গল্পঃ জোকার | শেষ পর্ব | লেখক - তাসফি আহমেদ

bangla-golpo-joker-end-part-by-tasfi-ahamed-tasfis-blog


গল্পঃ জোকার | শেষ পর্ব | লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ জোকার

শেষ পর্ব
লেখক - তাসফি আহমেদ



গল্পঃ জোকার
শেষ পর্ব
.
ঘটনা- ৬
.
নুরুজ্জামান চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল,
-তিনটা মেয়ে ছিল। মারিয়া, ইমা এবং রুবাইদা। তিনজনই স্কুলে পড়তো। দশম শ্রেনীতে। পড়াশোনায় বেশ ভালো। একদিন সন্ধ্যায় মারিয়ার বাবা থানায় এসে জানালেন তার মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি প্রথমে তেমন গা দেইনি। ভাবলাম বান্ধুবিদের সাথে আছে হয়তো। কিন্তু যখন ইমা এবং রুবাইদার বাবাও আসলেন থানায় তখন খানিকটা চিন্তায় পড়ে যাই। হুট করে তিনজনের গায়েব হয়ে যাওয়াটা আসলে রহস্যজনক। সবাই মিলে খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও পাই না। দিনরাত কেবল ওদেরই খুঁজতে থাকি। পত্রিকায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেই। কিন্তু কেউই কোনো খবর দিতে পারে না। এর ঠিক চারদিন পরে আমরা তিনজনের লাশ পাই। উলঙ্গ অবস্থায়। হাত পা বাঁধা ছিল। চোখময় অব্যক্ত আর্তনাদ।
নুরুজ্জামান থামল। শিশির ভালো করে তাকাতেই দেখল নুরুজ্জামানের চোখ ছলছল করছে। শিশির বলল,
-এই লাইনে ইমোশন থাকতে নেই স্যার।
নুরুজ্জামান চোখ মুছে বলল,
-আসলে আমি এমন কেস আগে পাইনি। প্রথম তো, তাই একদম মনে গেঁথে গেছে। এজন্যে একটু ইমোশনাল হয়ে গেলাম। এভাবে তিনজন কিশোরীর অকাল মৃত্যু ঠিক নিতে পারিনি।
-বুঝতে পেরেছি। এরপর কী হলো বলুন।
-ওদের বাবারা থানায় কেস করলো। কিন্তু লাশ ফরেন্সিক অফিসে পাঠানোর আগেই উনারা কেসটা উঠিয়ে নেন। সাধারণ মৃত্যু বলে ব্যাপারটা ওখানেই চাপা পড়ে। এমনকি এ ব্যাপারে আর কোথাও কোনো আলোচনা হয়নি। কোথাও না। বহুল আলোচিত সোশ্যাল মিডিয়া গুলোতেও নয়।
-আশ্চর্য! এটা আবার কেমন কথা? এভাবে তিনজনের খুন হুট করেই সাধারণ মৃত্যু হয়ে গেল? কীভাবে?
নুরুজ্জামান কিছু বলল না। চুপ থাকল কেবল। শিশির বলল,
-তা ওই কেসের সাথে বর্তমান কেসের সম্পর্ক কী?
-আমি ওই কেসটা আড়ালে থেকে খানিকটা ইনভেস্টিগেশন করি এবং জানতে পারি পাঁচটা ছেলে ওই মেয়ে গুলোকে প্রায়ই বিরক্ত করতো। ওদের বাসায় গিয়েও নাকি থ্রেড দিয়েছিল। যদিও ওদের বাবা মা তা স্বীকার করেননি। আশাপাশের লোকজন থেকে নেওয়া টুকটাক তথ্য তাই বলছে।
নুরুজ্জামানকে থামিয়ে শিশির বলল,
-অদ্ভুত ব্যাপার! ওদের বাবা মা অস্বীকার যাচ্ছে কেন? ওদের সন্তানের খুন হলো অথচ তারা কোনো প্রতিবাদ করলো না?
নুরুজ্জামান ম্লান হাসি দিল। বলল,
-এখনও বুঝতে পারেননি ব্যাপারটা?
শিশির কিছু সময় নুরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখে চোখে আলাপ হলো খানিক। তারপর হুট করেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল শিশির। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে। বলল,
-ও মাই গড।
তারপর খানিকটা চুপ থেকে আবার বলল,
-এর মানে দাঁড়ায় যে, যারা ওদের বিরক্ত করত ওরাই ওদের ধর্ষণ করে এবং মেরে ফেলে। ওই পাঁচ জনের পেছনে নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে, এমন ক্ষমতাশীল কেউ একজন যে ওই পরিবার গুলোকে হুমকি দিয়ে কেস উঠিয়ে নিয়েছে। ওদের মুখ বন্ধ করে ফেলে। তাই তো?
নুরুজ্জামান হাসল। বলল,
-একদমই তাই।
-আপনি আগাননি এর পর?
-যেখানে কেসই হয়নি সেখানে আমার এগিয়ে যাওয়াটা অনেকটা অযৌক্তিক। এছাড়া আমি দু'দিন ইনভেস্টিগেশন করায় আমার উপর হামলাও হয়েছিল। হুমকি দিয়েছিল কয়েকবার।
শিশির মনে মনে কিছু একটা বলল যেন। শব্দ না হওয়ায় শোনা গেল না। কিছুক্ষন ভাবল কিছু একটা। খানিক পর বলে উঠল,
-এখন এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে এটা একটা রিভেঞ্জ ক্রাইম। কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে।
-হ্যাঁ। এমনটাই। কিন্তু কে করবে এমন?
-কেউ একজন তো অবশ্যই করেছে। সেই কেউ একজনকেই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
-হ্যাঁ।
-আচ্ছা দ্বিতীয় মাথাটা কখন পান? মানে প্রথনটার কয়দিন পর?
-ঠিক চারদিন পর।
-চারদিন! বাহ! দারুণ!
-দারুন?
শিশির হাসল। বলল,
-একটা বিষয় খেয়াল করুন। মেয়ে তিনটা নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর ওদের লাশ পাওয়া যায়। ঠিক চারদিন পর! এখন আমরা প্রথম পাওয়া মাথার ঠিক চারদিন পর আরেকটা মাথা পাই। মানে দুটো খুনের মাঝে চারদিনের তফাত। এখানে নিশ্চয়ই কোনো কানেকশন আছে। খুনি আমাদের একটা ক্লু দিচ্ছে। খুব গোপনে। রিভেঞ্জ ক্রাইম গুলোয় এমন কানেকশন গুলো পাওয় যায়। আমাকে এটা বলুন যে প্রথম দুটো মাথা কাদের বাসায় পাওয়া যায়?
-মারিয়া এবং ইমা।
-তারমানে পরবর্তীটা রুবাইদার বাসায়?
নুরুজ্জামান সোজা হয়ে বসল। বলল,
-হ্যাঁ। রুবাইদাদের বাসায়।
-দ্বিতীয় মাথাটা পেয়েছেন যে কয়দিন হবে।
-তিনদিন শেষ হবে আজ।
-ফাইন। তাহলে আর একদিন বাকি আছে। আশা করছি সেদিনই খুনিকে ধরা যাবে। কী বলেন?
নুরুজ্জামান এক গাল হাসল। বলল,
-ইনশাল্লাহ।
তারপর খানিক চুপ থেকে বলল,
-কেসটা সলভ হচ্ছিল না। তাই মন মেজাজ খারাপ ছিল। এখন সহজেই সলভ হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে।
শিশির চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
-কেসটাকে যতটা সহজ ভাবছেন ওটা আসলেই তত সহজ নয়। আমরা যে ওখানে ওই রাতে খুনিকে পাবো তার নিশ্চয়তা কী?
-তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপারে কিন্তু আপনি নজরই দিলেন না।
শিশির হাসল। বলল,
-আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন। আমাদেরকে খুনির পাশাপাশি খুনকেও বন্ধ করতে হবে এবং যারা খুন হচ্ছে তাদের বাঁচাতে হবে। তাই তো?
-হ্যাঁ। এটাই তো আমাদের কাজ।
-নুরুজ্জামান সাহেব! আপনি কি খুনিদের খুন হওয়া থেকে বাঁচাতে চাইবেন?
-মানে?
-বুঝেন নি?
-জ্বী না। ঠিক...
শিশির সোজা হয়ে বসে টেবিলের উপর হাত রেখে মুখটা নুরুজ্জামানের কাছাকাছি নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-যারা খুন হচ্ছে, তারাও তো খুনি। তাই না? আমাদের আইন তাদের শাস্তি দিতে পারবে না। আমরাও না। কারণ আমরা ওই খুনিদের গোলাম। এখন যেহেতু কেউ একজন ওই খুনি গুলোকে ধরে ধরে মারছে তাহলে আমরা কেন সেখানে নাক গলাবো? অন্তত পৃথিবীতে থাকতেই কুত্তার বাচ্চা গুলোর একটা বিহিত তো হোক। কী বলেন?
কথাটা বলে শিশির হাসল। হাসিতে তাল মেলালো নুরুজ্জামান। ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করল কনস্টেবল আহসান সাহেব। হস্তদন্ত হয়ে বলল,
-স্যার, দুটো লাশ পাওয়া গিয়েছে নদীর পাড়ে।
নুরুজ্জামান ব্যস্ত হলো না। বলল,
-যাও না! নিয়ে আসো তোমরা। আমি এখানে একটা মিটিংয়ে আছে। কী কী করতে হবে তা তো তোমরা জানোই।
নুরুজ্জামান মৃদু হাসল। কনস্টেবল আহসান বিপরিতে হেসে বিদায় নিলো। কিছু সময় চুপ থেকে শিশির বলল,
-আচ্চা, আপনার কী মনে হয়? আমাদের কে কি আসলেই এখানে খুনিকে ধরতে পাঠানো হয়েছে? কিংবা যারা খুন হচ্ছে তাদের বাঁচাতে?
ভ্রু কুচকালো নুরুজ্জামান। বলল,
-তাই নয় কী?
ঠোঁট বাঁকিয়ে শিশির বলল,
-অবশ্যই তা নয়।
-কী বলছেন?
-ঠিকই বলছি স্যার। আমরা আসলে দুটো খেলনা পুতুল। বুঝলেন? ডি আই জি'র উপর প্রেশার অনেক। তাই আমাকে এখানে ইনভলব করেছে। এসবই লোক দেখানো। যাতে তিনি মিডিয়ায় বলতে পারেন যে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বেস্ট অফিসার কাজ করছে এই কেসের উপর।
-হোয়াট?
শিশির হাসল। বলল,
-প্যাঁচ এখনো বুঝেননি আপনি। বুঝবেন। ধীরে ধীরে বুঝবেন। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার দেখুন। যারা খুন হচ্ছে তারা কি আমাদের হাতের নাগালে?
কপাল কুচকে এলো নুরুজ্জামানের। বলল,
-তাই তো। তারা তো লুকিয়ে আছে। আমাদের নাগালের বাহিরে।
-হ্যাঁ। আপনি কি এটা ভেবে দেখেছেন যে তারা কেন আমাদের নাগালের বাহিরে?
-কেন?
-কারণ তারা যে আসলেই খুনি, ওই তিনটা মেয়ের খুন যে তারাই করেছে সেটা প্রামণ হয়ে যাবে এই ভয়ে।
-মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝছি না।
-আচ্ছা, এটা বলুন যে ওরা কেন খুন হচ্ছে? কেন মারা হচ্ছে ওদের? কিংবা ওদের মাথা কেটে মারিয়া এবং ইমাদের দরজার সামনে রাখা হয়েছে কেন? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কিন্তু একদিকেই ইঙ্গিত করছে। বলুন তো কোনদিকে?
-সিম্পল। মারিয়াদের কেসের দিকে।
-রাইট। এখন যদি ওরা ধরা পড়ে, কিংবা ধরুন খুনিই ধরা পড়ল তখন দেখবেন মারিয়াদের কেসটার কথা উঠে আসবে। উঠে আসবে না?
-অবশ্যই উঠে আসবে।
-তখন এই খুনির তো ফাঁসি হবেই। সাথে সাথেই ওই পাঁচ জনের মধ্যে বাকি তিনজনও কিন্তু ফেঁসে যাবে। কিন্তু তারা ফাঁসতে চাচ্ছে না। তারা আসলে ওই খুনি আর হাত থেকে বাঁচতে চাচ্ছে। এজন্যে ওরা লুকিয়ে আছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নুরুজ্জামান। শিশির আবার বলল,
-আর তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার দেখুন, ধরুন আমরা খুনি ধরে ফেললাম। কিন্তু এর পর কি হবে জানেন? আমাদের আড়াল করে চট করেই ওই খুনিকে মেরে ফেলা হবে। আর আদালতে যাওয়ার আগে খুনি মারা গেলে বেঁচে যাবে ওই পশু গুলো।
-সেটাও তো কথা। তাহলে কি আমরা এখন খুনিকে ধরব না?
শিশির হাসল। বলল,
-খুনিকে ধরা এতো সহজ হবে না মিস্টার! কারণ খুনির পেছনে একা আমরা নই। প্রাইভেট ভাবে ওদের বাবারা এতোদিনে স্পাই লাগিয়েছে নিশ্চয়ই।
-মানে খুনির পেছনে বেসরকারি ভাবে স্পাই লাগানো হয়েছে?
-এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। টাকাওয়ালারা এটাই করে। হারহামেশাই এমন ঘটে।
-তাহলে আমরা কী করবো? এভাবে বসে থাকবো?
শিশির হাসলো খানিক। বলল,
-আমরা আড়ালে থাকবো। সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে আমাদের।
-কীভাবে?
-কাল রাতটা হবে একটা গুরুত্ব পূর্ন রাত। কারণ কাল চতুর্থ দিন শেষ হবে। আরেকটা খুন হবার সম্ভাবনা। ঠিক আমরা এখন যা ভাবছি ওরাও এবং ওদের গোয়েন্দারা তা ভাবছে। কাল কারো মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু কার সেটা অনিশ্চিত। আমরা খুন ঠেকাবো না। খুনিকে ধরবোও না। পারলে বাঁচাবো। শুধু দেখব খুনি কে? জাস্ট এটাই। তার জন্যে আমাদের রুবাইদাদের বাসার উপর কড়া নজর রাখতে হবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে কাল ওখানে কেবল আমরা নই, অন্য আরেকটা গোয়েন্দা বাহিনী থাকবে।
-কোন গোয়েন্দা বাহিনী?
-আরে ওদের বাবারা যাদের প্রাইভেট ভাবে নিযুক্ত করেছেন।
-কিন্তু সেটা তো নিশ্চিত নয়! ওরা তো নাও নিযুক্ত করতে পারেন।
-আবার অনিশ্চিতও কিন্তু নয়। করতেও তো পারেন। সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
-তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।
-হুম। তাহলে এটাই ফাইনাল রইলো। কাল একটা টিম বানিয়ে রাতে রুবাইদাদের বাসায় যাচ্ছেন আপনি।
-আর আপনি?
শিশির মৃদ্যু হাসল। বলল,
-আমি স্যার গোয়েন্দা মানুষ। খোঁজাখুঁজির কাজ আমার। আমি অন্য আরেকটা কাজে বের হবো। কিছু একটা খুঁজতে হবে।
-কী সেট? জানা যাবে?
শিশির আবারো হাসলো। বললো,
-সিক্রেট। পরে বলবো। আপাতত আমার থাকার ব্যবস্থা কী হয়েছে?
-পাঁচ তারকা হোটেলে থাকতে পছন্দ করবেন?
শিশির হেসে বলল,
-কেন নয়?
নুরুজ্জামান বিপরিতে হেসে বলল,
-চলুন ব্যবস্থা করা যাক?
.
ঘটনা- ৭
চতুর্থ দিনের শেষ তখন। সন্ধ্যা নেমে গাঢ়ো অন্ধকারে হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ের খুনের পর বাকি তিনজনকে অন্য আরেকটা বাংলোয় স্থানান্তরিত করা হয়। শহর থেকে বেশ দূরে এই বাংলো। বাংলোর গেইটে দুজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে। দু'জনই সিগারেট ফুঁকছে। বাংলোর উঠোনে দুজন দু'কোনায় দাঁড়িয়ে। তারা বেশ শক্তপোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের নীরাপত্তার কথা বলা যাচ্ছে না। তবে ছাদের উপরে চারকোণায় চারজন স্নাইপার ধরে আছে। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই গুলি করার আদেশ দেয়া হয়েছে। বাংলোর পেছনে জঙ্গলের ভরপুর। সেদিকে মুখ করে একটা পুরনো দরজা আছে। সেটাকে ভেতরে থেকে ভালোভাবে আঁটকে দেয়া হয়েছে। দুপাশে দুটো জানালা। একটা কিচেনের। আরেকটা বেড রুমের। এছাড়া সেখানে কোনো প্রহরী রাখা হয়নি। তাহলে বলাই যায় যে দৃশ্যমান আটজন পাহারাদার আছে। বাকি ভেতরে কয়জন আছে সেটা ঠিক বলা যায় না।
রাত তখন সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে। প্রহরীরা তাদের স্থান বদল করছে। ছাদের চারজন স্নাইপারধারি প্রহরী নিচে নেমে এল। ছাদে উঠলো নতুন করে চারজন। উঠোনের প্রহরীরা ভেতরে চলে গেল। কিন্তু বেরিয়ে এলো না। গেইটের কাছে দুজন ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকল। হুট করেই একজন বলে উঠল,
-কিরে? ওদের ডিউটি কি শেষ নাকি? ভেতর থেকে আসছে না কেন?
আরেকজন ভ্রু কুচকে বলল,
-কাদের কথা বলছিস?
-আরে উঠোনে দুটো ষাঁড় দাঁড়িয়ে ছিল যে ওরা।
অন্যজন হাসল। বলল,
-আজকের খাবার ভালো হয়েছে মনে হয়। খেয়ে দেয়ে আমোদ করছে। গানের আওয়াজ পাচ্ছিস না?
-হ্যাঁ। তা তো পাচ্ছি। ভেতরে তাহলে বেশ মজা হচ্ছে।
-তা তো হবেই। রাঁধুনি মেয়েটাকে দেখেছিস? মা* একটা *লই।
-ষাঁড় গুলো ওকে নিয়ে খেলছে মনে হয়।
-যাবি নাকি?
-ওরা করতে পারলে আমরা পারব না কেন? চল।
কথাটা বলার পরই থেমে গেল প্রথম প্রহরী। চোখ বড় বড় করে দ্বিতীয় প্রহরীর পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। কিছু বলল না। দ্বিতীয় প্রহরী ভ্রু কুচকে বলল,
-কীরে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
সে কাঁপাকাঁপ কণ্ঠে বলল,
-পেছনে দেখ!
দ্বিতীয় জন পেছনে দেখল। ভালো করে তাকাতেই দেখল একটা জোকার তার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। জোকারটা মাথা কাত করে হাসল আবার। বলল,
-খুব যেতে ইচ্ছে করে না? দাঁড়া পাঠাচ্ছি তোকে।
তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্বিতীয় প্রহরীর গলায় ছুরি বসিয়ে দেয় সে। প্রথমজন চিৎকার করে উঠে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্যে নয়। জোকারটা ছুরিটা মেরে দেয় ওর গলা বরাবর। একদম কণ্ঠনালি ছেদ করে ছুরিটা। দ্রুতই মাটিতে পড়ে যায় প্রহরী। জোকার এগিয়ে যায়। গলা থেকে টেনে ছুরিটা বের করে। তারপর গলার কাছে টান দেয় জোরে। ছিৎ করে বেরিয়ে পড়ে রক্ত। জোকারটা হাসে। বড় আনন্দ পায় যেন। ধীরে পাঁয়ে ভেতরের দিকে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। দেখে সবাই বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। কুত্তার বাচ্চা গুলো কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। জোকারটা দাঁড়িয়ে দেখল সবাইকে। ইরা বলে ডাকল কাউকে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক রমনী। জোকারটা বলল,
-তোমার কোনো সমস্যা হয়নি তো?
ইরা হাসল। বলল,
-হয়নি। আজকের রাতটা তোমার। কেবল তোমার।
জোকারটা হাসল। বলল,
-বড় উপকার করলে। এর ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।
-তুমি আমার জন্যে যা করলে, তার বিন্দু পরিমাণও আমি করিনি। কোথায় পথে পথে গা বেচতাম, সেখান থেকে উঠিয়ে এনে তুমি আমায় রাঁধুনি বানিয়েছো। একটা নতুন জীবন দিয়েছো। তোমার চেয়ে আমার কর্ম বিশেষ কিছু নয়।
জোকার হাসল। বলল,
-ভালো থেকো তুমি। দ্রুত পালিয়ে যেও। আবার দেখা হবে। যদি বেঁচে থাকি।
-তোমাকে এভাবে মৃত্যু মুখে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। ওই বদমাশটা চলে আসবে যে কোনো সময়।
-তুমি যাও ইরা। এটা আমার লড়াই। এখানে আমার মৃত্যু হলেও আমি তা সহজে মেনে নিবো। তুমি যাও।
ইরা দাঁড়িয়ে থাকলো না আর। দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
জোকারটা ধীরে ধীরে ভেতরে ঘুমন্ত সকল প্রহরীর গলায় কাটল। ছাদে উঠে স্নাইপারের উপর ঘুমিয়ে যাওয়া চারজন প্রহরীর গলা কেটে রেখে এলো। এরপর চেয়ারের সাথে বাঁধলো ওই তিনটা জানোয়ারকে। তারপর অপেক্ষা করতে থাকল কারো। হুট করেই কিছু একটা মাথায় চাপল তার। সে পড়ে থাকা একজন প্রহরীর পোষাক পরে নিলো। মৃদু সাউন্ডে গান বাজিয়ে বেরিয়ে এলো। গেটের কাছে পড়ে থাকা লাশ দুটোকে টেনে আড়াল করে রাখল। অন্ধকারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে। হাতে একটা স্টিলের রোল। অল্প কিছুক্ষন পরেই কালো একটা মার্সিডিজ এসে থামলো গেটের কাছে। অন্ধকারে আড়ালা করে রাখল গাড়িটাকে। উঠোনে উনি নিয়ে এলো না। ড্রাইভার বেরিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল। গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি সুন্দর ফর্শা চেহারা। দেখতে কী নিষ্পাপ লাগে। অথচ তার ভেতরে সমস্ত নষ্টামিতে ভরপুর। জোকারটা অন্ধকারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মানুষটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ওর দিকে। ওর কাছে এসেই বলল,
-কী ব্যাপার। এভাবে অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? লাইট জালাচ্ছো না কেন?
-ফিউজ হয়ে গিয়েছে স্যার।
কথাটা বলেই সুন্দর চেহারাওয়ালা মানুষটার মাথার উপর স্টিলের রোল দিয়ে বেশ জোরেশোরে আঘাত দিল। পেছনে ড্রাইভার লোকটা ততক্ষনে পকেটে হাত দিয়ে ফেলেছে। পিস্তল বের করবে ঠিক তার আগ মূহুর্তে ড্রাইভারের মাথার উপর রোলের আঘাত পড়ে। মাটির উপর পড়ে থাকে দুজনে। পকেট থেকে ছুরিটা বের করে গলায় পোঁচ দিয়ে দেয় জোকারটা। ছ্যাঁৎ করে রক্ত বেরিয়ে পড়ে। গোঁ করে একটা দীর্ঘ শব্দ হয়। গলা কাটা মুরগির মতো লাফাতে থাকে ড্রাইভারটা। পাশ থেকে রোলটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে ফর্শা মানুষটার দিকে। বেশ জোরে আঘাত করা হয় তার মাথার উপর। কাঁধের কাছে। পেটে, পিঠে। ব্যাথায় তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠে সে।
.
ঘটনা- ৮
.
তৃতীয় আরেকটা খুন হলো। রুবাইদাদের বাসার দরজার সামনে মাথাটা রেখে পালিয়ে গেল সে। কেউই তাকে ধরতে পারলো না। খানিকটা গোলাগুলি হলো বটে। কিন্তু খুনির কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। এদিকে তিনদিন হয়ে গেল শিশিরের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। নুরুজ্জামান তাকে হন্যে হয়ে খুঁজল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না তাকে। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় হুট করেই তার দেখা মিলা নুরুজ্জামানের অফিসে। হস্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে সে। দরজা আঁটকিয়ে বসে পড়ে নুরুজ্জামানের সামনের চেয়ারে। বসেই বলে,
-উফফ! ফাইনালি! ফাইনালি কেসটা শেষ হচ্ছে। একদম মাথা খেয়ে ফেলেছিল কেসটা।
নুরুজ্জামান দ্রুত বলল,
-কেস ফাইনাল? মানে খুনিকে পেয়ে গিয়েছেন?
-ইয়েস!
-কে সেই খুনি। বলে ফেলুন। এক্ষুনি ধরে নিয়ে আসছি।
-আরে ধরা লাগবে না। যে জাল বিছিয়েছি! খুনি নিজেই এসে ধরা দিবে।
বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত কথাটা বলল শিশির। নুরুজ্জামান বলল,
-অন্তত নামটা বলে দিন!
-ওটা আপনার জন্যে একটা সারপ্রাইজ গিপ্ট থাকবে।
-অহ! ওকে। তাহলে এটা বলুন যে এ কয়দিন কই ছিলেন?
-আর বলবেন না। কেসটা মাথা খেয়ে ফেলেছিল। তাই খুঁজতে খুঁজতে অনেক ভেতরে যেতে হয়েছে।
-আচ্ছা। নাম না হয় না বললেন। কী কী করলেন, কোথায় কোথায় গেলেন সেটা বলুন। সেটা অন্তত শোনা যাক।
-বেশ। তবে তাইই হোক। এরপর না হয় নামটা জেনে নিবেন।
নুরুজ্জামানকে বেশ উত্তেজিত দেখালো। যেন সে এই ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। শিশির বলল,
-প্রথম দিনের কথা বলি। যেহেতু কেসটা রিভেঞ্জ ক্রাইমের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, তাই একজন রিভেঞ্জ নেওয়ার মতো মানুষকে খুঁজছিলাম আমি। প্রথম দিন আমি মারিয়া, রুবাইদা এবং ইমা এই তিনজনের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলাম। খুঁজতে থাকলাম এদের ফ্যামিলিতে এমন কেউ আছে কী না যে এতগুলা খুন করতে পারে। সেখানে আমি তিন পরিবার থেকে দুটি নাম পেলাম। মারিয়ার বড় ভাই সাদিক আর ইমার পেছনে ঘুরতে থাকা এক ভবঘুরে প্রেমিক। নাম আবির। ইমা এবং মারিয়ার মৃত্যুতে এই দুই জনেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। সাদিক তার ছোট বোন মারিয়াকে নিজের জানের চেয়ে ভালোবাসতো। আবার ইমার ভবঘুরে প্রেমিকা অনেকটা আশক্ত ছিল ইমার প্রতি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে মারিয়া এবং ইমার মৃত্যুতে এরা দুজনই নেশায় আশক্ত হয়ে যায় এবং বলা বাহুল্য এরা দুজনই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। এরা যার রাজনীতি করতো সেই এমপি সাহেবের চ্যালারাই এদের দুজন প্রেমিকাকে রেপ করে খুন করে। তাই ওই চ্যালাদের খুন করার জন্যে পাকাপোক্ত কারণ আছে এদের কাছে। আমি এদের দুজনকেই ফলো করি। তার আগে আরেকটা বিশেষ কাজ শেষ করি আমি। সেটা পরে বলছি। এই বিশেষ কাজ থেকে আমি নিশ্চিত হই খুন একজনই করেছে। তার কোনো সঙ্গি নেই। আমি এদের পিছু নেই। আবির আমাকে নিরাশ করে। সে সারাক্ষণ মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। সাদিকের প্রতি আমার আগ থেকেই সন্দেহ ছিল। এবং আমার সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়। আমি বিশেষ কিছু জায়গায় সাদিকের অবস্থান পাই। যা প্রমাণ করে মূল খুনি সাদিকই।
ভ্রু কুচকে তাকায় নুরুজ্জামান। অবাক স্বরে বলে,
-সাদিক? তাকে তো আমি বড় ভদ্র জানতাম। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে শিশির।
-আমিও তাই ভাবছিলাম। আমি হয়তো ভুল করছি। কিন্তু তার ভদ্রতার আড়ালে সে অন্য একটা দুনিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। এদিকে একটু খুঁটিয়ে দেখতেই আরেকটা বিষয় জেনে যাই। মনিরের বাবা মনিরকে খুন করার জন্যে একজনকে লোককে সুপারিশ করেন। টাকা দিতে চান। সেই লোকটা টাকা নেয় না বটে, তবে খুনের প্রতিশ্রুতি দেয়। জানেন সেই লোকটা কে?
-কে? সাদিক?
-ইয়েস। সেই খুনের প্রতিশ্রুতি দেয়া মানুষটা সাদিকই। এটা শোনার পর তো আমার হুশই উড়ে যায়। বিশ্বাসই হচ্ছিল না সাদিক এমন কাজ করবে। আমি পরেরদিনও সাদিকের উপর নজর রাখি। কিন্তু সেদিন বিশেষ কিছু পাই না।
-ও মাই গড। তাহলে খুনি সাদিকই?
চেয়ারে হেলান দেয় শিশির। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বলে,
-বলছি। তার আগে আমার বিশেষ কাজটার কথা শুনুন। চতুর্থ দিন আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম টিম বানিয়ে রুবাইদাদের ওখানে যেতে। আপনি ওখানে গেলেন। আমি গেলাম ওই তিনজনের খোঁজে। রাত সাড়ে এএগারোটায় একটা বাংলো বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাই আমি। একটা গাছের উপর উঠে চুপচাপ বসে থাকি। এই যে হাত দেখুন। মশা কামড়িয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে।
-আশ্চর্য! আপনি ওখানে মশার কামড় খেতে গিয়েছেন কেন?
শিশির হাসল। বলল,
-মশার কামড় খেতে যাইনি। খুনিকে খুঁজতে গিয়েছি।
-খুনিকে?
-হ্যাঁ। খুনিকে। জানেন সে খুনি কে? সেই খুনি হচ্ছে একটা জোকার।
ভ্রু কুচকে বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে নুরুজ্জামান বলে,
-জোকার?
-হ্যাঁ। সে জোকারটা মারাত্মক চতুর। ইরা নামক একটা মেয়ে আছে। যে এক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের খুঁজত। এই মেয়ের সাথে জোকারটার কোনো একটা সম্পর্ক আছে। কি সম্পর্ক সেটা আমি জানতে পারিনি। বলতে গেলে ইরা মেয়েটা আমাকে কিছু বলেনি।
-ওয়েট। তার মানে আপনি ইরা নামক ওই দেহ ব্যবসায়ীকে খুঁজে বের করেছেন?
শিশির এই কথার জবাব না দিয়ে বলল,
-পরে বলছি। আগে শুনুন। জোকারটা ওই ইরার সাহায্য ওই বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করে। তবে ইরাকে কীভাবে ওই বাংলোয় রাঁধুনি হিসেবে প্রেরণ করেছে তার সঠিক তথ্য নেই। তার প্রয়োজনও নেই। যাই হোক, এই ইরা ওই বাংলো রান্না করতো। সেদিন রাতে, রাতের খাবারে সে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। ওই খাবার গুলো খেয়ে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঠিক তখনই আসে জোকারটা। গেটে অবস্থান রত দু'জন প্রহরীকে পশুর মতো মেরে ফেলে। ভেতরে ঢুকে। এক এক করে সবাইকে মেরে ফেলে। শালা এই মারাত্মক ছিল যে সে রাতে ইরাকেও মেরে ফেলে। কী নির্মম ভাবে মেরেছে! জামা খুলে মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে। ওর স্তন...
-আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
-আরেহ কোথাও ভুল হয়নি। আমি নিজেই দেখলাম। মেয়েটার সাথে কী...
-আপনি জানেন না। আন্দাজে বলছেন। তেমন কিছুই হয়নি ওখানে।
-চুপ করুন। আপনি ওখানে যান নি। আমি গিয়েছি। মেয়েটা শেষ আর্তনাদ শুনেছি আমি। ছিহ,কী নির্মম ভাবে...
নুরুজ্জামান দাঁড়িয়ে গেল। রাগে লাল হয়ে বলল,
-স্টপ! কি যাচ্ছে তাই বলছেন? আপনাকে কে বলেছে ইরাকে মেরে ফেলেছি আমি। ইরাকে নিয়ে বাজে কিছু ভাবতেও পারি না আমি। আর আপনি কি না... ছিহ!
চেয়ারে হেলান দিলো শিশির। উচ্চস্বরে হাসতে থাকল। তার যেন হাসিই শেষ হয় না। নুরুজ্জামান হতবম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মুখ শুকিয়ে কাঠ। এতো গুলো খুন করলো, কোথাও কোনো এভিডেন্স রাখল না। শেষমেশ এখানে এসে ধরা খেতে হলো?
শিশির হাসতে হাসতে বলল,
-কেস সলভড মিস্টার নুরুজ্জামান। খুনি সাদিক নিয়। খুনি আপনি।
ধপাস করে বসে পড়ল নুরুজ্জামান। শিশির বলল,
-আপনি আসলে ইরাকে খুন করেননি। ইরার সাথে আমি দেখা করেছি বটে। কিন্তু সে আমায় কিছুই বলেনি আপনার সম্পর্কে। শেষে যা যা বললাম ওসব মিথ্যা। ইরাকে আপনি খুন করেননি তা আমি জানি। শেষে মিথ্যাটা বললাম এই কারনে যে আপনি যেন উত্তেজিত হয়ে সত্যটা বলে দেন। এবং আপনি তাই করেছেন।
নুরুজ্জামান মর্মাহত চেহারা নিয়ে বলল,
-আপনি আমার উপর সন্দেহ করলেন কখন?
শিশির কিছু বলল না। পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে বলল,
-ল্যাপটপটা অন করে দিন।
নুরুজ্জামান ল্যাপটপ অন করে দিল। শিশির সেটা নিজের কাছে নিয়ে বলল,
-আপনি মেবি সালমান খানে ফ্যান। রাইট?
-আপনি কীভাবে বুঝলেন?
-আপনার হাতে একটা ব্রেসলেট আছে। ঠিক সালমান খান যেমন হাত দিতো তেমন। খুন টুন করার সময় এগুলো রেখে করলে ভালো হয়। নাকি আপনি ভাবছেন এই ব্রেসলেটটা আপনার জন্যে লাকি?
নুরুজ্জামান জবাব দিলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শিশির বলল,
-রুবাইদাদের বাসার একটা জায়গায় ছোট্ট একটা ক্যামেরা সেট করে রেখেছিলাম। সেখান থেকে পাওয়া এই ভিডিওটি। দেখুন।
শিশির ল্যাপটপটা বাড়িয়ে দিলো নুরুজ্জামানের দিকে। নুরুজ্জামান তা দেখল। শিশির বলল,
-পুলিশের জুতাটা পরে যাওয়া উচিৎ হয়নি আপনার। এটাই আমাকে আপনার কাছে সহজে নিয়ে গিয়েছে। ভিডিওটি প্রথমে দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি। একটা জোকার কারো সদ্য কাটা মাথা রেখে চলে যাচ্ছে। আমি অনেকক্ষন দেখলাম ভিডিওটা। হঠাৎই ব্রেসলেটটা চোখে পড়লো। আরেকটু খুঁটিয়ে দেখতেই দেখলাম আপনার পাঁয়ে পুলিশের জুতা। খানিকটা অবাক হলাম। মাথায় বাজ পড়লো। বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি খোঁজ লাগালাম। এরপর যা জানতে পারলাম সেটা শুনে আমার গা কেঁপে উঠেছিল। আপনি আমার কাছে এতো কিছু লুকালেন কেন?
নুরুজ্জামানের চোখে ভিজে এল। বলল,
-সবে বিয়ে করেছিলাম স্যার। প্রায় সাত বছর প্রেম করে বিয়ে করেছি। মেয়ে বাবা মা বিয়ে দিবে না। কারণ আমি পুলিশ। কতো যুদ্ধ করেছি এ নিয়ে। অনেক কষ্টে রানুর বাবাকে রাজি করাই। আমাদের বিয়ে হয়। কী সুন্দর দিন যাচ্ছিল আমাদের। বউটা বড় পাগলি ছিল। এতো খেয়াল রাখত যা বলার মতো না। রোজ রাত করে আমার জন্যে অপেক্ষা করে। একসাথে খাই। কতো গল্প করি আমরা। রাতে আকাশ দেখি। সুখ দুঃখের আলাপ করি। এমনই এক রাতে বউ জানায় সে প্রেগন্যান্ট। চোখে জল জমে। আমি কান্না করে দেই। বউকে জড়িয়ে ধরি। বিশ্বাস করবেন না বাবা হওয়ার অদ্ভুত একটা অনুভূতি আছে। কী অসাধারণ সেই অনুভূতি। আমার বউয়ের মুখে মায়ের ছাপ। কতো স্বপ্ন ছিল স্যার। কতো স্বপ্ন দেখেছি ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাবুর বয়স সাত মাস পার হলো। দু একটা লাথি মারতো তখন। কী যে খুশি হতাম। আমার সেই খুশি ছিনিয়ে নিলো ওই কুত্তারবাচ্চা গুলো। মারিয়াদের কেসটা ইনভেস্টিগেশন করেছিলাম। আমি অনেকদূর এগিয়ে যাই স্যার। অনেক গুলো এভিডেন্স জমা করেছি। ওরা আমাকে থ্রেট দেয়। আমি গায়ে মাখি না। আমার উপর গুলি চালায়। তাও গায়ে মাখি না। এগিয়ে যাই। কিন্তু শেষে ওরা কী করলো জানেন? এক রাতে আমার বাসায় এসে, আমাকে চেয়ারে বেঁধে পাঁচজন মিলে আমার স্ত্রীকে গণধর্ষন করে। রানুর পেটে কী নির্মম ভাবে আঘাত করে। বউয়ের বুক ফাটা আর্তনাদ আমার গা কাঁপিয়ে দেয়। স্যার,এখনও কানে বাজে। আমি এখনও শুনি। কী চিৎকার তার। আমি পাগল হয়ে যাই কিছুই করতে পারি না। ওরা আমার বাচ্চাকে, আমার সমস্ত জীবনের প্রেম, আমার স্ত্রীকে আমার সামনে খুন করে ফেলে। আমি আর সইতে পারি না। তাই এমন করি। সব গুলারে খুন করে ফেলি। একদম সব গুলারে।
নুরুজ্জামান হু হু করে কান্না করে। শিশির ভেজা চোখে তাকায় সেদিক। বলে,
-কী করবেন স্যার। যুগটাই তো যাচ্ছে খারাপ। কিন্তু আপনার...
-আমি ভুল করেছি স্যার। আমাকে ফাঁসি দিন। আমি ফাঁসিতে ঝুলবো এখন। আমি আর বাঁচতে চাই না।
শিশির চুপ থাকল কিছুক্ষন। ডি আই জি স্যারকে ফোন করতে যাবে ঠিক তার আগেই নুরুজ্জামান রিভালবার নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বলে,
-স্যার, একটা উপকার করবেন স্যার। কাউকে আমার মৃত্যুর আসল কারণ বলবেন না। বলবেন যে আমি এই কেস সলভ না করতে পেরে আত্মহত্যা করেছি। তবুও লোকজন অন্তত পুলিশকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাববে না। যদি বলি পুলিশ হয়ে এতো গুলো বেআইনি খুন করেছি তাহলে সামান্য যে আস্থা টুকু আছে সেটাও হারিয়ে ফেলবে মানুষ। আমি তা চাই না স্যার। আর তাছাড়া এতো গুলো খুন করে আমি বেশিদিন বাঁচতে পারবো না। অপরাধবোধ আমায় একটু একটু করে খাচ্ছিল। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল স্যার। তাই আগেই চলে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ বাকি দুটো মাথা আমার বাসার ফ্রিজে পাবেন। ওইদিন রাতেই আমি সব গুলাকে মেরে ফেলেছিলাম। যাই স্যার। ভালো থাকবেন।
এরপর কিছু বুঝে উঠার আগেই গুলির শব্দ হয়। ছিৎ করে কিছু রক্তের ছিটে শিশির মুখে পড়ে। কিছুটা মোবাইলের স্ক্রিনে। শিশির কেবল স্থির হয়ে থাকে। কিছু বলতে পারে না ও। বোবার মতো বসে থাকে। একটা মানুষ কী সাবলিল ভাবে চলে গেল অথচ ও কিছুই করতে পারল না। পৃথিবীর নিয়ম বড় অদ্ভুত। এরচে বড় অদ্ভুত এর মানুষ গুলো। আপনি ভালো থাকুন নুরুজ্জামান।
.
ভুলত্রুটি বিশেষ ভাবে মার্জনীয়।
-তাসফি আহমেদ।

সমাপ্ত
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url