদো না। তোমার চোখের জল আমাকে আরো বেশি কষ্ট দেয়৷ আমি সইতে পারি না৷
মিহিন এগিয়ে আসতে চায়৷ কয়েক পা আসার পরই মেয়েটা মাটিতে বসে পড়ে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা স্বর বেরিয়ে আসে। যেন সে ব্যাথা পেয়েছে৷ আমি চট করেই উঠে দাঁড়াই৷ ওর কাছে চলে যাই। ভালো করে তাকাতেই দেখি ওর পায়ে ব্যান্ডেজ৷ আমি ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি৷ ওর হাত শক্ত করে ধরি৷ বলি,
-তোমার পায়ে কী হয়েছে?
মিহিন কিছু বলে না৷ সে খানিক দাঁড়াতে পেরেই আমাকে আঁকড়ে ধরে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-এটা তো কিছু না তাসফি৷ আমার ভেতরের ক্ষতটুকু এরচেয়ে তীব্র৷ এটার ব্যাথায় আমার চোখে জল আসে না। আমার চোখে জল আসে তোমার অপূর্নতায়৷
কথাটা বলে মিহিন কাঁদতে থাকে৷ কী তীব্র কান্না তার৷ বাড়ির সবাই শুনছে যেন৷ আমি কী করব ভেবে পেলাম না৷ মিহিন ভেজা স্বরে বলল,
-আ'ম সরি তাসফি।
আমি এবারেও কিছু বললাম না৷ সে আমার বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকলো৷ ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলতে থাকল,
-ফরগিব মি প্লীজ!
মিহিন কেঁদে যায়৷ আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি৷ আমার চোখে স্পষ্ট জল৷ মিহিন বলে,
-তুমি এখনও আমায় জড়িয়ে ধরোনি৷ ধরোনা প্লীজ! সব ভুলে গিয়ে আমরা একটু ভালো থাকি। একটু সুখে থাকি! কতোদিন হাসি না যেন!
আমি ভাবাভাবি বাদ দেই৷ নিজেকে রোখানো সম্ভব হয় না আমার৷ আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে৷ খুব শক্ত করে আগলে রাখি বুকের মাঝে৷ বলি,
-আমি কীভাবে এই আবেদন ফিরিয়ে দেই? মিহিনকে আমি ফেরাতে পারি না৷
মিহিন কিছু বলে না৷ ভাঙ্গা স্বরে কেঁদে যায় কেবল! আমি তার সেই কান্নায় আশ্চর্য রকম সুখ অনুভব করি৷ কী অসাধারণ সেই সুখ৷ বুকের ভেতর হঠাৎ এতো প্রান্তি কোত্থেকে এলো? কীভাবে এলো? কোথায় হারিয়ে গেল সব অস্থিরতা, ক্লান্তি-ক্লেদ? আমার আজ এতো সুখ অনুভব হচ্ছে কেন? মিহিনের মাঝে এতো তীব্র সুখ কেন?
.
সমাপ্ত


গল্পঃ আমার সুখ পাখি - মিহিন৷
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।


আমার সকল গল্পের লিংক


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url